ঈষৎ লাল সেই আপেলের কথা কে না জানে, যার ফেটে যাওয়া দেখে মহামতি স্যার আইজ্যাক নিউটন আবিষ্কার করেছিলেন তিনটি মহান সত্যকে, আর সেই সত্যকে প্রমাণিত করার জন্য আবিষ্কার করেছিলেন ক্যালকুলাস (এটি লাতিন শব্দ, যার বাংলা অর্থ নুড়িপাথর) নামের আপাত বিদঘুটে, বাস্তবে গণিতের অসম্ভব মজার একটি শাখা। যদিও জার্মান পলিম্যাথ এবং দার্শনিক লাইবনিৎস ক্যালকুলাস নিয়ে তাঁর গবেষণার ফল স্যার আইজ্যাক নিউটনের আগেই প্রকাশ করেন। এই নিয়ে জলও কম ঘোলা হয়নি। লাইবনিৎসভক্ত বার্ট্রান্ড রাসেল অবশ্য স্বীকার করেছেন, স্যার আইজ্যাক নিউটনই আগে আবিষ্কার করেছেন ক্যালকুলাস। প্রকাশের ক্ষেত্রে নিউটনের বরাবরই ইচ্ছার অভাব ছিল। পৃথিবী কাঁপিয়ে দেওয়া বই প্রিন্সিপিয়াও প্রকাশ পেয়েছিল স্রেফ অ্যাডমন্ড হ্যালির হস্তক্ষেপে।
বিজ্ঞানী নিউটনের প্রকৃতপক্ষে দুইটি কুকুর ছিল, ডায়মন্ড আর গ্রাফাইট। স্রেফ ডায়মন্ডের নামটি রয়ে গেছে বিখ্যাত দুষ্কর্মটির জন্য, যার ফল অধ্যবসায় নামের অখাদ্য একটি রচনা (অসম্ভব বিচ্ছিরি, কঠিন এবং পারতপক্ষে দু-তিনটি গল্প ছাড়া মনে রাখার আর কিছু সেই রচনায় ছিল বলে আমার মনে নেই)। শৈশবে-কৈশোরে যারা অধ্যবসায় পড়েছেন সবাই জানেন একবার নিউটনের সব কাজ সেই ডায়মন্ড পুড়িয়ে দিয়েছিল। কৈশোরে হিরা নামের একটি মেয়ের প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে আমি বুঝে গিয়েছিলাম যে, মূল সমস্যা আসলে কুকুরটার নামে। ডায়মন্ড না হয়ে অন্য কোনো নাম হলেই কুকুরটি আর এই দুষ্কর্ম করতো না। ডায়মন্ড নামের কিচ্ছু ভালো হতে পারে, এমনকি সে মিষ্টি হলেও, একটা সময় পর্যন্ত আমি বিশ্বাস করতাম না। যা-ই হোক, আসল ডায়মন্ডে আসি…
গত কয়েকরাত ঘুম হচ্ছিল না মহামতি আইজ্যাক নিউটনের। তাঁর প্রিয় দুইটি কুকুরের জন্য নতুন একটি ঘর বানিয়েছেন মিস্ত্রীদের দিয়ে। ঘর তৈরি করার সময় বারবার তাগাদা দিচ্ছিলেন, যা তাঁর চরিত্রের সাথে ঠিক যায় না। তিনি নিশ্চুপ ধরনের মানুষ। তাও প্রিয় দুই কুকুরের জন্য তিনি তাঁর অতি পরিচিত চরিত্র বিসর্জন দিলেন। ঘর তৈরি হলো। এত সুন্দর ঘর, পারলে তিনি নিজেই গিয়ে ঘুমান। কিন্তু সেটা সম্ভব না। চারপাশের নিন্দুক মানুষজন ভালোভাবে দেখবে না। তাঁর চেয়েও বড় যে সমস্যা তা হলো এই ঘরে তাঁর শরীর ঢুকবে না। ঢুকলেও লম্বা হয়ে শুতে পারবেন না তিনি। আবার হাত-পা লম্বা করে না শুলে তাঁর ঘুম হয় না। এটা ভাবতে ভাবতেই তিনি আবিষ্কার করলেন, আরে, দুইটা কুকুরের জন্য একটি মাত্র দরজা! তা হলে কীভাবে হবে! কুকুর দুইটা তো সমান সাইজের না। একটা বড় সাইজের, একটা অপেক্ষাকৃত ছোট। মহা মুশকিলে পড়ে গেলেন তিনি। দুইটা ভিন্ন সাইজের কুকুরের জন্য দরজার সাইজও ভিন্ন হওয়া আবশ্যক। শেষ-মেশ ভেবেচিন্তে একটা বুদ্ধি পেলেন তিনি। নিজেই যন্ত্রপাতি হাতে নিলেন। সারাদিন খেটেখুটে নতুন একটি দরজা বানালেন ছোট কুকুর ডায়মন্ডের জন্য। ঘসে ঘসে মসৃণ করলেন সেই দরজা, মানানসই রঙ লাগালেন। তারপর দূর থেকে, কাছ থেকে, মাঝামাঝি দূর থেকে, বিভিন্ন জায়গা থেকে দেখে অবশেষে সন্তুষ্ট হলেন। এবার ঠিক আছে! যথেষ্ট সুদৃশ্য হয়েছে। এবার বড় কুকুরটা বড় দরজা দিয়ে ঢুকবে, আর ছোটটা এই ছোট দরজা দিয়ে। যদিও পরদিন ভোরেই কুকুরদ্বয় তাকে হতাশ করে। ঘুম ভাঙার পরেই কুকুরের ঘরের সামনে গিয়ে বসে ছিলেন তিনি। কিছুক্ষণ পরেই দেখতে পেলেন, বড় দরজা দিয়ে নচ্ছার ছোট কুকুরটি বের হচ্ছে, আর ছোট দরজাটি দিয়ে দিব্যি হেলতে দুলতে বের হয়ে আসছে বড় কুকুরটি, গ্রাফাইট যার নাম। তিনি বড় আহত হলেন। তাও ধৈর্যের পরিচয় দিলেন তিনি, বরাবরই তা-ই দিয়ে আসছেন। কুকুরগুলিকে তিনি কিছুই বললেন না। ভাবলেন, থাক না, যার যেমনটাতে আনন্দ তেমনই করুক। এই সামান্য আস্কারাটিই তাকে ফেলে দিয়েছিল পরবর্তী বিপদের মুখে।
কুকুরের ঘর বানানোর মাস দুয়েক পরের ঘটনা। মাঝরাত। আপনভোলা হয়ে কাজ করছিলেন নিউটন। বিশ বছর ধরে এই একটিই কাজ করে যাচ্ছেন, ক্যালকুলাস নিয়ে। প্রায় শেষ করে এসেছেন। এটা করতে পারলে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি নিয়ে যে তত্ত্বগুলি তাঁর মাথায় এসেছিল সেই কত আগে, সেটাকে প্রমাণ দিতে পারবেন। প্রমাণ ছাড়া বিজ্ঞানের কাছে কিছুরই গুরুত্ব নেই, সেটা অ্যারিস্টটল বললেও, আর তিনি তো সামান্য নিউটন! হয়ত এই আবিষ্কার তাকে অসামান্য করে দিলেও দিতে পারে, কিন্তু কে জানে নিয়তি কী রেখেছে তাঁর জন্য! যদিও বিজ্ঞানী হয়ে নিয়তিতে বিশ্বাস রাখা পাপ, তাও মাঝে মাঝে এসব বিশ্বাস করতে ভালো লাগে তাঁর। এসব কারণেই জীবনের বড় একটা অংশ ল্যাবরেটরিতে কাটিয়েছেন ঘোর বিশ্বাস নিয়ে পরশপাথর তৈরিতে, পারদ থেকে সোনা সৃষ্টি করার প্রয়াসে, বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট এবং নিউ টেস্টামেন্টের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে যিশুর পৃথিবীতে দ্বিতীয় আগমনের দিনটি নির্ধারণের ব্যর্থ প্রচেষ্টায় কিংবা পৃথিবীর যবনিকাপাতের সঠিক ক্ষণ আবিষ্কারে। কীভাবে কীভাবে পাপপুণ্যের কথাও মাঝেমধ্যে মনে আসে তাঁর। মুহূর্তেই ওসব গা-ঝাড়া দিয়ে কাজ শুরু করেন তিনি। এভাবে দিন কেটে যায়।
সেই মাঝরাতে হঠাৎ জরুরি একটা কাজের কথা মনে পড়ল তাঁর। ভাবলেন, থাক, কালই করা যাবে সেটা। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ল, বন্ধুকে কথা দিয়েছেন। না রাখলে বেইজ্জতি হয়ে যাবে। বন্ধুটি ভালো হলেও তাঁর নিন্দামন্দ করার বাজে একটা স্বভাব আছে। শেষমেশ উঠেই পড়লেন। বাসায় কেউ নেই। ক্যাথরিন বার্টন কই যেন গেছে! ক্যাথরিন বার্টন নিউটনের ভাগনি, নিউটনের সঙ্গেই থাকেন। বার্টন সেই বিখ্যাত নারী, ফরাসী লেখক এবং মহান দার্শনিক ভলতেয়ার একবার যাকে নিয়ে বলেছিলেন- বিশ্বব্যাপী নিউটনের খ্যাতি স্রেফ তাঁর সুন্দরী ভাগনি ক্যাথরিন বার্টনের জন্য! ওটা রসিকতা ছিল। কিন্তু এটা সত্যি যে ক্যাথরিন বার্টনের রূপ-গুণে আচ্ছন্ন ছিল সমগ্র ইওরোপ। ভলতেয়ারও ছিলেন। ফরাসী গণিতজ্ঞ ও পরিসংখ্যানবিদ রেমঁ দ্য মঁমর্ত একবার নিউটনের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। সেখানে ক্যাথরিনকে দেখে তিনি এতটাই মুগ্ধ হন যে, ফ্রান্সে ফিরেই পঞ্চাশ বোতল শ্যাম্পেন উপহার পাঠান, সাথে ছোট্ট একটি নোট, বিশিষ্ট দার্শনিক ও মিস বার্টনের মতো সুন্দরীদের জন্য এই ছোট্ট উপহার। যা-ই হোক, আপাতত ক্যাথরিন প্রসঙ্গও বাদ। শুধু নিউটন আর তাঁর কুকুর।
মোমবাতিটা জ্বালিয়ে রেখে একাই বের হলেন মহামতি নিউটন। চোরের উৎপাত বেড়েছে খুব। মোমবাতিটা জ্বলতে দেখলে চোর ভাববে যে ঘরে লোক আছে। অপেক্ষাকৃত নিরাপদ সেটা। সেই সাথে পাহারা দেওয়ার জন্য ডায়মন্ড আর গ্রাফাইট তো আছেই। গ্রাফাইট বাইরে থাক, তাঁর এই বড় শরীর দেখে চোর কাছে ঘেঁষবে না। ডায়মন্ড ভিতরেই থাক, যদি গ্রাফাইটের চোখ ফাঁকি দিয়ে চোর ঢোকেই, ডায়মন্ড বড় ঘাঘু জিনিস। চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় তুলবে। বাইরে থেকে তালা দিয়ে বের হয়ে গেলেন মহামতি স্যার আইজ্যাক নিউটন। এদিকে মনিব নিউটনকে বড় ভালোবাসে ডায়মন্ড। তাঁকে এক পলক না দেখলেই অস্থির হয়ে ওঠে সে। তার মনে আছে নিউটন তাকে তুলে এনেছিলেন এক জোচ্চর লোকের কাছ থেকে, যে তাকে সারাদিন মারতো। এমনকি ঐ জোচ্চরের ছেলেটাও ছিল আরেক জোচ্চর। সেও ডায়মন্ডকে নানা উপায়ে নির্যাতন করতো। রীতিমতো গবেষণা শুরু করে দিয়েছিল ছেলেটা, কত কত ভাবে ডায়মন্ডকে নির্যাতন করা যায়। সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করেন বর্তমান মনিব নিউটন। তিনি বড় ভালোবাসেন ডায়মন্ডকে। কিছুদিন আগেই তাঁর জন্য কত সুন্দর একটা ঘর বানিয়ে দিয়েছেন। সেখানে প্রতি রাতে আরামদায়ক উষ্ণতায় ঘুমাতে ঘুমাতে সে মনিবের খ্যাতি এবং যশের জন্য প্রার্থনা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে। সেই মনিব এখন কোথায় চলে গেলেন তাকে আটকে রেখে! ডায়মন্ড অস্থির হয়ে ওঠে। লাফালাফি শুরু করে দেয় ঘরময়। কাগজপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। মুহূর্তেই ঘটে যায় বিপত্তিটা। তার লেজের ধাক্কায় মোমবাতিটা কাঁত হয়ে পড়ে টেবিলে। সুদৃশ্য ওয়ালক্লথে আগুন ধরে যায়। সেখান থেকে আগুন ছড়ায় কাগজপত্রে। আচমকা নিজেকে যেন নরকে আবিষ্কার করে ডায়মন্ড। গলার সব জোর একত্র করে ডাকাডাকি শুরু করে। টের পেয়ে বাইরে থেকে তারস্বরে চেঁচাতে শুরু করে গ্রাফাইটও। নিউটন মোটামুটি দূরেই চলে গিয়েছেন, কিন্তু গ্রাফাইটের ডাক তাঁর কানে গেলো। তিনি বুঝলেন কিছু একটা ঘটেছে। আবার বাড়ির দিকে ঘুরলেন। হনহন করে হাঁটা শুরু করলেন। পারলে দৌঁড়েই আসতেন, কিন্তু বয়স আর সেটা সহ্য করবে না। যত দ্রুত সম্ভব বাড়ি পৌঁছুলেন তিনি। যা বোঝার বুঝে গেলেন।
আশপাশ থেকে নিন্দুক প্রতিবেশীরাও ততক্ষণে পৌঁছে গেছে, যাদেরকে তিনি এড়িয়ে চলতেন। যে জেমসকে তিনি মোটেই পছন্দ করতেন না বিস্মিত হয়ে দেখলেন সেই জেমসই কোত্থেকে বড় বড় পাত্রে বালু এনে ছুড়ছে আগুনের কুণ্ডলিতে। সারা শরীর ঘেমে আছে তার। মুখ লাল টকটকে। মিসেস ফারলং, মিস্টার ল্যান্ডর্ট, কালো প্রতিবেশী মিস্টার ওয়ালশ, সবাই ছুটোছুটি করে একসময় আগুন নিভিয়ে ফেললো। সর্বাধিক খুশি হয়েছিলেন নিউটন যে-জন্য, মিস ক্যারোলিন কীভাবে কীভাবে যেন ডায়মন্ডকে জীবিত উদ্ধার করে ফেলেছেন। কীভাবে তিনি এটা করলেন সে এক রহস্য! সবার প্রতি এক ধরনের কৃতজ্ঞতা আর ভালোবাসা বোধ করলেন নিউটন। সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে ঘরে ঢুকলেন। তাঁর সাথে আরও অনেকেই ঘরে ঢুকলো। খুব বেশি ক্ষতি করতে পারেনি আগুন। কিন্তু যা করার করে গেছে। বিশ বছরের সাধনার ফল পুড়ে ছাই। নিউটন কিচ্ছু বললেন না। নিজের নার্ভকে ঠান্ডা করলেন, আর ডায়মন্ডের দিকে ঘুরে শুধু বললেন, কত বড় ক্ষতি তুমি করলে, জানো না ডায়মন্ড। নেক্সট সপ্তাহে সবাইকে ডিনারের নিমন্ত্রণ জানিয়ে বিদায় দিলেন। তার পর পরই ওভারকোট চাপিয়ে তিনি নতুন কাগজ কিনতে বের হলেন, নতুনভাবে সব শুরু করতে হবে। পেছনে পেছনে নিঃশব্দ পায়ে ছুটছে গ্রাফাইট আর ডায়মন্ড।