নাসরীন সুলতানা মিতু-এর সাক্ষাৎকার ।। আলাপকারী : জুয়েইরিযাহ মউ

নাসরীন সুলতানা মিতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আই.ই.আর থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত আছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। রানা প্লাজার ঘটনার সময় বহুল আলোচিত সেই প্রাইসট্যাগের উপর রক্তের ছাপ দেওয়া কার্টুনটি মিতু-ই এঁকেছেন। কার্টুন শিল্প মাধ্যম আর কার্টুন-শিল্পকে ঘিরে তার চিন্তা-ভাবনা জানতেই জমে উঠেছিল আড্ডা…


কার্টুন মাধ্যমটা কেন নির্বাচন করলেন বা কেন স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন এ মাধ্যমে?

– প্রথমত ব্যক্তিগত ভাল লাগা থেকে। আর এই মাধ্যমে যত দ্রুত মানুষের কাছে পৌঁছানো যায়, অন্য মাধ্যমে সেটা কঠিন।

কার্টুন আঁকার সময় কোন বিষয়গুলো বিবেচনা করেন?

– কোন ধরনের কার্টুনের কথা বলা হচ্ছে সেটার উপর নির্ভর করে। রাজনৈতিক কার্টুনের ক্ষেত্রে কোন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আঁকছি, যে মেসেজ দিতে চাচ্ছি কিভাবে সেটা কত সহজবোধ্যভাবে বোঝানো যায় সেটা। উন্মাদের ফিচার আঁকার সময় আবার ফানটাই মুখ্য, সিরিয়াস মেসেজ নিয়ে ভাবার প্রয়োজন নেই। আবার ক্যারিকেচার করতে গেলে যেই ব্যক্তির ক্যারিকেচার করছি তার ব্যক্তিত্বের ধরন, বিশেষত্ব, কাজ, ব্যক্তিগত দর্শন এসবকিছুই চলে আসে।

কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, স্টাইল না আইডিয়া? কেন?

– আমার মতে অবশ্যই আইডিয়া। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কার্টুনিস্টদের মাঝে অনেকেই আছেন যাদের ড্রইং এমন কিছু আহামরি নয়, কিন্তু আইডিয়ার জোরে তারা অসাধারণ। কার্টুনের ক্ষেত্রে ড্রইং স্কিলের চেয়ে পেছনের ভাবনাটা নিঃসন্দেহে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেটাই মানুষের মাথায় গেঁথে থাকে। আইডিয়াটাকে প্রকাশ করার জন্য স্কিলের অবশ্যই প্রয়োজন আছে, কিন্তু সেটা কখনই আইডিয়াকে ছাপিয়ে নয়। আর স্টাইল তো কার্টুনিস্টের নিজস্ব, নিজের ড্রইং স্কিল, ভাবনা এবং রুচি মোতাবেক এক একজন কার্টুনিস্টের স্টাইল তৈরি হয়।

কার্টুনকে খুব হালকাভাবে দেখার প্রবনতা আছে, এটাকে ইতিবাচক মনে হয় না নেতিবাচক প্রবণতা?

– হাহাহা, কার্টুনের একটা বড় অংশ যেহেতু হিউমার নিয়ে কাজ করে, এটাকে হালকাভাবে দেখা হয় এটা অস্বাভাবিক না। সত্যি বলতে অতি সিরিয়াস শিল্প থেকে দূরে থেকে মাটির কাছাকাছি নেমে আসাটা বরং আমার কাছে মনে হয় কার্টুনের জন্য আশীর্বাদ। তাতে বরং কার্টুনের মাধ্যমে আমজনতার সাথে ‘আর্ট’ এর দূরত্বটাও কমে আসে। তবে হ্যাঁ, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে অন্যান্য আর্ট ফর্মের সাথে তুলনা করলে কার্টুন কিছুটা ব্রাত্য, এখনো, এমনকি কার্টুনের এই বলা চলে স্বর্ণযুগেও।

আমাদের দেশে কার্টুন শিল্প নিয়ে এখনো পড়াশোনা করার সুযোগ তেমন নেই। এ ব্যাপারে কিছু বলুন। মানে আপনি কি মনে করেন চারুকলায় যে ট্যাকনিক শেখানো হচ্ছে তাই যথেষ্ট কার্টুনিস্ট হিসেবে নিজেকে তৈরির জন্য, পৃথকভাবে কার্টুনশিল্প নিয়ে পড়ার প্রয়োজন নেই। না কি আছে?

 – দেখুন, আমি যেহেতু চারুকলার নই, সেখানকার পড়াশোনা সম্পর্কে আমার মন্তব্য করা কঠিন এবং সেটা উচিতও নয় বলে আমি মনে করি। কিন্তু এটা বলে রাখা ভাল যে, গোটা পৃথিবীতেই কার্টুন নিয়ে পড়ালেখার সুযোগ অপেক্ষাকৃত কম, কার্টুনিস্টরা সব দেশেই আসলে একটা ছোট্ট সম্প্রদায় হয়েই ছিল, এখনও আছে। ইদানিং এনিমেশন ইন্ডাস্ট্রিতে প্রচুর কাজের সুযোগ তৈরি হওয়ায় বিভিন্ন দেশে কনসেপ্ট আর্ট, ক্যারেকটার ডিজাইন, এনিমেশন ইত্যাদি নিয়ে পড়ালেখার সুযোগ বেড়েছে; কিন্তু কার্টুন বলতে আমরা যা বুঝি যেমন- পলিটিক্যাল কার্টুন বা গ্যাগ কার্টুন শেখার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা পৃথিবীতেই খুব বেশি আছে বলে আমার জানা নেই।

শিশুদের জন্য এখন কিছু কাজ হচ্ছে, মুজিব-সিরিজটা এল এইবার। শিশুরা কি আদৌ কাগুজে কার্টুনশিল্পের কাছে আছে এখন আর? কি মনে হয় ?

 – মুজিব সিরিজটা ঠিক শিশুদের উপযোগি মনে হয়নি আমার, বরং কিশোরদের জন্য বেশি উপযোগি হয়ত। আর হ্যাঁ, আমি মনে করি ভাল মানের কমিক কার্টুন ইত্যাদির প্রতি বাচ্চাদের ঝোঁক সময়ের সাথে মোটেই কমেনি, বরং বেড়েছে। পৃথিবীজুড়ে মাঙ্গা বা ডিসি মার্ভেলের কমিক্সের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা কিন্তু এরকম ইঙ্গিতই দেয়।

শিল্পীদের পৃথক পৃথক কমিউনিটি কতটা প্রয়োজনীয় শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে? কার্টুনিস্টদেরও পৃথক হাউজ আছে, সংখ্যায় যতই কম হোন তবু। এটাকে কিভাবে দেখেন?

 – খুবই প্রয়োজন বলে মনে করি। অনেক সময় জাতীয় ইস্যুতে এক হবার প্রয়োজন পড়ে, কিংবা কোন ইস্যুতে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করার প্রয়োজনও পড়ে, সেক্ষেত্রে এটা একটা কমন প্লাটফর্মের কাজ দেয়। যেমন- আমাদের এখানে বাংলাদেশ কার্টুনিস্ট এসোসিয়েশন এর ব্যানারে আমরা এমন অনেক কার্যক্রম এখন পর্যন্ত আয়োজন করেছি; বছরওয়ারী কার্টুন প্রদর্শনী ছাড়াও বিভিন্ন ইস্যুতে আমরা প্রতিবাদ জানিয়েছি, কার্টুন এঁকেছি, মানববন্ধন করেছি। টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে এঁকেছে আমাদের কার্টুনিস্টরা, গত বছর পহেলা বৈশাখের ভয়ানক ঘটনার পরেও কার্টুনিস্টরা তাদের ভাষায় প্রতিবাদ জানিয়েছে। কোন কমন প্লাটফর্ম না থাকলে এধরণের কিছুর আয়োজন করা কঠিন।

রাজনৈতিক কার্টুন কার্টুন-শিল্প মাধ্যমের একটা উল্লেখযোগ্য বিষয়। এ ব্যাপারে শিল্পীর নির্দিষ্ট রাজনৈতিক আদর্শকে কতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়?

– এব্যাপারে আমার একান্তই ব্যক্তিগত মতামত হল, কার্টুনিস্টদের নিরপেক্ষভাবে ঘটনা দেখতে পারা খুব জরুরি। ব্যক্তিগত রাজনৈতিক বিশ্বাস সবারই থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু সেটার প্রতিফলন কার্টুনের মাঝে চলে আসলে সেটার গ্রহনযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়। কার্টুনে অসৎ হওয়া খুব কঠিন বলে আমার মনে হয়। জোর করে কোন ঘটনাকে নিজের মত করে দেখাতে চাইলে সেটা দিনশেষে খুব সফল কার্টুন হয়েছে এমন দেখিনি।

আমাদের দেশের কার্টুনকে কিভাবে মুল্যায়ন করেন? আগে যারা করতেন, যেমন সেই কাজী আবুল কাশেম থেকে এখনকার সমসাময়িকদের কথা যদি বলি।

 কার্টুনকে মূল্যায়ন করতে হলে প্রেক্ষাপট মাথায় রাখা জরুরি।কাজী আবুল কাশেম ছিলেন মায়েস্ত্রো, তিনি পাইওনিয়ার আমাদের বিশেষত বাঙালি মুসলমান কার্টুনিস্ট উনিই প্রথম। উনার সময় উনি উনার সামাজিক দায়বদ্ধতার পরিচয় দিয়েছেন উনার মত করে। উনি অসাধারণ আর্টিস্ট ছিলেন, পাশাপাশি উনার চিন্তা দর্শন, হিউমার সবকিছুর একটা সাংঘাতিক সম্মিলন দেখা যায় তার কার্টুনে। এখনকার সময়টা আলাদা। এখনকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও আলাদা। কার্টুনের একটা কমার্শিয়াল বাজার তৈরি হয়েছে যেটা আগে ছিলই না। ব্যবসায়িক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে, কর্পোরেট উদ্দেশ্যেও কার্টূনের ব্যবহার বেড়েছে। এভাবে আসলে কিছুতেই মেলানো সম্ভব না। রাজনৈতিক কার্টুনিস্টরা তাদের দায়িত্ব এখনও ভালভাবেই পালন করছেন। কিন্তু এখনও আমার মতে আমাদের এই ক্ষেত্রের পরিপক্কতা আসতে কিছু বাকি, সেটা আমাদের তরুণ আর্টিস্ট ও দর্শক উভয় পক্ষেরই।

আমাদের এখনকার কার্টুনিস্টদের ইন্সপিরেশন ছিলেন ঠিক আগের জেনারেশন, আহসান হাবীব, রনবী, শিশির ভট্টাচার্য।

আপনার কি কখনো মনে হয়েছে, শিশির ভট্টাচার্যের পরবর্তী কার্টুনিস্টদের উপর তাঁর প্রভাব ভয়াবহ? মানে মোটাদাগে বললে আর কি এটাকে কিভাবে দেখেন?

 এটা অস্বাভাবিকও না, দেখুন, শিশির ভট্টাচার্য্য অসাধারণ স্কিলড আর্টিস্ট, পত্রিকার প্রথম পেইজে এই লেভেলের স্কিলড ক্যারিকেচার তার আগে মানুষ দেখেনি। কাজেই একটা মুগ্ধতা কাজ করাটা স্বাভাবিক। উনি দারুণ কার্টূনিস্টও। কাজেই উনার পরবর্তী প্রজন্মের রাজনৈতিক কার্টূনিস্টদের উপর প্রভাবে থাকতেই পারে। আরেকটা ব্যাপার হল, এটা অনেকখানি ক্ষেত্রবিশেষে অন ডিমান্ডও হয়ে দাঁড়ায়। দর্শকদের কাছে শিশির ভট্টাচার্যের কার্টুনের জনপ্রিয়তার মাত্রা মাথায় রেখে, পত্রিকার অথরিটি যদি পার্টিকুলার ওই স্টাইলটাই ফলো করতে বলেন সেক্ষেত্রে আর্টিস্ট নিরুপায়।

এরকম ঘটনার সম্মুখীন হয়েছেন না কি, অথবা কতবার হয়েছেন যে সম্পাদক কার্টুনিস্ট এর আঁকার উপর হস্তক্ষেপ করছেন অর্থাৎ সম্পাদকের কোন সেন্সরশীপ মেনে নিতে হয়েছে?

 আমি যেসব হাউজে কাজ করেছি এরকম ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নেই, তবে শুনেছি অনেকক্ষেত্রে অনেককে এমন আবদার শুনতে হয়েছে স্টাইলের ক্ষেত্রে। সেন্সরশীপ পত্রিকার পলিসি এবং দেশের চলমান প্রেক্ষাপট দুইটা ব্যাপারের উপরেই নির্ভর করে। সবচে আগে প্রয়োজন কার্টুনিস্টের সেলফ সেন্সরশিপ, আইডিয়াটা কিভাবে সাটলভাবে দেয়া যায় সেটা মাথায় রাখা। সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা, শালীন অশালীনতার মাত্রা মাথায় রেখে এবং কোনভাবেই নোংরা ব্যক্তিগত আক্রমণ না করে কাজ করা। মিসইন্টারপ্রিটেড যেন না হয় এজন্য আইডিয়া ক্লিয়ার থাকাও জরুরি।

আরকেটা যেটা মনে হলো, আমাদের পলিটিক্যাল কারেক্টার নিয়ে, কার্টুনিস্টদের ক্রিটিক্যাল কোন থিংকিং নাই তেমন। ক্রিটিক্যাল বলতে বোঝাচ্ছি, তারা খুব একটা অন্যভাবে পলিটিকসটাকে আমাদের দেখান নাই? অনেকটাই এজ ইজুয়্যাল। আপনার কি মনে হয়?

 আমার সেরকম মনে হয়না। অনেক কার্টুনিস্ট এখন কাজ করছেন। এক একজনের পড়াশোনা, আইডিয়া এক এক রকম, সারফেস লেভেলের রাজনৈতিক জ্ঞান থেকে কেউ কার্টুন আঁকলে সেটা হতেই পারে। কিন্তু সবাইকে এক পাল্লায় মাপা যাবেনা কখনই। আমাদের অনেকেই অনেক অসাধারণ কার্টুন আঁকছেন, সমসাময়িক রাজনীতির সমালোচনা করছেন।যথেষ্টই বৈচিত্র্য আছে দেখার ধরণে। পোলারাইজেশন আছে কিছুক্ষেত্রে অবশ্যই, কিন্তু ইন বিটুইন অনেক দৃষ্টিভঙ্গি আছে।

রাজনৈতিক কার্টুনের ক্ষেত্রে কার কার কাজ পৃথক বলে মনে হয়, সমসাময়িককালের?

এভাবে নাম ধরে বলা মুশকিল, কে কার চে পৃথক। আপনি আমি কে কিভাবে দেখছি সেটাও ইস্যু, এভাবে নাম ধরে বলা উচিতও না আসলে। একই কার্টুনিস্টের এক একটা কাজ আপনার কাছে ‘গতানুগতিক’ মনে হতে পারে, নাও হতে পারে, নির্ভর করছে আপনি কাকে গতানুগতিক বলছেন আর কিভাবে দেখছেন সেটার উপর।

শেয়ার