তারাদের ঘরবাড়ি ১৭
শূন্যতা সবাই সবাইকে দিতে পারে না। শূন্যতা দিতে জানতে হয়।
নিস্তব্ধতা। একটা না থাকার নাম। কিন্তু কি অদ্ভুত, তা বোঝানোর জন্য শব্দের প্রয়োজন হয়। অনস্তিত্ব প্রকাশ হয় অস্তিত্বের মাধ্যমে। এখন যেমন, ঠিক তেমনই হাওয়ার শব্দ ছাড়া বাসে আর কোনো আওয়াজ ছিল না। জানালা দিয়ে ইন্দিরা দেখতে পেয়েছিল বাইরের আকাশে ফটফট করছে চাঁদ। পাশে চোখ বুঁজে পড়ে থাকা আনন্দীর সারা গায়ে জানালা বেয়ে জ্যোৎস্না এসে পড়েছে। অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল ইন্দিরা। যেন আজ সে মরে যেতে পারত। জ্যোৎস্না গায়ে আধশোয়া আনন্দীকে দেখার পরে যেন সে মরে যেতেই পারে।
রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এসে আনন্দীকে অনুসরণ করে ইন্দিরা বাস টারমিনালে এসে পৌঁছেছিল। প্রতি পনেরো মিনিটে হাওয়াশহরের দিকে বাস ধেয়ে যায় সেখান থেকে। একটা যেকোনো বাসে উঠে এসেছিল আনন্দী। তার পিছু পিছু ইন্দিরাও। ফাঁকা সীটে শরীর ছুঁড়ে দিয়ে আনন্দী চোখ বুঁজেছিল। ইন্দিরা কিছু বলার সুযোগ পায় নি। বিব্রত ইন্দিরা বার দুই আনন্দীকে ডাকার চেষ্টা করে সাড়া পায় নি কোনো। বাস চলতে শুরু করেছে। চাঁদ উঠেছে আকাশে। চাঁদের আলো লেগে অপার্থিব হয়ে উঠেছে আনন্দী। আর ইন্দিরা ভুলে গিয়েছে কি বলা উচিৎ তার।
মনে মনে ফের কিছু শব্দ সাজায় ইন্দিরা। বিভিন্ন যুক্তির উপর যুক্তি সাজিয়ে চলে সারাটা রাস্তা ধরে। তবু বারবার তাকে ফিরে আসতে হয়, রুবাঈয়ের কথামতো যদি সে গতকালই আনন্দীকে নীলেশের ফোনের কথা বলে দিত, তবেই হয়তো ভালো হতো… ভালো হতো? এভাবে জ্যোৎস্না লাগা আনন্দীকে তবে কিভাবে দেখতে পেতো ইন্দিরা?
হাওয়াশহরে পৌঁছে রাতের অটো করে আনন্দী আর ইন্দিরা অ্যাপার্টমেন্টে এসে পৌঁছোয়। আনন্দী কোনো কথা বলে না। ইন্দিরা তাকে অনুসরণ করে। দরজার লক খুলে ভিতরে এসে ইন্দিরা বলে, “Can I say something now?”
নিজের ঘরে ঢুকে গিয়েও বেরিয়ে আসে আনন্দী, বলে, “বলো”
“Sorry…”, আর কিছু বলতে পারে না সে, আনন্দীর চোখে চোখ পড়তে গুঁটিয়ে যায় ইন্দিরা।
“তুমি তো আমার দিকে ঠিক করে তাকাতেই পারছো না… যেদিন আবার চোখে চোখ রেখে দাঁড়াতে পারবে সেদিন এসো…”, দরজা বন্ধ করে দেয় আনন্দী।
ধীরে ধীরে হলঘরের সোফায় এসে বসে ইন্দিরা। চুপ করে অন্ধকারে তাকিয়ে থাকে। কি মনে হতে একবার রুবাঈয়ের নম্বর ডায়াল করেও কেটে দেয়।
সকাল হতে ইন্দিরা নিজেকে হলঘরের সোফায় আবিষ্কার করে। তার পায়ে তখনও মোজা, গায়ে গতকালের পোষাক। মোবাইলে দেখে বেলা ন’টা বেজে গিয়েছে। মুখটা ভীষণ তেতো লাগে ইন্দিরার। চট করে মনে পড়ে যায় গতকাল ঠিক কি হয়েছিল। ইন্দিরা এসে দাঁড়ায় আনন্দীর ঘরের দরজার সামনে। দরজায় নক করতে গিয়ে বোঝে দরজাটা বন্ধ। ইন্দিরা একবার নক করে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে। কোনো সাড়া আসে না ভিতর থেকে। আরো একবার নক করে অপেক্ষা করে ইন্দিরা। কোনো আওয়াজ নেই আনন্দীর ঘরে। ইন্দিরা ফোন তুলে নেয়। আনন্দীর নম্বর ডায়াল করে। কিছুক্ষণ বাজার পর ফোনটা কেটে যায়। ইন্দিরা শুনতে পায়, “The person you are calling is currently busy. Please try after sometime.”
নিজের ঘর থেকে একটা স্টিকি নোট নিয়ে এসে ইন্দিরা সোফায় বসে পড়ে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে ভেবেও সে বুঝতে পারে না কি লেখা উচিৎ। অবশেষে ইন্দিরা লেখে, “because I love you”, স্টিকি নোটটা আনন্দীর ঘরের দরজায় আটকে রেখে স্নানে যায় ইন্দিরা। আধঘণ্টা পরে অফিসের জন্য তৈরি হয়ে ফিরে এসেও সে দেখে দরজা বন্ধ এবং স্টিকি নোট নিজের মতো রয়েছে।
আরো একবার আনন্দীর নম্বর ডায়াল করে ইন্দিরা, ফোনটা একবার বেজেই কেটে যায়, ইন্দিরা শোনে, “The person you are calling is currently busy…” ফোন কেটে দিয়ে ইন্দিরা দেখে ঘড়িতে দশটা বাজতে দশ।
অফিসের জন্য বেরিয়ে পড়ে সে।
“কি হয়েছে? উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে তোমায়…”
রুবাঈকে লাঞ্চ টেবিলে গতকালের ঘটনা জানায় ইন্দিরা। সবটা শুনে রুবাঈ মাথা নিচু করে বসে কি যেন ভাবে। তারপর বলে, “ও কি জানে, কেন তুমি ওকে নীলেশের ফোনের কথা জানাও নি?”
“বলার সুযোগ পাই নি রুবাঈ, ওর সামনে নিজেকে কি প্রচণ্ড ক্ষুদ্র মনে হচ্ছিল, গলা বুঁজে আসছিল, আমি মাথা তুলে তাকাতে পর্যন্ত পারি নি।”
“ওর প্রতি তোমার মোহ… তোমায় মাথা তুলতে দিচ্ছে না ইন্দিরা। প্রেমকে এমন হতে হয়?”
“মানে?”
“তুমি কি ওকে বলেছো, তুমি ওকে ঠিক কতটা… ভালোবাসো? যদি না বলে থাকো ইন্দিরা, এখনই যাও, এখনই গিয়ে বলো, নয়তো…”, রুবাঈ দুহাতে নিজের মাথা চেপে ধরে।
“রুবাঈ কি হলো! তুমি ঠিক আছো তো?!”
“আমি ঠিক আছি ইন্দিরা, কিন্তু তুমি যেন দেরি করে ফেলো না…”
“আমি বুঝতে পারছি না রুবাঈ তুমি কি বলতে চাইছ, সব ঠিক আছে তো? তোমার শরীর…”
চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে রুবাঈ, “আমার মিটিং আছে এখন, আমি আসি ইন্দিরা”
লাঞ্চ টেবিলে একা ইন্দিরাকে ফেলে রেখে রুবাঈ চলে যায়।
ইন্দিরার ফোন বেজে ওঠে, “বলো হিরণ…”
“আনন্দী আজকেও এলো না অফিসে, ওর শরীর ঠিক আছে তো? এসটি-তে পিং করলাম, কোনো জবাব দিলো না…”
“ও আসে নি!”
“সেকি! তুমি জানো না?! সব ঠিক আছে তো ইন্দিরা?”
“হ্যাঁ, সব ঠিক আছে”, হিরণের ফোনটা কেটে দিয়ে ইন্দিরা আরেকবার আনন্দীর নম্বর ডায়াল করে, আবারও বার দুই বেজে ওঠার পরে ফোনটা কেটে যায়। দেরি… কিসের দেরি হওয়ার কথা বলছিল রুবাঈ? ইন্দিরা বোঝে না, তবু অজানা একটা চাপা ভয় তার মাথার মধ্যে সেঁধিয়ে যায়। ডেস্কে ফিরে এসে এসটি থেকে আনন্দীকে পিং করে সে। কোনো জবাব আসে না। আনন্দীর নামের পাশে জ্বলতে থাকা সবুজ আলোটার দিকে তাকিয়ে থেকে মিটিঙে মন বসে না ইন্দিরার, কাজে মামুলি ভুল হয়ে যায়। সময়ের আগেই অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে আসে সে।
দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতেই ইন্দিরা টের পায়, কি যেন একটা নেই… ব্যাগটা সোফায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সে আনন্দীর ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়। দেখে স্টিকি নোটে তার লেখার নিচে বড় করে লিখে কেটে দেওয়া আছে একটা শব্দ- “TRUST”
স্টিকি নোটটা দরজা থেকে খুলে নিজের হাতে নেয় ইন্দিরা।
শব্দটার সামনে নিরস্ত্র লাগে তার নিজেকে। দরজায় নক করে ইন্দিরা। কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। ফোন বের করে আবার আনন্দীর নম্বর ডায়াল করে সে। যথারীতি বার দুয়েক বেজে ফোন কেটে যায়। ইন্দিরা হোয়াটসঅ্যাপে আনন্দীকে লেখে, “আমার সংশয় ছিল, তুমি চলে যাবে,- কার কাছে সেটা বড় কথা নয়, আমায় ছেড়ে,- এটাই সব। নীলেশ কিভাবে আমার নম্বর পেয়েছে আমি জানি না আনন্দী। তবে আমি তাকে তুমি অবধি পৌঁছোতে দেব না কখনো,- কথা দিলাম।”
মেসেজটা পাঠিয়ে ইন্দিরা অপেক্ষা করে, মেসেজ ডেলিভার হয়, কিন্তু দুটো নীল টিক ফুটে ওঠে না।
আনন্দীর ঘরের দরজায় হেলান দিয়ে মেঝেতে বসে পড়ে ইন্দিরা। তার আবার মনে হয়, কি একটা যেন নেই।
একটা রক্তমাখা ওড়না, তার দিকে বাড়িয়ে আছে আনন্দী। ওড়নাটা হাতে নেয় ইন্দিরা।
“দিয়ে গেলাম, সাথে রেখো”
“কি হবে এটা দিয়ে?”
আনন্দী ইন্দিরার প্রশ্নের জবাব দেয় না।
“তুমি কোথায় যাচ্ছো আনন্দী?”
আনন্দী ইন্দিরার প্রশ্নের জবাব দেয় না।
“কেন যাচ্ছো!”
ইন্দিরার ঘুম ভেঙে যায়। অদ্ভুতভাবে সাথে সাথে ইন্দিরা টের পায় অ্যাপার্টমেন্ট থেকে আনন্দীর গন্ধটা চলে গেছে। দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে আনন্দীর দরজায় জোরে জোরে নক করে ইন্দিরা, বারবার ডেকেও কোনো সাড়া পায় না সে। তারপর আরো দ্রুত রুবাঈয়ের নম্বর ডায়াল করে। ফোন বেজে বেজে কেটে যায়। হঠাৎ ডোরবেল বেজে ওঠে। ছুটে এসে দরজা খোলে ইন্দিরা, দেখে, আনন্দী নয়, মঞ্জুনাথ দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে।
“আপনি?”
“হ্যাঁ, আপনাকে চাবিটা দিতে এলাম”
“কিসের চাবি?”
“আপনি বলেছিলেন না, পুরো অ্যাপার্টমেন্ট নিয়ে থাকতে চান, আপনার ফ্ল্যাটমেট আজ বিকেলে চাবি হ্যান্ডওভার করে দিয়েছে, এই নিন।”
ইন্দিরার শূন্যহাতে মঞ্জুনাথ আনন্দীর ঘরের চাবিটা রাখে।
“ও চলে গেছে?!”
“হ্যাঁ, আপনাকে বলে নি?”
“না, কোথায় গেছে কিছু বলেছে?”
“জিজ্ঞেস করি নি, বলল অফিস থেকে ট্রান্সফার নিয়েছে, এই শহরে মন লাগছিল না”
মন লাগছিল না… ইন্দিরা কিছু বলার আগে মঞ্জুনাথ বলে, “বাকি অ্যাডভান্স টাকাটা আপনি পরের মাসে আমার অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দিলেই হবে।”
মঞ্জুনাথ চলে যায়। বন্ধ সাদা দরজাটার সামনে এসে দাঁড়ায় ইন্দিরা। চাবি ঘুরিয়ে লক খোলে। শূন্যতার গন্ধ…
অন্ধকারে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আলো জ্বালায় ইন্দিরা। ফাঁকা শূন্য একটা সাদা ঘর। দেওয়ালের আনন্দীর ছোটবেলার ছবিগুলো নেই। আনন্দীর সাজের সরঞ্জাম, পাউডার, পারফিউম, চিরুনি,- নেই। গোটা তিনেক পড়ার বই, আলমারি ভরা জামা-কাপড়, কিচ্ছু নেই। মাথাটা টলে যেতে ইন্দিরা মেঝেতে পড়ে যায়। ইন্দিরা দেখে একটা ওড়না পড়ে আছে তার চোখের সামনে, বিছানার নিচে। হাত বাড়িয়ে ওড়নাটাকে বের করে আনে ইন্দিরা। তাতে কোনো রক্ত লেগে নেই। ফেলে যাওয়ার বিষাদও না। ওড়নায় মুখ গুঁজে বুক ভরে শ্বাস নেয় ইন্দিরা। আনন্দীর গন্ধে তার ফুসফুস ভরে ওঠে।
বহু বছর পর চিৎকার করে ফাঁকা অ্যাপার্টমেন্টে কেঁদে ওঠে ইন্দিরা। কারণ সে জানে, এখানে আর কেউ তার কান্না শুনতে পাবে না।
ঘন্টা দুই পরে ইন্দিরা মোহগ্রস্থের মত হলঘরে আসে। মোবাইল ফোন তুলে নিয়ে দেখে কোনো নোটিফিকেশন নেই। হোয়াটসঅ্যাপে এসে দেখে, আনন্দী তখনও তার মেসেজ পড়ে নি। রুবাঈকে ফোন করে ইন্দিরা। ফোন বেজে বেজে কেটে যায়। রুবাঈকে মেসেজে সে লেখে, “ও চলে গেল। ধরে রাখার আগেই। এবারও মুঠো বন্ধ রাখতে পারলাম না।”
টেবিলে ফোন রেখে সামনের দেওয়ালের দিকে তাকায় ইন্দিরা। দেওয়াল জুড়ে ছড়িয়ে আছে তার ও আনন্দীর ছবিগুলো। সময়… খুব অবাক লাগে ইন্দিরার। ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে সে অপলক।
হঠাৎ কি মনে হতে আবার ফোনটা তুলে সমীকের নম্বর ডায়াল করে ইন্দিরা, ওপাশ থেকে সাড়া আসে, “ঠিক আছো ইন্দিরা?”
“আনন্দী চলে গেছে…”
“হ্যাঁ, যাওয়ার আগে দেখা করে গেছে আমার সাথে… একা থাকতে অসুবিধা হচ্ছে না তো তোমার?”
“ও কিছু বলে গেছে যাওয়ার আগে? এত তাড়াতাড়ি ট্রান্সফার পেল কি করে?”
“ট্রান্সফার তো পায়নি এখনও, ওয়ার্ক ফ্রম হোম করবে বলেছে যতদিন না ট্রান্সফার পাচ্ছে”
“হোম… ও বাড়ি ফিরে গেছে?!”
“না ইন্দিরা, তুমি কি নীলেশের সম্পর্কে জানো?”
“হ্যাঁ, ও বলেছে আমায়”
“তবে নিশ্চয়ই জানো পুনে শহরে কি হয়েছিল ওর সাথে?”
“জানি”
“ও আমায় বলে যায় নি কোথায় গেছে, আমিও জিজ্ঞেস করি নি, তবে ও কথা দিয়েছে যেকোনো অসুবিধা হলে আমায় জানাবে।”
ফোন রেখে দিয়ে সোফায় এসে বসে ইন্দিরা।
ঘরে আলো থাকতেও চোখে যেন অন্ধকার নেমে আসে তার। ইন্দিরা ঘুমিয়ে পড়ে।
রাত ন’টা নাগাদ ডোরবেলের আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় ইন্দিরার। চমকে উঠে গিয়ে সে দরজা খোলে, দেখে রুবাঈ দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে।
“এসো”, নির্বিকার মুখে বলে ইন্দিরা।
কিছু না বলে রুবাঈ হলঘরে এসে টেবিলের ওপরে খাবারের কিছু প্যাকেট রাখে। তারপর সোফায় গিয়ে বসে।
ইন্দিরা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে টেবিলের কাছে।
“কখন জানতে পারলে?”
“মঞ্জুনাথ এসেছিল বিকেলে, চাবি দিতে”
দুজনে চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ।
তারপর রুবাঈ বলে, “আমি কি কিছুদিন তোমার সাথে থাকবো?”
“দরকার হবে না”
“ও যে চলে যাবে আমি জানতাম না ইন্দিরা”
ইন্দিরা কিছু বলে না। চুপ করে টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে।
“জানলে…” রুবাঈ থেমে যায়।
“জানলে কি?”
মাথা নিচু করে বসে থাকে রুবাঈ, জবাব দেয় না কোনো।
“জানলে কি, রুবাঈ?”
“আজ দুপুরে লাঞ্চের আগে আনন্দী আমার কাছে এসেছিল।”
ইন্দিরা স্থির দৃষ্টিতে রুবাঈয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।
রুবাঈ বলে চলে, “ওর অ্যাকাউন্টে তেমন টাকা না থাকায় ফ্লাইটের টিকিট কাটার জন্য টাকা চাইতে। একটু অবাক লেগেছিল, কেন তোমার থেকে না চেয়ে আমার কাছে এসেছে ও… আমি বুঝি নি যে ও নিজের জন্য টিকিট কাটতে চায়। বললো পরের মাসে টাকা ফেরত দিয়ে দেবে। আমি টাকাটা ট্রান্সফার করে দিলাম।”
ইন্দিরা ধীরে ধীরে সোফায় এসে বসে।
রুবাঈ বলে চলে, “লাঞ্চে তোমার সাথে কথা হওয়ার পর আমি বুঝলাম আনন্দী টিকিটটা নিজের জন্যই কাটছে। বারবার ফোনে ধরার চেষ্টা করলাম ওকে। ফোন বেজে গেল। সন্ধ্যে থেকে ঘণ্টা দেড়েক ফোন স্যুইচড অফ ছিল। ওই সময়টা ও ফ্লাই করছিল সম্ভবত। রাত আটটায় একটা মেসেজ করে এল ফোনে”, নিজের ফোনটা অন করে ইন্দিরার হাতে ধরিয়ে দেয় রুবাঈ, ইন্দিরা দেখে স্ক্রিনে লেখা রয়েছে, “Tell her not to search me, take care”
ফোন হাতে স্থবির হয়ে থাকে ইন্দিরা। গলার কাছটা এমন ব্যথা করছে যেন যন্ত্রণা। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে, রুবাঈয়ের সামনে নিজেকে ধরে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করে ইন্দিরা। বলে, “তুমি ডিনার করেছো?”
“না, একসাথে খাবো ভেবে খাবারগুলো আনলাম”
আর বসে থাকতে পারে না ইন্দিরা, ভাঙা গলায় বলে, “তুমি বসো, আমি আসছি”, ছুটে নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দিয়ে ইন্দিরা কেঁদে ফেলে। বারবার আনন্দীর গলা তার কানে ভেসে ওঠে, “Tell her not to search me… Tell her not to search me…”
মিনিট দশ পর নিজেকে সংযত করে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে ইন্দিরা। দেখে টেবিলে খাবার সাজিয়ে ফেলেছে রুবাঈ।
চুপচাপ ডিনার সারে ইন্দিরা ও রুবাঈ। খাওয়া শেষ হলে রুবাঈ আবার জিজ্ঞেস করে, “তুমি একা থাকতে পারবে তো ইন্দিরা?”
“আমার অভ্যাস আছে রুবাঈ”, নির্বিকার স্বরে জবাব দেয় ইন্দিরা।
“যদি অসহ্য লাগে… আমায় ফোন কোরো…” টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় রুবাঈ। সে কিচেনে হাত ধুতে গেলে ইন্দিরা চুপ করে বসে থাকে।
হাত ধুয়ে বেরনোর জন্য প্রস্তুত হতে হতে রুবাঈ বলে, “তোমার যদি কিছু লাগে, জানিও আমায়”
“আনন্দী…” বলেই চুপ হয়ে যায় ইন্দিরা।
রুবাঈ থেমে যায়। তারপর ধীরে ধীরে বলে, “ও কি তোমার প্রয়োজন ছিল ইন্দিরা?”
“না”, অস্ফুটে জবাব দেয় ইন্দিরা।
“তবে?”
“ও যে কে ছিল আমার, তা বোঝার আগেই তো ও চলে গেল রুবাঈ”
রুবাঈ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ইন্দিরার দিকে, তারপর বলে, “টাকাটা চাওয়ার সময় ও আমায় বলেছিল কোথায় যাওয়ার টিকিট কাটছে… তুমি যদি চাও, আমি তোমায় জানাতে পারি আনন্দী কোথায় আছে এখন,”
“Tell her not to search me”, একটু ভেবে জবাব দেয় ইন্দিরা।
“সত্যিই জানতে চাও না?”
“আনন্দী চায় না জানাতে”, ইন্দিরা বলে।
“ইন্দিরা, আর যাই হোক, তোমাদের মধ্যে যে দূরত্বটা আছে, সেখানে যেন অভিমান নিজের জায়গা করে না নেয়”
ইন্দিরা কোনো উত্তর দেয় না।
“অভিমান একটা মারণড্রাগ ইন্দিরা, খুব সাবধানে তা সেবন করতে হয়, খুব সাবধানে তা সেবন কোরো।”
রুবাঈ চলে যেতে ইন্দিরা হলঘরের মেঝেতে এসে বসে। সামনের দেওয়ালের দিকে তকিয়ে থাকে। দেওয়াল ভরা ছবিগুলোর দিকে। বিগত সময়ের দিকে ফিরে বসে থাকে ইন্দিরা। আজ অবধি যেমন থেকেছে, ঠিক তেমনই। হঠাৎ করে হলঘরটার নাম দিতে ইচ্ছে হয় তার- অভিমান ঘর। অভিমানের হিন্দি কি ‘অভিমান’-ই? আনন্দীকে অভিমান শব্দের মানে বোঝাতে গেলে আরো কতটা দূরে যেতে হবে ইন্দিরাকে? অভিমানের ইংরেজিই বা কি? ইন্দিরা ভেবে পায় না কিছু। হলঘরের মেঝেতে বসে সে ফিসফিস করে কাকে যেন জিজ্ঞেস করে, “অভিমানের ইংরেজি কী, সুপর্ণা?”