আমাদের স্ক্রিনময়ী জীবন অনর্গল ডিজি-ছবির বন্যায় চিন্ময়। এই নেটেড দর্শনের গ্লোবাল রাজত্ব শুধু আমাদের অবসরকেই শাসন করে না, কোন ছবির ঝাঁক কিভাবে ইন্টারনেট আর স্ক্রিন বেয়ে আমাদের চোখ ধাঁধায় আর মন মাতায়, তা দিয়ে গড়ে ওঠে আমাদের রোজওয়ারি গণদর্শন আর রাজনীতি। ভিসুয়ালের সেই সাইবারশাহীর নানা ঝাঁকিদর্শন নিয়েই এই কলামের নানান কিস্তি।
ভ্রূ–পল্লবে ডাক দিলে, দেখা হ‘বে নীললোহিত সনে
না, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এই লেখার বিষয় নন। শিরোনাম ও তাঁর ছদ্মনাম যাঁর নামে, সেই লোহিতকেশ-নীলকন্ঠ শিবও নন এর বিষয়। বরং এর বিষয় লাল ও নীল নোটি(ফিকেশন) ও ভেরিফিকেশন মার্কা। যথা ফেসবুকের লাল, হোয়াটসঅ্যাপের আর টুইটারের নীল। এই বিন্দুবৎ রঙের ফোঁটার সিন্ধুবৎ সম্মোহনকে চিড়েফেঁড়ে দেখাই আমাদের উদ্দেশ্য। ফেবু বা চালাকফোনের অনিঃশেষ লাল নোটির পিড়িং কেন কিছুতেই তার সম্মোহনী শক্তি হারায় না, হোয়াটসঅ্যাপের নীল ‘read’ স্ট্যাটাস পাবার জন্য আর টুইটারের নীল ভেরিফিকেশন টিক পাবার জন্য আমাদের মন কেনই বা লালায়মান হতেই থাকে?
নিউ ইয়র্ক টাইমসে জন হেরম্যান এই দৃশ্যইতিহাসের এক চমৎকার চুম্বক পেশ করেন। ট্রাফিকের ‘এখুনি থামো’ লাল বাতি কিভাবে অতিগতিময় ‘এখুনি দেখো’-র লাল ফোঁটায় বদলে গেলো, তার বাখান খুব দীর্ঘ নয়। Mac OS X-এ প্রায় কুড়ি বছর আগে এর শুরু আর ২০০৭ এ আইফোন OS লঞ্চে তা সারা। উইন্ডোজ ডেস্কটপের নিচের-বাঁকোণের নীল, ব্ল্যাকবেরির সাদা তারা বসানো লাল, নানা ওয়েবসাইটে আর সোশ্যাল মিডিয়ায় স্পিচ বাবল বা নানা রকম চৌখুপির ছাঁদ, বা গুগলের বিরাট বিরাট সংখ্যাভরা নানা দেখা-বাকি-নোটি পেরিয়ে এই চিহ্ন এখন শুধু লাল ফোঁটায় এসে ঠেকেছে।
টাচ-স্ক্রিন ফোন খুব চটজলদি ইন্টারনেট অবগাহনের প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠলো সারা দুনিয়ায়। ডেস্কটপ জি ইউ আই ডিজাইন, ওয়েবসাইট জি ইউ আই ডিজাইন আর মোবাইল অপারেটিং সিস্টেমের জি ইউ আই ডিজাইন(মানে গ্রাফিক ইউজার ইন্টারফেস, আগের কিস্তি পড়ুন) তিনধারার হুড়মুড়িয়ে- মিলিত ত্রিবেণী যখন বিশ্ববাজারমান্য এক অতিখাসা বকচ্ছপাবতার মূর্তি ধারণ করল, এই লাল টিপ তার কপালে জ্বলজ্বল করে উঠলো। এই জ্বলা কখনই ফুরোয় না কারণ এই নোটি এমন এক দৃশ্যচিহ্ন যা এক floating signifier। তার অর্থ যা-খুশি-তাই হতে পারে – আপনার প্রবাসী পিসঠাকুমার মৃত্যুসংবাদ কিংবা রদ্দি কাপড়ের সেল কিংবা কোন গ্রুপ চ্যাটপোস্টে কোনো ট্রোলের বিষবমি কিংবা আপনার চাকরি পাবার খবর, সবকিছুর নোটিই লাল টিপ।

অগণিত দেখা-বাকি নোটি-র সংখ্যাকে শূন্যতে নামিয়ে আনার যে অস্থিরতা তার প্রাথমিক প্রকাশ ছিলো Gmail এর Inbox এ unread ইমেল সংখ্যা শূন্যতে নামিয়ে আনার অভ্যেস। আজ থেকে দশ বছর আগেওwikipedia তে একে Inbox Zero Syndrome নামক একটি ব্যবহারিক বিকার বলে ডাকা হত। কিন্তু হালে তা Wiktionary-র অভিধানে শুধু Inbox Zero নামক একটি অভ্যাস হিসাবে পরিগণিত। এতটাই বহুব্যাপ্ত সেই বিকার যে তাকে স্বাভাবিক ব্যবহার বলে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে পৃথিবী।
হোয়াটসঅ্যাপের নীল ‘read’ স্ট্যাটাস আর টুইটারের নীল ভেরিফিকেশন টিকের সম্মোহনের হিসেব আলাদা। হোয়াটসঅ্যাপের অনেক আগে থেকেই এই ‘রেড’ স্ট্যাটাস আমাদের পরিচিত। একে ‘Read Receipt’ নামে ডাকা হয়। চিঠি পাঠানোর যুগ থেকেই সে চিঠি পৌঁছেছে কিনা, পাঠানো ইমেল পড়া হয়েছে কিনা, IM বা ইন্সট্যান্ট মেসেঞ্জারের মেসেজ পৌঁছেছে কিনা, এসব রসিদ পেতে আমরা বহুকাল ধরেই অভ্যস্ত । কিন্তু হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পড়া হয়েছে কি হয়নি সেই নীলনিশানের সাথে গাঁটছড়া বাঁধে user এর online status। সে, মেসেজ পাঠানোর সময় ইন্টারনেটে আছে কি নেই, বা কত আগে সে অনলাইন ছিলো, সেই তথ্যের সাথে যুক্ত হয় সে মেসেজ পড়েছে কি পড়েনি সেই তথ্য। তয়ের করা হয় ধৈর্যহীনতার এক বিষবৃত্ত। রসশাস্ত্রে দয়িতের জন্য অপেক্ষমানার মন যেমন নানা ব্যভিচারীভাবে আন্দোলিত হয় – গ্লানি, লজ্জা, শঙ্কা, হর্ষ, দৈন্য, অসূয়া, বিষাদ, চিন্তা, ত্রাস, মদ, মোহ, জড়তা, ঔৎসুক্য, বিষাদ – সেই অস্থিরতা কৃত্রিমভাবে উৎপাদন করে এই নীল টিক। যাতে আরো আরো আরো মেসেজ পাঠায় প্রেরক।

আইডেন্টিটি ভেরিফিকেশনের নীল টিক টুইটার চালু করে ২০০৯-এ, তারপর একে একে তাকে নকল করে গুগল প্লাস (২০১১), ফেসবুক (২০১২), ইন্সটাগ্রাম (২০১৪) আর পিন্টারেস্ট (২০১৫)। নামজাদা লোকদের নামচুরি, নকল থেকে সাবধান, বা মুখোশ পরে কুকথা-কুকাজ থেকে সুরক্ষার উদ্দেশ্যে যার সৃষ্টি তা আজ এক বিচিত্র ঢালে পরিণত হয়েছে। তা টাকা দিয়ে কেনা যায়, যে কেউ কিনতে পারে আর তার আড়ালে থেকে জমিয়ে টিকরমবাজি করা যায়।

আমাদের চোখে এই ছোট ছোট লাল চিমটি-নীল চিমটি অবলীলায় আমাদের অনন্যমনস্কতার পাছা দিয়ে লাল সুতো-নীল সুতো বের করে ছাড়ে। অধ্যাপক ইয়ান বোগোস্তের তত্বায়নে তা procedural rhetoric বা এক ধরণের পদ্ধতিগত বশীকরণ পদ্ধতি – যা আসে ভিডিও গেমের ডিজাইন ইতিহাস থেকে। যেখানে নতুন নিয়মের মধ্যে দিয়ে নতুন জগত তৈরি করা হয় – লেখা, ছবি আর চলচ্ছবি দিয়ে সেই নিয়মপালনের জন্য বশ করা হয় মনকে। এখানে আমাদের উদাহরণ – চোখে দেওয়া লাল নীল পাকচিমটি – যা আমাদের চটজলদি আনন্দ আর দীর্ঘস্থায়ী অস্থিরতা দেয়, যা শুধু দেখাকেই না দর্শনকেও বদলে দেয়। যেই দর্শনমতে সময় অতিরিক্ত দ্রুত চলে, মানুষ হয় অতিপণ্ডিত নয় গণ্ডমূর্খ, সম্পূর্ণ সহমত বা ঘোর বিরোধিতার মাঝামাঝি কিছু নেই ইত্যাদি। রাজনীতি, বিজ্ঞাপন আর শিক্ষার নানা মূলনীতির বিকৃতির অশুভ আঁতাতে এই পদ্ধতিগত বশীকরণের গোড়াঘাট তৈরি হয়।
Oxford Internet Institute-এর Computational Propaganda Research Project -এর গবেষণামতে সারা পৃথিবীতে ফেক নিউজে ধীরে ধীরে ছবির পরিমাণ বাড়ছে আর লেখার পরিমাণ কমছে। কিন্তু সেই ফেক ছবি সবসময় পরিপাটি করে ফটোশপ করা নয়। নিচের উদাহরণে শুধু হোয়াটসঅ্যাপের টিক নিয়ে বানানো এই ফেক নিউজ এত বিপুল ভাবে সফল হয় যে, ভারতসরকারকে তা বিজ্ঞাপন দিয়ে খণ্ডন করে জনতাকে আশ্বস্ত করতে হয়। ভারতসরকারের তার নাগরিকদের ওপর পেগাসাস দিয়ে আন্তর্জালিক আড়ি পাতে বলেই এই ফেক নিউজ যে সফল তা না। বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের ক্রমান্বয়ে পরিবর্তনশীল বশীকরণমূলক জি ইউ আই আর অ্যালগরিদমের আড়িপাতার ছেনালি নিয়ে মানুষ এমনিতেই ঘোর সন্দেহপ্রবণ।


টুইটারের নীল টিক যা কড়ি দিয়ে কেনা যেত না তা এক কালে ছিল বনেদিয়ানার নীলরক্ত। ইনি-শুধু খাঁটি-না-সাথে-নোটেবল-ও, বহু-পথ-ঘুরে-বহু-ক্লেশ করে অর্জিত এই নীল টিক টুইটার দিত তার নিজ মর্জিতে। এলন মাস্ক এসে ফেলো-কড়ি-মাখো-নীল ব্যবস্থা করতেই নকল-নোটেবল-এ ভরে গেলো টুইটার। তার মধ্যে এলনের মাস্ক পরা একাউন্টই বেশি। এই সব গেরো থেকে বাঁচতে কেড়ে নেওয়া হল সবার নীল টিক, পয়দা হল সোনালী টিক (সংগঠনের জন্য) আর ছাই টিক (সরকারি সংস্থার জন্য) আর নীল টিক ফিরিয়ে দেওয়া হ’ল আগের নোটেবলদের এবং আট ডলার দিয়ে নীল টিক কেনা আটকড়ির ব্যাটাবেটিদের, এবং এই তুষ আর খুদদের আলাদা করতে এখন ব্লু টিক-এর পাশে লেখা থাকে ‘may or may not be notable’। নীললোহিতের এই অর্ধমিথ্যার বাজারে এটাই বোধহয় সত্যের সবচেয়ে কাছাকাছি।
আরও পড়তে চাইলে:
https://www.nytimes.com/2018/02/27/magazine/red-dots-badge-phones-notification.html
Alhddad, Lujayn, “Read Receipts Feature in Mobile Platform: An Investigation Study Based on Social Tie Between the Sender and Receiver” (2015). Thesis. Rochester Institute of Technology.
https://wire-haired/story/twitter-elon-musk-verification/
https://en.wikipedia.org/wiki/Procedural_rhetoric
https://www.reuters.com/article/us-facebook-disinformation-idUKKBN1WB0ED
https://timesofindia.indiatimes.com/gadgets-news/this-whatsapp-message-on-blue/red-ticks-is-fake/articleshow/75046391.cms

সৌরভ রায়
লেখক, সম্পাদক, অনুবাদক ও চিত্রগবেষক
বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের LGBTIQ+-সংক্রান্ত অনলাইন ভিসুয়াল কন্টেন্ট নিয়ে গবেষণা করছেন।