শুক্রবার। সপ্তাহে এই একটা দিন ছুটি। বাসা থেকে বের হতে ইচ্ছে করে না। তারপরো আড্ডার লোভে মাঝেমাঝে শাহবাগ যাই। গত ২৫ আগস্ট বের হয়েছিলাম আরামবাগের উদ্দেশে। এই জায়গায় যে খুব গেছি, তা না। মেইন রাস্তাটা চিনি। গলি-টলি সম্বন্ধে একটুও ধারণা নাই। আরামবাগে যাবার আগে শাহবাগে যাওয়া ভালো।ওইদিন আবার বন্যার্তদের সহায়তার জন্যে বইমেলা চলছিল। বন্ধু কমল আর ডায়নাকে আসতে বলছি, আরামবাগ যামু। আমার মতন কমলও বের হয়েছে আরামবাগ যাবার জন্যেই, ডায়না আসছে আমারে বই দিতে। শাহবাগে রীদার সাথেও দেখা। ও-ও আরামবাগে যাবে। আরামবাগে কি? আরামবাগে যাওয়ার এত ইচ্ছা কেন?
তাসের দেশ। একটা আর্ট এক্সিবিশনের নাম। এসব এক্সিবিশনে যাবার অভ্যাস খানিকটা আছে। ঘুরেফিরে শিল্পকর্ম দেখতে ভাল লাগে। শিল্পীর চিন্তার সাথে নিজের চিন্তাজগৎকে মেলাতে চাই, কখনো কখনো অবাক হয়ে ভাবি – এভাবেও ভাবা যায় এবং প্রকাশ করা যায়! আরামবাগে আর্ট এক্সিবিশন হয়, এরকমটা কখনো শুনি নাই। কবিবন্ধু রাজীব দত্ত শিল্পী।এটা কে না জানে! রাজীবের ফেসবুক পোস্টে ‘আরামবাঘ’ সংক্রান্ত কিছু পোস্ট দেখে ধারণা করছিলাম, আরামবাগে কিছু একটা হতে যাচ্ছে। এরপর জানলাম এই আর্ট এক্সিবিশনে দুজন কবিকেও যুক্ত করা হয়েছে। হাসনাত শোয়েব এবং মিঠুন রাকসাম। চিন্তাটা অভিনব লাগলো। রাজীবের কাজ দেখার জন্যে এমনিতেই যেতাম। শোয়েব আর মিঠুনযোগ এক্সিবিশনটার ব্যাপারে আরো কৌতুহলী করে তোলে। আমি ফাইন আর্টসের লোক না, শিল্পের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাপার-স্যাপার জানি না। বুঝিও না। শিল্পকর্ম দেখে নিজে নিজের মতো বোঝার চেষ্টা করি।
আরামবাগে আর্ট এক্সিবিশন। দেওয়ানবাগ পীরের গলিতে। এত চিপা গলি, প্রথমে বিশ্বাস করি নাই এরকম একটা গলির নাম সব রিক্সাওয়ালা জানে। নামায়ে দিয়ে যখন পীরের গলি দেখায়ে ভাড়া চাইলো, একবার গলি আরেকবার রিক্সাওয়ালার মুখের দিকে তাকাচ্ছিলাম। বিশ্বাস করতে শোয়েবরে ফোন দিলাম। সে নিশ্চিত করলো ওইটাই পীরের গলি। গলিতে ঢুকেই আমার মনে পড়ে, গোয়েন্দা গল্প আর থ্রিলার ছবির সাথে দারুণ যায়। কিন্তু আর্ট এক্সিবিশন? ওই গলির দেয়াল থেকেই শুরু। এরপর সিঁড়িসহ পুরা বিল্ডিংটাই আনা হয়েছে আর্টের আওতায়।এক্সিবিশনের কিউরেটর অতীশ সাহাকে ওখানেই এ প্লাস দিয়ে ফেললাম। আর্ট এক্সিবিশনের স্থানটাও যে আর্ট ওয়ার্কের মধ্যে পড়ে, এই ধারণাটা আগে আমার ছিলো না।
তাসের দেশ মানে কি? একেকজনের কাছে মানে একেক রকম। তা নিয়ে সন্দেহ নেই। আমার কাছে যেইটা লাগে, সেটা হলো তাস মানে তো কার্ডস। একটা খেলা। যে খেলায় কে জিতবে কেউ জানে না। খালি চালাকি এই খেলায়। জুয়া আছে খেলাটায়। একটা দেশ হাউজ অব কার্ডস বা খেলার তাসের মতো হয়ে গেলে তার রূপ কেমন হয়? এলোমেলো। ঘিঞ্জি। অনিশ্চয়তায় ভরপুর। কোলাহলপূর্ণ। যেখানে ল্যাঙ মেরে একে অন্যকে ছাড়িয়ে যাবার চেষ্টা। চতুরদের পৌষমাস সারাক্ষণ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তাসের দেশ কি নিয়ে আমি জানি না। পড়া হয়নি। তবে আর্ট এক্সিবিশন তাসের দেশ চেনা হয়েছে।তো আমার মনে হয় ‘তাসের দেশ’এর জন্যে পীরের গলির চেয়ে উৎকৃষ্ট জায়গা হতে পারতো না।
তাসের দেশের পোস্টার করা হয়েছে অংশগ্রহণকারী শিল্পীদের জাতীয় পরিচয়পত্রের ছবি দিয়ে। এই আইডিয়াটাও নতুন। অন্তত আমার কাছে। এরকম কিছু আগে চোখে পড়েনি। সিঁড়িতে উঠতে উঠতে উঠতে শিল্পকর্মগুলো দেখছিলাম। দুজন ক্যারেক্টারকে নিয়ে আলোকচিত্রগুলোর দিকে আলাদাভাবে নজর যায়। দুজন আগন্তুক, যেন এলিয়েন। তারা ঢাকা দেখছে। তীব্র কৌতুক আছে এই দেখায়। সিঁড়িতেই মিঠুন রাকসামের কবিতা নিয়ে শিল্পকর্ম চোখে পড়ে। ভূমি রেজিস্ট্রি স্ট্যাম্পে টাইপ রাইটারে ছোট ছোট সেসব কবিতা দর্শনার্থীদের ভাবাবে। কবিতার টেক্সট আর ভূমি রেজিস্ট্রি স্ট্যাম্প মিলে বাংলাদেশের আদিবাসীদের ভূমি হারানোর বেদনা পাওয়া যায়।
সালমা আবেদীনের তোলা ছবির একটা সিরিজ বেশ ভাল লেগেছে এই এক্সিবিশনে। সম্ভবত বিমান বাহিনীর জাদুঘরে গিয়ে ছবিগুলো তুলেছেন। জাদুঘরে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীদের পুরনো বিমানে চড়া নিয়ে এই ছবিগুলোকে দর্শনার্থীরা চাইলেই নানারকম ব্যাঙ্গার্থে ভাবতে পারেন। আমরা পরিপাটী ড্রয়িং রুম দেখি। সেই ড্রয়িংরুম সাজাতে যেসব পণ্য আর আসবাবের দরকার হয়, তার পেছনের মানুষদের গল্পগুলি এতো পরিপাটী না। জান্নাতুল মাওয়ার শিল্পকর্মে এরকম বিষয়ও তুলে ধরা হয়েছে।
আবীর সোমের কাজটা উঠার মুখে সিঁড়িতেই। একটা ব্যানার ঝুলানো। তাতে লাল রঙের টেক্সট। অস্পষ্ট অনেকটাই। টেক্সট দৃশ্যত করারই প্রয়াস থাকে সচরাচর। এখানে তা নয়। টেক্সট হাইড করতে চাচ্ছেন যেন। অবশ্য টেক্সটা ইংরেজিতে যেহেতু শিক্ষিতদের বাইরে তার মিনিং এমনিতেই লুকানো। এখন শিক্ষিতদের কাছেও। সাথে ছিল থার্মোপলের ভাস্কর্য। সচরাচর শক্ত মেটেরিয়ালেই ভাস্কর্য বানান সবাই। এখানে উল্টাটা। ফলে ভেঙ্গেও গেছে। ভাঙ্গাটুকুও শিল্পে শরীক হয়েছে। রনি আহমেদের কাজটা আরো বিস্তৃত পরিসরে হলে আরো দৃশ্যনীয় হতো। এইটাই বেশি সাইট স্পিসিফিক ছিল এখানে। অবশ্য আরো কয়েকটা কাজও সাইট রিলেটেড ছিল।
তাসের দেশের যে ক্যাওস, তা অনুভব করা যায় প্রত্যেকটি শিল্পকর্মেই। প্রিন্টিং প্রেস, গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি, মাজার সংস্কৃতিও জায়গা পেয়েছে এই আর্ট এক্সিবিশনে। ২৫ জন আর্টিস্টের কাজ নিয়ে তাসের দেশ এক মহাযজ্ঞ। দিলারা বেগম জলি এবং জিহান করিমের ভিডিও প্রজেকশনের কাজ দুটি অসাধারণ। কমিউনিজম এবং সোশ্যালিজম নিয়ে মিজানুর রহমান সাকিবের কাজটাও আলাদাভাবে চোখে পড়ে।
লেখায় মতের বিরোধ হলেই লেখক-প্রকাশক হত্যা, বই বাজেয়াপ্ত করা, প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়া, সাহিত্য চর্চার পথ রুদ্ধ করে দেয়া একমাত্র তাসের দেশেই সম্ভব।তাই পেরেক গাথা বই এবং রক্তঝরা লেখার আদলে কবি হাসনাত শোয়েবের শিল্পকর্মটি দুর্দান্ত। রাজীব দত্তর শিল্পকর্মের একটা সিগনেচার আছে। এই এক্সিবিশনেও সেটা রয়েছে। আঁকার সঙ্গে টেক্সটের বৈচিত্র রাজীবের শিল্পকর্মকে আলাদা মাত্রা দেয়। প্রথমে দেখলে মনে হয়, এ কোন এক শিশুর খামখেয়াল। অপ্রচলিত আঁকা এবং টেক্সট দর্শনার্থীকে প্রথমে হাসায়। তারপর চিন্তার খোড়াক যোগায়।
সব মিলিয়ে তাসের দেশ ব্যাপকভাবে অভূতপূর্ব এক পলিটিক্যাল আর্ট এক্সিবিশন।শিল্পবোধ থাকার দরকার নাই, চিন্তা করার ক্ষমতাসম্পন্ন যেকোন মানুষকে তাসের দেশে স্বাগত জানাই। ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক্সিবিশনটা চলবে।