তারাদের ঘরবাড়ি – অলোকপর্ণা ।। ধারাবাহিক উপন্যাস । চতুর্থ পর্ব

ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে উঠে গেছে পাহাড়ি রাস্তাটা। ইন্দিরা দাঁড়িয়ে আছে। ধূসর কুয়াশায় সামনের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ইন্দিরা তবু জানে, কুয়াশায় এক দল মানুষ তার আগে আগে এই পথ বেয়ে উপরে উঠছে,- সে একা নয়। কিভাবে এই মানুষগুলোর কথা সে জানতে পারল, ইন্দিরা জানে না। বিনা বাক্যব্যায়ে আন্দাজে সে তাদের পিছু পিছু উপরে উঠতে শুরু করল। ঘন কুয়াশা চোখ বেয়ে যেন মাথার মধ্যে ঢুকে আসছে। হঠাৎ মোড় ঘুরেই ইন্দিরাকে দাঁড়িয়ে পড়তে হল,-

তার সামনে বিশাল একটা খাদ কুয়াশায় ডুবে আছে। আর তখনই কে যেন পিছন থেকে ডেকে উঠল তার নাম ধরে। পিছু ফিরে তাকাতে নিজেকে খুব হালকা লাগে ইন্দিরার। খাদের ধার থেকে সে অল্প অল্প করে সরে আসে। যত সরে আসে তত তার মনে হয় কুয়াশার ওপারে যেন কেউ অপেক্ষা করছে তার জন্য। আরো খানিকটা এগিয়ে আসার পর কুয়াশার ওপারে দাঁড়ানো মানুষটা ডেকে ওঠে, “ইন্দিরা!” হঠাৎ কুয়াশা পাতলা হয়ে যায়, ইন্দিরা দেখে সেই দুটো চোখ, খুব শান্ত, কিন্তু তীব্র, তাকিয়ে আছে তার দিকে।

ইন্দিরা মানুষটার মুখ দেখার চেষ্টা করে, কিন্তু চোখদুটো থেকে নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিতে পারে না। পলক ফেলার চেষ্টা করে, চোখ বোজার চেষ্টা করে, তবু ইন্দিরার দৃষ্টি আটকে থাকে উজ্জ্বল চোখদুটোয়।

হঠাৎ কাছেই কোথাও, কিছু ভেঙে পড়ার শব্দ হয়।

 

জেগে উঠে ইন্দিরা বোঝে আওয়াজটা তার ঘরের বাইরে থেকে এসেছে। বিছানা ছেড়ে সে উঠে দাঁড়ায়, বাইরে জানালা দিয়ে অন্ধকার ঢুকে আসছে ঘরে, কতক্ষণ সে ঘুমিয়েছিল আন্দাজ করতে পারে না। দরজা খুলে বাইরে আসতে দেখে হলঘরে আলো জ্বলছে। হলের ঠিক মাঝখানে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে একটা মেয়ে, ইন্দিরা আন্দাজ করে সম্ভবত এই তার নতুন ফ্ল্যাটমেট। তার এক হাতে একটা বেশ বড়ো কাঁচি, সেই কাঁচি দিয়ে খচখচ করে নিজের চুল কেটে ফেলছে মেয়েটা। সেই চুল, হালকা পালকের মত ধীরে ধীরে নেমে আসছে মেঝেতে। হলের মেঝেয় সাদা সাদা আরো কিছু পড়ে আছে, ভালো করে খেয়াল করতে ইন্দিরা বোঝে পোর্সেলিনের টুকরো ছড়িয়ে আছে চারদিকে। আর তখনই পায়ে একটা যন্ত্রণা টের পায় ইন্দিরা। বাঁ পায়ের পাতা তুলে সে দেখে পায়ের তলায়, দুটো আঙ্গুলের মাঝ বরাবর একটা ইঞ্চি দেড়েক লম্বা পোর্সেলিনের টুকরো কখন যেন ঢুকে গেছে চামড়া ভেদ করে। ডান হাত দিয়ে হাল্কা করে টান দেয় ইন্দিরা, টুকরোটা বেরোয় না, রক্ত বেরিয়ে এসে যন্ত্রণায় কুঁচকে ওঠে তার মুখ। এবার একটু জোরেই টানে ইন্দিরা,- “উফ্‌!”
টুকরোটা পা থেকে বেরিয়ে আসে, যন্ত্রণায় কুঁচকে ওঠা মুখে ইন্দিরা সোজা হয়ে দাঁড়ালে দেখতে পায় মেয়েটা তার দিকে তাকিয়ে আছে।

“হাই”

প্রত্যুত্তরে ইন্দিরার মুখ থেকে অদ্ভুত কিছু আওয়াজ বেরোয়।

“আই থিঙ্ক ইউ শ্যুড অ্যাপ্লাই সাম ওয়াটার অ্যান্ড মেডিসিন অন দ্যাট”, কাঁচি দিয়ে আনন্দী ইন্দিরার পায়ের দিকে নির্দেশ করে।

“আই উইল”

“ইফ ইউ প্লিজ এক্সকিউজ মি”, ইন্দিরার ফ্ল্যাটমেট কাঁচি সমেত নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। তার অর্ধেক কেটে ফেলা চুল হলের মাটিতে পড়ে থাকে।

 

হোম ডেলিভারির খাবার খেতে খেতে ইন্দিরা বাড়িতে ফোন করে। ফোন বেজে যায়। এসময় সাধারণত বাবা বারান্দায় বসে খবরের কাগজ পড়েন। তবে ইন্দিরার ফোন তিনি যে ধরবেন না তা ইন্দিরা জানে। অপরেশ এবং ইন্দিরা দুজনেই অপেক্ষা করেন কখন ধীরেশ এসে ফোন তুলবেন। যথাসময়ে ধীরেশের গলা শোনা যায়,

“ঘরটা কেমন? আলো আসে?”

“আলো আসে”

“খেয়েছিস কিছু রাতে?”

“হ্যাঁ, তোমরা?”

“হ্যাঁ, জয়তীও আজকাল খাওয়া দাওয়া শুরু করেছে আবার, তোর দাদা আজকে দুপুরে দরজা খুলে দিয়েছে ঘরের”

“যাক”, ইন্দিরা বোঝে আস্তে আস্তে সবাই ইন্দিরার না থাকার সাথে মানিয়ে নিতে শুরু করেছে।

“একটা কথা বলবো?”

ইন্দিরা বোঝে জ্যেঠু কি বলতে চান, “পারবো না জ্যেঠু, তুমি বোলো না আমায়”

“একবার কথা বলে তো দেখ”

“কথা বলে মেটাবার মত সমস্যা নয় এটা। আসলে, এটা কোনো সমস্যাই নয়। আমরা আমাদের জায়গায় ঠিক আছি, কারোর কাউকে জাস্টিফাই করার প্রয়োজন নেই।”

“নিজেদের জায়গায় ঠিক হয়ে, স্থির হয়ে যদি থেকে যাস, এই দূরত্ব তো মিটবে না কোনোদিন!”

“কিছু কিছু সম্পর্ককে দূরত্বই টিকিয়ে রাখে, কাছাকাছি এসে পড়লে দুতরফকেই জ্বলে পুরে ছাড়খার হয়ে যেতে হয়।”

ধীরেশ ওপারে চুপ করে থাকেন।

ইন্দিরাও চুপ করে দুপুরবেলার ফোনটার কথা ভাবতে থাকে, রঞ্জনা… প্রায় মাস দেড়েক পরে ফোন করেছিল।

এমনই অপ্রাসঙ্গিক ভাবে ফোনটা এসেছিল যে ইন্দিরা টানা আধ মিনিট ফোনের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল চুপচাপ। ফোন কেটে গিয়েছিল। ইন্দিরা জানে রঞ্জনা আর ফোন করবে না। আবার এমনও হতে পারে… ভুল করেই হয়তো ফোনটা চলে এসেছিল। ইন্দিরা ফোন রিসিভ করেনি, তাই জানা হবে না কি কারণে রঞ্জনা মজুমদারের তাকে মনে পড়েছিল।

“তোর রুমমেট এসেছে?”

ধীরেশের প্রশ্নে বাঁ পায়ের দিকে চোখ চলে যায় ইন্দিরা, সাদা গজ বাঁধা পায়ের পাতায় চোখ রেখে ইন্দিরা বলে, “হ্যাঁ, মনে হয় বিকেলে এসেছে”

“কেমন?”

ব্যথার মত… বলতে গিয়েও সে সামলে নেয় নিজেকে, কেন একথা মনে হল বোঝে না, ইন্দিরা বলে, “এখনই বুঝতে পারব না, কদিন যাক…”

“তা ঠিক”

 

ধীরেশ ফোন ছেড়ে দিলে নিজের পায়ে উঠে দাঁড়ায় ইন্দিরা। বাড়ির কাছেই ওষুধের দোকান থাকায় ব্যান্ড এইড খুঁজতে অসুবিধা হয়নি তার। বাঁ পায়ে কম ভর ফেলে হলঘরে আসতে সে দেখে মেঝে পরিষ্কার হয়ে গেছে। চুল বা ভাঙা পোর্সেলিন কিছুই পড়ে নেই মাটিতে। বরং রান্না ঘরে সেজে উঠেছে বাসনপত্র। একবার উঁকি দিয়ে ইন্দিরা দেখতে পায় কাপ প্লেট কড়াই হাতায় রান্নাঘরটা জ্যান্ত হয়ে উঠেছে। ইন্দিরা আস্তে আস্তে বারান্দায় চলে আসে। চাপা অশান্তির মত ঠান্ডা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে বারান্দায়। রেলিং-এ দাঁড়ালে সামনের হাইরাইজে লেগে থাকা শিশুটির উপর চোখ পড়ে। ইন্দিরা গুনগুন করে গেয়ে ওঠে, “আওগে জব তুম সাজনা…”

“তোমার গলাটা সুন্দর”

চমকে উঠে ইন্দিরা দেখে তিনতলা থেকে চারতলায় উঠে যাওয়ার সিঁড়িতে ভাঙা মোবাইল হাতে বসে আছে আনন্দী।

“হাই”, অপ্রস্তুত গলায় বলে ইন্দিরা।

“বিরক্ত করলাম?”

মাথা নাড়িয়ে ইন্দিরা না বলে। তার চোখে হাল্কা হতাশা ফুটে উঠেই মিলিয়ে যায়। বারান্দার ভাগ বাটোয়ারা তার কখনই পছন্দ নয়।

আনন্দী বলে, “সরি”

“কেন?”

আনন্দী ইন্দিরার পায়ের ব্যান্ডেজ উদ্দেশ্য করে বলে “আমি কদিন হল একটু ডিস্টার্বড আছি। তুমি যে ঘরে ছিলে খেয়াল ছিল না।”

ইন্দিরার চোখ চলে যায় আনন্দীর চুলের দিকে, সদ্য কেটে ফেলা কাঁধ ছাপানো চুলে কোনো অসঙ্গতি চোখে পড়ে না।

“ব্যথা আছে?”

চমকে ওঠে ইন্দিরা। তার পরেই বোঝে আনন্দী তার পায়ের প্রসঙ্গে প্রশ্নটা করেছে, “খানিকটা”।

“এসো, স্যান্ড্যুইচ বানিয়েছি, খেয়ে যাও”, কেমন যেন আদেশ করার সুরে বলে আনন্দী, না বলতে চেয়েও পারে না ইন্দিরা।

একটু দূরত্ব রেখে সিঁড়িতে বসে সে আনন্দীর দেওয়া স্যান্ড্যুইচে কামড় বসায়।

“তুমি তো বাঙালি, তাই না?”

“কি করে জানলে?” অবাক হয় ইন্দিরা।

“দেখেই বোঝা যায়, বাড়িতে কে কে আছে?”

একটু অতিরিক্ত কৌতূহল, নয় কি? ইন্দিরা বলে, “জ্যেঠু, জ্যেঠি, দাদা আর বাবা”

“মা, মা নেই?”

কি বলা উচিত বুঝে ওঠার আগেই ইন্দিরার মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়, “আছে।”

আনন্দী কি যেন ভেবে আর কিছু জিজ্ঞেস করে না তাকে।

ইন্দিরা বোঝে না, মা আছে কি না জিজ্ঞেস করাতে কেন সে হ্যাঁ বলল। মায়ের না থাকাটাকে কি সে অপূর্ণতা বলে মনে করে, অপরিচিত কারোর কাছে নিজের অসম্পুর্ণতা যাতে ধরা না পড়ে যায়, তাই কি ইন্দিরা মিথ্যেটা বলে ফেলল? অপরাধবোধ হয় ইন্দিরার। মিথ্যে বলা উচিত হয়নি।

নিস্তব্ধতা ভেঙে আনন্দী বলে, “তুমি একটা জিনিস খেয়াল করেছো, ঘরে কোথাও একটাও আয়না নেই! আমি মঞ্জুনাথকে ফোন করে বলেছি কাল একটা আয়না যেন ফিট করে দিয়ে যায় হলঘরে”

“আচ্ছা” আয়নার কি এতই প্রয়োজন আনন্দীর? ইন্দিরা তো আয়না ছাড়াও বেঁচে থাকতে পারে।

“খাবার বানাতে পারো?”

“না”, বলতে বেশ লজ্জা হল ইন্দিরার।

আনন্দী চুপ করে কিছু ভেবে বলল, “কাল থেকে হেল্প কোরো আমায়, বাইরের খাবার আর খেতে হবে না।” বলেই ইন্দিরাকে ফেলে রেখে হঠাৎই উঠে ঘরে চলে গেল সে।

তার আদেশ বারান্দায় হাওয়ার সাথে পাক খেতে থাকল। ইন্দিরা ভাবল পিসি মারা যাওয়ার পর, এরকম অধিকারবোধ একজনই দেখিয়েছে তার প্রতি,- রঞ্জনা। পকেট থেকে ফোন বার করে সে কললিস্টে চোখ বোলায় আরো একবার, রঞ্জনার নাম সেখানে জ্বলজ্বল করছে।

 

চোখ খুলতে ধরফড়িয়ে ওঠে ইন্দিরা, ধাতস্থ হতে বোঝে তার বিছানার পাশে আর কেউ নয়,- রুবাঈ বসে আছে একগাল হাসি নিয়ে। জানালা দিয়ে সকালের রোদ এসে পড়ছে তার কোঁকড়ানো চুলে।

“কখন এলে?” অপরিষ্কার গলায় প্রশ্ন করে ইন্দিরা।

“মিনিট দশেক”, হাসিমুখে বলে রুবাঈ।

“দরজা কে খুলে দিল তোমায়?”

“কেন, আনন্দী!”

“ও চেনে তোমায়?”

“হ্যাঁ, নামও জানে দেখলাম” রুবাঈয়ের ঠোঁটে হাসি দীর্ঘায়িত হয়।

বিছানা ছেড়ে উঠে গায়ে একটা পাতলা জ্যাকেট চাপায় ইন্দিরা।

“না বলে এলাম বলে রাগ করলে?”

বলে কয়ে তো কেউ আসেনি আজ অবধি, ইন্দিরা হেসে বলে, “না, তুমি বসো আমি দেখি কিছু খাবার আছে কি না”

হলঘরে এসে ইন্দিরা দেখে আনন্দীর ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। ব্রাশ করতে বেসিনের সামনে এসে দাঁড়ায় সে। ব্রাশদানীতে তার নিজের টুথব্রাশের পাশে হালকা বেগুনী রঙের একটা ব্রাশ জ্বলজ্বল করছে। হঠাৎই মন ভালো হয়ে যায় ইন্দিরার। ফ্রেস হয়ে রান্নাঘরে এসে সে দেখে তার জন্য এক কাপ কফি আর দুটো বিস্কুট রাখা গ্যাস ওভেনের পাশে। যেন পিঠে শীতের রোদ এসে পড়ল, রান্নাঘরে এক মুহূর্ত চোখ বুজে দাঁড়ায় ইন্দিরা, পিসি চলে যাওয়ার পর এমন যত্ন করে শেষ কবে ব্রেক ফার্স্ট তাকে দেওয়া হয়েছিল, মনে পড়ে না।

ঘরে ফিরে ইন্দিরা রুবাঈকে কফি কাপ ধরিয়ে দিয়ে নিজে বিস্কুট নিয়ে বসে।

রুবাঈ ইন্দিরার দিকে তাকিয়ে হাসে,

“হাসছ কেন?”

“তোমার ভিতরের আনন্দটা আমার মধ্যে চলে আসছে, এত খুশি কিসের?”

উত্তরে ইন্দিরা হাসে, কোনো জবাব দেয় না।

কফি খাওয়া শেষ হলে রুবাঈ বলে, “ছাদ দেখেছো?”

ইন্দিরা জানায় দেখা হয়নি এখনও।

“সে কি, আমি তো কোথাও গেলে সবার আগে ছাদ দেখি, বাড়ির ছাদ দেখলে বাড়ির মানুষ কেমন হবে টের পাওয়া যায়,”

“কিভাবে?”

“ধরো ন্যাড়া ছাদ, শ্যাওলা ধরা, সেই ছাদে যে মানুষ আসে সে একলা উদাসীন, তার পাশে চুপ করে বসে থাকতে হয়, আবার ঢালাই করা ফুল গাছে সুসজ্জিত ছাদ যদি হয়, সে ছাদের মানুষ সংযত, এদের সাথে মনের কথা বলা যায় না।- বোঝাতে পারলাম?”

ইন্দিরা হেসে বলে, “চলো,”

 

ছাদটা ন্যাড়া নয়, আবার ঢালাই করা ফুল গাছে সুসজ্জিতও নয়। সাদামাটা। কিছু সোলার সেল রাখা আছে একদিকে। তার পাশে কাপড় মেলার দড়ি। একদিকে জলের পাইপ আর কল। আরেকদিকে একটা লোহার সিঁড়ি সোজা উঠে গেছে আরো উপরে।

সেই সিঁড়ি বেয়ে আরো উপরের ছোট ছাদে উঠে যায় রুবাঈ, তার পিছু পিছু পায়ের ব্যান্ডেজ সামলে ইন্দিরাও উঠে আসে।

এবং উঠে এসেই স্থির হয়ে যায় সে। তার চোখে যা ধরা পড়ছে তা শুধুই আকাশ, ফাঁকা নীল, ঘন নীল। তাতে পাখি নেই কোনো, কিন্তু তীব্র হাওয়া আছে। চোখ অনেকটা নীচে নিয়ে এলে নানা রঙের বাড়ির স্তবক পরপর জেগে উঠছে। আর তার ফাঁক গলে চলে গেছে রাস্তা, অলি, গলি। রাস্তায় কুকুর, গরু, মানুষ, সাইকেল, বাইক, ছোট গাড়ি দেখা দিয়েই যে যার নিজের দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে।

একটু দূরে রেলিং ঘেঁষে বসে পড়ে রুবাঈ, সামনের আকাশের দিকে মুখ করে চোখ বোজে।

“চোখ বুজলে যে? ছাদটা ভালো লাগেনি?”

মুখ না ফিরিয়ে রুবাঈ বলে, “আকাশ দেখছি।”

 

এক সময় আকাশ দেখতে দেখতে রুবাঈয়ের পাশে বসে পড়ে ইন্দিরা।

“কাল একটা অন্যায় করেছি আমি”

“কি অন্যায়?” আকাশের দিকে মুখ তুলে চোখ বোজা অবস্থাতেই রুবাঈ জানতে চায়।

“আনন্দী কাল জানতে চেয়েছিল বাড়িতে কে কে আছে, মা যে নেই তা বলিনি ওকে, মিথ্যে বলেছি, বলেছি মা আছে”

“কেন বললে?”, রুবাঈয়ের চোখ তখনও বন্ধ।

“হয়তো নিজের অসম্পূর্নতা ঢাকার জন্য, কেউ মায়ের ব্যাপারটা জেনে যাক তা বোধ হয় আমি চাই না।”

“কেউ, না কি খালি আনন্দী…”, রুবাঈ ইন্দিরার দিকে তাকায়।

“মানে?”

“আমার কাছে তো লুকিয়ে যাও নি, তবে আনন্দীর কাছে লোকালে কেন?”

ইন্দিরা বোঝে না কি জবাব দেবে।

রুবাঈ হাসিমুখে আবার আকাশের দিকে ফিরে চোখ বোজে।

ইন্দিরার কাছে কোনো যুক্তি নেই বুঝে রুবাঈ বলে, “কেন তুমি প্রথম দিন থেকে আনন্দীকে লক্ষ্য করো ইন্দিরা? কেন ওর ফোন সেদিন অতো লোক থাকতে তোমার পায়ের কাছেই এসে পড়ল? কেন এত জায়গা থাকতে ও তোমার কাছাকাছি কোনো হোটেলে উঠেছিল? আবার গতকাল তোমার ফ্ল্যাটমেট হিসেবে আনন্দীই এলো কেন? কেন আজ তুমি খুশি? বোঝো না? কোনো কিছুই কারণ ছাড়া হয় না এই পৃথিবীতে, তোমার ক্লাস সেভেনের ভৌত বিজ্ঞান বইয়ের প্রথম লাইনটা মনে আছে? ‘সব কিছুরই কারণ থাকে, কারণ ছাড়া কোনো কার্য এই পৃথিবীতে হয় না’, there is always something rather than nothing ইন্দিরা”

ইন্দিরা অবাক হয়ে রুবাঈয়ের মুখের দিকে তাকায়। চোখ বুজে সে তখনও আকাশ দেখছে।

“এই ছাদ তোমার মত”, বুক ভরা হাওয়ার মাঝে বসে রুবাঈ বলে।

“মানে?”

“যে কেউ উঠে এলে দেখতে পাবে কিছু সোলার সেল, ভিজে কাপড় মেলার দড়ি, এটা সেটা। কিন্তু আরেকটু উপরে উঠে এলেই…”

“উপরে উঠে এলেই?”, ইন্দিরার চোখে পড়ে নীচে রাস্তায় আনন্দী হাতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে ফিরছে।

“আকাশ দেখা যায়।”, রুবাঈ চোখ খোলে, “আনন্দীর সাথে ওটা কে?”

ইন্দিরা খেয়াল করে আনন্দীর সাথে তাদেরই বয়সী একটা ছেলে আরো কিছু বাজারের ব্যাগ হাতে হেঁটে আসছে। তারা দুজনে কথা বলতে বলতে একসময় তাদের অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে গিয়ে রুবাঈ আর ইন্দিরার চোখের আড়ালে চলে যায়।

“আমার মনে হয় এবার আমাদের নেমে যাওয়া উচিত”, রুবাঈ উঠে দাঁড়ায়।

 

“ঘরোয়া নিরামিষ তেহ্‌রি তৈরির প্রক্রিয়া,

ব্যাগ থেকে একটা মাঝারি পেঁয়াজ নিয়ে এসো, একটা টমেটো… রান্নায় টমেটো খাও তো? তিনটে কাঁচালঙ্কা, ফুলকপি, দুটো মাঝারি আলু আর… সোয়াবিন… আনা হয়নি। ঠিক আছে ব্যাস এই নিয়ে এসো… এনেছো? ঠিক আছে। টমেটো চার টুকরো, আর ফুলকপি, আর একটা কি যেন, ও হ্যাঁ, আলু মাঝারি করে কেটে ফেলো, পেঁয়াজ, লঙ্কা আর রসুন আমি কাটছি, আচ্ছা, তুমি এত কম কথা বলো কেন?”

রান্নার রেসিপি মুখের সামনে থেকে সরিয়ে আনন্দী জিজ্ঞেস করে ইন্দিরাকে।

আলু পেঁয়াজ টমেটো কপি হাতে কিছু বুঝে ওঠার আগেই ইন্দিরার মুখ থেকে বেরিয়ে যায়, “আমি হিন্দিতে স্বচ্ছন্দ্য নই ঠিক… তাই বলতে অসুবিধা হয়”, আবার একটা অর্ধসত্য, কেন বার বার নিজেকে আড়াল করছে ইন্দিরা আনন্দীর থেকে? নিজের উপর বিরক্ত হয় ইন্দিরা।

“আচ্ছা, এবার অভ্যাস হয়ে যাবে”, বলে আনন্দী।

ধক্‌ করে ওঠে ইন্দিরার বুক, অভ্যাস!…

আড়চোখে আনন্দীর দিকে তাকিয়ে ফুলকপিটা হাতে তুলে নেয় ইন্দিরা। নির্মম ভাবে তার ফুলগুলো একটা একটা করে কেটে ফেলতে ফেলতে ইন্দিরা ভাবে আনন্দীর কথা। পশ্চিমভারতীয় কোনো এক পরিবার থেকে আসা মেয়েটা তার পাশে দাঁড়িয়ে পেঁয়াজের খোসা ছাড়িয়ে চলেছে, আর নিজের মনে কথা বলে চলেছে, নিজের মনে বলছে কি? না, ইন্দিরাকেই বলছে, কিন্তু ইন্দিরা শুনছে না, ইন্দিরা আড়চোখে তার দাঁতের গড়ন দেখছে, ঝকঝকে পাশাপাশি সেজে বসে থাকা দাঁতের সারি। ইন্দিরা এত সুন্দর সাজানো দাঁত আগে কারোর দেখেনি, অস্বস্তি হয় তার। বেশি সাজানো, বেশি ঝকঝকে কিছুর সামনে এসে পড়লে তার অস্বস্তি হয়। ইন্দিরা চোখ সরিয়ে নেয় ফুলকপির দিকে, কেটে ফেলা ফুলগুলো রান্নাঘরের স্ল্যাবে ছড়িয়ে আছে।

“আরে, এত বড় করে কাটছো কেন!” আনন্দী হাসতে শুরু করে, “এত বড় করে কেউ কপি কাটে!”

ইন্দিরার বলা হয় না বাঙালী রান্নায় গড়পড়তা ফুলকপির আকার কেমন হয়, বলা হয় না আজীবন সে এই ভাবেই কপি খেয়ে এসেছে, বলা হয় না, ছোট করে কাটা ফুলকপি আলু পেঁয়াজে ভাজা ছাড়া অন্য রান্নায় ব্যবহার করা হয় না কোনো বাঙালী বাড়িতে। ইন্দিরা স্থির হয়ে যায়।

স্তব্ধ হয়ে ইন্দিরা দেখে,- আনন্দী হাসছে।

ইন্দিরা ভুলে যায় গত আট মাস কুড়ি দিন তার জীবনে কি কি হয়েছে, ইন্দিরা ভুলে যায় ছেলেবেলায় মায়ের চলে যাওয়া, ইন্দিরা ভুলে যায় দাদার অসুস্থতার কথা, ইন্দিরা ভুলে যায় শেষশয্যায় পিসি কি বলেছিলেন তাকে, ইন্দিরা ভুলে যায় বাবার সাথে তার দ্বন্দ্বের কথা।

কানে কোনো আওয়াজ আসছে না তার, নিজের উপর যেন কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই আর, ইন্দিরার মনে হয় আজীবন তাকে এইভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। তার কি কোনো অসুখ হল? অসুখ হলেই কি এত সুন্দর কিছুর সামনে মানুষ স্থির হয়ে যায়? শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে? ইন্দিরার মাথা কাজ করে না।
ইন্দিরা রুদ্ধশ্বাসে আনন্দীকে হেসে যেতে দেখে।


চলবে



প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব, তৃতীয় পর্ব

শেয়ার