কূটালাপ ১১ ।। ফয়সাল আদনানের সঙ্গে আড্ডা

দ্বিতীয় দশকের নির্বাচিত কবিদের সঙ্গে কূটালাপের ১১-তম আলাপ এটি। গত নভেম্বরে দেয়া এই আড্ডার মধ্যমণি ছিলেন ফয়সাল আদনান। ১৩ জন কবির সঙ্গে আড্ডার বই ‘কূটালাপ’ ইতোমধ্যেই প্রকাশিত; প্রকাশ করেছে ঐতিহ্য। ফয়সাল আদনানের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছেন রুহুল মাহফুজ জয়, ইলিয়াস কমল, মারুফ আদনান, রাজীব দত্ত, হাসান রোবায়েত ও মোস্তফা হামেদী। পাঠক, এই আড্ডায় আপনাদেরও স্বাগত জানাই।


কোন মতবাদকে প্রিচ করে, পূজা করে সাহিত্য হলে আমার এলার্জি লাগে রীতিমত।


রুহুল মাহফুজ জয়: ফয়সাল, কেমন আছো মেইট?
ফয়সাল: এই তো জয়, চলে যাচ্ছে, বেঁচে আছি।
জয়: বাঁচাটা কেমন, কবি মানুষের বাঁচা? যদিও কবিদের অনেকেই নিজেদের মানুষ-টানুষ মনে করে না।
ফয়সাল: নাহ্, নরমাল, আমার কাছে কবি কোন আলাদা ব্যাপার না আসলে, মানুষই, কবিতা লেখে আরকি। তো আমার বাঁচাটা মানুষের বাঁচাই। স্ট্রাগলিং অ্যান্ড সার্ভাইভিং আর দশজনের মতই।
জয়: ঢাকা-চিটাগং-ঢাকা করতেছ। বিয়া করছ সম্প্রতি। লাইফের এই অবস্থায় কবিতা তোমারে কি কইতেছে, কিরূপ আচরণ করিতেছে তোমার সাথে?
ফয়সাল: হ্যাঁ, ২০১৭ একটা হ্যাপেনিং ইয়ার আমার জন্য। দু’দফা চাকরি বদল, বিয়ে, শহর বদল, আবার বদল, প্রথম কবিতার বই সব মিলায়ে হুলস্থুলের মধ্য দিয়েই যাচ্ছে। লেখালেখি বেশ কম এখন, আমার লেখার জন্য একটা মানসিক স্থিরতার প্রয়োজন পড়ে, সেরকমটা নেই বলেই হয়তো।
জয়: চতুর্থ সেলাইয়ের নিচে, তোমার প্রথম বই। বইটা নিয়া তুমি নিজে যদি সমালোচনা করো, কি কি নিয়া করবা?
ফয়সাল: দু-চারটা কবিতা হয়তো আছে না দিলেও চলত, বইয়ের বাকি কবিতার স্ট্যান্ডার্ডে, এর বাইরে তেমন কোন সমালোচনা করি না বইটার আমি। কাব্যরুচি তো পাল্টায়, ভবিষ্যতে হয়তো কখনও এই ধরনের কবিতা থেকে নতুনতর কিছু আমার ভালো লাগবে, তখন হয়তো আরো সমালোচনা করা যাইতে পারে। আপাতত দিজ ইজ দ্য বেস্ট আই কুড, হ্যাপি উইথ দ্যাট।
জয়: তোমার বইটা নিয়া পাওয়া সেরা কমপ্লিমেন্ট কোনটা মনে হয় তোমার?
ফয়সাল: আমার কয়েকজন খুব প্রিয় কবি আছেন, তারা প্রিয় মানুষও। তারা তাদের ভালো লাগাটা জানিয়েছেন। এটা বেশ বড় পাওয়া আমার কাছে।
জয়: সেই ভাল লাগার মধ্যে নিদির্ষ্ট একটা মন্তব্য জানতে চাই।
ফয়সাল: বলতে চাচ্ছি না আসলে, কমপ্লিমেন্ট ব্যাপারটা খুব ব্যক্তিগত, সমালোচনা হতো যদি প্রকাশ্য কোন, তাহলে হয়তো বলতাম।
জয়: আল ইমরান সিদ্দিকী ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিছিলেন, তোমার বইটা প্রত্যাশার বাইরে গিয়ে ভালো হইছে। এইটা নিয়া কি বলবা?
ফয়সাল: ওর ভালো লেগেছে, যে কারো ভালো লাগাই ভালো লাগে, এটাও ভালো লেগেছে। ওর কথাটায় একটা মৃদু ইঙ্গিত ছিলো আমার মনে হয়েছিলো, তাতে আবার খারাপও লেগেছিলো, তুমি জানো সেটা। সে সেটা বুঝতে পেরেছিলো আমার ধারণা, সো সেটুকু আমি এখন ইগনোর করতে চাই।
ইলিয়াস কমল: এই সময়ে যাদের কবিতার বই বের হইছে বা যাদের বের হবে, তাদের মধ্যে চতুর্থ সেলাইয়ের নিচে কতটুকু ভূমিকা রাখবে?
ফয়সাল: এইটা আমার জন্য বলাটা হয়তো কার্টেসির বাইরে পড়বে, নিজের বইকে এইভাবে মূল্যায়ন করা তো কঠিনই। তারপরেও প্রশ্ন আসছে বলে উত্তরটা দিচ্ছি, খুবই হাইপোথেটিক্যাল ধারণা হিসেবে, আমার কাছে কোন এভিডেন্স নাই হেতু… ভূমিকা কতটা রাখবে সেটা সময় বলবে। আমার কাছে মনে হয়েছে রাজনৈতিক কবিতা, প্রেমের কবিতা এমন কিছু বীভৎস ট্যাগিং বাংলা কবিতায় আছে যেগুলো অর্থহীন। আমার বইয়ের মনযোগী পাঠক জানার কথা, আমি এই বাউন্ডারিগুলো ভাঙার চেষ্টা করেছি। 
জয়: আচ্ছা, তোমার কাছে কবিতা ব্যাপারটা কী? ফিলসফিক্যাল অবস্থানটাই বা কী?
ফয়সাল: ফিলসফিক্যালি বললে, আমি একটু ভাবতে পছন্দ করি, পড়তেও। যেমন ধরো আমি এখন পড়ছি ইউভাল নোয়াহ হারারির হোমো ডিউস। এই বইটায় সে মানব সভ্যতার ভবিষ্যত এজেন্ডা কি হবে তা নিয়ে কথা বলছে। সে বলছে কিভাবে টেকনোলজি হিউম্যান লেবারকে রিপ্লেস করছে, কিভাবে কম্যুনিকেশন টেকনোলজির উন্নতি আমাদের প্রগতির গতি বাড়িয়ে দিচ্ছে। আগের শতকে কিভাবে আমরা ওয়ার, ফেমিন আর প্লেগের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হয়ে অমরত্বের দিকে আগাচ্ছি। ক্রাইসিসটা কেমন হবে তখন ইত্যাদি। সে আরেকটা মজার জিনিস বললোআধুনিক মানুষের এই যে সমস্যা, ওয়ার্ক লাইফ ব্যালান্স বলো, STEM সেক্টরের কোন একটায় অভিজ্ঞতা না থাকলে যে আজকের পড়াশোনা কম জানা মানুষের মতো পরিণতি সামনে, বা আশি বছরেও কর্মক্ষম থাকা মানুষ কিভাবে ইউথ এমপ্লয়মেন্ট কমিয়ে দিচ্ছে, এসব প্রশ্নের উত্তর কোন রেলিজিয়াস বইয়ে নাই। এগুলো আমাকে অনেক ভাবায়। আমি ভাবি যে চ্যাটবক্সে কথা বলতে বলতে আমরা কিভাবে ক্রমে দূরে সরে যাচ্ছি। কিভাবে সাতশ ফিট নিচে গর্তে একটা শিশু পড়ে যাচ্ছে, উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে। এইগুলা আমাকে ফুল-পাখি-লতা-পাতার চেয়ে অনেক বেশি এফেক্ট করে। আর এই কথাগুলো আমি একটা ভবিষ্যতের জায়গা থেকে ভাবতে চাই, বলতে চাই, অনেকটা ফিকশনের মাঝ থেকে রিয়ালিটি দেখতে চাওয়ার ইচ্ছা, সেটা আমি কবিতা দিয়ে করতে চাই। আরেকটা ব্যাপার একটু আগে কমলের প্রশ্নের উত্তরে বলতেছিলাম। ধরো পলিটিক্স, সোশলজি, ইকোনমিক্স কিংবা লিটারেচার কোনটাই বাউন্ডারি দিয়ে ঘেরা না, এগুলা ক্রসকাটিং। আমি এই হোলিস্টিক জায়গা থেকে দেখতে চাই। এই ফেব্রিকটা ধরতে চাই। আমার এই তাড়না ট্রান্সলেট করার জন্য এমন একটা মাধ্যম দরকার ছিলো যে একইসাথে বহু পথের প্রতিনিধত্ব করে, বা বিবিধ অর্থবহতা একই উৎস থেকে পাঠায়, আমার কাছে এর জন্য কবিতার কোন বিকল্প ছিলো না।
জয়: তোমার কবিতা এ কারণেই কী রাজনীতি সচেতন?
ফয়সাল: কোন কারণে?
জয়: হোলিস্টিক জায়গাগুলা
ফয়সাল: আমার কবিতা রাজনীতি সচেতন বললে তো তার অন্যান্য কনশাস আইডেন্টিটিকে অগ্রাহ্য করা হবে। সো ওই হোলিস্টিকের জায়গাটাই ঠিক বলা যায়।
জয়: তোমার বইয়ে অনেক কবিতাতেই সমকালীন অস্থিরতা, বিগ্রহ এগুলা এসেছে।
ফয়সাল: সমকালীন প্রেক্ষাপট বাট ক্রাইসিসগুলা ক্লাসিক আই গেস।
জয়: এই যে আমাদের দেশের নানা সমস্যা, যেগুলা চিরন্তন এবং চিরন্তনের সাথে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা যোগ হচ্ছে। তা কি তুমি আমাদের সময়ের কবিতায় দেখতে পাও?
ফয়সাল: রেয়ারলি
জয়: কারণটা কি মনে হয়? আমরা কি এসকেপিং চরিত্রের হয়ে যাচ্ছি?
ফয়সাল: আমরা চরিত্রগুণে কম-বেশি সবাই এসকেপিস্ট। রাজনীতি নিয়ে আমাদের কাজ করে হয় ভয়, নইলে প্রলোভন। একে আমরা টুল হিসেবে ব্যবহার করতে ব্যর্থ। আর কবিদের একটা ক্লিশে ফিগার দাঁড়ানো আছে। ময়লা জামা, লম্বা চুল, আকাশের দিকে তাকায়ে হাঁটতে গিয়ে উষ্টা খায়। এই ইমেজের সাথে হয়তো রাজনীতি যায় না তেমন। তবে অনেকেই লিখছেও এই সময়ে। সেখানে আমার কিছু পার্সোনাল অবজার্ভেশন আছে। আমি যেমন ব্যক্তিগতভাবে মার্ক্সবাদী সাহিত্যের বিরুদ্ধে, বা আসলে কোন মতবাদকে প্রিচ করে, পূজা করে সাহিত্য হলে আমার এলার্জি লাগে রীতিমত। ঐটাও আমি চাই না আসলে। আমি সাহিত্যিককে অনেস্ট হইতে বলি না বাট সাহিত্যকে অনেস্ট দেখতে চাই। কোন রাজনৈতিক মতবাদের দাসত্ব করে তেমনটা করা যায় কিনা আমি নিশ্চিত না
জয়: তোমার কি কবিতা নাজেল হয় নাকি বানাও?
ফয়সাল: হাহা আমি তো কোন ধর্মগ্রন্থও নাজিল হইছে বলে ভাবি না।
জয়: তোমার কবিতা লেখার প্রক্রিয়া সম্বন্ধে জানতে চাই।
ফয়সাল: দ্যাখো, আমার কবিতা লিখতে অনেক সময় লাগে। মানে আমি একটা কারেক্ট স্পার্ক না আসলে লিখতে পারি না এখন আর। এইটাকে আমি নাজিল হওয়া বলি না। বরং আমার বিভিন্ন অভিজ্ঞতা, রিডিং, লার্নিং, সব মিলায়ে নিজের ভেতরে ক্রমশ যে একটা বিক্রিয়া চলতেছে আমার। মনে হয় সেইটা একসময় একটা পরিণতি চায়। তখন আমি লিখি, মানে টাইপ করি, মোবাইলে বা ল্যাপটপে। এরপর সেটাকে কিছুটা শেপে আনতে হয়, ছুরি-কাচি চালাইতে হয়, এই আরকি, নাথিং স্পেশাল।
কমল: কবির তো কোনও আইডলজি থাকতেই পারে। কবি নিজে যেহেতু মানুষ। সেখানে কেউ মার্ক্সবাদ বা কেউ পুঁজিবাদি রাষ্ট্রের প্রতি কেউ ইসলামি ভাবধারায়ও আগ্রহী হইতে পারে। এইখানে মার্ক্সবাদী সাহিত্যের প্রতি বিরাগটা কেনো?
ফয়সাল: আমার মার্ক্সবাদের প্রতি বিরাগ নাই, ইসলামি ভাবধারায় বা পুঁজিবাদে সংশ্লিষ্ট হবার ব্যক্তিগত অধিকারও সকলের আছে। সেখানে সমস্যা না। সমস্যা হয় যখন সাহিত্য এই আইডিওলজিকে সার্ভ করতে চায়। তখন সাহিত্য তার অনেস্টি হারায় আমার মতে। যে কারণে কাশেম বিন আবু বাকারকে আমি সাহিত্যিক মানতে পারি না। আল মাহমুদের কবিতা কেন আমার ভালো লাগে নাই, বা শামসুর রাহমানেরও— সেইটার ব্যখ্যা দাঁড় করাতে যেয়ে আমার এই হাইপোথিসিসটা এসেছে। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, আমি আল মাহমুদ কিংবা শামসুর রাহমানের সব কবিতাকে একত্রে খারিজ করি নাই। আর অবশ্যই এ সমস্ত আমার ইন্ডিভিজুয়াল স্ট্যান্ড। কারো তো কাশেম বিন আবু বাকারকে সুসাহিত্যিক মনে হতেই পারে। আমি কোন অথরিটি না তার পছন্দকে খারিজ করার।
কমল: বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাস লিখলেও সেখানে ম্যাক্সিম গোর্কির মা উপন্যাসের নাম আসবে। তার এই উপন্যাসকে বলা হয়, তৎকালীন রাশিয়ার দর্পণ। কিন্তু একটু আগে যে কথা বললি, সাহিত্য দিয়া আইডিওলজির পারপাস সার্ভ করা। সে অর্থে তো মা উপন্যাসও পড়ে। এইটারে তাহলে কিভাবে ব্যাখ্যা দিবি?
ফয়সাল: আমি মা উপন্যাসটা এর আগে পড়ছি, খুব সহজ না এই প্রশ্নের স্পেসিফিক উত্তর দেয়া। তাও বলছি.. ভালো সাহিত্য, টিকে যাওয়া সাহিত্য চিরকালই ক্লাসিক ক্রাইসিসকে ডিল করেছে। আমার মাকে জানি আমি, তার সংগ্রামকে জানি আমি, আমি যদি তা নিয়ে লিখি, সেটা গোর্কির মায়ের চেয়ে কম মর্মস্পর্শী হবে না। এই উপন্যাসের উপজীব্য কিন্তু সেখানেই। মার্ক্সের থিওরির ভূমিকা সেখানে কতটা বল? ওয়ার্কিং ক্লাসের স্ট্রাগল তো মার্ক্স আইডেন্টিফাই করার আগেও ছিলো, পরেও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে।কিন্তু সারাদিন যদি শুধু একটা থিওরির ডাইমেনশনে দেখা হয়, তাহলে উত্তরটাই একমাত্রিক আসে। আর সেই সাহিত্য আমাকে শান্তিও দেয় না।
কমল: তার মানে সাহিত্যে রাজনৈতিক চিন্তা বা দর্শন আসবে। সেটা ইচ্ছাকৃত হইলেও যদি তা সর্বজনীন হয় সেইটা কি গ্রহণযোগ্য?
ফয়সাল: আমার মনে হয়, সাহিত্য বরং চিন্তা বা দর্শনকে লিড করা উচিৎ, ফলো করার থেকে। আমি কি ভাবছি, দেখছি, বুঝছি, জানছি তা মার্ক্সের চেয়ে, লেনিনের চেয়ে, ট্রাম্পের চেয়ে অনেক ভালো জানি আর বুঝি। আমি সবকিছুকে নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে প্রশ্ন করতে চাই। সে যতই প্রুভেন, ফলোড বা ভাইরাল হোক না কেন। সার্বজনীনতা গ্রহণযোগ্যতার কোন শর্ত না আমার কাছে। আই ওয়ান্ট টু লিবারেট মাইসেল্ফ, লিভ এ ট্রু লিবারেল লাইফ, টু ক্রিয়েট ট্রু লিবারেল পোয়েট্রি। যতক্ষণ তা পারি না, আমি লিখি না।
মারুফ আদনান: সাহিত্যে আঞ্চিলিকতার ব্যাপারটাকে কীভাবে দেখন?
ফয়সাল: আঞ্চলিকতা ব্যাপারটা একটু ডিফাইন করবেন?


হাসনাত আব্দুল হাই শাহবাগ পরবর্তী সময়ে একটা গল্প লিখলেন, যেটাতে উনি লাকী আক্তারকে পোর্ট্রে করতে চাইলেন দেহপসারিনী, মদখোর, গাঁজাখোর হিসেবে। আমার এই তিন বিশেষণের কোনটাতে আপত্তি নেই যদিও, কিন্তু এই ট্যাগিং ডিজঅনেস্ট ছিলো। একটা বৃহত্তর আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য প্রপাগান্ডা মেশিনের প্রডাকশান ছিল এই গল্প। এই ডিজঅনেস্ট গল্পের সাহিত্যমূল্য কি?


মারুফ: গত আলাপটায় যে ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ হচ্ছিলো— ইউরোপ, আমরা এসব কিংবা দুই বাংলা। ফারাহ্ বলছিলেন ইউরোপ থেকে আমাদের আলাদা যে আইডিওলজি তার কথা। শোয়েব বলছিলেন আজকের এই দিনে আলাদা থাকা বা হওয়ার প্রশ্নটা কতোটা যৌক্তিক বা আদৌ দরকার আছে কিনা। এ প্রেক্ষিতে দুই বাংলার আলাদা আইডেন্টিটি আর প্রবণতা নিয়ে আপনার মন্তব্য জানতে চাইছি। অনলি কবিতা নিয়ে আর কি।
ফয়সাল: শুধু কবিতার জন্য আলাদা করা ঠিক না, আমি আগেও বলেছি, আমি এদের ইন্টারটোয়াইন্ড হিসেবে দেখি। সেদিক থেকেই বলি। আমরা ডাইভার্সিটিকে যত রেস্পেক্টই করি না কেন, ধীরে কিন্তু গ্লোবালাইজড হচ্ছেই সব। এই ব্যাপারটা ইনএভিটেবল, তাই এ নিয়ে বেশি ভাবা বোকামি, অপ্রয়োজনীয়। মানুষ বলেন, সমাজ বলেন, সভ্যতাই বলেন, ইভলভ করে, করছে। টিকে থাকার জন্য যে কালচারটা জরুরী সেটাই টিকে থাকবে, এটা বাস্তবতাই। আপনি হেরিটেজের জন্য কাঁদতে পারেন ঠিকই, কিন্তু ঘরে আপনি মাটির সানকি ইউজ না করে কিন্তু আরএফেলের মেলামাইনের প্লেটেই খাচ্ছেন। আবার হেরিটেজ টিকানোর জন্য কাল থেকে যদি মাটির সানকিতে খাওয়া শুরুও করেন, গণরুচিকে তা প্রভাবিত করে না। এভাবে দেখেন, আমরা নিজেদের বা এই বাংলার বলে কাকে ভাবি? ইসলাম, সে তো বারো শতকের আগে ছিলোই না অত্র অঞ্চলে। লালনের গান? সেকি শুধুই পূর্ববাংলার? কলোনিয়াল ফোরফাদারদের লিটারেচার থেকে আমরা ধার করেছি ত্রিশ শতকে, খুব কমন একটা অভিযোগ। কিন্তু এই অভিযোজন তো আমার কাছে খুব স্বাভাবিক লাগে, অভিযোগের কিছুই দেখি না। 
আমি চরম মাত্রায় অ্যান্টি ন্যাশনালিস্ট। কোন একটা জিওগ্রাফিক রিজিওনে জন্ম বলে (বাই দ্য অ্যাক্সিডেন্ট অফ বার্থ) আমি সেই রিজিওনকে ওউন করতে বাধ্য না, তার ভাষার, গানের, সাহিত্যের, কৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিতেও প্রস্তত না। দুই বাংলার আইডেন্টিটি এ মুহূর্তে আলাদা, ইউরোপ আর আমাদের জীবনযাত্রা এক না, তাতে আসলে কি এলো-গেলো? মজার ব্যাপার হলো আমরা সবকিছু পজেজ করতে চাই, প্রেমিক, বৌ, জমি, বাড়ি, গাড়ি, কালচার, আইডিওলজি ইত্যাদি। সবখানেই শ্রেষ্ঠত্ব চাই। এগুলো খুব অর্থহীন আর পেছনের দিকে হাঁটা।
মারুফ: ঠিক। আমিও অ্যান্টি ন্যাশনালিস্টদের পক্ষে নিয়ে ভাবতে চাই। আর এটা অভিযোগ ছিলো না।
ফয়সাল: না না বুঝেছি আমি, কমন পিপলের এক্সপ্রেশনের কথা বলছিলাম আরকি। মানে এই যে ধরেন কম্যুনিস্ট সাহিত্য, পুঁজিবাদী সাহিত্য, ইসলামিক সাহিত্য এরা তো প্রপাগান্ডায় পরিণত হয়। প্রপাগান্ডা আর সাহিত্যের মাঝে দূরত্ব দেখতে চাই।
মারুফ: আচ্ছা। সাহিত্যকে অনেস্ট হতে না বলে অনেস্ট দেখতে চান, কেনো? আরেকটু কি ব্যাখ্যা করা যায়? অনেস্ট দেখতে চাওয়ারও দরকার আছে?
ফয়সাল: আমি আসলে বলতে চেয়েছি সাহিত্যিক অনেস্ট কি অনেস্ট না, তা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নাই। তার ক্রিয়েশান নিয়ে আমি ভাবতে চাই, সেটাকে অনেস্ট হইতে বলি। এখন অনেস্টি একটা বড় ভোলাটাইল বিষয়। একে ডিফাইন করা মুসিবৎ। এই জন্য আমি মোটাদাগে প্রোপাগান্ডা দিয়ে একে আইডেন্টিফাই করতে চাই। আরেকটু বলছি…যেমন ধরেন হাসনাত আব্দুল হাই শাহবাগ পরবর্তী সময়ে একটা গল্প লিখলেন, যেটাতে উনি লাকী আক্তারকে পোর্ট্রে করতে চাইলেন দেহপসারিনী, মদখোর, গাঁজাখোর হিসেবে। আমার এই তিন বিশেষণের কোনটাতে আপত্তি নেই যদিও, কিন্তু এই ট্যাগিং ডিজঅনেস্ট ছিলো। একটা বৃহত্তর আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য প্রপাগান্ডা মেশিনের প্রডাকশান ছিল এই গল্প। এই ডিজঅনেস্ট গল্পের সাহিত্যমূল্য কি?
মারুফ: একই জায়গা থেকে ভাবলে ফরহাদ মজহারসহ অনেকরে খারিজ করার প্রশ্নটা আসে। নাকি?
ফয়সাল: হ্যাঁ, আসতে পারে, তবে আমি খারেজি না, ওনার ভাল কবিতা বা গানকে আমি নিতে চাই, প্রপাগান্ডাকে দূরে রাখতে চাই।
রাজীব দত্ত: শাহবাগের ঘটনার সময় অদিতি ফাল্গুনীর একটা গল্প নিয়েও তর্ক হয়েছিল, এই রকম অনেস্টির দাড়িপাল্লা হাতে? মনে আছে আপনার?
ফয়সাল: ভাসা ভাসা মনে আছে, রাজীব।
রাজীব: অদিতি কিন্তু শাহবাগের পক্ষেরই। কিন্তু তিনিও মাফ পান নাই। অনেস্টির এটাই সমস্যা। আগেই দাড়িপাল্রা হাতে নিয়া রাখে। ফয়সাল কি বলেন? আমি আপনার হাই’র গল্প নিয়ে বলা অনেস্টির প্রশ্নটাতে দ্বিমত করতে চাচ্ছিলাম।
ফয়সাল: শাহবাগের পক্ষ-বিপক্ষ ব্যাপার না রাজীব। দ্যাখেন, আমি অদিতি ফাল্গুনীর লেখাপত্র যা পড়েছি সামান্য উনাকে নিতে পারি নাই। সুপারফিসিয়াল মনে হয়েছে খুব। আমি অদিতির লেখার একটা অংশ এখানে তুলে দিচ্ছি ‘…না, হাঁটুর নিচে সালোয়ার বা সায়া টাইপের কিছু নেই। একটি গোটা জামাই শুধু পরনে। স্তন না অতি ভারী, না অতি শীর্ণ। চুলগুলো একটা আরেকটার ওপর জটা পাকিয়ে। স্নান করেনি কত বছর ? ‘দিবি না সিগারেট ? আমি কইলাম সব শ্লোগান কইতে পারি! ক-তে কাদেও মোল্লা, তুই রাজাকার/ তুই রাজাকার! ন-তে নিজামী, তুই রাজাকার/ তুই রাজাকার! জ্বালো-জ্বালো-আগুন জ্বালো! তোমার আমার ঠিকানা/ পদ্মা মেঘনা-যমুনা…কি রে ভাইয়ারা, পারতাছি না? এইবার দে…এই পাগলিডারে একটা সিগারেট দে।’ শুরুতে তা ছিল বারডেম হাসপাতালের উল্টা দিকে।’ 
দেখেন শাহবাগে এই ক্যারেক্টারগুলো ছিলো, ছিলো লাকী, ছিলাম আমি।
রাজীব: আপনি যেটা কৌট করলেন, অইটার সমস্যাটা ধরতে পারি নাই আমি।
ফয়সাল: এর মাঝ দিয়ে কেউ যখন লাকী বা ইমরানকে হিরো বানায় সেটাই প্রপাগান্ডা, কেউ যখন এটাকে গাঁজার আসর, পতিতাবৃত্তির স্পট বানায় সেটাও প্রপাগান্ডা। আংশিক সত্য আর মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য কি? গল্পের এই ক্যারেক্টারাইজেশনে কি কারো পারপাস সার্ভ হচ্ছে, সার্ভ করার জন্যই কি এই ক্যারেক্টার তৈরি হচ্ছে?
রাজীব: কিন্তু সাহিত্যরে এরকম শাহবাগের পক্ষ-বিপক্ষ দিয়ে দেখা, অনেস্টি দিয়ে মাপা সমস্যার না?
ফয়সাল: অবশ্যই।


আমার কাছে মনে হয় এইসব পুরনো থিওরি অবসলিট হয়ে গেছে। ধর্মগ্রন্থের মতই। এরা কোনটাই আর আধুনিক মানুষের বতর্মান প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম না।


রাজীব: সাহিত্যের সত্য-মিথ্যা কি?
ফয়সাল: পক্ষ-বিপক্ষ ব্যাপার না, বললাম না?
রাজীব: পারপাস সার্ভের বিষয় আসলে পক্ষ-বিপক্ষও আসতেছে তো। ইমরানরে রাজাকার বানাইয়াও, লাকীকে পতিতা বানানোর পরও সাহিত্য হতে পারে। সাহিত্যের সত্যের দায় নাই।
ফয়সাল: পক্ষ-বিপক্ষ ঘটনা না, কোন যুদ্ধে বা বিপ্লবে কে কোন পক্ষে ছিলো সেটা অগুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার হয়ে যায় এক সময়। কিন্তু সাহিত্যের একটা ভূমিকা হয়ে যায় সেই ইভেন্টের প্রতি অনেস্ট থাকার। সাহিত্যিক ফিকশন লিখে, এটা ঠিক। কিন্তু ফিকশন কিন্তু সত্যের বিপরীত না।
রাজীব: আপনি কই দাঁড়াই আছেন, তার উপর নির্ভর করবে আপনার সত্য কেমন, সত্য চেঞ্জ হইলে অনেস্টির মাপকাঠিও চেঞ্জ হয়ে যাবে। সাহিত্যের ধরনও।
ফয়সাল: আপনার কথার সাথে আমি একমত যে সেভাবেও সাহিত্য হতে পারে। যদি সেটা ব্যক্তিপাঠকের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারে। ফর ইন্সট্যান্স, ইমরানের শাহবাগে ভূমিকা কিন্তু প্রশ্নবিদ্ধই, ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী লাকী আক্তারের ফটোশ্যুট টাইপের ছবি প্রথম আলোতে দেখাটাও হাস্যকর ছিলো। এগুলো সবই সত্য। মানুষ সেইন্ট না, ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট কিছু নাই, মোস্টলি তো গ্রে। তাই অনেস্টি আমি যেমন বললাম একটা ভোলাটাইল ব্যাপার, শেষ পর্যন্ত প্রপাগান্ডায় রূপ না নেওয়াই সাহিত্যের সাফল্য হয়তো।
রাজীব: সেটাই। গ্রে পার্টও আছে। স্ট্যান্ডপয়েন্টের উপরও ব্যক্তি-পাঠকের বিশ্বাস দাঁড়ায় থাকে। আর ধরেন আপনার ইজম আসলো আপনার লেখায়, আমি যদি অইটা বিলং না করি তাইলে অইটা আমার কাছে প্রোপাগান্ডা ঠেকবে।
ফয়সাল: এক্স্যাক্টলি। মাস এক্সেপ্টেন্স যে কোন মাপকাঠি না, সেটাও আমি আগে বলেছি মারুফের প্রশ্নের উত্তরে। এবং এ যুগে এসে ইন্ডিভিজুয়ালের রুচিই সব। মুশকিল হলো, এই রুচি কোন অর্গানিক ব্যাপার না। এটা একটা মেকানিক্যালি ম্যানিপুলেটেড ব্যাপার। আমরা কি নেবো কি নেবো না, যদিও আমরা ভাবছি এটা আমাদের ফ্রি উইল, ফ্রি উইল বলে আসলে কিছু নেই।
রাজীব: সবই মেনিপুলেটেড তো। শিশু হিসেবে যখন আমরা পরিবার থেকে শিখতে থাকি, পরে সোসাইটি থেকে আমরা ম্যানিপুলেটেড হইতেই থাকি। এভাবেই আগাই।
ফয়সাল: সেটাই। এর মাঝে ঢুকে পড়ে ফ্রিডমের ইল্যুশন। দিজ ইজ জাস্ট প্লেইন ক্যাওস।
রাজীব: ইল্যুশন জিনিসটা ভালো বলছেন। ফ্রিডম অব চয়েজ বড় খাঁচা থেকে ছোট খাঁচা। বা ছোট খাঁচা থেকে বড় খাঁচা। আলটিমেট খাঁচাই।
ফয়সাল: সেটাই। আমরা নিজেদের খাঁচাবন্দী করতেছি নিজেরাই। এইখানে মার্ক্সের ক্লাস স্ট্রাগল কিছুটা রেলেভেন্ট মানিও আমি।
রাজীব: নিজেরাই? একমত না। খাঁচার বাইরে তো অপশন নাই আদতে।
ফয়সাল: তবে আমার কাছে মনে হয় এইসব পুরনো থিওরি অবসলিট হয়ে গেছে। ধর্মগ্রন্থের মতই। এরা কোনটাই আর আধুনিক মানুষের বতর্মান প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম না। নতুন করে ভাবার দরকার অনেক, নতুনভাবে থিওরাইজ করা জরুরী।
মারুফ: ফ্রিডমের ইল্যুশনের একটা পর্যায় কি বিয়ে?
ফয়সাল: হাহা মারুফ অনেকক্ষণ ধরে বিয়ে নিয়ে ভাবিত। দেখেন রাজীব, খাঁচার ভেতর-বাইর বলে আসলে কিছু নাই কিন্তু, পুরোটাই কেইজ এখানে, সার্কাসমাস্টার হলো প্রতিষ্ঠানগুলো, এগুলো আমাদেরই তৈরি, ধর্ম, সমাজ, বিয়ে এইসব প্রতিষ্ঠান যেমন।
মারুফ: আপনারা ভীষণ কঠিন হয়ে আছেন, তাই মজা করেই বললাম।
রাজীব: যেসব প্রতিষ্ঠান বলতেছেন, তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াইতে গিয়া উল্টা প্রতিষ্ঠান দাঁড়ায় যাচ্ছে। এর ভালো উদাহরণ মার্কসবাদ।
ফয়সাল: দুজনের প্রশ্নের উত্তর একত্রেই দেই। ধরেন বিয়ের যে ব্যাপারটা আমরা গত কয়েক হাজার বছরে ডেভেলপ করলাম, কেন করলাম? ফিউডাল সোসাইটিতে জমির মালিকানা একটা বিশাল ব্যাপার ছিলো, তায় আবার লেখাপড়া খুব কমন ব্যাপার না তখন, কে কার মেয়ে কে কার ছেলে বোঝা না গেলে এই সদ্য পজেশান পাগল সোসাইটি টিকতে পারত না। ফলে এলো মনোগ্যামি, বিয়ে ইত্যাদি। আমি নিশ্চিত হাজার পাঁচেক বছর আগে কন্ডম আবিষ্কার হলে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কোন উপযোগ থাকত না। হাহা।
রাজীব: কন্ডমও সম্পত্তি রক্ষার স্বার্থেই। কম ওয়ারিশ বেশি সম্পত্তি।
ফয়সাল: দেখেন প্রতিষ্ঠানের নর্মই এটা। এর বিরুদ্ধে যে দাঁড়ায় সেও প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে। এই জন্যই আমার কাছে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা গুরুত্বপূর্ণ। যাতে এইটা একটা চলমান প্রক্রিয়া থাকে।
রাজীব: সিসিফাসের মতোন লাগে বিষয়গুলা। যতই পাথর উপরে তোলেন, ভোর রাইতে পাথর গোড়ায় নিয়ে নেমে আসবে।
ফয়সাল: নাহ॥ ঠিক কম ওয়ারিশ অর্থে কনডম জনপ্রিয়তা পায় নাই। ইন্ডাস্ট্রিয়াল এবং পোস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্ল্ডে শিশু একটা লায়াবিলিটি। শুধু নিজের জেনেটিক কোডকে অল্টার করতে পারি না বলেই আমরা শিশু দেখলে বিমোহিত হয়ে যাই। বাবা-মা হইতে চাই। কিন্তু প্রাক শিল্প বিপ্লবের পৃথিবীতে ধীরে ধীরে সন্তানের উপযোগিতা কমছে কিন্তু।
রাজীব: মানুষের শাস্তি হচ্ছে তার জ্ঞান। জ্ঞান এ কারণে, পাথর উপরে তুলতে পারবেন, এ আশাটুকু থাকলে আপনি টায়ার্ড হবেন না। কিন্তু যখন জানবেন, পারবেন না, তারপরও তুলতেই হবে। তখন আপনি ক্লান্ত হবেন। এই যে জানবেন এটার কারণেই আমরা শাস্তি পাবো। আমরা এ জানাটুকু এড়াইতে নানানরকম মতবাদের দ্বারস্থ হচ্ছি।
ফয়সাল: আপনার কথার সাথে আংশিক একমত। কিন্তু আমি মানুষের ক্ষমতা নিয়ে ভীত। আশাবাদী ও ভীত। কারণ আমার ধারণা শেষ পর্যন্ত এই পাথর তারা তুলে ফেলবেই। আমি ভাবি যখন এই ক্রাইসিস থেকে সে মুক্তি পেয়ে যাবে, কি করবে সে? ভবিষ্যতের মানুষ কি নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখবে?
রাজীব: চূড়ায় তো উঠবে বাট পরদিন আবার নিচে নেমে যাবে। যেটা নিয়ে আপনি ভাবতেছেন।
ফয়সাল: হাহা দেখা যাক। আমাদের লাইফটাইমে আমরা মানুষকে ১০০ বছর হরহামেশা আয়ুষ্কাল পেতে দেখবো, ইলন মাস্ক বলছেন অমরত্বই আর বেশি দূর না। এত বছর মানুষ আসলে কি করবে? কি ভয়ঙ্কর!
রাজীব: অমরত্ব আবিষ্কার হইলে অইটা আরেকবার গন্ধম খাওয়ার মতোন ঘটনা হবে।
মারুফ: জানতে না চাইলে বয়স তো ফ্যাক্ট না। কিছুই না জেনে মানুষ হাজার বছর বাঁচতে সমস্যা ছিলো না। ঝামেলাটা জানার পরই শুরু।
ফয়সাল: এ যুগে এসে কিছু না জেনে থাকাটাই কঠিন। জোর করে প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় সব আপানাকে জানিয়ে যাবেই। ক্লাটার্ড করেই ছাড়বে আপনার মগজ।
মারুফ: আচ্ছা, একটা কমন প্রশ্ন। আপনার বইটা আবার করা হলে কিছু কি চেঞ্জ করতে চাইবেন?
ফয়সাল: হয়ত চাইবো, দিস ইজ নট এ হলি বুক, সো চেঞ্জ করা যাবে, এ মুহূর্তে ছোটবড় কিছু টাইপো চেঞ্জ করা ছাড়া অন্যকিছু করার মাথায় আসে না। বইটা তো ভালো হয়েছে হাহা।
মারুফ: সময়ে আমাদের অনেক কিছুই বদলে ফেলতে ইচ্ছা করে, সে ভাবনা থেকেই প্রশ্নটা। সেক্ষেত্রে আপনার বই-এ আপনার পার্সপেক্টিভ থেকে এখনো কোনো প্রভাব পড়েনি?
ফয়সাল: আসলে খুব বেশি সময় তো যায়নি, মাত্রই ক’মাস, ভালোমন্দই বলতে পারি না এখনো বইটা নিয়ে। আরো বছর দুয়েক পরে হয়তো বুঝবো এটাকে আর নিজের বই বলে পরিচয় দেয়া ঠিক হবে কিনা হাহা।
মারুফ: ঠিক বলেছেন।
মারুফ: আপনি বললেন লেখার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার কথা, বিয়ে বা সংসার লেখালেখিতে কেমন প্রভাব ফেলতে পারে বলে মন হচ্ছে? 
ফয়সাল: ঘটনা হলো বিয়ের পরে আমি তেমন একটা লেখালেখি করি নাই। মানসিক স্থিতির একটা অভাব যাচ্ছে পারিবারিক বিবিধ ব্যস্ততার দরুণ। বিবাহিত জীবন আনন্দের এতটুকু বলতে পারি, সব মিলিয়ে খারাপ লাগছে না। আর আমার সহধর্মিণী যেহেতু এ সকল ব্যাপারে আমার মতই সমান সেনসিটিভ কোন অ্যাডিশানাল বা প্রেশারড চেঞ্জের মধ্য দিয়ে আমার যাইতে হয় নাই। আর বই নিয়ে যেমন কিছু বলতে পারলাম না, বিয়ের প্রভাব নিয়েও তেমন কিছু বলতে পারছি না আসলে, টু আর্লি টু সে, দুই-তিন বছর পরে প্রশ্নগুলা আবার করে দেইখেন হাহা।
কমল: আমি এতক্ষণ দেখলাম বিভিন্ন বিষয় নিয়া আলোচনা হইছে। তো কবিতার বৈশ্বিক হয়া যাওয়ার প্রসঙ্গও আসছে। এই ক্ষেত্রে একটা বিষয়, যে কবিতার কি জাতিগত পরিচয় জরুরী না?
ফয়সাল: আমার কাছে জাতিগত পরিচয় ব্যাপারটা মূখ্য না, অজরুরী বলবো না। দ্যাখ, আমাদের সভ্যতা যে স্পিডে আগাচ্ছে, এটাকে এভয়েড করাও তো যাচ্ছে না। দ্রুতই সবকিছু গ্লোবাল হয়ে যাচ্ছে লোকাল থেকে। একসময় বিটলস গান করতেছিলো লিভারপুলের পাব গোয়িং ক্রাউডের জন্য, থিংস এস্কালেটেড কুইকলি আর কিছু বছরের মধ্যেই ওরা আমেরিকাতেও সুপারহিট। আর এখন তো ধর একটা গান প্রকাশের দু দিনেই মিলিয়ন হিট পায় ইউটিউবে। কবিতার সাথে এই স্কেল না মিললেও, প্রেক্ষাপট একই। এখন কথা হইলো আমি কি আমার এথনিসিটিকে ইগনোর করবো নাকি কবিতায়? আমার উত্তর, অবশ্যই না। কিন্তু আমি কি তাকে কোন আলাদা গুরুত্ব দিবো আমার কবিতায়? আমার আবারো উত্তর— না!


যে কথা আমি অন্য কোন মাধ্যমে বলতে পারি, বরং তা আমি কবিতায় লিখতে চাই না। আমি কবিতাকে আরো নির্মেদ ভাবতে চাই, নিরাভরন। একটা জিওগ্রাফির নিজস্ব কবিতাও অন্য যে কোন ল্যাটিচুড লংগিচুডে আবেদন তৈরি করতে পারুক। ক্লাসিকের বৈশিষ্ট্য এটাই। সে সময় বা স্থানিকতায় হারায় না।


কমল: তাইলে যে হারে আগাইতেছে এতে তো একটা সময় সবকিছু দখল হয়ে যাবে। রিয়েলিটি বেইজ টেক্সট বা বর্তমান সময়কে ধরতে চাইলে তো একটা সময় গ্লোবাল হয়েই যাবে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলা কবিতা ঠিক কোন পথে যাবে?
ফয়সাল: দখলদারটা কে? আইডেন্টিফাই কর।
কমল: দখলদার তো কোনও ব্যক্তি না। সময়।
ফয়সাল: বাংলা কবিতা কোন পথে যাবে বলার মত জাদু আমার কাছে নাই, ভবিষ্যৎবাণী করাটাও আমার ধাত না। আমি বরং নিজে কি লিখতে চাই আবার রিইটারেট করতে পারি। যা কিছু লেখা হয়ে গেছে, তা আমি আর লিখতে চাই না। সে কালীদাস হোক, জীবনানন্দ হোক, মজনু শাহ হোক, ফয়সাল আদনান নিজে হোক। যে কথা আমি অন্য কোন মাধ্যমে বলতে পারি, বরং তা আমি কবিতায় লিখতে চাই না। আমি কবিতাকে আরো নির্মেদ ভাবতে চাই, নিরাভরন। একটা জিওগ্রাফির নিজস্ব কবিতাও অন্য যে কোন ল্যাটিচুড লংগিচুডে আবেদন তৈরি করতে পারুক। ক্লাসিকের বৈশিষ্ট্য এটাই। সে সময় বা স্থানিকতায় হারায় না।
কমল: আমি আরও যে বিষয়টা জিগাইতে চাইতেছিলাম, ধর যে কবিতাগুলি লিখছিস। তুই যদি আরও পঞ্চাশ বছর পরেও কবিতা লিখিস তাইলে তোর কবিতার ধরনটা বা মূল ভাবনার জায়গাটা কই থাকবে?
ফয়সাল: আমি মূলত আমার দশ বছর আগের লেখাগুলো দেখে হাসি, ছিঁড়ে ফেলি এবং নিজেকে করুণা করি। পঞ্চাশ বছর পরে সেইটা একই রকম তীব্র হওয়াই স্বাভাবিক। সুতরাং এইটা সেইফলি বলা যায় আমার পঞ্চাশ বছর পরের কবিতা এখনের থেকে অনেক দূরের হবে। না হইলে আমি লিখবো না আর, আশা করি। সেই দূরটা কোথায় আমি জানি না। আমি মূলত কি লিখতে হবে না জানতে পারছি আপাতত, কি লিখা হবে তা খুঁজতেছি, পঞ্চাশ বছর পরে তোরে বলবোনে, হাহা!
হাসান রোবায়েত: একবার এক আড্ডায় আপনি বলছিলেন আপনার কবিতা হইলো মিউজিক্যাল। তো, এই মিউজিক ঠিক রাখতে বাক্যে অর্থের চাইতে আপনি কি শব্দের উপর বেশি জোর দেন?
ফয়সাল: আপনার মেমরিকে আমি হিংসা করি, হাসান রোবায়েত। আমি অর্থের ব্যাপারে উদাসীন না, কিন্তু চেষ্টা করি কম্প্রোমাইজ না করতে। কিন্তু সাউন্ড আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। এমন কিছু কাজ জ্যাক ক্যারুয়াকের ছিলো, আপনারা শুনে থাকবেন। কিন্তু আমি আবার অর্থহীনতায় আকৃষ্ট নই, যদিও একটা আপাত অর্থহীনতার দিকে টেনে নেয়ার ছল আমি মাঝেসাজে করি, খুব একটা কনশাসলি না, যদিও। মোটের উপর, ধ্বনি বা সাউন্ড আমার কাছে অনেক গুরুত্ব রাখে, তবে সেটা আমার প্রজেকশনকে কোনভাবেই কম্প্রোমাইজ করে না বলে ভাবি।
রোবায়েত: ধ্বনি বা সাউন্ডের ব্যাপারটা ঠিক কিভাবে বেছে নেন। মানে, কখন মনে হয় যে একটা শব্দ মেলোডিয়াস? যেমন ধরেন, দুইটা শব্দ ‘সন্তাপ’, ‘ভাণ্ড’ এই শব্দ দুইটার কোনটাকে আপনার বেশি মেলোডিয়াস মনে হচ্ছে? ঠিক কিসের ভিত্তিতে আপনি মেলোডি ঠিক করেন?
ফয়সাল: দ্যাখেন, এইটা তো কন্টেক্সুয়াল। আমি কোন শব্দের প্রতি বায়াসনেস রাখতে চাই না। আই মিন কারো ধ্বনিমাধুর্য বেশি কারো কম এমন আমি ভাবতে মানা করি নিজেকে। কোথাও হয়তো ভাণ্ড শব্দটা বিফিটিং কোথাও সন্তাপ, আমি বিনা অনুতাপও তাদেও সেখানে ব্যবহার করতে চাই।
রোবায়েত: গদারের একটা সিনেমায় এক পিচ্চি মেয়ে তার মাকে প্রশ্ন করে, ‘মা, ভাষা কী?’ মা বলে, ‘ভাষা হচ্ছে একটা বাড়ি যেখানে আমরা বসবাস করি।’ আপনার কাছে ভাষা কেমন?
ফয়সাল: আমার কবিতার একটা দোষ হয়তো এই আলোচনা থেকে আসলো আমি প্রচলিত আঞ্চলিক স্ল্যাং যেগুলো, সেগুলোর তেমন ব্যবহার কবিতায় করি নাই। বা বলা যায় আমার রুচি যেভাবে তৈরি হয়েছে তাতে একটা বেশ এলিটপনা আছে হাহা.. আমার কাছে ভাষা একটা টুল মাত্র। কম্যুনিকেশন একটা বিশাল চ্যালেঞ্জ। ভাষার আবিষ্কার, অন্তত লেখ্যরূপে ধারণাা করা হয় যে রেকর্ড কিপিংয়ের স্বার্থে। তো এত বছরের ইভোল্যুশনের পরেও ভাষা একা কম্যুনিকেট করতে পারার মতো এনাফ হয় নাই একাই। তার সাইন লাগে, ভঙ্গি লাগে। তো ভাষা আমার কাছে তাই নেহাৎ একটা টুল মাত্র, যাকে আমি ব্যবহার করতে চাই তার নিজের দুর্বলতাকে ঢাকার জন্যই। ভাষার ঘেরাটোপের মাঝে লুকিয়ে ফেলে নিজেকে প্রকাশ করা, এইটা শুনতে কমিক্যাল বা সার্কুলার শুনাইতে পারে, কিন্তু এটাই ভাষার গুরুত্ব, বা কবিতায় ভাষার গুরুত্ব, আমি কি সেন্স মেক করলাম, রোবায়েত?
কমল: ধ্বনি বা ভাষার প্রসঙ্গ যখন আসলো তখন, সিনেমায় যেইটারে মন্তাজ বলে বা সিনেমাভাষা ওইটা ঠিক অনেক ক্ষেত্রে বাস্তব চিত্র না। তেমনি কাব্যভাষার প্রশ্ন যখন আসে তখন সেই কথটা বাস্তব? নিজের লেখার জায়গা থেকে বল।
ফয়সাল: আমি আমার কবিতাকে রিয়ালিটি থেকে উঠে আসা আনরিয়েল বা হাইপার রিয়েল বলে ভাবতে চাই। সিনেমা কখনোই বাস্তব না, এবং ট্রাস্ট মি কমল, সিনেমায় আমরা বাস্তবকে পুঙ্খানুপুঙ্খ দেখাতে চাই না, দর্শক হিসেবে দেখতে চাই না। আমরা চাই বিশ্বাসযোগ্য ফিকশন দেখতে। ঠিক যেমন মার্কেসের বইয়ে আমরা একটা ক্যারেক্টারকে পর্দা হয়ে বাতাসে উড়ে হারিয়ে যেতে দেখেও বিশ্বাস করে ফেলি, তেমন। কবিতাও তেমনি। যা খুশি তা বলে দেয়ার রাইট কবির আছে, কিন্তু পাঠকেরও রাইট থাকে কবির ফিকশনের অবাস্তবতার বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্ন করার। আমি কি বোঝাতে পেরেছি?
রোবায়েত: কিন্তু ধরেন এই যে এলিটপনার কথা বলছেন, সেইটা কি আপনাকে সবকিছু লিখতে পারমিট করে? মানে, যেকোনো বাক্য আপনি লিখতে পারেন?


আমার কিছু লিখতেই বাধে না, বাধে না লেখার পরে ছুঁড়ে ফেলে দিতেও, মুশকিল হলো এলিটিজম চোদানোর কারণে, দ্বিতীয়টা বেশি হয়।


ফয়সাল: রোবায়েত, হ্যাঁ পারে। আমার কিছু লিখতেই বাধে না, বাধে না লেখার পরে ছুঁড়ে ফেলে দিতেও। মুশকিল হলো এলিটিজম চোদানোর কারণে, দ্বিতীয়টা বেশি হয়।
কমল: তার মানে শিল্প মানেই একটা ফ্যান্টাসি থাকতেছে, কবিতা, সিনেমা বা অন্য মাধ্যমেও?
ফয়সাল: কমল, শিল্প মানেই ফ্যান্টাসি, ফ্যান্টাসি ছাড়া যা হয় তা নিম্নমানের সাংবাদিকতা।
মারুফ: শিল্প মানেই ফ্যান্টাসি! কথাটা আরো ব্যাখ্যা দাবি করে।
রোবায়েত: আপনার কি মনে হয় না, এইসব করতে গিয়ে কবিরা অসুন্দরকে দূরে ঠেলে দিয়ে শুধু সুন্দর সুন্দর করতেই ব্যস্ত?
ফয়সাল: শতভাগ একমত, হাসান। আমরা আমাদের রুচির দাস। সেই রুচি আবার তৈরি করে দেয়া। এককালে কলোনির প্রভু, তারপরে ঠাকুর, তখন থেকেই ইউরোপ, মাঝে একটু কোলকাতা, এখন ঢাকাই টাউট মধ্যবিত্ত। সবাই আমাদের রুচি শিখিয়েছে, আমরাও শিখে তালেবর হয়ে তাতেই কবিতা লিখছি এখন পর্যন্ত। মুশকিল হলো আমি যা বলতে চাই, নিজেকেই, হয়তো কোন পাঠককেও, তার জন্য যে ভাষা সেটা এই চলমান প্রভাবিত, তৈরি রুচির ভাষাই। আর তাই আমি এ নিয়ে কোন জুলুম বা অত্যাচার করি না। ভাষাকে আমি থাকতে দেই প্রশ্রয়ের প্রেমিকার মতো।
রোবায়েত: তাইলে আপনি কি মনে করেন আপনার কবিতা লেখার যে টেকনিক আপনি প্রয়োগ করতে চান তা আসলে পারতেছেন না ঠিকভাবে?
মোস্তফা হামেদী: এবং চলমান-প্রভাবিত রুচির ভাষাকে চ্যালেঞ্জ করছেন না?
ফয়সাল: নাহ্। একদমই না, আমি যা করতে চাই তাই করতেছি। আমার রুচি তৈরি করে দেয়া তা আমি স্বীকার করেছি। কিন্তু তৈরি বলেই তারে বর্জন করতে হবে কেন, তা আমার বোধগম্য না।
রোবায়েত: কিন্তু আপনি বলছেন, ‘আমার কিছু লিখতেই বাধে না, বাধে না লেখার পরে ছুঁড়ে ফেলে দিতেও, মুশকিল হলো এলিটিজম চোদানোর কারণে, দ্বিতীয়টা বেশি হয়।’ তাহলে দ্বিতীয়টা কেন বেশি হচ্ছে?
ফয়সাল: আমি কম্যুনিকেট করতে চাই, আবার করতে চাইও না, কবিতা আমাকে এই বহুমুখিতার সুযোগটা দেয়, সেটা আমার এই ন্যাটিভ বাংলা ভাষায় আমি করতেছি, যেহেতু বাই দ্য এক্সিডেন্ট অফ বার্থ আমি বাংলাদেশি। যদি স্পেনে জন্মাইতাম তাহলে তাদের ভাষায় যদি জুলুদের মাঝে তাহলে তাদের ভাষায় এবং অবশ্যই তাদের তৈরি করে দেয়া রুচিতে। কিছু আসত-যেত কি তাতে?
রোবায়েত: না। আসতো ও যাইতোও না। কিন্তু অন্তর্দ্বন্দ্ব তৈরি হইতো না আমি নিশ্চিত। কী জানি, এইটা হয়তো ব্যক্তির ভেতরে একজিস্ট করে। আপনি কি প্রতিষ্ঠানবিরোধী?
ফয়সাল: দ্বিতীয়টা বেশি হচ্ছে কারণ আমার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মনে হয় আমি যা কম্যুনিকেট করতে চাইছি তা হয় নাই, সো বাদ। যদি দেখি হচ্ছে, আই অ্যাক্সেপ্ট দ্যাট এজ পোয়েট্রি, সেটা যে শব্দই রাখুক না কেন কবিতায়। অন্তর্দ্বন্দ্বহীন মানুষ কি হয়? আর হলে কি সে কবিতা লিখবে, হাসান? আমি প্রতিষ্ঠানবিরোধী। সিলেক্টিভলি। কারণ প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতা আবার প্রতিষ্ঠান তৈরি করে, সেটা একটা নির্দিষ্ট লাইফ সাইকেল পার করে ভূষিমাল হয় আর উত্তরাধুনিক মানুষ সেই ভূষিমালকে নেয়, রিজেক্ট করে।
রোবায়েত: তার মানে, আপনি নিজেও নিজের এই চিন্তাকে একদিন রিজেক্ট করবেন?
ফয়সাল: যদি আমার চিন্তা ভূষিমাল হয়, কেন নয়?
রোবায়েত: এইটা ভালো। আপনার বইয়ের ভূমিকা-কবিতার পেছনের কথা বলেন। ঐটা আমার খুবই প্রিয়। নাকি উৎসর্গ-কবিতা?
ফয়সাল: ভূমিকা বা উৎসর্গ যাই বলেন, হবে। ২০১৭ একটা ইভেন্টফুল বছর আমার জন্য। নানা কারণে জানুয়ারি মাসে আমি বেশ ভাঙাচোড়া অবস্থায় একটা লম্বা আনঅ্যানাউন্সড ছুটি নিয়ে চট্টগ্রাম চলে আসি। আমার মা মারা গেছেন সাড়ে তিন বছর হলো, আমি এখনো এই শোকটা কাটাতে পারি নাই। আর আমার কেবলই মনে হয়, আম্মু থাকলে আমি এসব ঝামেলা-টামেলায় পড়তাম না, খুব অযৌক্তিক ভাবনা। এর মাঝেই বাসায় আসলে যা হয়, আমাকে জোর করে মসজিদে পাঠানো হয়, আর আমিও খুব একটা না করি না, যাই। যে মসজিদে আমি জুমা’র নামাজ পড়তে যাই সেখানেই আমার মায়ের কবর। তো এই পুরো সেটাপটা সেই মানসিক কন্ডিশনে আমার জন্য আনবিয়ারেবল ছিলো। আমি বোকার মতো মসজিদে বসে কেঁদেছি মায়ের মৃত্যুর প্রায় তিন বছর পরে, প্লিজ ডোন্ট সিম্প্যাথাইজ ফর মি, মোর অর লেস যে কারোই এমন হতে পারে। তো সেই দুর্বল মুহূর্তটাই এই কবিতা।এই কবিতা আমার পাণ্ডুলিপি ফাইনাল হওয়ার পরে লেখা, এবং কবি বিজয় আহমেদ চাপাচাপি না করলে কবিতাটা বইয়ে যায় না। তো বিশাল একটা ধন্যবাদ ওনার প্রাপ্য।
রোবায়েত: কবিতা হিসেবে ঐটা আমার খুব প্রিয়, টেক্সটের পেছনের গল্প ছাড়াই। আমি জানি, ঐটা আরো আরো মানুষের প্রিয়। তো, এইখানে একটা প্রশ্ন উঠে আসে। আর্টের কি কোনো ইউনিটি আছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই? না হলে একটা টেক্সট বেশিরভাগের ভালো লাগে কেন?
কমল: ব্যক্তিগতভাবে পুরো বইয়ে উৎসর্গ কবিতাটাই প্রিয় আমার।
ফয়সাল: এইটাতে আপনি আমার সাথে ডিসএগ্রি করবেন জানি। এবং আপনার ডিসেগ্রিমেন্ট শেয়ার কইরেন আবারো, এগুলা বেশ কাজের। আমি আগেও বলেছি, অনেক ছলচাতুরির পরেও কবি কম্যুনিকেট করতে চায়। এই যে মা হারানোর ক্রাইসিস, এটা ক্ল্যাসিক, সবাই রিলেট করতে পারে। এই কবিতায় আহামরি নতুন কিছু নেই যে নাড়া দিয়ে যাবে, কিচ্ছু নেই, খুবই ডিরেক্ট অ্যাপ্রোচ, একদম ফকফকা ইমেজ, কিন্তু অনুভূতিটা এত রিলেটেবল, কবিতাটা গণরুচিতে উৎরে গেছে। এইখানে আর্ট ইউনিটি ক্রিয়েট করেছে বলেই ভাবি।
রোবায়েত: অর্থাৎ গণরুচিকেই আপনি আর্টের ইউনিটি বলতে চান?
কমল: এইখানে একটা প্রশ্ন, যতটা চারপাশের মানুষ অনেকেই এই কবিতাটা মেনশন করে। এইখানে যে অনুভূতিটার উপস্থিতি পুরো বইয়ে এরকম বা অন্যরকম অনুভূতি অনেক। কিন্তু তারপর বলতেছিস কবিতায় কানেক্ট করার ইচ্ছা থাকেই। তাইলে কিছুটা বৈপরীত্য দেখা দিলো না?
ফয়সাল: গণরুচি কাউন্টস টু নাথিং, রোবায়েত। আই পার্সোনালি ডোন্ট গিভ অ্যা ড্যাম। আমার কাছে কবিতার একমাত্র অথরিটি আমি, ইন্ডিভিজুয়াল।
কমল, বুঝি নাই বৈপরীত্য কোথায়, বুঝায়া বল আবার।
কমল: বলছি। ধর, আগে বলছিস কবিতা একটা শেষ পর্যন্ত বৈশ্বিকে রূপান্তরিত হইতেছে, আবার শিল্প মানেই একটা ফ্যান্টাসি এরপর অনুভূতির প্রাধান্য। আবার কমিউনিকেট করার ইচ্ছা। সবগুলোই তো পৃথক। একটার সাথে আরেকটা বৈপরীত্য সৃষ্টি করে না?
ফয়সাল: নাহ্। এগুলো পরস্পরবিরোধি না, এরা সহযোগী, এইটা একটা ফেব্রিকের মতো কল্পনা করতে পারিস। শুধু কবিতা না, সবই গ্লোবালাইজড, অনুভূতি, ফ্যান্টাসি এসবই, আর এইটা কম্যুনিকেট করতে চাস বলেই কিন্তু সিনেমা, সাহিত্য এতসব। এই ইচ্ছার সাথে কর্পোরেট হাউজের ডকুমেন্টেশনের তেমন কোন পার্থক্য নাই বলা যায়।
মারুফ: “শিল্প মানেই ফ্যান্টাসি।” ভিজুয়াল আর্টের দিক থেকে অবজারভ করলে কথাটা দিয়ে পুরো দৃশ্যশিল্পের আওতাটাকে ধরা মুশকিল। শিল্পীর একটা জার্নি না থাকলে, দর্শনগত অবস্থান বা ইউনিক বক্তব্য না থাকলে এখানে টেকা কঠিন। সাহিত্যের বেলায়ও এই পয়েন্টগুলো খুব কম গুরুত্ববহ নয়। এখন শুধু ফ্যান্টাসি বললে অনেক কিছুই বাইরে থেকে যাচ্ছে। আপনার কি মনে হয়?
ফয়সাল: দেখেন “শিল্প মানেই ফ্যান্টাসি” এইটা আসলে একটা ওয়ান লাইনার। আর এক বাক্যে পুরা সাহিত্যের ইতিহাস, শিল্পের ইতিহাসকে আমি ধরতে পারবো এমনও না। এইটাকে আমার শিল্পভাবনার সামারি ধরে নিলে ভুল করা হবে আই গেস। আমি যেটা বলতে চেয়েছিলাম তা অনেকটা এরকম— খালি চোখে যা আপাতত দেখা যাচ্ছে, তাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করলে আসলে সেটা শিল্পসৃষ্টি হয় বলে আমি ভাবি না। শিল্পীকে রিয়ালিটির বাইরে যাইতে হয়, রিয়েলিটিকে সেন্টারে রেখেই, রিয়ালিটির ব্যবচ্ছেদ করা দরকার পরে তার।
জয়: কবি-সাহিত্যিকদের নিজেদের শ্রেষ্ঠ ঘোষণা এবং প্রচারকে কিভাবে দেখো? যেমন ধরো, গুণ পোয়েটলর্ড!
ফয়সাল: আহাম্মকি মাত্র, শ্রেষ্ঠত্ব ব্যাপারটা ওভাররেটেড। মোস্ট ইম্পর্ট্যান্টলি, আমার কাছে সাকসেস ইন্সট্যান্ট গ্রাটিফিকেশন ছাড়া কিছু দেয় বলে মনে হয় না। পার্মানেন্ট কিছু এটা না। আই মিন কিছুই তো পার্মানেন্ট না আসলে। তো আমি আসলে কবিশ্রেষ্ঠ হইলেই কি নিকৃষ্ট হইলেই বা কি? আমার বই মানুষ পড়লেই কি আর না পড়লেই কি?
জয়: যৎসামান্য আর্থিক প্রাপ্তি ছাড়া সাহিত্য পুরস্কারে কবি/লেখকের কোন লাভ আছে?
ফয়সাল: থাকতে পারে ব্যক্তিবিশেষে। ইন্সট্যান্ট ঐ গ্রাটিফিকেশনটা কিন্তু কাজেও দেয়। মানে ধরেন, মানুষ তো মোটিভেশন ছাড়া কিছু করে না। কারো কারো জন্য হয়তো এই পুরস্কারগুলো মোটিভেশান হিসেবে কাজ করতে পারে। সমস্যা হয় যখন এই পুরস্কারগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠান হিসেবে অসৎ ভূমিকা রাখে। তখন এইগুলা অর্থযোগ বাদে আর কোন গুরুত্ব রাখে না।
মারুফ: এলিটিজমকে নেগেটিভ পার্সপেকটিভ থেকে দেখা কেনো? আপনার কবিতার বৈশিষ্ট্যের কথায় বলা হচ্ছিলো।
ফয়সাল: নেগেটিভভাবে দেখি না তো। আমি নিজেই এলিট, ভাবে-চক্করে, লেখায়, পড়ায়। বাট এইটাকে আমি ক্রিটিক করি। আবার আমি নিশ্চিতভাবেই গণমানুষের জন্য লিখতে চাই না। একটা ক্রাইসিস আছে আরকি। আমি শুরুতে বলছিলাম না, আমি কিছু জিনিস নিয়ে ভাবি, ওটা আরকি। ধরেন পৃথিবী এত আগাই যাচ্ছে, মানুষ অমরত্বের পিছে ছুটছে, কিন্তু রাজশাহীর বর্ডার সংলগ্ন এক গ্রামের কথা আমি শুনেছিলাম যেখানে রোগে-শোকে বাচ্চাদের হাসপাতালে নিতে রাজি না বাবা-মা। উন্নত চিকিৎসা কি জিনিস তারা জানেও না, একটা ভীতির চোখেই তারা দেখে একে। এই যে আমি কবিতা লিখি, জাকারবার্গ ফেসবুক বানায়, ইলন মাস্ক মঙ্গলে মানুষ পাঠাবে বলে, এসবের কোন ইম্পলিকেশন ঐ ইন্ডিভিজুয়ালের কাছে নাই। এদের সামনে দাঁড়ায়ে নিজের এই এলিটিপনা আমার ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ে। এবং আমি নিজেকে নিয়ে কুণ্ঠিত হয়ে যাই। 
গণমানুষের জন্য তো আসলে অনেক কিছু হয় না। তার খুব দরকারও বা কি। পাঠক বা দর্শকরা কতোটা গণমানুষের কাতারে? এখানেও কি দল বা গ্রুপে ভাগ হয়ে যাচ্ছে না? গণমানুষের জন্য আসলে কিছুই হয় না। এবং সাহিত্যও আর দশটা প্রোডাক্টের মতো এটাও সেগমেন্টেশনের মধ্য দিয়ে যায়, নিশে তৈরি হয়। এবং এইখানেই এটার এলিটপনা, তাই না?
মারুফ: হ্যাঁ, আর্টের ব্যাপারে কথাটা আরো বেশি খাটে। আমাদের দর্শকই তৈরি হয়নি আর বাকি সব তো পরে।
ফয়সাল: শিল্পের ভোক্তা তৈরি হওয়ার সাথে পটুজির বিকাশের সম্পর্ক আছে কিন্তু। আমরা এখনো লিস্ট ডেভলপড কান্ট্রিগুলোর একটা। শিল্প-সাহিত্য নিয়ে প্রচুর নাড়াচাড়া হচ্ছে এমন দেশগুলোর কোনটাই অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল না। আমাদের অর্থনৈতিক সংকট কাটছে, মানুষের হাতে কাঁচা টাকা আসছে, নিশ্চিত থাকেন আর্টেও ভোক্তা তৈরি হবে, তৈরি হবে সিনেমার দর্শক। বাট আর্ট অ্যাজ উই নো ইট, উইল চেঞ্জ ফর শিওর। কি হবে সেটা আমি জানি না।
মারুফ: পলিটিক্যালি সাহিত্যের ভেতর দিয়ে দলগুলো তাদের দর্শন (যদি এদের তেমন কোনো দর্শন নাই) স্থায়ী করতে চাইছে, নতুন প্রজন্মের ভেতর দিয়ে ইতিহাস ঢাকার যে প্রবণতা তার প্রভাব কেমন করে কাটবে? এর সাথে তো সাহিত্যের সম্পর্ক খুব কাছের।
ফয়সাল: নতুন প্রজন্ম সাহিত্যের ব্যাপারে এত ননচ্যালান্ট তার পরেও দলগুলা এইখানে ম্যানিপুলেট করতে চাচ্ছে। এইটাই আমার কাছে খুব মজার লাগে। দ্যাখেন, প্রপাগান্ডা সাহিত্য দীর্ঘস্থায়ী কিছু না। এগুলা টেকে না। অদিতি ফাল্গুনী বা হাসনাত আব্দুল হাই শাহবাগ নিয়ে কি লিখেছেন ইতোমধ্যেই আমরা ভুলে গেছি। প্রতি বইমেলায় বহেরা তলায় একটা গোষ্ঠীকে বসে থাকতে দেখি, সরকারী দল গ্রুপ হবে বোধকরি। কিন্তু এদের কার সাহিত্যকৃতি কে পড়েছে কবে? সো এইসব অগুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে নিজের কাজ নিয়ে ভাবা ঢের ভালো। মুশকিল হলো প্রপাগান্ডা সাহিত্য না টিকলেও প্রপাগান্ডার ইফেক্ট-এ ইতিহাস পাল্টে যায়। এর প্রভাব কাটাতে পালটা প্রোপাগান্ডা কোন সল্যুশন বলে ভাবি না।
হামেদী: আপনি এক জায়গায় বলছিলেন, প্রচলিত ভাষারীতির দ্বারা আপনি প্রভাবিত। এই অবস্থানটা আপোষমূলক কিনা? একজন কবির জন্য নতুন কাব্যভাষা কতটা জরুরি?
ফয়সাল: এটা আপষমূলক না। আমি প্রভাবিতও না, এটা আমার কনশাস চয়েস। কাব্যভাষা আর ভাষা এক নিক্তিতে মাপা যায় না। প্রচলিত ভাষারীতির মাঝে থেকেও নতুন কাব্যভাষা আসতে পারে। আমি ভাষা, ছন্দ এইসব টুল নিয়ে বেশি কব্জির জোরাজুরি করতে চাই না, বরং প্রচলের মাঝ থেকেই নতুন প্রজেকশন করতে চাই।
হামেদী: আপনার এই নতুন প্রজেকশন কি স্বতোৎসারিত? এর কোনো ব্যাকগ্রাউন্ড আছে কিনা? কী কী উপাদান আছে এই প্রজেকশনে, যেটা অভিনবত্ব দাবি করবেন?
ফয়সাল: আমি নিজের এই অভিনবত্বেও কোন দাবি করি না। এই দায় আমি আপনাদের দিতে চাই। আপনারাই বলবেন এখানে আদৌ নতুন কিছু আছে কিনা বা কি আছে।


আমি ভালো কোন কবিতা পড়িনি, যেটা একটা ইমেজ ক্রিয়েট করে না।


হামেদী: আচ্ছা। প্রভাবিত হতে পছন্দ করেন? কবিতা লিখতে গিয়ে কার কার দ্বারা বা কী কী দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন?
ফয়সাল: প্রভাবিত হওয়া নিয়ে ভাবি না। সবাই প্রভাবিত কম-বেশি। আমি আমার এক্সপেরিয়েন্স দ্বারা প্রভাবিত, সেটা আমার লেখা, পড়া, দেখা সব নিয়েই।
হামেদী: কোনো কবি আপনাকে প্রাণিত করেন কিনা?
ফয়সাল: নট অ্যানিওয়ান স্পেসিফিক। তবে লেখালেখি করবো এই ভাবনাটা আমার আসত না যদি আমার বন্ধু সুদীপ চৌধুরী কবিতা না লিখত। যদি অমিত চক্রবর্তী, আন্দালীব, মুক্তি মণ্ডল ওদের সাথে আমার পরিচয় না হতো। এবং একটা পর্যায়ে এসে শিরদাঁড়া লিটল ম্যাগের সবাই সুহৃদ দা, নকীব ভাই, দীপ দা, খোকন ভাই—ওনাদের কন্টিনিউয়াস ইন্সপিরেশন আর প্রেশার না থাকত।
হামেদী: কবিতার জন্য ইমেজ কতটা অপরিহার্য?
ফয়সাল: আমি ভালো কোন কবিতা পড়িনি, যেটা একটা ইমেজ ক্রিয়েট করে না।
হামেদী: ইমেজ সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রতিবেশ কবিকে কতটা প্রভাবিত করে? আমার তো মনে হয়, ইমেজ দিয়ে কবিকে চেনা যায়। এমনকী কবির জগতও। ফলে ইমেজের মধ্যে চিন্তার সূত্র খুঁজে পাই আমি। এক্ষেত্রে আপনার ভাবনা কী? ইমেজ কি স্বয়ংক্রিয় কোনো ব্যাপার?
ফয়সাল: দেখেন প্রতিবেশ তো প্রভাবিত করেই। যেমন অমিতের বইটার কথা ভাবেন। অমিতের পড়া বোর্হেস, মার্কেস, লাতিন সাহিত্য সেখানে সুদূর প্রভাববিস্তারি। ওর সিনেমা দেখা, দর্শনের পাঠও ধরা যায়, রঙ নিয়ে ওর যে কথা তা থেকে চিত্রশিল্প সম্পর্কেও যে ওর একটা আন্দাজ আছে সেটা ধরা যাচ্ছে। তো এমন প্রভাব আসেই। আমি অবশ্য একটু আলাদা করে ভাবতে চাই, আমি চাই আমার এই প্রতিবেশ-পরিস্থিতি কবিতায় গোপন থাকুক। আমি নিজেকে ধরা দিতে চাই না বলেই কবিতা লিখি, নাহলে হয়তো অন্য কিছু করতাম।
হামেদী: গোপন আদৌ থাকে কিনা এই প্রশ্নটা থেকেই যায়। আল্টিমেটলি শব্দের ফাঁদে পড়ে যেতে হয়। যাপনের খণ্ড খণ্ড দৃশ্যে, বর্ণনার দ্যুতিতে ঠিকই পরিষ্কার হয়ে ওঠে কবির ভূ-বিশ্ব। যেমন আপনার কবিতা পড়ে মনে হয়, আপনি নোম্যান্সল্যান্ডর কবি। যেখানে ওয়াগনভর্তি বিষাদ, বুর্বনের গন্ধ, মাশরুমের বন।
ফয়সাল: আমার কাছে বরং মনে হয় এটা একটা রিডিংয়ের ফাঁদ। ধরেন এই যে ওয়াগন, বুর্বন, মাশরুম এই ঝোপ-জঙ্গল সরানোর পরে একটা ফাঁকা স্পেস তৈরি হয়, আর সেখানেই কবিতা থাকে।
হামেদী: আমার তো মনে হয়, ভাষা নিজেই দাবি করে এমন সব বস্তুপুঞ্জ, প্রতীক, চিত্ররূপের উপস্থাপনা যেটা ঐ ভাষাভাষী লোকদের ‘যৌথ অবচেতন’ ধারণ করে। আপনি নিজেও বলছিলেন, আপনি কম্যুনিকেট করতে চান। তো আপনি তো নিশ্চয়ই সে ক্লু-গুলো ধারণ করবেন, যেটা ঐ ভাষাভাষী মানুষের মনস্তত্বকে, তার ঐতিহ্যকে কিংবা তার যৌথ অবচেতনকে রিপ্রেজেন্ট করে। এটা যদি নাই হয়, তাহলে কম্যুনিকেশনের সূত্র কী?
ফয়সাল: এটা আসলে কে কার আগে আসে, চিকেন-এগ থিওরির মতো। দেখেন আমি যে জনগোষ্ঠীর তাতে ওয়াগন, এপাচি বা বুর্বন কিন্তু কমন কিছু না, তারপরেও এরা এসেছে। তারপরেও কিন্তু কবিতাটা কোথাও কোথাও কম্যুনিকেট করতে পারছে, কারো কারো কাছে করতে পেরেছে। সো (a+b)=2 এর মত রকান সূত্র হয়তো না এটা, কিন্তু কম্যুনিকেশন আসলে এসবের উপরে ডিপেন্ডেন্ট না।
হামেদী: একটা বিশেষ কবিতা শুধু না। ওভারঅল সাহিত্যচিন্তার জায়গা থেকে কথাগুলো বলা। যাই হোক, কম্যুনিকেশন ডিপেন্ড করে কিসের উপরে?
ফয়সাল: সেটা বুঝেছি। আমি উদাহরণটা ধরে জবাব দিলাম বোঝার সুবিধার জন্য। 
রোবায়েত: বইমেলায় আমরা ডিবেট করছিলাম লাউ-এর ডগা নিয়ে। জসীম উদ্দীন-এর কবিতায় এটার ব্যবহার নিয়ে। আপনি লাউডগার ব্যবহার ইগনোর করছিলেন। তো, বাংলা কবিতায় কমিউনিকেশনের সিম্বলগুলো খুব বেশি পশ্চিমমুখী হয়ে যাচ্ছে কি?
ফয়সাল: কম্যুনিকেশন স্পেসিফিক কিছুর ওপরে ডিপেন্ড করে না বোধহয়। একটু আগেও বলছিলাম যে ভাষা অনেকগুলো টুলের একটা কম্যুনিকেটের জন্য, সাইন ল্যাংগুয়েজ যার ওর কিন্তু ভাষা লাগে না, শিশু তার মায়ের সাথে কম্যুনিকেট করেও কিন্তু প্রথাগত ভাষা ছাড়াই। ভাষা গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু সে-ই সব না, এই আর কি। পশ্চিমমুখী বলবো না, বলবো গ্লোবাল হচ্ছে, আপডেট হচ্ছে, আধুনিক হচ্ছে। এটা ভালো কিংবা মন্দের প্রশ্ন না কিন্তু। লাউয়ের ডগা আমার কাছে রেলেভেন্ট না, আমার পিয়ার ক্লাসেও রেলেভেন্ট না। কিন্তু জসীম উদ্দীনের কাছে রেলেভেন্ট, এখনো জাস্ট আমার কাছে আধুনিক না।
রাজীব: তার মানে লাউয়ের ডগা অনাধুনিক?
রোবায়েত: লাউডগা কেন আধুনিক না? আধুনিকতার চরিত্র কী তাহলে? কেবল পশ্চিমের জিনিসপত্রই আধুনিক?
ফয়সাল: না। লাউডগা অনাধুনিক না, আমার কাছে রেলেভেন্ট না। আমার এক্সপেরিয়েন্সে এই জিনিস নাই, তার চেয়ে রাস্তার উপচে পড়া ড্রেন আমার জন্য রেলেভেন্ট, আমার বাস্তবতা।
রাজীব: আপনি বললেন গ্লোবাল হচ্ছে, আপডেট হচ্ছে, আধুনিক হচ্ছে।
ফয়সাল: হামেদীর ক্ষেত্রে লাউডগা আধুনিক এবং রেলেভেন্ট।
রাজীব: অথচ লাউডগা অনেক বেশি জড়িয়ে আছে আপনার সাথে। বাজারে তো এর দেখা অহরহ পান। 
ফয়সাল: কিনি না, খাইতে ভালো লাগে না আমার। লিখতেও ভালো না, খাইতেও ভালো না আমার রুচিতে হাহা…
রাজীব: আমার তো ধারণা ঘোড়া বা জেব্রা টাইপ ইমেজের চে লাউ বেশি রেলেভেন্ট। যদিও রেলেভেন্ট হইতেই হবে এমন মনে করি না। এলিয়েনও কবিতায় আসতে পারে।
রোবায়েত: তার মানে কি আপনি আপনার প্রতিবেশকে অস্বীকার করে ওয়েস্টার্ন ওয়াগনকে বেশি স্বীকার করেন?
ফয়সাল: নাহ্, ঐ একটা কবিতা দিয়ে আপনি মে বি আমার পুরা কবিতার জগৎকে প্রশ্ন করতে পারবেন না।
রাজীব: আচ্ছা, আধুনিকতা কি জিনিস?
ফয়সাল: ঐটা একটা স্পেসিফিক পরিবেশকে টার্গেট করে লেখা, একটা স্পেসিফিক ইমেজকে প্ল্যান করে লেখা। সে কারণেই সেটা এসেছে। ‘কম্যুনিকেশনের স্বার্থে’। ঐখানে লাউডগা দিয়ে আসলে হইত না মে বি। রাজীব আমি আবারো বলতেছি কিন্তু, আমি পার্সোনাল এক্সপেরিয়েন্স দ্বারা মোটিভেটেড অনেক। এখন লাউডগা আসলেই আমার এক্সপেরিয়েন্সে আসে না। বরং কিয়োসলস্কির সিনেমার সাদা ঘোড়া আমাকে অনেক চিন্তা করায়, আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।
মোস্তফা: লাউয়ের মাচায় শাদা শাদা ফুল— এই রকম দৃশ্য খুব ভালো লাগে। আর লাউপাতারও খুব স্বাদ। লাউয়ের ডুগডুগির সুর অনন্য।
রাজীব: এক্সপেরিয়েন্স আসলে সিনেমা দিয়েও হতে পারে। স্বপ্নেও হতে পারে।
ফয়সাল: এখন আপনার এই দৃশ্য দেখার অভ্যস্ততা আছে। আমি সারাজীবন শহরে কাটায়ে লাউ দেখছি খালি কাঁচাবাজারে, তাও প্রচণ্ড বিরক্তির সাথে। বিরক্ত হয়ে কোন কবিতা লিখলে সেখানে আমার লাউডগা চলে আসতে পারে হাহা..
ঠিক ধরেছেন রাজীব, কিছুটা মনে হয় বোঝাতে পারলাম।
রাজীব: ইটও যে পোড়ামাটি। এইটা আসলে সবসময় মনে থাকে না আমাদের।
ফয়সাল: এইটা দারুণ বলছেন।
হামেদী: ‘জানোই তো সীমালঙ্ঘনকারীর জন্য আছে হাবিয়া দোজখ।’ কিংবা ‘লোভ হয় বিশ্বাসের, লোভ হয় ঝরাপাতার, গানের ক্লাসের, লাম ইয়ালিদ ওয়া লাম ইউ লাদ’ — এই যে ধর্মীয় অনুষঙ্গ- বিষয়-আশয় আপনি ব্যবহার করেছেন, এইটা কি সচেতনভাবেই? কবিতায় ধর্মীয় অনুষঙ্গ ব্যবহার করাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
রাজীব: আমি একটু নাক গলাই হামেদীর প্রশ্নে। আসলে ধরেন আমরা ধর্মীয় অনুসঙ্গগুলারে যেভাবে ক্যাটাগরাইজ করি, কতটুক সোশ্যাল সায়েন্স ঢুকলো, কতটুক হিস্ট্রি ঢুকলো এভাবে কি ভাগ করি?
হামেদী: এইটা আমি ইনটেনশনালিই করেছি। কারণ অনেকে এগুলো দেখলে আঁতকে ওঠেন। তকমা দিতে দেরি করেন না।
ফয়সাল: দেখেন ধর্ম না মেনেও আমি বলি ধর্ম আমার জীবনের ইন্টিগ্রাল পার্ট। আমার বাবা খুশি হয় আমি জুমা’র নামাজে গেলে, আমি যাই। আমার ঈদে নামাজে যেতে ভালো লাগে, সিন্নি সেমাই ভালো লাগে, পূজার মণ্ডপ ভালো লাগে, আমি এদেরকে আলাদা করে দেখতে রাজি না। সোসাইটি এট লার্জ আমার কাছে গবেষণার বিষয় হলেও আমার জীবন আমার কাছে উপভোগের, ধর্ম সেখানে খাদ্যাভাস, যৌনাচার, নিদ্রা, রেচন সব কিছুর মতই একটা অনুষঙ্গ। আমার কবিতায়ও তাই অনুষঙ্গ হিসেবে এরা চলে এসেছে। এগুলো সচেতনভাবে কিনা উত্তর দিতে হলে বলতে হবে কবিতা আমি সচেতনভাবে লিখি কিনা, সেটা মনে হয় আগেই বলেছি, না?
হামেদী: এই সময়ের পাঁচজন কবির নাম বলেন, যাদের লেখা আপনাকে মুগ্ধ করে।
ফয়সাল: এই সময়ের কি কোন সেট টাইমলাইন আছে? এই প্রশ্নটা আমি আসলে এড়িয়ে যেতে চাই। এসময়ের অনেক কবিই আমার বন্ধুস্থানীয়, তাদের আমি আসলে এভাবে র‌্যাংক করতে চাই না। হাবিজাবি বলে বুঝ দেবার চেয়ে সরাসরি বলে দিলাম, আশা করি বুঝছেন ব্যাপারটা আপনারা।
জয়: এইটা মনে হয় খুব দরকারি কিছুও না। আড্ডা দিয়ে অনেক ভালো লাগলো, ফয়সাল। সময় দেবার জন্য ধন্যবাদ।
ফয়সাল: তোমাদেরকেও অনেক ধন্যবাদ।



ফয়সাল আদনান

প্রকৌশলী, উন্নয়নকর্মী, কবি। একমাত্র প্রকাশিত কবিতার বই ‘চতুর্থ সেলাইয়ের নিচে (২০০৭)।
যোগাযোগঃ faisalrabbi@gmail.com

শেয়ার