কবির হোসেনের ‘ক্ষুধার্ত মাছের স্বাদ’ পাঠের অভিজ্ঞতা | রনক জামান

‘ক্ষুধার্ত মাছের স্বাদ’ কবির হোসেন-এর নতুন ও চতুর্থ কবিতাগ্রন্থ। প্রকাশ পেয়েছে চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন থেকে। আগের তিনটি বইয়ের কবিতার ধরন থেকে সরে এসে ৫০০-টি এক লাইনের কবিতা দিয়ে সুসজ্জিত হয়েছে পুরো বই। বইটি প্রকাশ হয় গত অমর একুশে গ্রন্থমেলায়।

নির্দ্বিধায় বলে ফেললাম, ‘এক লাইনের কবিতা’, দেখতেও তাই— ‘সলিড ওয়ান-লাইনার’। কিন্তু একেকটি বাক্য ধারণ করে আছে আসলে বিস্ফোরণ-পূর্ব গ্রেনেডের শক্তি (হয়তো তারও বেশি? সময়ই বলে দিক।)। আর সেই শক্তি তৈরি হয়েছে—কবির জগত দেখার অভিনবত্বে, জীবন দর্শনে খেয়ালি অথচ গভীর এক মেজাজে, পরিশীলিত শব্দ ব্যবহার করে বাক্যকে ক্ষুরধার করার সচেতন প্রয়াস বা দক্ষতায়; যার সর্বশেষ বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে প্রতি-কবিতার ঢঙে নানান মাত্রার কারুণ্য, কৌতুকপূর্ণতা ও সময়ের বা নিজস্ব অস্থিরতার সুসংহত অভিব্যক্তির মধ্য দিয়ে। সব মিলিয়ে তা নিঃসন্দেহে কবির শক্তি হিসেবেই বিবেচনা করব বা করতে বাধ্য।

‘ধান সোনালি হলো, কৃষক স্বর্ণকার হলো না।’

‘রাস্তার পাশে গাছ হয়নি, রাস্তাই হয়েছে গাছের পাশে।’

‘বৃষ্টির একটি ফোঁটা কাঁটাতারে কেটে দ্বি-খণ্ডিত হয়ে জল ও পানি হয়ে যায়।’

বাস্তবতার সংজ্ঞা কী? আমাদের চারপাশের প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়াই কী বাস্তবতা? সেও একেকজনের চোখে একেকরকম। এইক্ষেত্রে জীবন ও জগতের বাস্তবতা কবির হোসেনের চোখে কিরকম অদ্ভুত সুন্দর কায়দায় ধরা পড়েছে তার প্রশংসা না করলেই নয়। কৃষকের স্বর্ণকার না হয়ে ওঠার রূপক—কয়েকটি শব্দমাত্র, অথচ কৃষকের আস্ত জীবনটাকেই একবাক্যে তুলে আনা কিংবা একটি বাক্যেই কাঁটাতারের বিভেদ ও বৈষম্য স্পষ্ট দেখিয়ে দেবার ক্ষমতা—স্বীকার করছি, সচরাচর চোখে পড়ে না।

‘মা আঁচলের গিঁট থেকে টাকা বের করতে গিয়ে দেখেন সেখানে আমি লুকিয়ে আছি।’

‘পাখির একটি ডিম রোপণ করেছিলাম উর্বরে—গাছ হয়ে উড়ে গেছে আকাশে।’

প্রকাশকঃ চন্দ্রবিন্দু

এরকম বুদ্ধিদীপ্ত, চমকপ্রদ ও দূরদর্শী একেকটা বাক্য পাঠ করতে করতে পাঠকের নিজস্ব বাস্তবতা বা বইটির প্রতি পূর্ব-নির্ধারিত ধারণা বা আকাঙ্ক্ষাকে মুছে দিয়ে কবির নির্মিত এক বাস্তবতায় টেনে নিয়ে যায়, এবং অসংখ্য নতুন অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে, বিস্ময় ও আনন্দ নিয়ে পাঠককে যাত্রা করতে হয় বাকিটা বই।

নতুন কী পেলাম?

‘নদীর পাশেই একটি পুকুর— অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে।’

‘ঘরে আমাদের জায়গা সংকট বলে, মা বেলুন দিয়ে রুটির মতো মানচিত্রটা ডলেন।’

‘জেলখানার ভেতরেও গাছ হয়, জন্মানোর অপরাধে।’

কোনো কবিতাকে সাহিত্যে সম্পূর্ণ নতুন বলা এক প্রকার দুঃসাহস ও ধৃষ্টতা। তাই আমিও এখানে ‘নতুন’ শব্দটির অপপ্রয়োগ করব না। বইয়ের কবিতায় ব্যবহৃত জগত ও দৃশ্য যে নতুন, এমন তো নয়। পরিচিত শব্দ, কল্প, দৃশ্যকে নতুন বোধের চরমে পৌঁছে দেবার যে ধাক্কাটা, তা নতুন—মেনে নিতেই হয়। পুকুরকে পারসোনিফাই করার কল্পনাশক্তি নতুন নয়, তার অস্তিত্বসঙ্কটে ভোগার ফলে সহমর্ম জাগানোর কৌশল নতুন। জেলখানার ভেতরে গাছ জন্ম তো নিতেই পারে, কিন্তু তার কারণ দর্শানো নতুন। বেলুন দিয়ে মায়ের এই মানচিত্র ডলে বড় করার ইমেজটি নিছক খেয়ালি চিত্র না, বরং তা নতুন এবং সাহিত্যের বাস্তবতায় বাস্তব। এমন আরো অসংখ্য কবিতাই নতুনত্বের স্বাদ নিয়ে হাজির হয়। 

তবে এও মনে রাখা জরুরি, নতুনকে জানতে গেলে তাকে নতুন হিসেবেই মেনে নিতে হবে এবং পুরনো ধারণাকে সাময়িক অবসর দিতেই হবে। নয়তো তা পুরনোরই পুনঃ উপলব্ধি হবে। সেই অর্থে পাঠককে বইটির নতুন অভিজ্ঞতা উপহার দেবার ক্ষেত্রে কবির হোসেন সার্থক। এবং সহজ অথচ গভীর হয়ে ওঠা কবিতাগুলোতে মুগ্ধ হতে বাড়তি কোনো প্রস্তুতি বা কসরতেরই প্রয়োজন পড়েনি তা নির্দ্বিধায় বলতে পারি।

‘আটকে যাওয়া চতুর ব্যাঙের মত কুয়ার দুরবিনে আকাশ দেখি।’

এভাবে কুয়ার তলা থেকে কুয়াটাকে দুরবিনের উপমার আইডিয়া যে কোনো  পাঠককেই নড়েচড়ে বসতে বাধ্য করবে বলে মনে করি। এবং মনে করি এরকম আরো অসংখ্য বাক্যই পাঠককে ভিন্ন মাত্রার পার্সপেক্টিভ ধরিয়ে দেয়—

‘যে কচুপাতাটি এক ফোঁটা বৃষ্টিও নিতে চাইতো না, তাকেই দেখলাম নদীতে ভাসছে।’

‘জলপট্টিতে জ্বর সারলো, কপাল সারলো না!’

‘মাছ, তোমার দেহে এতো কাঁটা, বিঁধে না?’

‘রেসে প্রথম হওয়া ঘোড়ার বিরুদ্ধে পেট্রোল পানের অভিযোগ আছে।’

‘দর্জির চোখে সবকিছুই ছেঁড়া ছেঁড়া লাগে।’

আবার— “নিজেকে নক করে দেখেছি, ভেতরে কেউ নেই।” এরকম কিছু কবিতা পড়তে পড়তে মনে হবে কবি বুঝি শুধু গিমিকই করতে চেয়েছেন।

খুঁড়তে খুঁড়তে নিজের ভেতরে শেষমেশ কে থাকে আর? এক নিরেট শূন্যতা—অথচ সে শূন্যতাভর্তি ‘আছি’ জানান দেয়া এক সত্তা। যাকে কবি হয়তো বাহ্যিক জগতের অভিজ্ঞতায় ‘কেউ না’ বলেই মেনে নিয়েছেন। কিন্তু আসলে কি তাই? এইদিক থেকে কবি খুব বেশি তত্ত্ব জিজ্ঞাসায় যাননি, বাক্যগুলোতে সরল দর্শন রয়েছে কিন্তু তার কচলাকচলি করেননি।

ভালো লেগেছে কবির কথার মারপ্যাঁচ [Pun/ শ্লেষালংকার] ব্যবহারের স্মার্টনেস—

‘ঠোঁটকাটা মেয়েরা দারুণ চুমু খেতে জানে।’

‘কত সের কথা দিলে, বলো, এক মন পাওয়া যায়!’

আবার—

“কানে তার গোলাপফুল—শরীরভর্তি কাঁটা!”— এরকম রূপকের সার্থক সব ব্যবহারে কবিতাগুলো পাঠের আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হয়।

সম্পূর্ণ বইতে স্পষ্ট যে দিক চোখে পড়ে তা হলো, কবির হোসেন প্রচলিত কবিতার ছন্দ বা ফর্মের তোয়াক্কা করেননি, এক বাক্যের কবিতায় কোনো বাক্যকেই জটিল করে তোলেননি। তাঁর উদ্দেশ্য সাবলীল অথচ তাৎপর্যপূর্ণতার মধ্য দিয়ে পাঠকের মনোজগতকে নাড়া দিয়ে যাওয়া। এবং এক্ষেত্রে একজন শক্তিমান ও প্রতিশ্রুতিশীল কবি হিসেবে কবির হোসেন সফল এবং তাঁকে ধন্যবাদ চমৎকার একটি বই পাঠকদের উপহার দেবার জন্য।


ক্ষুধার্ত মাছের স্বাদ / কবির হোসেন

প্রচ্ছদ : আল নোমান

চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন

মূল্য: ২৪০ টাকা

শেয়ার