ওরহান পামুক। তুরস্কের আধুনিক কথাসাহিত্যের বিশ্ব প্রতিনিধি। হতে চেয়েছিলেন চিত্রকর, কবি বাবার পথ ধরে শুরুতে কবিতাও লিখতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ২২ বছর বয়সে বাকীসব ছেড়ে উপন্যাস লেখা শুরু করেন। যা তাকে বিশ্বব্যাপি খ্যাতি দিয়েছে। ওরহান পামুকের সাহিত্যকর্ম ৪০টিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯৫২ সালের ৭ জুন ইস্তানবুলে সম্ভ্রান্ত এক পরিবারে জন্ম নেয়া ওরহান পামুক যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক হিসাবেও দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ‘পোস্টমডার্ন সাহিত্য আন্দোলন’র সঙ্গেও যুক্ত। পামুকের বিখ্যাত বইগুলি হলো Cavdet Bey and His Sons, The White Castle, The Black Book, The New Life, My Name is Red, Snow, Istanbul: Memories and the City, The Museum of Innocence ও A Strangeness in My Mind. সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি হিসাবে বেশ কটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। সবচেয়ে বড়টি, অর্থাৎ নোবেল পুরস্কার পান ২০০৬ সালে। এই সাক্ষাৎকারটি প্যারিস রিভিউতে প্রকাশ হয় তার আগের বছর। অ্যাংহেল হুয়েরেরেয়া-কুইন্তানার নেয়া সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে পামুকের জীবন-দর্শন, লেখক পামুকের চিন্তাধারা, তুরস্কের ইতিহাস ও প্রাচ্য-পাশ্চাত্য বিষয়ক অস্থিরতাসহ নানান বিষয়। ২০০৫ সালে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারটি শিরিষের ডালপালার জন্য অনুবাদ করেছেন নীলাঞ্জনা অদিতি।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমার রাজনৈতিক মন্তব্যের কারণে আমি কুখ্যাত – যার বেশিরভাগই আন্তর্জাতিক সাক্ষাতকার থেকে নেয়া আর তার্কিশ জাতীয়তাবাদী সাংবাদিক দ্বারা খুব নির্লজ্জভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল, যাতে আমাকে খুব গোঁড়া বা আমি যতটা না তার থেকে রাজনৈতিকভাবে মূর্খ প্রমাণ করা যায়।
ইন্তানাঃ সাক্ষাতকার দিতে কেমন লাগে?
পামুকঃ আমার কখনো কখনো বিচলিত লাগে কারণ আমি কিছু যুক্তিহীন প্রশ্নের বোকা বোকা উত্তর দেই। এটা ইংরেজির তুলনায় তার্কিশ এ বেশি হয়। আমি খুব বাজে তার্কিশ বলি আর বোকা বোকা কথা বলি। তুরস্কে আমাকে আমার বই থেকে সাক্ষাতকারের জন্য বেশি আক্রমণ করা হয়েছে। রাজনৈতিক-তার্কিকরা বা কলামিস্টরা সেখানে গল্প উপন্যাস পড়েন না।
কুইন্তানাঃ আপনি ইউরোপ আমেরিকা থেকে নিজের বইয়ের ক্ষেত্রে ইতিবাচক সাড়া পেয়েছেন। তুরস্কে কেমন সমালোচক ছিল?
পামুকঃ ভাল বছরগুলি ফুরিয়ে গেছে। আমি যখন আমার প্রথম দিকের বইগুলি প্রকাশ করছিলাম, লেখকদের আগের প্রজন্ম হারিয়ে যাচ্ছিল, কাজেই আমাকে স্বাগত জানানো হয় কারণ আমি নতুন লেখক ছিলাম।
কুইন্তানাঃ আপনি যখন আগের প্রজন্মের কথা বলেন কার কথা মনে আসে?
পামুকঃ যেসব লেখকরা সামাজিক দায়িত্ববোধসম্পন্ন, যেসব লেখকরা অনুভব করেন সাহিত্য নৈতিকতা ও রাজনীতির উদ্দেশ্য সাধন করে। তারা নিরস বাস্তববাদী ছিলেন, পরীক্ষামূলক না। অন্য অনেক দরিদ্র দেশের লেখকদের মতো তারা দেশের সেবায় মেধা নষ্ট করেছেন, আমি তাদের মতো হতে চাইনি কারণ এমনকি আমার যৌবনেও আমি ফকনার, ভার্জিনিয়া উলফ, প্রাউস্ট উপভোগ করেছি। আমি কখনো স্টেইনবেক বা গোর্কির সামাজিক বাস্তববাদী মডেলের প্রতি তাড়িত হইনি। ষাট সত্তর দশকের সাহিত্য সেকেলে হয়ে যাচ্ছিল, কাজেই নতুন প্রজন্মের লেখক হিসেবে আমাকে স্বাগত জনানো হয়।
মধ্য ৯০ এর পরে আমার বইগুলো যখন এত বিক্রি হতে শুরু করে যা তার্কিশরা স্বপ্নেও ভাবেনি, তার্কিশ সংবাদপত্র ও বুদ্ধিজীবিদের সাথে আমার মধুচন্দ্রিমার মতো দিনগুলো শেষ হয়ে গেছিল। তখন থেকে সমালোচনা আমার বই এর বিষয়ের চেয়ে হতো মূলত প্রচার ও বিক্রির উপর। এখন দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমার রাজনৈতিক মন্তব্যের কারণে আমি কুখ্যাত – যার বেশিরভাগই আন্তর্জাতিক সাক্ষাতকার থেকে নেয়া আর তার্কিশ জাতীয়তাবাদী সাংবাদিক দ্বারা খুব নির্লজ্জভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল, যাতে আমাকে খুব গোঁড়া বা আমি যতটা না তার থেকে রাজনৈতিকভাবে মূর্খ প্রমাণ করা যায়।
কুইন্তানাঃ মানে আপনার জনপ্রিয়তার প্রতি নিষ্ঠুর প্রতিক্রিয়া হয়?
পামুকঃ এ ব্যপারে আমার দৃঢ় মতামত হলো এটা আমার বইয়ের বিক্রির অনুপাত আর রাজনৈতিক মন্তব্যর প্রতি অনেকটা শাস্তির মত। কিন্তু আমি এই কথা বলা চালিয়ে যেতে চাই না, কারণ শুনতে রক্ষনাত্মক লাগে। আমি হয়ত পুরো চিত্রটার ভুল চিত্রায়ণ করছি।
কুইন্তানাঃ আপনি কোথায় লেখেন?
পামুকঃ আমি সবসময় ভেবেছি, যেখানে আপনি ঘুমান বা কারো সাথে ভাগ করেন সেই জায়গাটা আর লেখালেখির জায়গাটা আলাদা থাকা উচিত। ঘরের নিয়ম-কানুন কল্পনাশক্তিকে হত্যা করে। তারা আমার ভেতরের দৈত্যকে হত্যা করে। ঘরের দৈনন্দিন কাজগুলো অন্য দুনিয়ার প্রতি আমাদের আকাঙক্ষা তৈরী করে, যা আমাদের কল্পনাশক্তি দ্বারা পরিচালিত হওয়া দরকার। কাজেই অনেক বছর যাবত আমার একটা অফিস ছিল অথবা বাসার বাইরে ছোট্ট জায়গা ছিল কাজ করার। আমার সবসময় আলাদা বাড়ি ছিল।
কিন্তু একবার আমি আমেরিকায় আমার অর্ধেক সেমেস্টার কাটিয়েছিলাম যখন আমার সাবেক স্ত্রী কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করছিলেন। আমরা এমন বাড়িতে থাকতাম যা বিবাহিত ছাত্রদের জন্য আর আমাদের কোন জায়গা ছিল না। কাজেই যেখানে ঘুম সেখানেই লিখতে হতো। পারিবারিক জীবনের চিহ্ন সব দিকে। এটা আমাকে বিষণ্ন করতো। সকালে আমি স্ত্রীকে শুভ সকাল বলতাম যেন কেউ কাজে যাচ্ছে। আমি বাইরে যেতাম কিছু দূর হাঁটতাম আর ভাবতাম যেন অফিসে পৌঁছে গেছি।
দশ বছর আগে আমি একটা বাসা পেয়েছিলাম পুরান শহরের দৃশ্যসহ। এটা সম্ভবত ইস্তাম্বুল এর অন্যতম শ্রেষ্ঠ দৃশ্য। আমার বাসা থেকে ২৫ মিনিটের হাঁটা পথ। বই-এ ঠাসা আর টেবিল বাইরের দিকে মুখ করা। সেখানে আমি প্রতিদিন আনুমানিক দশ ঘণ্টা কাটাই।
কুইন্তানাঃ দিনে ১০ ঘণ্টা?
পামুকঃ হ্যাঁ, আমি পরিশ্রমী। আমি এটা উপভোগ করি। লোকে বলে আমি উচ্চাকাঙ্ক্ষী, আর হয়ত এই কথায় সত্যতা আছে। কিন্তু আমি আমার কাজকে ভালবাসি। আমি টেবিলে বাচ্চারা যেমন খেলনা দিয়ে খেলে তেমন টেবিলে বসতে উপভোগ করি। প্রয়োজনে এটা কাজ, কিন্তু এটা মজার খেলাও।
কুইন্তানাঃ ওরহান, আপনার মিতা এবং স্নো-এর কথক নিজেকে ক্লার্ক হিসেবে বর্ণনা করেন যিনি প্রতিদিন একই টাইমে বসেন। আপনি কি লেখালেখির ক্ষেত্রেও একই নিয়ম অনুসরণ করেন?
পামুকঃ কবি হওয়া জনপ্রিয় ও সম্মানিত হবার মতো ব্যপার। অটোমান সাম্রাজ্যের বেশিরভাগ সুলতান ও রাষ্ট্রনায়ক কবি ছিলেন। কিন্তু আমরা যেভাবে কবিদের এখন বুঝি সেভাবে না। ১০০ বছর ধরে এটা ছিল নিজেকে বুদ্ধিজীবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার একটা রাস্তা। বেশিরভাগ তাদের কবিতা পাণ্ডুলিপিতে লিখতেন যাকে ডিভান বলে। আসলে, অটোমান কোর্ট-এর কবিতাকে ডিভানের কবিতা বলে। অর্ধেক অটোমান অধিপতি ডিভান রচনা করতেন। এটা ছিল লেখালেখির ক্ষেত্রে পরিশিলীত ও শিক্ষণীয় রাস্তা যেখানে অনেক নিয়ম সংস্কার ছিল। খুব প্রচলিত ও খুব পুনরাবৃত্তিমূলক। তুরস্কে পশ্চিমা চিন্তা আসার পরে, এই উত্তরাধিকার কবির প্রেম ও আধুনিক চিন্তার সংমিশ্রন- যিনি সত্যির জন্য দগ্ধ হন। এটা কবির সম্মানে বাড়তি ওজন যোগ করে। অপরদিকে একজন ঔপন্যাসিক স্বভাবতই এমন কেউ যে ধৈর্যের সাথে দূরত্ব মেটান খুব ধীরে, পিঁপড়ার মতো। একজন ঔপন্যাসিক আমাদের পরাবাস্তব বা প্রেমময় দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে মুগ্ধ করেন না, ধৈর্য দিয়ে করেন।
কুইন্তানাঃ আপনি কি কখনো কবিতা লিখেছেন?
পামুকঃ আমাকে প্রায়ই লিখতে বলা হয়। লিখেছিলাম ১৮ বছর বয়সে আর তার্কিশে কিছু কবিতা ছাপিয়েছিলাম, কিন্তু তারপর ছেড়ে দেই। আমার কথা হলো আমি বুঝতে পারলাম কবি হচ্ছেন এমন কেউ যার মাধ্যমে ঈশ্বর কথা বলেন। কবিতার অধিকারে থাকতে হবে আপনাকে। আমি কবিতা লিখতে চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু কিছুদিন পর বুঝতে পারলাম ঈশ্বর আমার সাথে কথা বলছিলেন না। এ ব্যপারে আমার মন খারাপ ছিল তারপর আমি ভাবার চেষ্টা করলাম – ঈশ্বর যদি আমার সাথে কথা বলতেন, কি বলতেন? আমি খুব সতর্ক হয়ে লেখা শুরু করলাম, ধীরে ধীরে, সমাধানের খোঁজে। এটা ছিল গদ্য লেখা, গল্প লেখা। কাজেই আমি ক্লার্কের মতো কাজ করেছিলাম। অন্য লেখকরা এটাকে অপমান হিসেবে নিয়েছিলেন। কিন্তু আমি মেনে নিয়েছিলাম; আমি কেরানির মতো কাজ করি।
কুইন্তানাঃ আপনি কি বলতে চান আপনার ওভারটাইমের কারণে গদ্য লেখা সহজ ছিল?
পামুকঃ দূর্ভাগ্যবশতঃ না। মাঝেমাঝে মনে হয় আমার চরিত্রের রুমের ভেতরে ঢোকা উচিত আর আমি এখনো জানি না কিভাবে ঢোকাব। আমার হয়ত অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাস আছে, যেটা অনেক সময় অসহায়ক হয় কারণ তখন আপনি পরীক্ষা করছেন না , কলমের আগায় যা আসছে সেটাই লেখেন। আমি গত ত্রিশ বছর যাবত গল্প লিখছি, কাজেই আমার ভাবা উচিত অল্প হলেও উন্নতি করেছি। আর এখনো মনে হয় আমি খাদের কিনারে চলে এসেছি এমন কোন চরিত্র হবে না। চরিত্র রুমের ভেতরে ঢুকতে পারবে না আর আমি জানি না কি করব। এখনো! এই ত্রিশ বছর পরেও।
আমার চিন্তাধারার জন্য বই-এর অধ্যায়ে ভাগ হওয়া খুব গুরুত্বপুর্ণ। উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে আমি যদি আগেই গল্পের প্রেক্ষাপট জেনে যাই – বেশির ভাগ সময় তাই হয় – আমি অধ্যায়ে ভাগ করি আর প্রতিটা অধ্যায়ে কি হবে তার খঁটিনাটি চিন্তা করি। আমি প্রথম অধ্যায় থেকে সব ধারাবাহিকভাবে লিখি না। যখন আমার লেখার ক্ষমতা থাকে না, যেটা আমার ক্ষেত্রে খুব একটা বিরল না, আমি তাই লিখতে থাকি যা কল্পনায় আসে। আমি হয়ত প্রথম থেকে পঞ্চম অধ্যায় অব্দি লিখি, তারপর যদি দেখি ভাল লাগছে না আমি ১৫ নাম্বার অধ্যায় থেকে শুরু করি।
কুইন্তানাঃ তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন আপনি আগেই বইয়ের চেহারা আঁকেন?
পামুকঃ সবকিছুই। উদাহরণস্বরূপ My Name Is Red-এ অনেকগুলো চরিত্র আর প্রত্যেক চরিত্রে আমি কয়েকটা অধ্যায় নির্ধারন করেছিলাম। যখন লিখছিলাম কখনো কখনো আমি একটা চরিত্র হতে চেয়েছি। কাজেই আমি যখন Shekure এর একটা অধ্যায় শেষ করেছি, হয়ত সপ্তম অধ্যায়, আমি একাদশ অধ্যায়ে চলে গেছি, যেটা আবার তার অধ্যায়। আমি Shekure হওয়া উপভোগ করেছিলাম। এক চরিত্র বা ব্যক্তিত্ব থেকে আরেকটাতে যাওয়া হতাশাজনক হতে পারে।
কিন্তু শেষ অধ্যায়টা সবসময় শেষে লিখি। এটা নির্ধারিতই। শেষটা কেমন হবে আমি এই নিয়ে নিজেকে খোঁচাতে, জিজ্ঞেস করতে পছন্দ করি। আমি একবারই সমাপ্তি সাজাতে পারি। শেষ করার আগে, সমাপ্তির দিকে আমি থামি আর আগের বেশির ভাগ অধ্যায়গুলো পুনরায় লিখি।
কুইন্তানাঃ আপনি যখন কাজ করেন, তখন পাঠক থাকে?
পামুকঃ আমি যার সাথে জীবনকে ভাগ করে নেই, তাকে সবসময় লেখা পড়ে শোনাই। আমি সবসময় কৃতজ্ঞ থাকি যদি সে বলে আমাকে আরো দেখাও, অথবা দেখাও আজ কি করেছ। এটা আসলে শুধু প্রয়োজনীয় চাপই দেয় না, এটা অনেকটা বাবা-মা যেমন পিঠ চাপড়ে সাবাশি দেয় তেমন । হঠাৎ হঠাৎ হয়ত সে বলবে, দুঃখিত আমি এটা কিনিনি। এটা ভাল। আমি এই নিয়ম পছন্দ করি।
আমার সবসময় থমাস মানের কথা মনে পড়ে, আমার অন্যতম আদর্শ। তিনি ওনার পুরো পরিবারকে একত্র করতেন, তার ৬ সন্তান ও স্ত্রী। পুরো পরিবারের সামনে তিনি পড়তেন। আমি এটা পছন্দ করি। বাবা গল্প পড়ছে।
কুইন্তানাঃ আপনি যখন ছোট ছিলেন, চিত্রকর হতে চেয়েছিলেন। চিত্রের প্রতি ভালবাসাটা লেখালেখিতে কবে পাল্টাল?
পামুকঃ ২২ বছর বয়সে। সাত বছর বয়স থেকে আমি চিত্রকর হতে চেয়েছিলাম আর আমার পরিবার মেনে নিয়েছিল। তারা ভেবেছিলেন আমি বিখ্যাত চিত্রকর হব। কিন্তু তারপর আমার মাথায় কি যে হলো, মনে হলো স্ক্রু ঢিলা হয়ে গেছে- আর আমি সাথে সাথে আঁকা বাদ দিয়ে আমার প্রথম উপন্যাস লিখতে শুরু করি।
কুইন্তানাঃ স্ক্রু ঢিলা ছিল?
পামুকঃ আমি বলতে পারব না এটা করার পেছনে কি কারণ ছিল। আমি সম্প্রতি ইস্তাম্বুল নামে একটা বই প্রকাশ করেছি। এর অর্ধেক হলো আমার আত্মজীবনী আর বাকি অংশ ইস্তাম্বুল সম্পর্কিত প্রবন্ধ, অথবা আরো স্পষ্টভাবে বললে ইস্তাম্বুল নিয়ে একটি শিশুর দৃষ্টিভঙ্গি। এটা শহরের রসায়ন আর চিত্র ও দৃশ্যকল্পের চিন্তার সংমিশ্রন, শহর নিয়ে শিশুর দৃষ্টিভঙ্গি আর শিশুর আত্মকাহিনী। সেই বই-এর শেষ লাইনে আছে “‘I don’t want to be an artist,’ আমি বলেছিলাম। ‘I’m going to be a writer.’” আর এই কথাটা বর্ণিত ছিল না যদিও- পুরো বই পড়লে হয়ত কিছু বোঝা যাবে।
কুইন্তানাঃ আপনার পরিবার কি আপনার এই সিদ্ধান্তে খুশি ছিল?
পামুকঃ আমার মায়ের মন খারাপ ছিল। আমার বাবা কিছুটা বুঝতেন তার যৌবনে তিনি কবি ছিলেন আর তার্কিশ ভাষায় ভ্যালেরি অনুবাদ করেছিলেন, কিন্তু যখন উচ্চবিত্ত মানুষের ঠাট্টার পাত্র হন, তখন ছেড়ে দেন যে শ্রেণির মানুষ তিনিও ছিলেন।
কুইন্তানাঃ আপনার পরিবার আপনাকে চিত্রকর হিসাবে মেনেছিল কিন্তু ঔপন্যাসিক হিসেবে নয়?
পামুকঃ হ্যাঁ, কারণ তারা ভাবেনি আমি পুরোদস্তুর চিত্রকর হব। আমার পরিবারের ঐতিহ্য হল সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং। আমার দাদু একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন যিনি রেলপথ বানিয়ে অনেক টাকা কামিয়েছেন। আমার চাচারা আর বাবা টাকা হারান কিন্তু তারাও একই ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলে গেছেন, ইস্তাম্বুল টেকনিক্যাল কলেজ। সবাই ভেবেছিল আমিও যাব আর আমি বলেছিলাম, ঠিক আছে আমি যাব। কিন্তু যেহেতু আমি পরিবারে শিল্পী ছিলাম, আমার আগ্রহ ছিল স্থাপত্যে। এটা সকলের কাছেই সন্তোষজনক ছিল। কাজেই আমি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু মাঝপথে আমি হঠাৎ আঁকা ছেড়ে দেই আর উপন্যাস লিখতে শুরু করি।
কুইন্তানাঃ আপনি যখন ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেন তখনি কি প্রথম উপন্যাসের কথা মনে আসে? এ জন্যই এমন করেন?
পামুকঃ আমার যতদূর মনে পড়ে যখন আমি জানতাম না কি লিখব, তখনি ঔপন্যাসিক হব ভেবেছিলাম। আসলে আমি যখন শুরু করি, দুই-তিনবার ভুল হয়েছিল শুরুটা। আমার এখনো নোটবুক আছে। কিন্তু প্রায় ৬ মাস পর আমি বড় ধরনের উপন্যাসের কাজে হাত দেই যেটা শেষ অব্দি Cevdet Bey and His Sons নামে প্রকাশ পায়।
কুইন্তানাঃ এটা ইংরেজিতে অনূদিত হয়নি।
পামুকঃ এটা আসলে পরিবারের কাহিনী যেমন Forsyte Sagaঅথবা থমাস মানের Buddenbrooks। লেখা শেষ করার অল্পদিনের মধ্যেই সেকেলে লেখা লেখার জন্য আমি অনুতাপ করতে লাগলাম, খুব বেশি ১৯ শতকীয় উপন্যাস ছিল। আমি এটা লিখে অনুতাপ করলাম কারণ ২৫- ২৬ বছর বয়সে আমি নিজের মধ্যে এই চিন্তা ঢোকাতে শুরু করলাম যে, আমার আধুনিক লেখক হওয়া উচিত।
কুইন্তানাঃ আপনি যখন বলেন আপনি আরো আধুনিক পরীক্ষামূলক হতে চেয়েছিলেন মনে কোন মডেলের নাম আসে?
পামুকঃ সে সময় আমার কাছে তলস্তয়, দস্তয়ভস্কি, স্তেনধাল আর থমাস মান দারুণ লেখক ছিলেন না। আমার নায়ক ছিলেন ভার্জিনিয়া উলফ ও ফকনার। এখন তালিকায় প্রাউস্ট আর নবোকভ-এর নাম যুক্ত করব।
আমার প্রথম বই প্রকাশের একমাত্র পথ ছিল তুরস্কে অপ্রকাশিত লেখাগুলোর প্রতিযোগিতায় লেখা দেয়া। আমি তাই করি ও পুরস্কার জিতি, যেটা বড়, ভাল প্রকাশক দ্বারা প্রকাশের কথা ছিল।
কুইন্তানাঃThe New Life এর প্রথম লাইনে আছে “I read a book one day and my whole life was changed.” এরকম কোন বইয়ের প্রভাব কি আপনার উপর পড়েছে?
পামুকঃ আমার যখন ২০- ২১ বছর বয়স, The Sound and the Fury বইটা আমার কাছে গুরুত্ববাহী ছিল। আমি পেঙ্গুইন সম্পাদনার এক কপি কিনেছিলাম। বুঝতে সমস্যা ছিল বিশেষত আমার দুর্বল ইংরেজির জন্য। কিন্তু তার্কিশ ভাষায় চমৎকার অনুবাদ ছিল, কাজেই আমি টেবিলে ইংরেজি আর তার্কিশ দুটাই রেখেছিলাম আর একটা থেকে অর্ধেক প্যারা পড়ে আরেকটায় ফিরতাম। এই বই আমার মধ্যে ছাপ রেখেছিল। বাকিটুকু ছিল আমার কণ্ঠ যার উন্নতি করেছিলাম। আমি খুব দ্রুত প্রথম পুরুষে লেখা শুরু করেছিলাম। বেশিরভাগ সময় আমি তৃতীয় পুরুষে না লিখে অন্য কারো ছদ্মবেশে লিখতে ভাল বোধ করি।
কুইন্তানাঃ আপনি বলতে চাচ্ছেন যে আপনার প্রথম উপন্যাস বেরোতে কয়েক বছর লেগেছে?
পামুকঃ ২০ বছর বয়সকালে আমার কোন সাহিত্যভিত্তিক বন্ধুত্ব ছিল না; ইস্তাম্বুলে কোন সাহিত্য দলও ছিল না। আমার প্রথম বই প্রকাশের একমাত্র পথ ছিল তুরস্কে অপ্রকাশিত লেখাগুলোর প্রতিযোগিতায় লেখা দেয়া। আমি তাই করি ও পুরস্কার জিতি, যেটা বড়, ভাল প্রকাশক দ্বারা প্রকাশের কথা ছিল। সে সময় তুরস্কের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ ছিল। তারা বলেছিল তারা চুক্তি করবে কিন্তু উপন্যাস প্রকাশে দেরি করে।
কুইন্তানাঃআপনার দ্বিতীয় বইটা কি দ্রুত আর সহজেই প্রকাশ পেয়েছিল?
পামুকঃ দ্বিতীয় বইটা রাজনৈতিক বই ছিল। কোন প্রচারণা ছিল না। প্রথম বই আসার অপেক্ষা করতে করতেই এটা লিখতে শুরু করি। এই বইয়ের পেছনে আড়াই বছর ব্যয় হয়। হঠাৎ এক রাতে সেনাবাহিনীর বিদ্রোহ হয়। এটা ছিল ১৯৮০ সাল। পরের দিন প্রথম বইয়ের ভাবি প্রকাশক জানান তিনি এই বই প্রকাশ করছেন না, যদিও আমাদের চুক্তি ছিল। আমি অনুভব করলাম যে আমি যদিও দ্বিতীয় বই শেষ করলাম- সেই রাজনৈতিক বই- সেদিন থেকে আগামী ৫-৬ বছর আমি বইটা প্রকাশ করতে পারব না কারণ সেনাবাহিনী অনুমতি দেবে না। কাজেই আমার চিন্তাধারা এমন ছিল- ২২ বছর বয়সে আমি বলেছিলাম, আমি ঔপন্যাসিক হতে যাচ্ছিলাম আর সাত বছর ধরে লিখছিলাম তার্কিশ-এ কিছু প্রকাশের আশায় … কিন্তু লাভ হয়নি। এখন আমার প্রায় ৩০ বছর বয়স আর কিছু প্রকাশের সম্ভাবনা নেই। এখনো আমার একটা ড্রয়ারে আমার অসম্পূর্ণ রাজনৈতিক উপন্যাসের ২৫০ পৃষ্ঠার মতো আছে।
সেনাবাহিনীর বিদ্রোহের পরপরেই আমি তৃতীয় বই লিখতে শুরু করি, কারণ আমি হতাশ হতে চাচ্ছিলাম না। আপনি যে বই-এর কথা উল্লেখ করলেন, The Silent House । এইটা সেই বই যার উপর আমি ১৯৮২ সালে কাজ করছিলাম, যখন প্রথম বই অবশেষে প্রকাশিত হয়। Cevdet ভাল গ্রহণযোগ্যতা পায় যার মানে যখন লিখছিলাম তখনি প্রকাশ করা যেত। কাজেই আমার তৃতীয় লিখিত বইটাই দ্বিতীয় বই হিসেবে প্রকাশিতব্য ছিল।
কুইন্তানাঃ সামরিক শাসনব্যবস্থায় কেন আপনার লেখা প্রকাশের অযোগ্য হলো বলে মনে করেন?
পামুকঃ চরিত্রগুলো ছিল উচ্চবিত্তের তরুন মার্ক্সবাদী। তাদের মা-বাবা গ্রীষ্মকালীন অবকাশে যেতেন। তাদের বড় বাসা ছিল আর মার্ক্সবাদী হওয়াটা তারা উপভোগ করত। তারা একে অন্যের সাথে লড়াই ও হিংসা করত আর প্রধানমন্ত্রীকে অপমানের ছক কষত।
কুইন্তানাঃ সোনালী বৈপ্লবিক বৃত্ত?
পামুকঃ উচ্চবিত্তের তরুণরা যাদের ধনীদের মতো অভ্যাস তারা ভাব দেখায় যে তারা মাত্রাধিক চরমপন্থী। কিন্তু আমি সেই ব্যপারে নীতিগত বিচার করছি না। বরং, আমি আমার যৌবনের সময় নিয়ে কল্পনা করছিলাম। বই নিষিদ্ধের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীকে বোমা ছোঁড়ার চিন্তা যথেষ্ট ছিল ।
কাজেই আমি এটা শেষ করিনি। আর বই লেখার সাথে সাথে আপনি বদলান। আপনি আবার সেই ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে অনুমান করতে পারেন না। আপনি আগের মতো চলতেও পারেন না। লেখকের লেখা প্রতিটা বইতে তার উন্নতির সময় ফুটে ওঠে। কারো উপন্যাস তার উন্নতির একটা নতুন দিক উন্মোচন করতে পারে। কাজেই আপনি ফিরে যেতে পারেন না। একবার গদ্যের স্থিতিস্থাপকতা মরে গেলে আর জাগাতে পারেন না।
কুইন্তানাঃ আপনি যখন নানা ধরনের ভাবনা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন, উপন্যাসের ধরণ কিভাবে নির্বাচন করেন? আপনি কি একটা অবয়ব দিয়ে শুরু করেন, প্রথম বাক্য দিয়ে?
পামুকঃ কোন স্থায়ী ফর্মুলা নেই। কিন্তু এভাবেই আমি আমার কাজ করে নিয়েছি যে দুটা উপন্যাস একই ধরন হবেনা। আমি সবকিছু বদলানোর চেষ্টা করি। এই কারণেই আমার অনেক পাঠক আমাকে বলেন যে, আপনার এই উপন্যাসটা আমার ভাল লেগেছিল, আপনি যে এমন উপন্যাস আর লিখেন না এটা লজ্জার অথবা আপনি না লেখা অব্দি আমি উপন্যাস উপভোগ করি না – আমি এ ব্যপারে শুনেছি বিশেষতঃ The Black Book সম্পর্কে । আসলে আমি এটা শুনতে ঘৃণা করি। এটা মজার বিষয়, আর একটা চ্যালেঞ্জ, ধরন আর ভঙ্গিকে নিয়ে- ভাষা, ভাব ও ব্যক্তিত্ব নিয়ে পরীক্ষার, আর প্রতিটা বই নিয়ে আলাদাভাবে ভাবারও।
বইয়ের বিষয়বস্তু নানাভাবে আমার কাছে আসতে পারে। My Name Is Red এ আমি চিত্রকর হিসেবে আমার উচ্চাশা তুলে ধরতে চেয়েছিলাম। আমার শুরুটা ভুল ছিল; আমি একটা তথ্যভিত্তিক বই লিখতে শুরু করি যা একজন চিত্রকরের উপর। তারপর আমি সেই চিত্রকরকে আরো চিত্রকরদের মত বদলে ফেলেছি যারা শিল্পশালায় একসাথে কাজ করেন। দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যায়, কারণ অন্য শিল্পীরা কথা বলেন। প্রথমে আমি সমসাময়িক চিত্রকরের কথা লিখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পরে মনে হলো এই তার্কিশ চিত্রকর হয়ত বেশি অমৌলিক হতে পারেন, পাশ্চাত্য দ্বারা প্রভাবিত হতে পারেন, কাজেই আমি চিত্রাঙ্কনকারীদের কাছে ফিরে গেলাম লেখার জন্য। এভাবেই বিষয় খুঁজে পাই।
কিছু বিষয়ের কিছু নির্দিষ্ট আবিস্কার অথবা গল্প বলার রূপকল্পের দরকার থাকে। যেমন ধরুন, আপনি হয়ত মাত্রই কিছু দেখলেন, অথবা পড়লেন, অথবা সিনেমায় গেলেন, অথবা সংবাদপত্র কিছু পড়লেন, তারপর ভাবেন, আমি আলুকে দিয়ে, কুকুরকে দিয়ে গাছকে দিয়ে কথা বলাব। একবার চিন্তাটা পেয়ে গেলে আপনি উপন্যাসের সামঞ্জস্যতা আর ধারাবাহিকতার কথা ভাবেন। এটা আপনার মধ্যে ভাললাগার অনুভূতি তৈরী করে যে এমন কেউ আগে করেনি।
পরিশেষে, আমি এই সব নিয়ে বছরের পর বছর ভেবেছি। আমার কোন চিন্তা এলে আমি আমার কাছের বন্ধুদের জানাই। আমি প্রচুর নোটবই রাখি সম্ভাব্য উপন্যাস লেখার জন্য। মাঝেমাঝে লিখি না, কিন্তু যদি নোটবই খুলি, আর নোট নিতে শুরু করি, তার মানে আমি সেই উপন্যাসটা লিখব। কাজেই যখন একটা উপন্যাস শেষ করছি, হয়ত আমার মনটা ওখানেই পড়ে থাকে; আর একটা শেষ করার দুই মাস পর আরেকটা লিখতে শুরু করি।
বোর্হেস এবং ক্যালভিনো আমাকে স্বাধীন করেছিল। চিরায়ত ইসলামিক সাহিত্যের সংজ্ঞা খুব প্রতিক্রিয়াশীল, রাজনৈতিক, আর গোঁড়াদের দ্বারা খুব পুরানো ও বোকাবোকা উপায়ে ব্যবহৃত, যার কারণে আমি কখনো ভাবিনি এইটা দিয়ে কিছু করতে পারব।
কুইন্তানাঃ অনেক ঔপন্যাসিক চলমান কাজ নিয়ে কখনো আলোচনা করেন না। আপনিও কি সেগুলো গোপন রাখেন?
পামুকঃ আমি কখনো গল্প নিয়ে আলোচনা করি না। কোন অনুষ্ঠানে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে আমি কি লিখছি, আমি খালি উত্তরে একটা কথাই বলিঃ সমসাময়িক তুরস্কের উপর আবর্তিত উপন্যাস। আমি খুব অল্প লোকের সামনে বিস্তারিত বলি শুধু যখন জানি তারা আমাকে আঘাত দিবে না। আমি যেটা করি চমক নিয়ে কথা বলি – আমি মেঘকে দিয়ে কথা বলাব, উদাহরস্বরূপ। মানুষ এতে কি প্রতিক্রিয়া দেখায় আমি দেখতে চাই। এটা শিশুতোষ। Istanbul লেখার সময় এমন প্রচুর করেছি। আমার মন অনেকটা সেই দুরন্ত বাচ্চার মতো হয় যে তার বাবাকে দেখাতে চায় সে কত চালাক।
কুইন্তানাঃ চমকের তো একটা নেতিবাচক সংজ্ঞা আছে।
পামুকঃ আপনি চমক দিয়ে শুরু করেন। কিন্তু আপনি যদি এর সাহিত্যমান ও নৈতিকতায় বিশ্বাস করেন , শেষ অব্দি এটা সাহিত্যকর্ম হিসাবে রূপ নেবে। এটা সাহিত্যভিত্তিক বাণী হয়ে যায়।
কুইন্তানাঃ সমালোচকরা প্রায়ই আপনার উপন্যাস কে উত্তরাধুনিক বলে অভিহিত করে। এটা আমার কাছে অনেকটা বর্ণনার কৌশল- আপনি আঁকেন প্রাথমিকভাবে কোন প্রাচীন সূত্র থেকে। আপনি উদাহরনস্বরূপ The Thousand and One Nights থেকে অথবা প্রাচ্যের অন্য কোন কালজয়ী বই থেকে উদ্ধৃত করেন।
পামুকঃ এটা শুরু হয়েছিল The Black Book দিয়ে, যদিও আমি Borges, Calvino আগে পড়েছি। আমি আমেরিকায় স্ত্রীসহ গিয়েছিলাম ১৯৮৫ সালে, এবং সেখানেই আমি প্রথম আমেরিকান সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য ও বিপুল সম্ভারের মুখোমুখি হই। যেহেতু মধ্যপ্রাচ্য থেকে এসে নিজেকে লেখক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছিলাম, আমি ভীত অনুভব করছিলাম। কাজেই আমি ফিরলাম, শেকড়ে ফিরে গেলাম। আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমার প্রজন্মকে আধুনিক জাতীয় সাহিত্য আবিস্কার করতেই হবে।
বোর্হেস এবং ক্যালভিনো আমাকে স্বাধীন করেছিল। চিরায়ত ইসলামিক সাহিত্যের সংজ্ঞা খুব প্রতিক্রিয়াশীল, রাজনৈতিক, আর গোঁড়াদের দ্বারা খুব পুরানো ও বোকাবোকা উপায়ে ব্যবহৃত, যার কারণে আমি কখনো ভাবিনি এইটা দিয়ে কিছু করতে পারব। কিন্তু আমেরিকা থাকাকালীন আমি অনুভব করলাম আমি বোর্হেস ও ক্যালভিনোর মানসিকতা নিয়ে সেখানে ফিরতে পারতাম, ইসলামী সাহিত্যের ধর্মীয় ও সাহিত্যিক সংজ্ঞার মধ্যে শক্তিশালী বিভেদ তৈরীর মাধ্যমে আমাকে শুরু করতেই হতো- যাতে আমি সহজেই এর খেলা, চমক ও দৃষ্টান্তের যথাযোগ্য মূল্য দিতে পারি।
বিভিন্ন মৌখিক গল্প বলার ঐতিহ্যের মধ্যে- যেমন চায়না, ভারত, পার্সিয়া- অনেক রূপক আছে যা ফিরে ফিরে আসে। আমি সেগুলো দেখার এবং সমসাময়িক ইস্তাম্বুলকে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। এটা একটা পরীক্ষা– সবকিছু একসাথে রেখে, Dadaist collage এর মতো; The Black Book এর এই গুণ আছে। কখনো কখনো এসব সূত্র মিলিত হয়ে নতুন কিছু উঠে আসে। আমি এসব পুনর্লিখিত গল্প ঠিক করে একটা রহস্যময় প্লট যোগ করি। এভাবেই The Black Book বেড়িয়ে আসে। কিন্তু এর সূত্র ছিল আমেরিকান সংস্কৃতির পূর্ণশক্তি আর আমার ইচ্ছা ছিল ভাল নীরিক্ষাধর্মী লেখক হবার। আমি তুরস্কের সমস্যা নিয়ে সামাজিক বিবরণ লিখতে পারতাম না– আমি এসবে ভয় পেতাম। কাজেই অন্য কিছু চেষ্টা করতেই হতো।
কুইন্তানাঃ আপনি কি কখনো সাহিত্যের মাধ্যমে সামাজিক ভাষ্য প্রদানে আগ্রহী হয়েছিলেন?
পামুকঃ না। আমি ঔপন্যাসিকদের বয়স্ক প্রজন্ম নিয়ে প্রতিক্রিয়া দিচ্ছিলাম, বিশেষত আশির দশকের। আমি পূর্ণ সম্মানের সাথে জানাচ্ছি, কিন্তু তাদের বিষয় খুব সীমাবদ্ধ ও সংকীর্ণ।
কুইন্তানাঃThe Black Book এর আগের সময়টাতে ফেরা যাক। The White Castle লিখতে আপনাকে কি অনুপ্রেরণা দিয়েছিল? এটা প্রথম বই যেখানে আপনি এমন একটা থিম ব্যবহার করেছেন যা আপনার বাকি সব উপন্যাসেই পুনরাবৃত্ত হয়েছে – ছদ্মবেশ। আপনার গদ্যে প্রায়ই এই অন্য কেউ হয়ে যাওয়ার চিন্তাটা কেন ঘুরেফিরে আসে বলে মনে হয়?
পামুকঃ এটা খুব ব্যক্তিগত ব্যপার। আমার সাথে প্রতিযোগিতা হয় এমন ভাই আছে যে আমার থেকে ১৮ মাসের বড়। এক অর্থে, সে আমার বাবা ছিল- বলা ভাল আমার ফ্রয়েডিয়ান পিতা। সে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে গেছিল, ক্ষমতার প্রতিনিধি। অপর দিকে, আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ন ও ভাতৃত্বসুলভ সঙ্গ ছিল। খুব জটিল সম্পর্ক। এই বিষয়ে আমি Istanbul বইতে বিস্তারিত লিখেছি।আমি খুব টিপিক্যাল তার্কিশ ছেলে ছিলাম, সসার খেলায় ভাল, এবং সব ধরনের খেলা আর প্রতিযোগিতায় উৎসাহী। সে স্কুলে খুব সফল ছিল, আমার থেকে ভাল। আমি তাকে হিংসা করতাম, সেও আমাকে হিংসা করত। সে যুক্তিবাদী ও দায়িত্ববান ছিল, যাকে আমাদের বড়রা ভরসা করতেন। আমি যখন খেলায় মনোযোগ দিতাম, সে নিয়মে মনোযোগ দিত। আমরা সবসময় প্রতিযোগিতা করতাম। আমি নিজেকে তার রূপে কল্পনা করতাম, এই ব্যাপারটা একটা মডেল তৈরী করেছিল, হিংসুটে– ব্যাপারটা খুব আবেগী ছিল। আমি সবসময় দুঃশ্চিন্তা করতাম আমার ভাইয়ের শক্তি আর সাফল্য হয়ত আমার উপর প্রভাব ফেলবে; এই ভেবে। এটা আমার আত্মার অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমি এই বিষয়টা জানি, কাজেই আমি সেই অনুভূতি আর নিজের মধ্যে কিছুটা দূরত্ব রাখি। আমি জানি, সেগুলো খারাপ। কাজেই আমি ভদ্র মানুষের প্রত্যয়েই তাদের সাথে যুদ্ধ করি। আমি এটা বলছি না যে আমি হিংসার শিকার। কিন্তু এটা আমার মস্তিষ্কের পরিমন্ডলে ঘুরতে থাকে যার সাথে সবসময় মানিয়ে চলার চেষ্টা করি। আর অবশ্যই, পরিশেষে, এটা আমার সব গল্পের বিষয়বস্তু হয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, The White Castle এ অনেকটা ব্যথাতুর সম্পর্ক দেখানো হয়েছিল দুইটি মূল চরিত্রের মধ্যে- যা মূলত আমার আর আমার ভাইয়ের ওপর তৈরী।
অপরদিকে, এই ছদ্মবেশী থিমের ছাপ ভঙ্গুরতায় দেখা যায় যেটা পাশ্চাত্য সংস্কৃতির মুখোমুখি হতে গিয়ে তার্কিশরা অনুভব করে। The White Castle লেখার পরে, আমি অনুভব করি যে, এই হিংসা– অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হবার এই আতঙ্কের সাথে তুরস্কের অবস্থার মিল পাওয়া যায়, যখন এটা পাশ্চাত্যর মতো দেখাচ্ছিল। আপনি জানেন, পাশ্চাত্যমুখী হবার আশা এবং তারপরে সঠিকভাবে তা না হতে পাবার অভিযোগ। ইউরোপের ধারা আয়ত্বের চেষ্টা আর তারপর অনুকরনের দিকে পরিচালিত হবার জন্য অপরাধী মনোভাব। সম্পর্কের এই উঁচু-নিচু মুড দুই ভাইয়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ সম্পর্কের স্মারক।
কুইন্তানাঃ আপনি কি বিশ্বাস করেন যে, তুরস্কের প্রাচ্য পাশ্চাত্যের মনোবৃত্তির এই ক্রমাগত সংঘর্ষ কখনো শান্তিপূর্ণভাবে মিটবে?
পামুকঃ আমি আশাবাদী। তুরস্কের দুই ধরনের ধারা, দুই ধরনের সংস্কৃতির বাহক, দুই আত্মা নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। সিজোফ্রেনিয়া আপনাকে বুদ্ধিমান করে। আপনি বাস্তবের সাথে সম্পর্ক হারাতে পারেন – আমি গদ্য লেখক, কাজেই মনে করি না এটা খুব একটা খারাপ – আপনার সিজোফ্রেনিয়া নিয়ে চিন্তিত হবার কিছু নেই। আপনি যদি এটা ভেবে বেশি চিন্তিত হন যে একটা অংশ আরেকটাকে মেরে ফেলছে আপনার একটাই আত্মা বাঁচবে। এটা অসুখ থেকেও বাজে। এটা আমার নিয়ম। আমি এই নিয়ম তার্কিশ রাজনীতিতে বিস্তৃত করতে চেষ্টা করি, তার্কিশ রাজনীতিকদের মধ্যে যারা চায় দেশের একটা স্থায়ী আত্মা থাকা উচিৎ- এটা হয় প্রাচ্য নয় পাশ্চাত্য আর না হয় জাতীয় হবে। আমি অদ্বৈতবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর সমালোচক।
কুইন্তানাঃ তুরস্কে এই ব্যপারটা কেমন ছিল?
পামুকঃ যত বেশি গণতান্ত্রিক, স্বাধীন তুরস্কের চিন্তাধারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তত বেশি আমার চিন্তা গ্রহনীয় হয়েছে। তুরস্ক শুধু এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই ইউরোপিয় ইউনিয়ন এ যোগ দিতে পারে। এটা জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার একটা পথ ।
কুইন্তানাঃ এমনকি ইস্তাম্বুলেও, আপনি একপ্রকার শহরকে নিয়ে কল্পনা করেছেন, মনে হয়েছে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনে আপনি শোকাতুর।
পামুকঃ আমি অটোমান সাম্রাজ্য নিয়ে শোকাতুর না। আমি পাশ্চাত্যবাদী। আমি খুশি যে পাশ্চাত্যবাদী হবার পদ্ধতি চালু হয়েছে। আমি শুধু সীমাবদ্ধ পথটার সমালোচনা করছি যেটায় ক্ষমতাসীন অভিজাতশ্রেণি – অর্থাৎ আমলা ও নব্য ধনী পাশ্চাত্যবাদী ধারণার উদ্ভব ঘটিয়েছেন। নিজের চিহ্ন ও নিয়মে জাতীয় সংস্কৃতি তৈরীতে যে আত্মবিশ্বাস দরকার ছিল সেটা তাদের ছিল না। তারা ইস্তাম্বুলীয় সংস্কৃতি তৈরীতে সচেষ্ট ছিল না যেটা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের গুণগত মিশ্রন হতে পারত; তারা প্রাচ্য ও পাশ্চাতের ব্যপারগুলা একসাথে করেছে। সেখানে অতি অবশ্যই শক্তিশালী স্থানীয় অটোমান সংস্কৃতি ছিল, কিন্তু আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে যাচ্ছিল। তারা যেটা করতেই পারত, হয়ত যথেষ্ট করতে পারেনি, সেটা হল স্থানীয় শক্তিশালী সংস্কৃতি আবিস্কার করা, যেটা প্রাচ্যের অতীত ও পাশ্চাত্যের বর্তমানের মিশ্রণ হতে পারত – অনুকরণ না। আমি আমার বইতেও একই জিনিস আনার চেষ্টা করি। হয়ত নতুন প্রজন্ম এটা করবে, আর ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রবেশ তার্কিশ পরিচয়কে ধ্বংস করবে না বরং নতুন তার্কিশ সংস্কৃতি আবিস্কারে আত্মবিশ্বাস ও আরো বেশি স্বাধীনতা দেবে ও ছড়িয়ে পড়বে। অন্ধের মত পাশ্চাত্যের অনুকরণ অথবা পুরানো মৃত অটোমান সংস্কৃতির অনুকরণ কোন সমাধান না। আপনার এসব নিয়ে কিছু করা উচিত আর কোন একটার অনুগত হবার জন্য আতঙ্কিত হওয়া উচিত না।
কুইন্তানাঃ ইস্তাম্বুলে, আপনাকে দেখে মনে হয় যে বিদেশীদের দ্বারা চিহ্নিত হতে চান। নিজের শহরকে পাশ্চাত্যের চোখ দিয়ে দেখেন।
পামুকঃ কিন্তু আমি এটাও বিস্তারিত বলেছি কেন পাশ্চাত্যবাদী তার্কিশ বুদ্ধিজীবিরা পাশ্চাত্যের দৃষ্টি দিয়ে সব চিহ্নিত করে- ইস্তাম্বুলের গঠন পাশ্চাত্যের দ্বারা চিহ্নিত হবার প্রক্রিয়া। সবসময় এখানে একটা দ্বিধা-বিভক্তি আছে, আর আপনি প্রাচ্যের ক্ষোভ দ্বারাও সহজে চিহ্নিত হতে পারেন। সবাই কোন না কোন সময়ে পাশ্চাত্যবাদী কখনো প্রাচ্যবাদী – আসলে দুইটার স্থায়ী মিশ্রন। আমি এডওয়ার্ড সাঈদের প্রাচ্যনীতি পছন্দ করি, কিন্তু যেহেতু তুরস্ক কখনো কলোনি ছিল না, তুর্কিদের জন্য তুরস্ককে নিয়ে কল্পনাবিলাসী হওয়া কোন সমস্যা ছিল না। পশ্চিমারা তুর্কিদের সেভাবে কখনো অপমান করেনি যেভাবে আরব অথবা ভারতীয়দের করেছে। ইস্তাম্বুল আবিস্কৃত হয়েছে মাত্র দু’বছর হয়েছিল আর তারা আসতেই শত্রুদের নৌকাগুলো চলে গেল, তো এটা জাতির আত্মায় কোন গভীর ক্ষত রেখে যায়নি। যেটা ক্ষত রেখে যায় তা হল অটোমান সাম্রাজ্যের পতন। কাজেই আমার সেই আতঙ্ক নেই , সেই অনুভূতি যে পাশ্চাত্যবাদীরা আমাকে নিচু চোখে দেখবে। যদিও প্রজাতন্ত্রের শুরুর পরে এক ধরনের হুমকি ছিল কারণ তুর্কিরা পাশ্চাত্যবাদী হতে চেয়েছিল কিন্তু বেশিদূর যেতে পারেনি, যেটা সাংস্কৃতিক হীনমন্যতার অনুভূতি ছড়িয়ে দিয়েছিল। যেটার মুখোমুখি আমাদের হতেই হবে আর যেটা কখনো আমারো হতে পারে।
অপরপক্ষে, ক্ষতগুলো তত গভীর নয় যতটা গভীর সেই জাতিগুলোর ক্ষত যাদের ২০০ বছর ধরে অধিকৃত করে রাখা হয়েছে কলোনীর আন্ডারে। তুর্কিরা কখনো পশ্চিমা শক্তি দ্বারা দমিত হয়নি। তারা যে দমন-পীড়নের স্বীকার হয়েছে সেটা তাদেরই নির্যাতনঃ আমরা আমাদের নিজেদের ইতিহাস মুছে ফেলেছি কারণ এটায় বাস্তবতা ছিল। সেই দমনে ভঙ্গুর হবার বোধ ছিল। কিন্তু নিজেদের চাপিয়ে দেয়া পাশ্চাত্যবাদ বিচ্ছিন্নতা নিয়ে আসে। ভারতীয়রা তাদের শোষকদের মুখোমুখি দেখেছে। তুর্কিরা খুব অদ্ভুতভাবে পশ্চিমা বিশ্ব থেকে আলাদা হয়ে যায় যেটার অনুকরণ তারা করেছিল। ১৯৫০ এমনকি ১৯৬০ এর দশকেও যখন কোন বিদেশি ইস্তাম্বুল হিলটনে থাকতে আসতেন প্রত্যেক সংবাদপত্রে খবর আসত।
কুইন্তানাঃ আপনি কি বিশ্বাস করেন এখানে কোন বিধি-নিষেধ আছে বা থাকা উচিত? আমরা পশ্চিমা বিধি-নিষেধের কথা শুনেছি কিন্তু এর বাইরের বিধি নিষেধের ব্যপারটা কি?
পামুকঃ হ্যাঁ, আরো অন্য বিধি-নিষেধ আছে। এটা আবিস্কৃত, উন্নত, ভাগ করে নেয়ার পর সমালোচিত হয়ে তারপর গৃহীত হওয়া উচিত। বর্তমানে তথাকথিত প্রাচ্যের অনুশাসন বিলুপ্ত হয়েছে। গৌরবোজ্জ্বল গ্রন্থগুলি চারিদিকে ছড়িয়ে আছে কিন্ত সেগুলো একত্র করার ইচ্ছা কারো নেই। পার্সিয়ান চিরকালীন থেকে, ভারতীয়, চাইনিজ ও জাপানিজ গ্রন্থ সব কিছুই মূল্যায়ন করতে হবে অনুপূঙ্খভাবে। এখন অব্দি, বিধি-নিষেধ পাশ্চাত্যের বুদ্ধিজীবিদের হাতেই আছে। এটা বিন্যাস ও যোগাযোগের মূল জায়গা।
কুইন্তানাঃ উপন্যাসটা খুব পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি ঘেঁষা। প্রাচ্যের ঐতিহ্যে এর কোন জায়গা আছে?
পামুকঃ আধুনিক উপন্যাস, মহাকাব্যের নিয়ম থেকে বিচ্ছিন্ন, কাজেই এটা প্রাচ্যবাদী না। কারণ ঔপন্যাসিক এমন একজন মানুষ যিনি কোন সম্প্রদায়ভুক্ত না, যিনি সম্প্রদায়ের মূল ধর্মকে ভাগ করে নেন না, আর যিনি নিজের জীবনের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে সম্পূর্ন ভিন্ন সংস্কৃতির ভিত্তিতে চিন্তা-ভাবনা ও বিচার করেন। যখনি তার সচেতনতা তার নিজের সম্প্রদায় থেকে আলাদা হল, তিনি বহিরাগত হয়ে গেলেন, একা হলেন। একবার বিশ্বকে এইভাবে দেখার অভ্যাস গড়ে নিলে, আর এই ভঙ্গিতে লিখলে , আপনারো সম্প্রদায় থেকে বিচ্ছিন্ন হবার ইচ্ছা জাগবে। আমি Snow তে এই রকম মডেলের কথাই ভাবছিলাম।
কুইন্তানাঃ আপনার এখন অব্দি প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে Snow সবচেয়ে রাজনৈতিক গ্রন্থ। এর চিন্তাটা আপনার মাথায় কিভাবে আসলো?
পামুকঃ ১৯৯০ এর মধ্যবর্তী সময়ে যখন আমি তুরস্কে বিখ্যাত হতে শুরু করি , সেই সময় কুর্দিশ গেরিলাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শক্তিশালী ছিল, পুরাতন বামপন্থী লেখকরা ও নবীন আধুনিক প্রগতিশীলেরা চাইলেন আমি যেন তাদের সাহায্য করি, আবেদনে সাক্ষর নিতে- তারা আমাকে রাজনৈতিক কাজ করতে বলতে শুরু করেন যা আমার গ্রন্থ বহির্ভূত ছিল।
দ্রুতই এই স্থায়ী ব্যবস্থা চরিত্র হননের প্রচারণার সাথে সাংঘর্ষিক হয় । তারা বিভিন্ন নামে আমায় ডাকতে শুরু করে। আমি ক্ষুব্ধ হই। কিছুক্ষণ পরে, আমি চিন্তা করি, আমি যদি এমন একটা রাজনৈতিক বই লিখি যেখানে আমি আমার আত্মিক সংশয়গুলো আবিস্কার করতে পারব – যেমন উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসে অরাজনৈতিক প্রতিনিধিদের অবস্থার জন্য নিজেকে দায়ী ভাবা তাহলে কেমন হয়? আমি উপন্যাসের শিল্পে বিশ্বাস করতাম। এটা খুব অদ্ভুত যে কিভাবে এটা আপনাকে বহিরাগত বানায়। আমি তখন নিজেকে বললাম আমি একটা রাজনৈতিক উপন্যাস লিখব। My Name Is Red শেষ করার পরপরই আমি এটা লিখতে শুরু করি।
তুরস্কে প্রগতিশীলদের শক্তি সেনাবাহিনী থেকে আসে। এটা তুরস্কের সহনশীলতা ও গণতন্ত্রের শক্তিকে ধ্বংস করে। একবার রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বেশি সেনাবাহিনীর সংযুক্তি হলে, জনগণ তাদের আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে আর সব সমস্যা সমাধানে সেনাবাহিনীতে নির্ভর করে।
কুইন্তানাঃ আপনি এই বইয়ের পটভূমি কার্সের মতো ছোট শহরকে রাখলেন কেন?
পামুকঃ এটা তুরস্কের ঠাণ্ডা শহরের মধ্যে অন্যতম। গরীব শহরের মধ্যেও অন্যতম। আশির দশকের প্রথমদিকে প্রধান সংবাদপত্রের একটায় প্রথম পৃষ্ঠা কার্সের দারিদ্রের খবরে ভরে থাকত। কেউ একজন হিসাব করেছিল যে মিলিয়ন ডলার দিয়ে পুরো শহর কেনা যাবে। আমি যখন সেখানে যেতে চেয়েছিলাম রাজনৈতিক আবহাওয়া প্রতিকূলে ছিল। শহরের বেশিরভাগ জায়গাতে কুর্দিরাই ছিল, কিন্তু মাঝখানটায় বিভিন্ন ধরনের কুর্দীদের সংমিশ্রণ ছিল, আজারবাইজান, তুরস্ক প্রভৃতি জায়গার মানুষ। সেখানে রাশিয়ান ও জার্মানরাও ছিলেন। সেখানে ধর্মীয় ভেদও ছিল- শিয়া ও সুন্নী। তার্কিশ সরকার কুর্দি গেরিলাদের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ শুরু করেছিল তা এত ভয়ঙ্কর ছিল যে পর্যটক হিসেবে যাওয়া কঠিন ছিল। আমি জানতাম যে, আমি শুধু লেখক পরিচয়ে সেখানে যেতে পারতাম না, কাজেই আমি সংবাদপত্রের সম্পাদকের সাহায্য নিলাম সাংবাদিকের পরিচয়পত্র পেতে, যাতে সেখানে যেতে পারি। তিনি খুব প্রভাবশালী লোক ছিলেন। তিনি নিজে মেয়র ও প্রধান পুলিশকে ডাকেন জানাতে যে আমি আসছি।
সেখানে যাওয়ার পরেই আমি মেয়রের সাথে দেখা করি, পুলিশ প্রধানের সাথে হাত মেলাই যাতে তারা আমাকে রাস্তা থেকে না তুলে নিয়ে যায়। আসলে, কিছু পুলিশ যারা জানতেন না আমি সেখানে আছি, উঠিয়ে নিয়ে যেতে উদ্ধত হয়, হয়ত অত্যাচারের ইচ্ছায়। আমি সাথে সাথে বলতে শুরু করি– আমি মেয়রকে চিনি, পুলিশ প্রধানকে চিনি… আমি সন্দেহজনক ছিলাম তাদের কাছে। কারণ যদিও তুরস্ক সেইভাবে দেখতে গেলে মুক্তই, ১৯৯৯ অব্দি যেকোন বিদেশিকেই সন্দেহ করা হতো। আশা করি এখন কিছুটা সহজ হয়েছে সব।
বইয়ের বেশিরভাগ মানুষ ও স্থান সত্যিকারের প্রতিরূপের ওপর রচিত। উদাহরনস্বরূপ, একটা স্থানীয় সংবাদপত্র যেটা বাস্তবে ২৫২ কপি বিক্রি হয়। আমি কার্সে গিয়েছিলাম একটা ক্যামেরা ও ভিডিও রেকর্ডার নিয়ে। আমি সবকিছু ধারন করছিলাম তারপর ইস্তাম্বুল ফিরে গিয়ে বন্ধুদের দেখাচ্ছিলাম। সবাই ভাবল আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ওখানে আরো কিছু ঘটনা ঘটেছিল আসলে। যেমন আমি যে স্থানীয় সংবাদপত্রের সম্পাদকের সাথে কথোপকথনের কথা বললাম, যেখানে তিনি কা-কে বলছেন তিনি গত দিন কি করেছেন, আর কা জিজ্ঞেস করছেন তিনি কিভাবে জানলেন, আর তিনি বললেন তিনি শুনছিলেন ওয়াকিটকিতে পুলিশ কি বলছিল আর পুলিশ কা-কে অনুসরণ করছিল। এটা সত্যি ঘটনা। আর তারা আমাকেও অনুসরণ করছিল।
স্থানীয় উপস্থাপক আমাকে টিভিতে নিয়ে গিয়ে বললেন, আমাদের বিখ্যাত লেখক জাতীয় সংবাদপত্রের জন্য একটা আর্টিকেল লিখছেন – যেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। পৌরসভা নির্বাচন সন্নিকটে ছিল কাজেই কার্সের জনগন আমার জন্য দরজা খুলে দেয়। তারা সবাই জাতীয় সংবাদপত্রে কিছু বলতে চায়, সরকারকে জানাতে চায় তারা কত গরীব। তারা জানত না এসব আমি উপন্যাসে লিখব। তারা ভাবছিল এসব নিয়ে আর্টিকেল লিখব। আমাকে স্বীকার করতেই হবে, আমার জন্যই এটা ঘৃণ্য ও নিষ্ঠুর কাজ ছিল। যদিও আমি এই ব্যপারে আর্টিকেল লেখার চিন্তা করছিলাম।
চার বছর পেরিয়ে গেল। আমি এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ালাম। সেখানে ছোট্ট একটা কফিশপ ছিল যেখানে আমি মাঝে-মধ্যে বসে লিখতাম আর নোট নিতাম। আমার এক আলোকচিত্রী বন্ধু , যাকে কিনা আমিই সাথে আসতে বলেছিলাম যেহেতু কার্সে তুষার পড়লে খুব সুন্দর লাগে, কফিশপে লোকজনের কথাবার্তা শুনতে পায়। আমি যখন নোট লিখছিলাম লোকজন নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল যে, সে কি ধরনের আর্টিকেল লিখছে? ৩ বছর হয়ে গেছে , উপন্যাস লেখার জন্য যথেষ্ট সময়।
কুইন্তানাঃ বই নিয়ে প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?
পামুকঃ তুরস্কে, রক্ষণশীল- অথবা রাজনৈতিক আলেমগন এবং প্রগতিশীল দুই পক্ষই বিরূপ হন। তারা আমার বই বাজেয়াপ্ত বা আমাকে শারীরিকভাবে আঘাত করেননি। কিন্তু তারা বিরূপ হয়ে দৈনিক সংবাদপত্রে এসব নিয়ে লেখেন। প্রগতিশীলেরা বিরূপ হন কারণ আমি লিখেছিলাম যে, তুরস্কে উগ্র প্রগতিশীল হবার মূল্য চুকাতে হয় এটা ভুলে গিয়ে যে আপনাকে গণতন্ত্রীও হতে হবে। তুরস্কে প্রগতিশীলদের শক্তি সেনাবাহিনী থেকে আসে। এটা তুরস্কের সহনশীলতা ও গণতন্ত্রের শক্তিকে ধ্বংস করে। একবার রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বেশি সেনাবাহিনীর সংযুক্তি হলে, জনগণ তাদের আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে আর সব সমস্যা সমাধানে সেনাবাহিনীতে নির্ভর করে। জনগন প্রায়ই বলে, দেশ আর অর্থনীতির একদম জগাখিচুড়ি অবস্থা, চলো এসব পরিস্কার করতে সেনাবাহিনীকে ডাকি। কিন্তু এসব পরিস্কারের সাথে সাথে তারা সহনশীলতার সংস্কৃতি ধ্বংস করে। প্রচুর সন্দেহজনক মানুষকে নির্যাতন করা হয়; একশ হাজারের মতো মানুষের জেল হয়। এটা নতুন সেনা বিদ্রোহের পথ দেখায়। প্রগতিশীলদের নিয়ে আমার এই কঠোর মনোভাব ছিল। আমি যে আলেমদের মানুষ হিসাবে অঙ্কিত করেছি এটাও তারা পছন্দ করেনি।
রাজনৈতিক আলেমগন বিরূপ হন কারণ আমি একজন আলেম নিয়ে লিখেছিলাম যিনি বিয়ের আগে যৌনতা উপভোগ করতেন। এটা সরল ব্যাপার ছিল। আলেমগন সবসময় আমাকে নিয়ে সংশয়ী ছিলেন কারণ আমি তাদের সংস্কৃতি থেকে আসিনি, কারণ আমার ভাষা, ভাবগতিক এমনকি ভঙ্গিও অনেক বেশি পশ্চিমা, ও অভিজাত। তাদের নিজেদের প্রতিনিধিত্ব করার সমস্যা ছিল তারা জিজ্ঞেস করল সে আমাদের নিয়ে কিভাবে লিখতে পারে? তিনি বুঝতে পারছেন না। আমি এটাও উপন্যাসের কিছু অংশে যোগ করেছি।
কিন্তু আমি অতিরঞ্জন করতে চাই না। আমি বেঁচে যাই। তারা সবাই বইটা পড়েন। তারা হয়ত রেগে যান, কিন্তু এটা স্বাধীন ভাবের বিকাশের চিহ্ন যে তারা আমাকে আর আমার বইকে সেভাবেই গ্রহণ করেছেন। কার্সের জনগণের প্রতিক্রিয়াও বিভক্ত ছিল। কয়েকজন বললেন, বইটা যেমন অবস্থা তেমনই। বাকিরা, সাধারণত তুর্কি জাতীয়তাবাদীরা, আর্মেনিয়ানদের উল্লেখ করার কারণে আমাকে নিয়ে বিব্রত ছিল। উদাহরণস্বরূপ, সেই টিভি উপস্থাপক, সেই বই একটা সাঙ্কেতিক কালো ব্যাগে ভরে আমাকে পাঠায়, আর সংবাদ সম্মেলনে বলে আমি আর্মেনিয়ানদের স্বার্থে কাজ করছি- যেটা অবশ্যই ভ্রান্ত। আমাদের সংস্কৃতি এমনই সংকীর্ণ, জাতীয়তাবাদী।
আমার নিজের টেবিলে নির্জন কয়েক ঘণ্টা, সাথে ভাল কাগজ ও ঝর্ণা কলম চাই যেভাবে কিছু লোকের স্বাস্থের জন্য ঔষধ চাই। আমি এই নিয়মগুলোর প্রতি দায়বদ্ধ।
কুইন্তানাঃ বইটা ভয়ঙ্কর বিষণ্ন, হতাশাজনক। পুরো উপন্যাসে একমাত্র যে মানুষটা সব দিকে শুনতে সমর্থ ছিল সে হল কা – যাকে সবাই তাচ্ছিল্য করেছে।
পামুকঃ আমি হয়ত তুরস্কে ঔপন্যাসিক হিসেবে নিজের অবস্থান নাটুকে করে ফেলেছি। যদিও সে জানে তাকে তাচ্ছিল্য করা হয়, সে সবার সাথে কথা বলা বজায় রাখা উপভোগ করত। তার টিকে থাকার খুব শক্তিশালী ক্ষমতা আছে। কা-কে তাচ্ছিল্য করা হতো কারণ তারা তাকে পশ্চিমা গুপ্তচর হিসেবে দেখত, যেটা আমার ব্যাপারেও অনেকবার বলা হয়েছে।
বিষণ্ণতার প্রসঙ্গে, হ্যাঁ আমি একমত। কিন্তু হাসির উপাদানও আছে। কেউ যখন এটাকে বিষণ্ন বলেন, আমি জিজ্ঞেস করি, মজার কিছু নেই? আমার মনে হয় অনেক কিছুই আছে। অন্তত আমার উদ্দেশ্য তাই ছিল।
কুইন্তানাঃ উপন্যাসের প্রতি আপনার দায়বদ্ধতা আপনাকে বিপদে ফেলেছে। আরো বিপদে ফেলতে পারে। আবেগী সংযোগগুলো ছিন্ন করছে। এটাই সবচেয়ে চড়া মূল্য চুকানোর ক্ষেত্রে।
পামুকঃ হ্যাঁ, এটা দারুণ। আমি যখন ভ্রমন করছি, আর একা নই, কিছুক্ষণ পর হতাশ হই। আমি যখন রুমে একা থাকি ও সৃষ্টি করি ভাল থাকি। আমি যেটার প্রতি উৎসর্গীকৃত সেই শিল্পকলার প্রতি দায়বদ্ধতার থেকেও অধিক দায়বদ্ধতা রুমে একা থাকার প্রতি। আমি এই নিয়ম এখনো মেনে চলি, এটা বিশ্বাস করে যে যা আমি এখন লিখছি, একদিন প্রকাশ পাবে, দিবাস্বপ্নগুলো বৈধতা পাবে। আমার নিজের টেবিলে নির্জন কয়েক ঘণ্টা, সাথে ভাল কাগজ ও ঝর্ণা কলম চাই যেভাবে কিছু লোকের স্বাস্থের জন্য ঔষধ চাই। আমি এই নিয়মগুলোর প্রতি দায়বদ্ধ।
কুইন্তানাঃ আপনি তাহলে কার জন্য লিখছেন?
পামুকঃ জীবনের ব্যাপ্তি যত কমে আসে, আপনি নিজেকে প্রায়ই এই প্রশ্ন করেন। আমি সাতটা উপন্যাস লিখেছি। মৃত্যুর আগে আরো সাতটা উপন্যাস লিখতে আগ্রহী। আর যাই হোক, জীবন সংক্ষিপ্ত। এটা ছাড়া আর কী বেশি উপভোগ্য হতে পারে? মাঝেমাঝে, আমাকে নিজেকে জোর করতেই হবে। আমি এটা কেন করছি? এসব করার অর্থ কি? প্রথমত, আমি যেমন বলেছি, রুমে একা থাকার তাড়না। দ্বিতীয়ত, আমার মধ্যে ছেলেমানুষি প্রতিযোগিতামূলক একটা দিক আছে, যে আরো একটা দারুণ বই লিখতে চায়। আমি বিশ্বাস করি লেখকদের জন্য চিরকালীন বলে কিছু নেই। ২০০ বছর আগে লেখা অনেক কম বই আমরা পড়েছি। সবকিছু এত দ্রুত বদলে যাচ্ছে যে, আজকের বইয়ের কথা ১০০ বছর পর ভুলে যেতে পারে। অনেক কম পড়া হবে। ২০০ বছরের মধ্যে হয়ত বর্তমানে লেখা ৫টা বই বেঁচে থাকবে। আমি কি নিশ্চিত যে আমার বই সেই ৫ টার মধ্যে থাকবে? ২০০ বছর পর আমাকে পড়া হবে কিনা তা নিয়ে কেন চিন্তিত হব? আমার কি আরো কিছুদিন বেঁচে থাকা নিয়ে ভাবা উচিত না? আমাকে ভবিষ্যতে পড়া হবে এই সান্ত্বনা কি আমার দরকার? আমি এসব কথাই ভাবি আর লেখালেখি অব্যাহত রাখি। জানি না কেন। কিন্তু আমি কখনো হাল ছাড়ি না। ভবিষ্যতে আপনার বই প্রভাব ফেলবে এই বিশ্বাসটাই জীবনে আনন্দ পাওয়ার ক্ষেত্রে একমাত্র সান্ত্বনা।
কুইন্তানাঃ তুরস্কে আপনার বই সর্বাধিক বিক্রি হয়, কিন্তু বিদেশে বিক্রি হওয়া বইগুলো এখানে কম চলে। আপনার বই ৪০ টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এখন কি লেখার সময় বিশ্বব্যপী বিস্তৃত পাঠক নিয়ে ভাবেন?
পামুকঃ আমি জানি যে, আমার পাঠক শুধুই এখন দেশিয় না। কিন্তু তাও আমি যখন লেখালেখি শুরু করি আমি হয়ত আরো বিস্তৃত পাঠকের কাছে পৌঁছাতে পারব। আমার বাবা তাঁর কিছু তার্কিশ লেখক বন্ধুদের আড়ালে বলতেন যে, তারা শুধু দেশিয় পাঠকের জন্য লিখছেন।
কারো পাঠকশ্রেণি নিয়ে জ্ঞাত হওয়াটা এখন সমস্যার, দেশিয় বা আন্তর্জাতিক যাই হোক। আমি এখন এই সমস্যাকে উপেক্ষা করতে পারব না। আমার শেষ দুইটা বই সারা বিশ্বের এক মিলিওনের অর্ধেকের বেশি পাঠকের কাছে মোটামুটি লেগেছে। আমি তাদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে পারি না। অপরদিকে, আমার কখনো তাদের সন্তুষ্ট করতে কাজ করতে মন চায়নি। আমি এটাও বিশ্বাস করি যে এটা করলে পাঠক বুঝতে পারত। শুরু থেকেই, আমি পাঠকের প্রত্যাশা টের পেলেই পালাই। এমনকি আমার বাক্য কৌশল – আমি পাঠককে প্রস্তুত করে তারপর চমকে দেই। হয়ত সে জন্যই আমি লম্বা বাক্য ভালোবাসি।
কুইন্তানাঃ তুর্কীদের বাইরে যে বেশিরভাগ পাঠক আছেন তাদের কাছে আপনার লেখার মৌলিকত্বের অনেক দায় থাকে তার্কিশ পরিবেশে। কিন্তু আপনি নিজের কাজকে তার্কিশ অনুষঙ্গ থেকে কিভাবে আলাদা করেন?
পামুকঃ হ্যারল্ড ব্লুম যেটাকে “the anxiety of influence.” বলেছেন সমস্যা সেটায়। অন্য সব লেখকদের মতো আমারো এটা ছিল, যখন অল্প বয়স ছিল। আমার ৩০ বছরের প্রথম দিকে আমি ভাবতে থাকতাম হয়ত খুব বেশি তলস্তয় ও থমাস মান দ্বারা প্রভাবিত হয়েছি। আমার উদ্দেশ্য ছিল আমার প্রথম উপন্যাসে সেই নম্র অভিজাত গদ্যশৈলী আনা। কিন্তু শেষ অব্দি আমার কাছে ব্যপারটা এমনভাবে আসে যে, যদিও আমার কৌশল অমৌলিক, যেটা দিয়ে আমি পৃথিবীর এই অংশ পরিচালনা করছিলাম, ইউরোপ থেকে অনেক দূরে- অথবা অন্তত এটা তেমনই লেগেছিল সে সময় – আর অন্যরকম পাঠককে আকর্ষণের চেষ্টা করা অন্যরকম সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক আবহাওয়ায়, এটা আমাকে মৌলিকতা দিতে পারত, যদিও খুব সস্তাভাবে উপার্জিত। কিন্তু এটাও কঠিন কাজ, যদিও এই ধরনের কৌশলের অনুবাদ বা হাজার ভ্রমণেও সহজে আয়ত্ব হয় না।
মৌলিকত্বের ফর্মুলা খুব সাধারণ – দুটো বিষয়কে একত্রে রাখা যেগুলোকে আগে একত্রে রাখা হয়নি। ইস্তাম্বুলে লক্ষ্য করুন, শহর সম্পর্কে রচনা, এবং কিভাবে কিছু বিদেশী লেখক – ফ্লাউবর্ট, নার্ভাল, গতিয়ার-এর চোখে শহর, এবং কিভাবে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি কিছু তার্কিশ লেখকের দলকে প্রভাবিত করেছিল। ইস্তাম্বুলের রোমান্টিক প্রাকৃতিক দৃশ্যের আবিস্কারের সাথে এই রচনার মিশ্রনই আত্মজীবনী। এমন এর আগে কেউ করেনি। ঝুঁকি নিন তাহলে নতুন কিছু নিয়ে আসতে পারবেন। আমি ইস্তাম্বুলকে মৌলিক বই বানানোর চেষ্টা করেছি। জানি না কতদূর সফল হয়েছে। দা ব্ল্যাক বুক-ও তেমন বই – স্মৃতিমেদুর প্রস্তিয়ান বিশ্বের সাথে ইসলামিক রূপক, গল্প ও কায়দা মেশান তারপর সব ইস্তাম্বুলে সেট করুন আর দেখেন কি হয়।
যদিও, আমি কোলাহলমুখর পরিবারে বড় হয়েছি আর সমাজকে লালনের শিক্ষা পেয়েছি, পরবর্তীতে, আমি নিয়ম ভাঙ্গার তাগিদ অর্জন করেছি। আমার ভেতরে আত্মধ্বংসের দিক আছে এবং ক্ষিপ্ততার পর্যায়ে এবং রাগের মুহূর্তে আমি এমন কিছু করি যা আমাকে সমাজের আনন্দময় সঙ্গ থেকে আলাদা করে, জীবনের শুরুর দিকে আমি অনুভব করলাম যে সমাজ আমার কল্পনাশক্তিকে মেরে ফেলছে। আমার কল্পনার কর্মক্ষমতার জন্য একাকীত্বের কষ্ট দরকার। তারপর আমি খুশি। কিন্তু তুর্কী হিসাবে কিছুক্ষণ পরে, সমাজের সান্ত্বসূচক স্নেহ আমার চাই, যেটা হয়ত আমি ধ্বংস করে ফেলেছি। ইস্তাম্বুল আমার মার সাথে আমার সম্পর্ক নষ্ট করে ফেলেছে – আমাদের আর দেখা হয় না। আর অবশ্যই আমার ভাইয়ের সাথেও দেখা হয় না। আমার সাম্প্রতিক মন্তব্যের জন্য তার্কিশ জনগনের সাথে আমার সম্পর্কটা কঠিন হয়ে গেছে।
কুইন্তানাঃ তবে, তার্কিশ হিসেবে কেমন অনুভব করেন?
পামুকঃ প্রথমত, আমি জন্মগতভাবে তার্কিশ। এতে আমি খুশি। আমি নিজেকে যতটা না আন্তর্জাতিক ভাবি, তার চেয়ে বেশি তার্কিশ ভাবি। আমি তার্কিশ লেখক হিসেবে পরিচিত। প্রাউস্ট যখন প্রেম নিয়ে লেখেন, তাকে এমনভাবে দেখা হয় যেন কেউ সার্বজনীন প্রেম নিয়ে কথা বলছে। বিশেষতঃ শুরুতে, আমি যখন প্রেম নিয়ে লিখেছিলাম, মানুষ বলত আমি তার্কিশ প্রেম নিয়ে লিখছি। আমার লেখা যখন অনুবাদ হতে শুরু হয়, তার্কিশরা গর্বিত ছিলেন। তারা দাবী করেন আমি তাদের আপনজন। আমি তাদের কাছে তার্কিশ থেকেও বেশি। আপনার জাতীয় সত্তাবোধ এমন হয় যে অন্যরা ব্যবহার করে। এটা অন্যদের চাপিয়ে দেয়া। এখন তারা আমার শিল্প থেকেও তুরস্কের আন্তর্জাতিক উপস্থাপনা নিয়ে চিন্তিত। এটা আমার দেশে আরো আরো সমস্যা তৈরী করে। বহুল পরিচিত সংবাদপত্রে তারা যা পড়ে, অনেকে যারা আমার বই নিয়ে জানে না এটা নিয়ে দুঃশ্চিন্তা শুরু করে যে আমি তুরস্ক নিয়ে বাইরের বিশ্বে কি বলি। সাহিত্য ভাল-মন্দ নিয়ে, শয়তান ও দেবদূত নিয়ে তৈরী, তারা অনেক বেশি আমার খারাপ দিক নিয়ে চিন্তিত।