মেঘের পর জমেছে মেঘ, আঁধার করে আসে আর ওই রূপনারানের কূলে জেগে ওঠে একজন। আমার আঁধার রাতের সে একলা পাগল। পাগল না হলে কেউ নির্দয় মহানগর আর ততোধিক নিষ্ঠুর আত্মীয়-পরিজনের গঞ্জনার ব্যামোয় বাঁধা ফটিকটাকে ওভাবে চিরকালের ছুটি দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়? পাগল না হলে কেউ অভাগী রতনের কাছ থেকে প্রিয় পোস্টমাস্টারকে দূরে সরিয়ে ফেলে? এর আগে সব লেখক তো জিতিয়ে দিতো তার নায়ক-নায়িকাকে আর এই পাগলটা কিনা তার বা আমাদের কারো ইচ্ছাকে পাত্তা না দিয়ে এক্কেবারে ন্যাংটো করে দেখায় সত্যটাকে। মাংস ছাপিয়ে হাড়হাড্ডি পর্যন্ত স্পষ্ট তখন। জোড়াসাঁকোর এই পাগল ঠাকুরটা কী করে যে বামুন কায়েতকে হটিয়ে চাড়াল-চণ্ডালদের দিয়ে পবিত্র রথের রশি টানায় তা সত্যি ভেবে পাওয়া যায় না। একদিকে এই বুড়ো বাংলা ছাড়িয়ে পারস্য, জাপান, য়ুরোপ ঘুরে বেড়ায় আবার অন্যদিকে গ্রামগহিনে একতারা হাতে শূন্যে লাফ দিয়ে বলে— ‘আমিই তো সেই চিরকালের বাউল। আমারে একদিনও চিনলে না তুমি।’ আর তার গোপন ছবির খাতাটা খুলে দেখি— এ মা! কোথায় ব্রহ্মবাদ? রক্তমাংসের ফাঁক-ফোকরে লুকানো পাপের রাগিণী এখানে তো শতকণ্ঠে উঠছে বেজে। পথ চলতেই আনন্দ পাগলটার। পথে যেতে যেতে তাই আরো কত পাগলিনীর সাথে তার দেখা হলো। কাদম্বরী, ইন্দিরা ওরফে বিবি, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। এদেরকে বাদ দিয়ে পাগলটার ছবি আঁকা অসম্ভব। আঘাতে-আঘাতে, বেদনায়-বেদনায় কীভাবে নিজেকে চিনতে হয় বৌঠান কাদম্বরী নিজের আঘাত আর বেদনায় শেখালেন পাগল দেবরটাকে। ভাইঝি ইন্দিরা পাগল কাকাটারে ছিন্নপত্রে সাজাতে শেখালেন বিশ্বসংসারের তরণী। সুদূর সাগরপাড়ের ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো আর বাংলার এ প্রেমিকপাগলের কণ্ঠ না মিললে কী করে দিকে দিকে ছড়াতো ‘ভালোবাসি, ভালোবাসি’ যুগলবন্দি? নোবেল পাওয়ার টাকাকড়ি কৃষকদের মাঝে ঋণ হিসেবে বিলিয়ে দিলো। ঋণের টাকা কি আর শোধ করতে পারে গরিব কৃষক? টাকা ফেরত না পেয়ে যেন আনন্দের সাথে বলতে লাগল ‘যাদের খেয়ে পরে বেঁচে আছি, তাদের ঋণ না হয় একটুখানি শোধ করলাম।’ ছেলে রথীকে ব্যারিস্টারি না, কৃষি শিক্ষার জন্যে আমেরিকা পাঠায় পাগল বাপটা। কবিতা যে লেখে আমরা জানি সে থাকে কেবল কুসুমমণ্ডিত আর এই পাগল কবি কিনা অভিধানের মতো আপাতগম্ভীর বিষয় থেকে শুরু করে গ্রহ-নক্ষত্র নিয়ে পর্যন্ত ভাবিত। তা না হলে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিয়ে কে প্রণয়ন করে বঙ্গীয় শব্দকোষ আর শান্তিনিকেতনের সেরেস্তাদার জগদানন্দ রায়কে কেইবা দেয় হ্যালির ধূমকেতু পর্যবেক্ষণের ভার? হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীতে নিত্য বাস করে নেহায়েত উন্মাদ ছাড়া কেউ শান্তি-পারাবারে তরণী ভাসায়? শুধু কি বাইরের পৃথিবী! মেয়ের সংসারটা সুখের হয়নি। ছেলে শমীটা মারা গেল অকালে। কেঁদে বুক না ভাসিয়ে পাগল বিনে বিষাদের অগ্নিতে কে আর ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু’ বলে জল ঢালে? আমরা সব সুস্থ-স্বাভাবিকেরা যখন উঁচু উঁচু দালানকোঠার প্রেমে মত্ত তখন ধরার এই বিরল পাগল ইট-সুড়কির তলে চাপা পড়া একটা রক্তকরবীর প্রাণ নিয়ে ব্যাকুল। পাগল বলেই সে জানে এই রক্তকরবীর ছোট্ট প্রাণে লুক্কায়িত বিশাল ব্রহ্মাণ্ডের প্রাণভোমর। উত্তরে, দক্ষিণে, পশ্চিমে, পুবে যখন সব রাজা আমাদের দাসানুদাস বানাতে তোড়জোড় চালাচ্ছে তখন এই পাগল এমন এক রাজার স্বপ্ন দেখায় যার রাজত্বে আমরা সব্বাই রাজা। শুধু কি রাজা, সামান্য দইওয়ালার স্বপ্নেও বিভোর করে তুলতে পারে এই স্বপ্নচারী উন্মাদ; যে দইওয়ালা বদ্ধ ঘর ভেঙে নিয়ে যাবে মাঠের পরের দূরের দেশে। হাজারদুয়ারি মহলে বন্দি অমল আমি। হাঁসফাঁস করতে করতেই তো দিন চলে যেত আমার। যদি না হে মধুর পাগল, তুমি একরত্তি সুধার সন্ধান দিতে। এখন তো মরে গেলেও ভেবে শান্তি পাব যে অন্তত সুধা আমায় ভোলেনি। যে মানুষ অপর মানুষের বুকে ধর্মের, বর্ণের, ভূগোলের ভিন্নতার দোহাইয়ে ছুরি বসায় সেই মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানোকে পাগল ব্যতিরেকে কে পাপ জ্ঞান করে? শ্রাবণের পায়ে যখন জলের মাদল বাজে তখন পাগলটা শ্রাবণের বুকে জ্বলতে দেখে আগুন। আর কিনা তোমরা তাকে বিদ্রোহবর্জিত ভাবো! সে কিন্তু ঠিক জানে জলের গভীরে নিহিত অগ্নি সহজে নেভে না। যুগ থেকে যুগান্তর জ্বলতে থাকে নিরবধি। পোড়া দেশটাকে পাগলটা খাঁটি পাগলের মতোই ভালোবাসে। দেশটা তাই তার কাছে সোনায় মোড়া। কিন্তু আবার দেশকে ভালোবাসে বলেই বিশ্বময়ী বিশ্বমা’কে পায়ে ঠেলতে পারে না কিছুতে। তাই বারবার উগ্র জাতীয়তার বিরুদ্ধে কণ্ঠচালিত তার । কেউ তাকে দেশপ্রেমিক ভাবল কি না তার তো সে দায় বা লোভ ছিল না। পাগল বলে কথা। আবার মিথ্যা দিয়ে, কুসংস্কার দিয়ে সত্যকে পাওয়া যে যায় না তা তার চেয়ে বেশি আর কে বুঝত? গুজরাটে ভূমিকম্পে মানুষ মারা গেলে গান্ধী বললেন-‘এ হচ্ছে অস্পৃশ্যতার পাপের বিরুদ্ধে প্রকৃতির প্রতিশোধ।’ এই কথা দিয়ে জাতবৈষম্যবাদীদের ভড়কে দেয়া যায়। অস্পৃশ্যতাবিরোধী আন্দোলনও চাঙ্গা হয়। শুধু একজন এর প্রতিবাদ করলেন এই বলে যে এর মধ্য দিয়ে মানুষের বিজ্ঞানবিরোধী-আধিভৌতিক কল্পনাকে প্রশ্রয় দেয়া হলো এবং রাজনীতিতে ধর্মকে জড়িয়ে ফেলার মতো ভুলও সংঘটিত করলেন গান্ধী। পাগল না হলে কেউ সমাজ-রাজনীতির মতো তপ্ত বিষয়ে এত সূক্ষ্ম চিন্তা করে? ক্রম-আধুনিক কবিরা পাগল কবিটাকে আর প্রয়োজনীয় মনে করে না। কী সব ‘মম’ ‘তব’ মার্কা কবিতা রে! এর মাঝে আধুনিক জীবনচেতনা কই? পুনশ্চ হাতে চক্ষু চড়কগাছ। শুচিশুভ্রতার সাধক যে জানতাম কবিটাকে। আরে একী! গলির কোণে জমে ওঠা-পচে ওঠা আমের খোসা ও আঁটি, কাঁঠালের ভুতি, মাছের কান্কো, মরা বেড়ালের ছানা পর্যন্ত ঠাঁই নিয়েছে তার শব্দ-ছন্দের সংসারে। এ যেন এক পঙ্কিল তথাগত। সুবচনে-প্রলাপে মিলেমিশে জন্ম দিয়ে চলেছে কবিতার এক নতুন নন্দনের। একালের পাঠিকা কয় কেমন ভিক্টোরিয়ান রুচির লেখকরে! মন মন কেবল। তার মানুষ-মানুষী শরীরহারা জড়পিণ্ড যেন! পাঠিকার শেলফ থেকে বৈশাখী হাওয়া লেগে ঝরে পড়ল মালঞ্চ- “হঠাৎ ঢিলে-শেমিজ-পরা পাণ্ডুবর্ণ শীর্ণমূর্তি বিছানা ছেড়ে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে উঠল। অদ্ভুত গলায় বললে, ‘পালা পালা পালা এখনই, নইলে দিনে দিনে শেল বিঁধব তোর বুকে, শুকিয়ে ফেলব তোর রক্ত।’ শরীর আর মনের একী অভূত তাথৈ! কালের মন্দিরা যে সদাই বাজে তা তো জানত সে। তাই কালের সীমাকে চুরমারের বাসনায় উন্মত্ত ছিল। শেষের কবিতায় নয়তো কেন নিজের বিরুদ্ধে মূর্তিমান নিজে? নতুন কালের নায়ক-নায়িকারা সেখানে ব্যঙ্গ করে স্বয়ং সে উপন্যাসের লেখককে। যুগের হাওয়াকে এত সহিষ্ণুমানতায় পাগল ব্যতিত কে গায়ে লাগায় রে! হৈ হৈ রৈ রৈ, এল এল মহা তিরিশ। পঞ্চপাণ্ডব। প্রকাণ্ড জেহাদ। ‘রবীন্দ্র ব্যবসায় নয়, উত্তরাধিকার ভেঙে ভেঙে চিরস্থায়ী জটাজালে জাহ্নবীকে বাঁধি না।’ আর যার বিরুদ্ধে জেহাদ সে কি না নিজেকে তরুণের আলোয় দেখতে শুরু করে। এতদিনের সাধু ভাষা ও শুদ্ধ কল্পনায় লাগে বদলের ছোঁয়া। কারণ প্রকৃত পাগল বলেই সে জানে বৈচিত্র্যের মাঝেই ব্যাপ্ত থাকে সৃষ্টিরহস্য। সবাই যখন কাশী-গয়ায় গিয়ে দেবতারে খোঁজে তখন আমার এই অধার্মিক পাগল জানায় গয়া-কাশীগামী তীর্থযাত্রীর দল দেবতারে পাবে না। পাবে সে, যে তীর্থযাত্রার পথে পড়ে থাকা কুষ্ঠরোগীর শুশ্রুষায় এগিয়ে যায়। এই পোড়া দেশ! শিশু বয়সেই মানুষকে শেখানো হয় এখানে সাদা আর কালো পিপড়ার ভেদ। শেখানো হয় ঠাকুরটা হিন্দুদের, নজরুল আমাদের। স্কুল-কলেজের এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টাররাও বলে শুনেছি বজ্জাত ঠাকুরই নজরুলকে পাগল বানিয়ে ফেলেছিল যেন সে নোবেল না পায়। হায়রে দেবালয়বাসী ভণ্ড! যদি জানতে বসন্ত চিরদিন স্বাগত জানায় নববসন্তকে। যদি জানতে বিধর্মী ঠাকুর নজরুলকে বসন্ত গীতিনাট্য উৎসর্গ করেছিল যখন সে নেহায়েত তরুণ যুবা। কেউ কেউ উষ্মা প্রকাশ করলে বসন্তকার বলল ‘জাতির জীবনে বসন্ত এনেছে নজরুল।’ পাগল বলেই রবি খোলামেলা ভালোবেসেছিল আরেক পাগল কাজী কবিকে। তোমাদের মতো সুস্থ-মস্তিষ্কের স্বজাতীয় হলে হয়ত তাকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে গোলাম মোস্তফার ঢঙে লিখত রাশি রাশি ব্যঙ্গ-পদ্য ।
২.
পাগল রে তুই ধরায়। কঠিন জেনেও ভালোবাসিলি সত্য রে। ফলাফলে কিছু না পেয়েও সে প্রসন্ন-হৃদয় এই ভেবে যে কপটের জোরে, মিথ্যার বাহুবলে জগত জেতার বিড়ম্বনা সহ্য করতে হলো না। জনমভর উপার্জন করা মুহুর্মুহু বেদনাকে কেবল রবীন্দ্রনাথ নামক এক ঐন্দ্রজালিক উন্মাদের পক্ষেই আনন্দযজ্ঞ ভাবা সম্ভব।
তার আনন্দযজ্ঞে সে তো দেখি আমাকেও নিমন্ত্রণ দিয়ে গেছে।
* আমার রবি আমার ইন্দ্র ॥ পিয়াস মজিদ ॥ প্রচ্ছদ শতাব্দী জাহিদ ॥ আলোঘর প্রকাশনী ॥ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ॥ ১৫০ টাকা
মেলার স্টল নং ৪২০-৪২১