রোববারের হাটে সে লাল মাটির বিস্কুট কেনে অবলা কন্যার জন্য। আর দু কড়ির বিনিময়ে পায় উৎকর্ষ কেমিক্যালের অরিজিনাল প্যাকেটজাত লিচু। সেসব নিয়েই সে বাড়ির দিকে রওনা হয়। তার ডুপ্লেক্স বাড়িটায় দুদিন হয় বিদ্যুত নাই। বৈদ্যুতিক বাতির আগ্রাসনে মানুষজন প্রাকৃতিক আলোর অবদান ভুলে গেছে কিনা তাই রাষ্ট্রীয় কর্তাদের অভিনব কার্যপদ্ধতি চলিতেছে। কেউ বলছিলো, এক সপ্তা কারেন আসপে না।
শনের দো-চালা ঘর আর পাটকাঠির দেয়াল ভেদিয়া ঠক্ ঠক্ আওয়াজ ভেসে আসে। তাহাদের মনে হলো এসব কাঠঠোকরার ঘর-গেরস্থালি। কিন্তু শব্দটা চলে দিনভর। তারপর সূর্য অন্ধকার নামিয়ে দেয় জংলার ওপারের গঞ্জে। তখন ঘর-ফেরত মানুষেরা হাটের দিকে যাত্রা করে। তাহাদের সবজি ও ফলফলাদির ডালাগুলো শূন্য। চারিদিকে শস্য পোড়ানো আগুনের আঁচ। অনেক উত্তাপ ঠেলে তাহারা দ্রুত পায়ে হাটের দিকে গমন করে। আর ক্রেতারা মনের ভেতরে জমানো কড়ি গোনে। কড়ির কাঁচামাল যেন হওয়া থেকে আসে। ব্যাগ ফস্কে শুধু বাইর হয়া যায়। হাটুরে মশারপ স্বাধীন পতাকার মতো পত্পত করে উড়ে যাওয়া লুঙ্গি সামলায় সেই ক্ষণে। যখন তাহার মন অধিক রসিক হয়ে ওঠে। সে আরো জনাপাঁচেক লোক জড়ো করে। বলে আমাদের গঞ্জে এক্কেরে ফ্রেশ হাওয়া উৎপাদন হয়। চারখানা ইটের কারখানা সর্বদাই বাতাস পরিশুদ্ধ করে। এমন হাওয়া রপ্তানিতে সমূহ কড়িপ্রাপ্তির সম্ভাবনা আছে। আর আমাদের রোপাপ্রসবা নদীটিও পানির বদলে সবুজ ভূমি উপহার দিয়েছে। কত আনন্দ যে, উৎকর্ষ ফসল ফলানোর জন্য মানুষের ভূমি বেড়ে গেছে। এই সূত্রে আনছের মণ্ডলের কথা কওয়া যায়। তার জমি ছিলো ছটাকখানেক। তারপর নদীর হাউশ হলো মনে হয়। তার ছটাকখানেক জমির মাথায় এমন উচা এক চর পড়লো, এক যুগেও সে চর আর ডুবলো না। তার জমির পরিমাণ বেড়ে হলো এক বিঘা। এখন তার ঘরে খাবার ধান আর আটে না। তাদের এখন ফ্রিজ ভর্তি পান্তাভাত থাকে। বৈশাখে এক টুকরো শস্তা ইলিশ নিয়ে তাদের দ্বারস্থ হলে নিশ্চয়ই এক থালা পান্তা ফ্রিতে পেয়ে যাবেন।
এভাবে মশারপ রসিক হয় কিন্তু মনটা নিকষ যাতনায় লিপ্ত। রোববারের হাটে সে লাল মাটির বিস্কুট কেনে অবলা কন্যার জন্য। আর দু-কড়ির বিনিময়ে পায় উৎকর্ষ কেমিক্যালের অরিজিনাল প্যাকেটজাত লিচু। সেসব নিয়েই সে বাড়ির দিকে রওনা হয়। তার ডুপ্লেক্স বাড়িটায় দুদিন হয় বিদ্যুত নাই। বৈদ্যুতিক বাতির আগ্রাসনে মানুষজন প্রাকৃতিক আলোর অবদান ভুলে গেছে কিনা তাই রাষ্ট্রীয় কর্তাদের অভিনব কার্যপদ্ধতি চলিতেছে। কেউ বলছিলো, এক সপ্তা কারেন আসপে না। আর তার অবলা কন্যা হুদাই গরমের অভিযোগ করে। এই ভরা ভাদ্রে গরম আসে কোত্থেকে! কিন্তু তার অবলা কন্যা গভীর রাত অব্দি ঘুমায় না। সে একটি অরিজিনাল কেমিক্যালের লিচুর জন্য জেগে থাকে, অথবা এক কড়ি দিয়ে কেনা লাল মাটি ও গুড়ের ফ্যানা দিয়ে তৈরি মিষ্টান্নর জন্য তার অপেক্ষা দীর্ঘ হয়। সে উপরতলার বারান্দায় বসে জোসনা দেখতে দেখতে দোল খায়। তার পাশে অ্যারোমেটিক জুঁই গাছে ফুলে ফুলে সয়লাব। সেখানে পুববাতাসে উড়ে আসে নীলরঙা নিশিপ্রজাপতি। তার কন্যার মনে হয়, ইহা সাদা হলেই অধিক মানতো। এই আবছা জোসনায় নীল রঙ একদম মানানসই না। সে তার সাদা ফ্রকটির দিকে তাকায়, অথবা থই থই সাদা অ্যারোমেটিক জুঁইয়ের দিকে। তারপর খপ করে প্রজাপতিটা ধরে। পাখনার রঙ তুলবে বলে ভাবতে ভাবতে আচমকাই সে গতিপথ বদলায়। সে ভাবে সাদা ফ্রক পরিহিত এক রাজকন্যার কাছে কোনো রাজপুত্র প্রজাপতিটা প্রেমের দূত হিসেবে পাঠিয়েছে। আর এসব ভাবনাবহুল ঘটনাপ্রবাহে তার মুঠোর ভেতরেই প্রজাপতিটা অক্কা পেয়েছে। এভাবে সমস্তই যখন শেষ হয় তখন সে কিঞ্চিত তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়। তার পিতা দীর্ঘদিনের সঙ্গী টর্চলাইটটা হাটে ভীড়ের ভেতরে নিলামে তোলে। সম্ভবত আলোর উপরে তার চরম বিরক্তি ধরেছে। অথবা সে ভবিষ্যতে সহজ চলাচলের জন্য বিশেষ পরিকল্পনা সাজায়। যেহেতু সামনের দিনগুলোতে অন্ধকার আরো ছড়িয়ে যাবে, তাই অন্ধকারে চলাচলের অভ্যাস রাখা সে উত্তম মনে করে। তারপর টর্চলাইটের মালিকানা ত্যাগ করে সে পাঁচখানা কড়িপ্রাপ্ত হয়। দুখানা কড়ির বিনিময়ে সে লাল মাটির বিস্কুট কেনে। আর তিনখানা কড়ি দিয়ে অরিজিনাল প্যাকেটজাত লিচু সঞ্চয় করে। ওদিকে তার কন্যা বোধ হয় উতলা হয়। তার স্মার্ট ফোনটা ঘন ঘন ভাইব্রেট করলে তার বিরক্তি আসে। পলায়নপর দিনের আলো সটকে পড়েছে সেই কবেই যেন। আকাশে চাঁদের মতো কিছু একটা দেখা যায়। শোনা গিয়েছিলো চিরদিনের জন্য চাঁদের আলো ঢেকে দেয়া হবে। বরং এমন এক চাঁদ অবতরণ করা হবে যার বুকে কখনো শুক্লপক্ষের ছায়া পড়বে না। ইহাই তবে সেই চাঁদ কিনা। কিন্তু আলোটা রাতের আঁধারের সাথে ঠিক মানানসই লাগে না। সাদা ফটফটা আলো কিন্তু পথের রেখা পরিস্কার হয় না। সে বোধ হয় তাৎক্ষণিক ও ভুলবশত টর্চলাইটকে মিস করে।
জংলার ওপারের গঞ্জ থেকে ভোররাতের ভেতরে সবাই ডেরার দিকে ফেরে। হাটুরে একটি দল সবার শেষে জংলার মধ্যবর্তী লম্বা পথটি পাড়ি দিতে থাকে। কিন্তু তাদের থামতে হয় শনের দো-চালা ঘরের সামনে। গতকালকের মতো তখনো পাটকাঠির দেয়াল ভেদিয়া ঠক্ ঠক্ আওয়াজ ভেসে আসে। তাদের কৌতুহলের মাত্রা চরম হলে মজবুত পাটকাঠির দেয়াল ভেদ করার চেষ্টা করে। সেই ক্ষণে তালপাতার গেইট খুলে গেলে তারা দেখে প্রাইম মিনিস্টার ভীষণ বেদনার্ত। তার মুখ থেকে যেন কোমল শেষ আভাটুকু নিভে গেছে। প্রাইম মিনিস্টার তাদের ভেতরে ডেকে হাঁড়ির ঢাকনা খুলে দেখায়। হাটুরে শেষ দলটি ভীষণ উতলা হয়। সম্ভবত কারো কারো কান্না পেয়ে গেলে তারা তাদের ব্যাগ হাতড়ায়। কিন্তু তখন তাদের ব্যাগেও বিশেষ কিছু থাকে না। অথবা আব্দুল বারেকের থলে হাতড়ে দুটি আনারস মার্কা লজেন্স পাওয়া যায়। শান্তনা স্বরূপ তাহাই প্রাইম মিনিস্টারের হাতে তুলে দিয়ে অনবরত ঠক্ ঠক্ শব্দটির উৎস খোঁজে। তারা সত্যিই দেখে এক জোড়া কাঠঠোকরার ঘর-বসতি। প্রইম মিনিস্টারের ঘরে দিন-রাত কাঠ ঠুকে তারা আপন আবাসের প্রসার ঘটায়।
একদল সাহায্য উত্তলনকারী বের হয় সন্ধ্যানাগাদ। প্রাইম মিনিস্টারের জন্য এক মুষ্টি সাহায্য, এমন এক শিরোনামে সন্ধ্যার পাতলা আঁধারে তারা গঞ্জের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। তাদের জন্য অনেক দুয়ার খুলে যায় বটে, কড়ি জমা হয় যৎসামান্য। মশারপের ডুপ্লেক্স বাড়িটার সামনে যখন আসে, তখন তার অবলা কন্যাটি একপিস লাল মাটির বিস্কুট দান করে। আর বিনিময়ে সে তার শ্যামলা প্রেমিকটিকে প্রার্থনা করে। নিশ্চয়ই প্রাইম মিনিস্টার বর দেবে, এমন এক আশ্বাসে তারা বিদায় হলেও মশারপের অবলা কন্যাটি বিষাদগ্রস্থ হয়। একবার আশ্চর্য সুন্দর এক প্রেমিক জুটেছিলো তার। সে তাকে তিনটি চমৎকার খেলনা কিনে দিয়েছিলো। একটা খেলনা সেট দিয়ে সে চমৎকার নগর বানাতে শিখেছিলো। তারপর একদিন সাজানো নগর প্রেমিকের নামে লিখে দিতে চাইলে তার প্রেমিক একটি সত্যিকারের চকলেট প্রত্যাশার কথা বলে। কিন্তু মশারপ তার কন্যার জন্য একটি সত্যিকারের চকলেট খরিদ করতে সমর্থ হয় না। সে কয়েকটা কড়ি ধার করার কথা ভাবে। কিন্তু সমস্ত কড়িই যেন মানুষ লুকিয়ে রাখার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এমন দিনে শাহাবুর তালুকদার অর্থিক প্রতিষ্ঠানের ধারণা দেয়। এমন যুগের সূচনা হলে কড়ি বিষয়ক ধারণা ও সংকট হ্রাস পাবে। কিন্তু সে বেলা মশারপের অবলা কন্যাটির দুঃখ হ্রাস হয় না। সেই দুঃখ তার পিতার মনেও ছড়িয়ে গেলে সে আড়ালে চোখের পানি ফেলে। অথবা দুঃখ লাঘবের জন্য কন্যার মুখোমুখি হলে কন্যা তার ঘোড়ার বদলে হেলিকপ্টার খরিদের কথা বলে। মশারপ খুশিতে গদগদ হয়। সামনের হাটে নিশ্চয়ই নানা ব্র্যান্ডের হেলিকপ্টারে বাজার সয়লাব হয়ে যাবে।
অসহনীয় ক্ষুধার এক রাতে প্রাইম মিনিস্টার মানুষের মাংসের স্বাদ নিয়ে ভাবে। অথবা নিজের মাংসল উরুর দিকে সে অপলক তাকিয়ে থাকে।
দানসামগ্রী নিয়ে প্রাইম মিনিস্টারের দারস্থ হলে শিক্ষা নিয়ে বিস্তর আলাপ হয়। কিন্তু সে আলাপে প্রাইম মিনিস্টারের মন থাকে না। সে দানসামগ্রী থেকে কড়িগুলো আলাদা করে। অথবা থলের তলা পর্যন্ত হাতড়ায় সোনা বা হীরে সামগ্রীর আশায়। কিন্তু ফোটানোর মতো কিছু চাল পেয়ে সে খুশি প্রকাশ করে। পুকুরের চালায় কলমিলতার বনে সে নিরুদ্দেশ হলে দানসামগ্রী ফেরত লোকজন পথে বের হয়। তখনো তাদের মুখে শিক্ষা নিয়ে নানা মতবাদ বিনিময় হয়। বিদ্যালয় কেন্দ্রিক শিক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীরা আর আগ্রহ পাচ্ছে না। তারা আরও স্বাধীন চিন্তার অধিকারী হয়েছে। নিরানন্দ এইসব চাপিয়ে দেয়া পাঠদান পদ্ধতি ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে। এসব অথর্ব পদ্ধতি জীবন থেকে তাৎপর্যপূর্ণ আয়ুসমূহ কেটে দিচ্ছে। একটি জীবন এরচেয়েও কিঞ্চিৎ উপভোগ দাবী করে। তারা বরং আগ্রহ দেখাচ্ছে অনুপযুক্ত মাটিতে কীভাবে কড়ি ফলানো যায় সেসব বিষয়ে। অন্তর্জাল ঘেটে তারা এ বিষয়ে কিছু উপায় বের করে। সে উপলক্ষে সেদিন গঞ্জে উরাধুরা হেলিকপ্টার ওড়ানোর আয়োজনে প্রাইম মিনিস্টার ফিতা কাটে। মশারপ তার অবলা কন্যার সাথে বিশেষ একটি দিন কাটাবে বলে বাড়ি থেকে বের হয়। তার আগে রাতভর তুমুল বৃষ্টি হয়ে গেছে বলে বাড়ি থেকে নেমেই কোমর সমান জলের মুখে পড়ে। সে জলে ভাসতে থাকা ইলেকট্রিক খেলনা দেখে তার কন্যা বায়না ধরলে জলের ভেতরে নেমে পড়ে। তখন তার মনে উদয় হয় যে, বহুদিন হলো সে তার কন্যাকে মাছ খাওয়াতে পারে নাই। অথবা তার মনে পড়ে বিগত বৃষ্টিমৌসুমের কথা। এক মুখর বর্ষন দিনে তার কন্যা ছাদে বালতি পেতে রেখেছিলো কিছু মাছ এসে পড়ার আশায়। কিন্তু আকাশের উপরে বিশাল পুকুরের জলে মাছেরা দারুণ সময় কাটায়। তারা জানে মানুষের ভূমিতে অবারিত দখলমুক্ত জলাভূমি আর নাই। মশারপ আর তার কন্যা পৃথিবীতে মানুষ হয়। তারা তাই বানের জলে মাছ আটকানোর ফাঁদ পাতে। মাছেদের কি ইশকুল আছে? কন্যার প্রশ্নে মশারপ মাথা নাড়ায়। আছে বৈকি। নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু কন্যা গম্ভীর হয়। তাদের ইশ্কুলে কি তাহলে মানুষের ফাঁদ থেকে বাঁচার কোনো উপায় পাঠ্যবইয়ে রপ্ত করে নাই? নাকি তাদের বাচ্চারাও চিরকাল ইশকুল বিমুখ! জন্মগতভাবে পেয়েছে শুধু অগাধ লালসা! তাই তারা মশারপ আর তার কন্যার পাতা ফাঁদে আলগোছে ধরা খায়। পৃথিবীতে এভাবেই মানুষ বিশ্বস্ততার সবক নিয়েছে। মশারপ তার কন্যাকে বলে। আর তার কন্যা লালসাগ্রস্থ স্কুলবিমুখ মাছেদের জন্য বটি আর কড়াই প্রস্তুত করে।
তেলের মজুদ ফুরিয়ে গেছে কিংবা মানুষের জীবনের সমান মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। পরবর্তী হাটে এই দুরবস্থা দেখে মশারপ হেলিকপ্টার কেনার আশা ত্যাগ করে। সেদিন হাটে আশ্চর্য এক ভবিষ্যৎ প্রবক্তা হঠাৎ জনপ্রিয় হয়। সে বলে বিশ্বে এখন তেলনীতি বড়ই বেসামাল। সামনের দিনগুলোতে এতটাই বেসামাল হবে যে, এই গঞ্জে আর কখনোই তেলের দেখা মিলবে না। কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রবক্তা নদী বিষয়ক কোনো বক্তব্য দেয় না। অথচ বর্ষা মৌসুম শেষ না হতেই জলের সংকট দেখা দেয়। আনছের মন্ডল কিংবা তারাপদ রায়দের জমি আরো বৃদ্ধি পেলে তাদের মুখ প্রসন্ন হয়। আরো অবারিত ফসলের মাঠ তাদের মনে সমৃদ্ধির স্বপ্ন বয়ে আনে। কিন্তু মশারপের কন্যা এ বিষয়ে চিন্তাশীল হয় যে, এই গঞ্জের জন্য এখন সবচেয়ে জরুরী অনুষঙ্গ কী! তেল না নদীর জল? এ নিয়ে তার ভেতরে দ্বান্দ্বিক চরিত্র তৈরি হয়। তেল না হলে তার হেলিকপ্টার ওড়ানোর স্বপ্ন পুরন হয় না। আর নদীর জল বিনা আদতে তার কী ক্ষতি হচ্ছে? মানুষজন বরং জমির মালকিন হয়ে মনে খুশি বুনে রেখেছে। কিন্তু তেলের জন্য হাহাকার ছড়াচ্ছে প্রতিটি কণ্ঠেই। এজন্যই কি ভবিষ্যৎ প্রবক্তা নদীর জল নিয়ে কোনো কথা বলে না!
হাটুরে শেষ দলের সদস্যরা মিলিত হয় পরবর্তী হাটেও। তাদের কাছে কানাকড়িও থাকে না সেদিন দুপুরে। দুপুরের চান্দি গরম রোদে প্রবল ক্ষুধা তাদের পথে নামায়। একটি দোকানে ঘামের দামে জমানো তেল বিকোচ্ছিলো। তারা মানুষের বিশাল সিরিয়ালের তদারকি করে। আর বহুদিন বাদে তারা মানুষের থলেভর্তি কড়ি ঢালতে দেখে। তারা আরোও দেখে, গঞ্জে মজুদ তেলের শেষ ভাণ্ডারটিও ফুরোলো। কিন্তু তাদের ক্ষুধার পর্বটি তারা ভোলে না কিংবা কোনো কিছুর বিনিময়েই সেটা যায় না। তখন তদারকির বিনিময়ে এক প্যাকেট গুড়মাখানো মুড়কি পায়। কিন্তু এত লাল তার রঙ! সম্ভবত তারা ভড়কে যায়। তবু গলা থেকে খুলে লাল গামছা বিছিয়ে প্যাকেটের সমস্ত মুড়কি তারা ঢালে। তারপর তাদের কেউ একজন বলে, বঞ্চনার পৃথিবীতে লাল ই হলো আরাধ্য রঙ। একে নানাভাবে ছড়িয়ে দেওয়া যাক। এই বলে তারা তাজা রক্তের মত লাল মুড়কি খায়। আর তাদের গঞ্জের নদীটি নিয়ে কথা বলে। হঠাৎ কেন জলের আকাল হলো! এভাবে তারা আসরে বিস্ময় ছড়িয়ে দেয়। কেউ ভবানির বাচ্চা ছেলেটির কথা বলে, যে নদীর পাড় ধরে খুঁজতে খুঁজতে চার মাইল আব্দি পাড়ি দেয়, তবু একটি কচ্ছপ অথবা হাঁসের ডিম কুড়িয়ে পায় না। অথচ এই সেদিনও এসব খুব সহজলভ্য ছিলো। হাঁস না হয় মানুষের প্রকল্পের খোঁয়ারে ঢুকে গেছে। কিন্তু এত কচ্ছপের কোথায় ঠাঁই হলো? এবং জলের রাজ্যের আরো সব প্রাণীদের? এসব অথর্ব প্রাণীদের জন্য মানুষের মনে শোকের ধারণাও আসে না। বরং তেলের জন্য বিক্ষোভ হয়ে গেল সকাল বেলা। আর একদল বিদ্রোহী শিক্ষার্থী স্কুলে তালা ঝুলিয়ে দিলো। শিক্ষকেরা পরস্পরে একরাশ সুখ বিনিময় করে দীর্ঘ নিদ্রায় চলে গেলে নিরীহ শিক্ষার্থীরা তখন নিয়তির ঘেরাটোপে। অথবা মুক্তির আনন্দে তারা জীবনকে উপভোগের নানা পরিকল্পনা করে। তাদের কেউ কেউ উঠতি তারকায় পরিণত হলে ফটো তোলার জন্য ঘন ঘন সেই মৃত নদীটির কাছে যায়, যেখানে তাদের জীবন্ত ছবি আসে। নদীর বুকে তখনো কিঞ্চিৎ সবুজের আভা ছড়ায়। ধূসর মৌসুম আগমনের আগে মানুষজন তখনো কি নদীটির মৃতদশা নিয়ে ভাবে? জন্ম পরম্পরায় যে নদীটি নিয়ে গঞ্জের মানুষ গর্ব করে। মূলত তাদের ছিলো সমৃদ্ধ এক ভাগাড়। গঞ্জের সমস্ত অবর্জনা ও ক্লেদ ভাগাড়টি গ্রহণ করতো। তবু তার বুকে উৎপাদন হতো অপরিমিত হাওয়া। গেল বছরেও ঘুড়ি ওড়ানো প্রতিযোগিতায় দারুণ হাওয়া সরবরাহ হয়। মশারপের কন্যা অবলা ক্যাটাগরিতে প্রথম স্থান অর্জন করলে তার শ্যামবর্ণের প্রেমিকের সাথে প্রথম সাক্ষাৎ হয়। সেদিন নদীর কূল ধরে তার প্রেমিকের সাথে লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে আসে। তার প্রেমিক বরং বলে, নদীটি মরে যাচ্ছে। একটি নদীর মৃত্যুর সাথে সাথে একটি সভ্যতাও যেন মরে যায়। মশারপের কন্যার এসব মনে পড়লে সে এক সন্ধ্যায় ভবিষ্যৎ প্রবক্তার কাছে যায়। নদীর প্রশ্নে সে বরাবরের মতোই নিশ্চুপ থাকে অথবা এসব প্রশ্নে সে ভীত হয়। তারপর নদীর পাড়ে ডিম টোকানো সঙ্গী ইরিতার সাথে প্রাইম মিনিস্টারের বাড়ি যায়। আর প্রাইম মিনিস্টার নদী নিয়ে কোনো আগ্রহ দেখায় না। তবে নিঃসঙ্গ জীবনে কিঞ্চিৎ প্রলাপের সুযোগে সে উৎফুল্ল হয়। তার মুখ দিয়ে কথার খৈ ফোটার ফাঁকে একটি কাগজে মোড়ানো কোনো খাবার তাদের দিকে তুলে ধরে। মশারপের কন্যা কাগজের প্যাচ খুলে দেখে সেটা তারই দেয়া লাল মাটির বিস্কুট। কিন্তু তার চোখমুখ উজ্জ্বল এ কারণে যে, পেটে তার ক্ষুধার ঘোড়দৌড় চলছিলো সেই বিকেল থেকে। কিন্তু খাদ্যের কোনোরকম জোগান ছিলো না। এই সুযোগে সে দাঁতের আগা দিয়ে কুট কুট করে মাটির বিস্কুট খায়। এরপর যখন তারা রাস্তায় নামে তখন আকাশে দুখানা চাঁদ। কিন্তু সেদিন আদি চাঁদ তারা বুঝতে পারে না। সে সূত্রে বুঝতে পারে না রাতের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ। প্রহর ডাকা পাখিরাও বহুদিন হাঁক ছাড়ে না। তাই তারা সন্ধ্যারাত অথবা মধ্যরাতে বাড়ির দিকে ফেরে। ফিরতে ফিরতে তারা টের পায় অসংখ্য নিরীহ শেয়াল জোসনার আলো-আঁধারে চতুর ও হিংস্র হয়। তাদের শরীরে কোথাও কোথাও রক্তের রেখা ফুটে ওঠে। কিন্তু তাদের বাড়ি পৌঁছাবার তাড়না অথবা পিপাসা জেগে থাকে বলে তারা বাড়ির সদর দুয়ারে পৌঁছে যায় সেদিন। মশারপ তখন মা মরা মেয়েটার জন্য চাল ফুটাবে বলে হাড়িকুড়ি হাতড়ে চলে। কিন্তু ফেনাগুড়ের লাল বিস্কুট ছাড়া সে আর কিছুই হাতড়ে পায় না।
প্রাইম মিনিস্টার এভাবে লোভাতুর ও ঘোরগ্রস্থ হলে ছেলেটির কথায় চেতনা ফেরে। ছেলেটি তখন একটি চিরকুট নিবেদন করে মিষ্টি করে হেসে ফিরে যায়। আর প্রাইম মিনিস্টার প্রশান্তিতে চিরকুটটা বুকে চেপে ধরে।
অসহনীয় ক্ষুধার এক রাতে প্রাইম মিনিস্টার মানুষের মাংসের স্বাদ নিয়ে ভাবে। অথবা নিজের মাংসল উরুর দিকে সে অপলক তাকিয়ে থাকে। তারপর সে কাঠঠোকরার ঘর-বসতির দিকে হাত বাড়ায়। একে একে সে কাঠঠোকরা দম্পতি ও তাদের তিনটি ছানাপোনাকে টেনে বের করে আনে। হঠাৎ তাদের সম্মিলিত চিৎকারে নির্জন জংলা জেগে ওঠে। কিন্তু চিরস্থায়ীভাবে ঠক্ ঠক্ শব্দটি বন্ধ হয়ে যায়। তখন তার মনে পড়বে বহু যুগ আগের এক শোক সমাবেশের কথা। সেখানে শোকের রঙ কালো না হয়ে সাদা হোক, অথবা লাল হোক এমন এক বিতর্ক গতি পায়। গত শীতেই মারা পড়েছিলো সমস্ত অতিথি পাখি। তাদের রঙ ছিলো সাদা আর লাল। তাদের নিয়ে এক স্মৃতিস্তম্ভ হোক।
কিন্তু পাখিরা মূলত শীতে উড়ে আসে মানুষের প্রাণ বাঁচাতে। একজন এসব বলে চিৎকার করছিলো। শীত এলেই কেন শহরের সমস্ত খাদ্য ফুরিয়ে আসছিলো সে বিষয়ে কোনো সমাধান মিলছিলো না। খাদ্যের সমৃদ্ধ গুদাম ভেল্কি দেখাচ্ছিলো মানুষের চোখে। কিন্তু গঞ্জের ইঁদুরগুলোর পেশি ফুলেফেঁপে উছঠিলো। সেসব দিনে তারা ক্ষুধার্ত আর দুর্বল মানুষকে দেখে ডরাতে ভুলে গেলো। কিন্তু তারা জানলো না মানুষ কখনোই তার স্বভাব বদলায় না। একদিন দেখা গেল ইদুরের মাংসের দশ রকম রেসিপি পেপারে ছাপা হয়ে এসেছে। আর সেসময় শহরে এসেছিলো লাল সাদা অতিথি পাখি। তারা সেবার মানুষকে বাঁচিয়ে দিয়ে ভাস্কর্য ও স্মৃতিস্তম্ভে জীবন পেয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ইঁদুরের শরীরে মাখানো হলো লাল আর পাখির ডানায় সাদা রঙ। এইসব স্মৃতিবেদনায় প্রাইম মিনিস্টার বুঁদ হয়ে থাকে সে রাত। স্বপ্নের মতো এমন এক ক্ষুধাহীন রাত যেন দ্রুতই ভোর ডেকে আনে। হাটুরে শেষ দলটি সেদিন ফিরে যাওয়ার সময়ে অনেক দিন পর ঠক্ ঠক্ শব্দটি আর শোনে না। তারা সেখানে দাঁড়িয়ে একপ্রস্থ গল্পে মেতে ওঠে। কাঠঠোকরা কি চিরকাল তার ঘরবসতির প্রসার ঘটায়! অথবা ইঁদুরের দাঁতের মতো জন্মগত স্থাবর এক সম্পদের মালিক হয়ে যায়। তারা পায় লম্বা শক্ত একজোড়া ঠোট। আজকে যেন চিরায়ত একটি কর্মের ইতি ঘটলো।
তারা তাদের কাঙ্খিত পথের দিকেই ঝুলে থাকে। তখনো তাদের থলে শূন্যতায় পরিপূর্ণ। পথে পথে তারা যেন অনেক সমৃদ্ধ খাদ্যভাণ্ডারের গন্ধ পায়। কিন্তু দিকে দিকে কড়িযুগের সমাপ্তি ঘটানো যায় না। মানুষের এতো কড়ির অভাব তবু কীভাবে বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন হয়ে ওঠে। এসব জটিল গণিতের হিসেব নিকেশে তারা বোধ হয় চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়। এভাবে জীবনের আরো নানাবিধ ব্যর্থতার ইতিহাস তাদের মনে পড়ে। কিন্তু তাদের মনে পড়ে না মনুষ্য জীবনের সার্থকতা কোথায় লুকোনো। এই নিয়ে তারা চর ডাকাতিয়ার মোহনায় আলাপে বসে। কিন্তু কোথায় সেই কাঙ্খিত নির্জনতা! এখানে বরং মাছ ও হাঁসের ডিমের টোকানোর জন্য নদী সাঁতরে অনেক বালক বালিকা আসে। অথবা বালক-বালিকারা ভাবে নদীর নির্জন মোহনায় সুস্বাদু লাল মাটির বিস্কুট বিতরণ করা হচ্ছে। কিন্তু আদতে সেখানে একদল মনুষ্য হাহাকার লুকোনোর জন্য কড়া রোদ উপেক্ষা করছে।
তখন একজন বিশেষ স্বপনের কথা বলে। একদা সে জেগে জেগে স্বপন দেখেছে প্রাইম মিনিস্টার মানুষের মাংসের চাহিদা প্রকাশ করছে। আমাদের মনেও কি মানুষের মাংসের চাহিদা আসতে পারে না? ধরা গেলো আগামী শীতে আবারো খাদ্যের গুদাম শূণ্য হয়ে গেলো। অথচ অতিথি পাখি এলো না। শোনা গেছে অতিথি পাখি ধীরে ধীরে গন্তব্য বদল করছে। তাহলে এবার মানুষের জীবন বাঁচিয়ে দেবে কিসে! এবার বরং মানুষ ত্রাতা হয়ে সামনে আসতে পারে। অথবা এতো সমৃদ্ধ খাদ্যের গুদাম হঠাৎ কেন শূন্য হয়ে যায় সেসব নিয়ে আরো গবেষণা হতে পারে। কিন্তু এখানে বরাবরই তদন্তকারীরা অসামান্য হেলদি হয়। আর গুদামের প্রহরীরা তাদের দশাসই ফোলা স্বাস্থ্য নিয়ে ওজন প্রতিযোগিতায় নাম ওঠায়। আর হাটুরে শেষ দলটির সদস্যরা নিজেদের শীর্ণ দেহের দিকে তাকিয়ে অনেক দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে ফেলে। একই কায়দায় যদি ক্ষুধা লুকিয়ে ফেলা যেত! তাদের ভেতরে কেউ ভাবতে ভাবতে কপালের ঘাম মোছে।
শীত এলে ক্ষুধার মাত্রা বাড়ে। মশারপের কন্যা এমন এক অভিজ্ঞতার কথা প্রাইম মিনিস্টারের কাছে প্রচার করে। আর প্রাইম মিনিস্টার সবচেয়ে নিকটবর্তী পরিপুষ্ট শীতের মৌসুম ডেকে আনে হেমন্তের এক মধ্য তারিখে। তখন দেখা যায় সত্যিই মানুষের পেটে ক্ষুধার ছুঁচো দৌঁড় শুরু হয়েছে। খাদ্যের গুদাম নতুন করে পুরনো ভেল্কি দেখিয়ে শূন্য হয়ে পড়েছে। কিন্তু এবার মানুষকে বাঁচিয়ে দিতে আর অতিথি পাখির ঝাঁক আসে না। এই সমস্ত ব্যাপার গঞ্জে ছড়িয়ে গেলে মানুষজন হাহাকার সংক্রমিত হয়। আর কোনো পাড়ায় এমন অর্জনের জন্য সান্ধ্য নৃত্যের আয়োজন করে। ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষ ছড়ানো উৎসবে মানুষের ঢল নামে। আচমকা সেখানে এসে প্রাইম মিনিস্টার একটি ঘোষণা প্রচার করে যে, আমাদের কিন্তু সমৃদ্ধ একটি চিড়িয়াখানা আছে।
এই বলে সে সংক্ষিপ্ত ঘোষণা শেষ করে। উৎসবমুখর মানুষজন হা হয়ে পরস্পরের দিকে তাকায়। এমন পুরনো আর অথর্ব এক ঘোষণায় মানুষজনের মাথায় ভিন্ন ভিন্ন চিন্তা ঢোকে। কিন্তু দুর্ভিক্ষ ছড়ানো উৎসবে তেমন ভাটা পড়ে না। কেবল মশারপের অবলা কন্যা প্রাইম মিনিস্টারের ঘোষিত সংবাদ নিয়ে ভাবে। সম্ভবত প্রাইম মিনিস্টার গভীর কোনো চিন্তা থেকে দারুণ এক রহস্য ছুঁড়ে দিয়েছে। তারপর মশারপের কন্যা বিষয়টি সহজেই ধরতে পারে বলে মনের ভেতরে খুশি নড়ে-চড়ে বসে। তখন সে প্রাইম মিনিস্টারের ঘোষণাটির ব্যাখ্যা করবে বলে স্পিকার হাতে নেয়। আর মানুষজন একটা দারুণ বেদনার সঙ্গীতের অনুরোধ করে। মশারপের কন্যা সঙ্গীতের বদলে খিলখিল করে হাসে। সম্ভবত তার চিকন গলার হাসি মিষ্টি শোনায় অথবা সঙ্গীতের মতো ঝংকার তোলে। মানুষ-জন কয়েক মুহূর্ত তাই শোনে। তারপর মশারপের কন্যার গলায় চূড়ান্ত বুলি ফোটে। সে বলে যে, আমাদের সত্যিই সমৃদ্ধ একটি চিড়িয়াখানা আছে। এবার শীতে অতিথি পাখি আসে নাই কিন্তু সমৃদ্ধ চিড়িয়াখানা আমাদের বাঁচিয়ে দিতে পারে। এবার শীতে প্রাণিদের মাংস নিশ্চয় দারুণ উপভোগ্য হবে সকলের।
এবার শীতের শুরুতেই খাদ্যের গুদাম রক্ষাকারীরা চিরায়ত শক্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। তবে এবারকার প্রতিযোগিতার মাঠে সকল মানুষ নিমন্ত্রণ পায়। গঞ্জের আনাচে কানাচে এই সংবাদ চাউর হয়ে গেলে মানুষজন উৎসব আমেজে নড়েচড়ে বসে। আর মাথায় লাল ঝাণ্ডা পেঁচিয়ে হাটুরে শেষ দলটি সন্ধ্যানাগাদ প্রতিযোগিতার মাঠে উপস্থিত হয়।
কিন্তু হাটুরে শেষ দলটি কড়ি নিয়ে ভাবে। কড়ির বিনিময়ে মাংস বা খাদ্য, এই নীতিতে খাদ্য বিতরণ হলে কড়ির মালিকানাবিহীন মানুষদের উচ্ছাসের কোনো জায়গা নাই। তাদের জন্য বরং আগত এই দুর্ভিক্ষ উৎসব চমৎকার আয়োজন। আধেক রাত্রি পর্যন্ত এই উৎসব না হয় চলুক। কিন্তু মানুষের মনে ক্রমশ নানা মাত্রার ব্যথা ছড়ায়। মানুষজন রোগগ্রস্থ মানুষের মতো ঘরে ফেরে। এমন ঘটনাবহুল রাতে প্রাইম মিনিস্টারের সাথে আরো কিছু ঘটনা ঘটে। ঘরে ফিরে সে রাতে সুস্থির হয়ে আর বসতে পারে না। তার মনে হয় সে স্টেনডাল সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়েছে। ফলস্বরূপ তার সাথে অনবরত হ্যালুসিনেশন হয়। সে দেখে তার ঘর খাদ্যের গুদামঘর হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু নিজের অসীম ক্ষুধা নিবারণ হচ্ছে না। কিংবা সে আরো দেখে নদী বন্দরে জাহাজ ভর্তি কড়ি এসে পৌঁছেছে। আর সেসব কড়ি আছড়ে পড়ছে তার ঘরেই। এসব দেখতে দেখতে রাতভর তার শরীর বেয়ে ঘাম ছোটে। সকালের আলোয় কিছুটা সুস্থির বোধ করলে সে স্টেনডাল সিনড্রোম নিরাময় কেন্দ্রে আসে। কিন্তু সেখানে এতো ভীড় যে, প্রাইম মিনিস্টার নিজের খুনি দেখে ফেলার মতো চমকায়। অথবা নতুন কোনো হ্যালুসিনেশন কিনা এসব ভেবে সে চোখ কচলে থাকায়। ব্যাগ হাতড়ে এক পিস লাল মাটির বিস্কুট খায়। এক পা দিয়ে নিজের আরেক পায়ের উপর চাপ দিয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু ঘটনার কোনো হেরফের হয় না। তখন হাসি মুখে শ্যাম বর্ণের সেই সুদর্শন ছেলেটি সামনে আসে, মশারপের কন্যা যাকে কিনতে চেয়েছিলো। প্রাইম মিনিস্টার ভাবে যে, আমারো যদি কিছু কড়ি থাকতো! এমন সুদর্শন তাগড়া জোয়ান ছেলে এ তল্লাটে আর হয় না।
প্রাইম মিনিস্টার এভাবে লোভাতুর ও ঘোরগ্রস্থ হলে ছেলেটির কথায় চেতনা ফেরে। ছেলেটি তখন একটি চিরকুট নিবেদন করে মিষ্টি করে হেসে ফিরে যায়। আর প্রাইম মিনিস্টার প্রশান্তিতে চিরকুটটা বুকে চেপে ধরে। সে ভাবে যে, তবে কি কড়ি ছাড়াই তাহাকে অধিকারে পাওয়া গেলো! এমন প্রেমপত্র সারাজীবনের আরাধ্য ছিলো। এমন ধুকপুকানি সুখের তোড়ে যেন স্টেনডাল সিনড্রোম ছুটে যায়। তখন সে চোখ জ্বালা করা রোদের ভেতর দিয়ে ঘরে ফেরে। তারপর চিরকুট খুলে পড়তে শুরু করে। ‘আমি আমাদের গঞ্জের নদীটির প্রেমে পড়েছিলাম। কিন্তু সেই নদীটি এখন মৃত প্রায়। আপনারা আমার নদীটি ফিরিয়ে দিন।’
চিরকুট পড়ে প্রাইম মিনিস্টার রাগে-ক্ষোভে গরগর করে। টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে চিরকুটটি আকাশে ওড়ায়। সে আসলেই বোঝে না এসব মশকরার হেতু কি। অথবা সে ভেবে পায় না নদীর প্রেমে পড়ার মতো কী কী উপাদান আছে। অথচ সে নিজে দারুন এক মানবী হয়েছে। মশারপের কন্যাও কি নয়! তবু এসব পুরুষদের কিসের দিকে যে যাতায়াত! প্রাইম মিনিস্টার এসব ভেবে পায় না। মশারপের কন্যাও নির্জন রাত্রে চোখের পানি ফেলার আয়োজন করে। মন খারাপের আয়ু আরো দীর্ঘ হলে সে বালক বয়সে ফিরে যায়। সেসব ছিলো সমৃদ্ধ শীতকাল, যখন নীলগাই ঘাস খেতে খেতে বন থেকে বেরিয়ে তাদের গঞ্জে চলে আসতো। তারপর এলাকার কর্তাব্যক্তিরা রাত্রে ভূড়িভোজ ও আগুন পোহানো উৎসবে মেতে উঠতো। অথবা চিড়িয়াখানা থেকে লোক এসে দড়ি টানতে টানতে খাঁচার ভেতরে নিয়ে যেতো। এভাবে বনের সমস্ত নীলগাই ও অন্যান্যরা বিলুপ্ত হলে চিড়িয়াখানা সমৃদ্ধ হলো। তারও বহুবছর পরে এসে চিড়িয়াখানার জন্তুরা মানুষের প্রাণ বাঁচিয়ে দেবার উপযোগী সময়ে এসে পৌঁছেছে। মশারপের কন্যা দেখে যে, ভোরের আলো ফুটতে শুরু করার আগেই চিড়িয়াখানার সদর দরজায় মাংসপ্রার্থীদের ভীড়। প্রাইম মিনিস্টার জীর্ণ এক কম্বল গায়ে রাস্তার উপরে বসে আছে। মশারপের কন্যাও সেই ভীড়ের ভেতর মিশে যায় অনায়াসে। তখন আকাশে সূর্য ওঠার পায়তারা চলতে থাকে। চিড়িয়াখানা থেকে একটি নেকড়ের দীর্ঘস্বরের ডাক ভেসে আসে।
এবার শীতের শুরুতেই খাদ্যের গুদাম রক্ষাকারীরা চিরায়ত শক্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। তবে এবারকার প্রতিযোগিতার মাঠে সকল মানুষ নিমন্ত্রণ পায়। গঞ্জের আনাচে কানাচে এই সংবাদ চাউর হয়ে গেলে মানুষজন উৎসব আমেজে নড়েচড়ে বসে। আর মাথায় লাল ঝাণ্ডা পেঁচিয়ে হাটুরে শেষ দলটি সন্ধ্যানাগাদ প্রতিযোগিতার মাঠে উপস্থিত হয়। নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহের প্রতিশ্রুতিতে মাঠ তখন জাকজমক উৎসবের আলোয় ভরে উঠেছে। তারপর দীর্ঘ এক সাইরেন বাজলে মানুষের সমস্ত মনোযোগ মঞ্চের দিকে ফেরে। সেখানে দেখা যায় হাটুরে শেষ দলটি স্পিকার হাতে দাঁড়িয়ে আছে। তারপর তাদের বিশেষ ঘোষণা প্রচার হয়। প্রচারের দায়িত্বে থাকে মশারপের কন্যার পছন্দের তাগড়া জোয়ান শ্যামবর্ণের সেই ছেলেটি। সে বলে যে, আমরা নিজেদের নাম মানুষের নামের খাতা থেকে কেটে দিলাম। আমাদের দল আজ থেকে মানুষের অর্জিত সকল কার্য ও পদ্ধতি বিসর্জন দিলো। আজ থেকে আমরা আমাদের ভিন্ন এক নাম দিলাম। আমাদের দলে সবাইকে স্বাগত।
ঘোষণাটি শেষ হলে উৎসবের মাঠে স্তব্ধতা নেমে আসে। সম্ভবত প্রচারিত ঘোষণাটি সবার মনে আন্দোলিত করে। তারা মানুষ বিষয়ে নীরবে চিন্তা করলে তাদের মনেও মানুষ বিষয়ে বিতৃষ্ণা জাগে। তখন অগণিত মানুষের ভেতরে কেউ একজন ‘মানুষ’ নামে দুয়োধ্বনি তুললে সবাই সমস্বরে মানুষ নামে চিৎকার করতে থাকে।
সুবন্ত যায়েদ
জন্মস্থান: কুষ্টিয়া
পড়াশোনা: রাজশাহী বিশ্বাবদ্যালয়
প্রকাশিত বই
কতিপয় মৃত্যুপ্রকল্পের প্রাণ, গল্পগ্রন্থ, ঐতিহ্য প্রকাশনী
মনোদৈহিক স্মৃতিবেদনারা, গল্পগ্রন্থ, ঐহিক প্রকাশনী
গোপন ও নির্জন কোনো ইশারা, গল্পগ্রন্থ, চিলেকোঠা প্রকাশনী
মানুষ নামে দুয়োধ্বনি, গল্পগ্রন্থ, ঘরামি প্রকাশনী