বাবা
দু’ধারে দু’বাড়ি কারো দু’ছেলের হাফেজ-হওয়া খুশিতে ভরা
তারপর যতদূর শহর-গাঁ— মনে হয় যুদ্ধের মহড়া;
মাঝে পাকা মসজিদ— গোরস্তান— নিঝুম হরিদ রঙে ছাওয়া
ঋজু আজানের ধ্বনি ক্ষয়ে পাঁচ বেলা একা করে আসা-যাওয়া।
কতকাল পরে এসে মনে হয় আমি যেন থাকি এইখানে—
হয়তো সেই ছেলেবেলায় ফেলে যাওয়া প্রাণ— বা কী কে-বা জানে!
শিশুকালে শেখা সব দোয়া ভুলে তবু চিনি বাবার কবর;
কাছে গিয়ে বুঝি আমার চোখে জল আর গায়ে ভীষণ জ্বর
তবু চিনি বায়ে কার কবর রয়েছে পড়ে— সযতনে মরা;
ডানে খ্যাপা শফিকের আর তার ছেলের কবর জোড়া;
তারপর মনে নেই কবে যে কারে রেখেছি চৌদিকে ফেলে;
কাছে তবু যেন দূরে দেখি এক কোরা গোর আছে অবহেলে।
জানি না কে পয়মন্ত— ক্ষণ পরে শুয়ে রবে চিরসাধসুখে;
কারো বাবা না কি! কারো বাবা না কি! সহসা যে দোলে ভয় বুকে—
যবনিকাপাতপরবর্তী
(দুঃখদিনের বন্ধুকে)
চাইলেই ডাকনাম ছুঁড়ে ফেলে হতে পারো ছদ্মনামী
কিবা মন্ত্রী হয়ে ভুলে যেতেই পারো দেশের সংবিধান;
আজ আমায় ডেকো না আর।
তুমি
চাইলেই হতে পারো সব;
কিবা চাইলেই হতে পারো সব;
অথবা চাইলেই হতে পারো সব।
তবু
আমায় ডেকো না আর।
প্রাণপ্রিয়ার মতো আজ আমারে একা কর যাও চলে, হে!
একাকী আমি— আমার কোনোই যুদ্ধরীতি জানা নেই: দু’ কিলো বাসমতী ধান মেরে আমি উড়িয়ে দিতে পারি হোয়াইট হাউজের সিকিউরিটি; শান্তিপ্রিয় আমি এমনি ক্ষ্যাপা: বিশ্বযুদ্ধের অশান্তি চালাই তিন বেলা মনে; আর সহসা বন্ধ হয়ে যায় মায়ের কোরান তেলাওয়াত।
একাকী আমি—
আমায় ডেকো না কেউ আর।
প্রাণপ্রিয়ার মতো আজ আমারে একা কর যাও চলে, হে!
একা করে চলে যাও, হে আগামীর রাষ্ট্রপতি
একা করে চলে যাও বাপ-মা, দাদাভাই
চলে গেছো— একা করে আরো দূরে চলে যাও তুমি, দুঃখদিনে যে বন্ধু বলেছিলে আমারে
একা করে চলে যাও সুরেলা আজান,
একাকী মসজিদ, তুমিও যাও চলে।
একা করা চলে যাও সবাই; প্রাণপ্রিয়ার চুলের ঘ্রাণ নিয়ে আসা পশ্চিমা বাতাস, তুমিও চলে যাও গাছ-পালা, বাটি-বটি, মাটি আর জল নিয়ে;
আজ কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে নেই
কিচ্ছু চাওয়ার ইচ্ছে নেই
ভুলে যেসব চেয়েছি আগে, চাই না আর।
চাই না কোনো কবিত্ব আমি; আমার ধাতে কবিতা নেই: বায়রন মনে হয়— মনে হয় শুয়োরের বিলাপ। আমি জেনে গেছি নারীর অশুদ্ধ মন: আসঙ্গলিপ্সা জাগে না আর। এখন কোনো তাড়া নেই।
আজ ইচ্ছেহীন আমি এখানে আছি পড়ে;
কাল কোনো বস্তিতে গিয়ে হবো রুমানার ভাই।
বয়সে বড়ো বলে
নেতা হবো আমি— নেতা হবো পাতা কুড়ানোর দলে।
নবীজী
বন্ধুর পথে চলতে অচল পা দু’টি অসম্মতি জানায়। মন তবু থেমে
পড়ছে না। গল্প করতে করতে ‘জীবন কী’ তা শেখার কাছে চলে
এলাম— ঐ যে… খানিক দূরে মৃত্যুকে দেখা যাচ্ছে; ঘোর ভেঙ্গে
গেলে দেখি তবু্ও একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। সমাধান দাঁড়
করালাম— পৃথিবী একটা গোলক। গল্প ফের ফিসফিস করে
বলে উঠলো— এখনো মক্কা থেকে মদিনা পথের গল্প শেষ হয়
নাই।
তিনটা নীরব ঘুঘু
তিনটা নীরব ঘুঘু নিঃসঙ্গ-মাঠ-বেয়ে-চলে-যাওয়া বৈদ্যুতিক
তারে বসা— সে অনেক আগের কথা। তুমি দেখো নাই এমন
সব দিন; বিষাদভরা মন নিয়ে ফটোগ্রাফের জন্য কৃষাণছেলের
হাসিমুখ—এমন সব দিন দেখো নাই তুমি। দূরে বসে তুমি দেখো
নাই, হৃদি— তোমাকে হারিয়ে আমি কতটা কৃষাণছেলে হয়ে
গেছি।
তুমি ছুঁয়ে দেখো নাই আমারে, হৃদি— সত্যযুগের মানুষ আমি।
ভরা পূর্ণিমার রাতে আজ কলিযুগে
এসে তোমায় ভালোবেসে যেন হয়ে গেছি তিনটা নীরব ঘুঘু— নিঃসঙ্গ-মাঠ-বেয়ে-চলে-যাওয়া বৈদ্যুতিক তারে বসা—
দু’পেয়ো মানুষ
অকস্মাৎ থেমে গিয়ে কোনো হেলেঞ্চা গাছের তলে—
ধরে নেও যে নিখোঁজ পিঁপড়ে তুমি কিবা তা না হলে
ধরে নেও যে ওই হেলেঞ্চা বরং বিশাল বট
উদ্বেগ নয় কোনো— এসব কেবলই কল্পনাজট
বিশ্বাস করো আমায়, তুমি দু’পেয়ো মানুষই রবে
বিশ্বাস করো আমায়, তুমি দু’পেয়ো মানুষই রবে
রোজ ভোরে চারা গাছে পানি দিতে দিতে মিথ্যা বলা
বা নবীজীর মৃত্যুদিনে আশ্বাস-ভাঙা-পথে চলা
সবই ঠিক রবে— ঠিক রবে শিশুটিকে ঘুমে রেখে
রাত্রি করে তাড়াহুড়ো-ফেরা দেবরের ঘর থেকে।
ঠিক রবে আরো ন’ বছর— যদি বাঁচো ততদিন
এখন জানবে না কেউ; পরে ধীরে হবে সব লীন।
আজ গল্প বলি; কবরের মতো মুছে যাবো কাল
খুব ভরসা রাখো: যদিও এখন শিল্পের আকাল।
অকস্মাৎ থেমে গিয়ে কোনো হেলেঞ্চা গাছের তলে—
ধরে নেও যে নিখোঁজ পিঁপড়ে তুমি কিবা তা না হলে
ধরে নেও যে ওই হেলেঞ্চা বরং বিশাল বট
উদ্বেগ নয় কোনো— এসব কেবলই কল্পনাজট
বিশ্বাস করো আমায়, তুমি দু’পেয়ো মানুষই রবে
বিশ্বাস করো আমায়, তুমি দু’পেয়ো মানুষই রবে
বিশ্বাস করো আমায়, তুমি দু’পেয়ো মানুষই রবে
বিশ্বাস করো আমায়, তুমি দু’পেয়ো মানুষই রবে
বিশ্বাস করো আমায়, তুমি দু’পেয়ো মানুষই রবে
বিশ্বাস করো আমায়, তুমি দু’পেয়ো মানুষই রবে
আমিও জানি বিশ্বাস ভেঙে তবে সুখী হয় সবে
জানি, সুখাসঙ্গলিপ্সা ভুলে গেছি সেই কবে
তবু থাকুক আজ; পরে না হয় এই গল্প হবে:
অকস্মাৎ থেমে গিয়ে কোনো হেলেঞ্চা গাছের তলে—
ধরে নেও যে নিখোঁজ পিঁপড়ে তুমি..
জীবনপথে জীবন
( সহিজ রায়কে)
ময়ুখ রায়। যদিও বিলাতি বন্ধুরা ডাকেন ‘মায়ুখ রয়’। তবুও ময়ুখ রায়।
বাঙাল। বাংলাদেশি। চুল অনেকটা আধোপাকা। নাকটা আগের চেয়েও
যেন ঢের বোঁচা হয়ে গেছে। নিয়ম করে সিগারেট খান। বাজারের সবচে’
দামী সিগারেটের ধোঁয়া টানেন বলে মাঝেমধ্যেই একধরনের গর্ববোধে
সিনা টান টান হয়ে যায়, দুই-একটা আধা-বেরোনো গর্বের কথাও প্রায়ই
মুখ ফুটে বের হয়ে যায়। ওসব নিম্নবর্গ-মানুষের অভ্যাস ভেবে লজ্জিত
হন এরপর। মনোযোগটা অন্য দিকে নিয়ে যান। বউয়ের কথা ভাবেন।
বউটা মেদবহুল; চোখা মায়াবী চোখ তার। মাঝেমধ্যেই লাল বা কালো
টিপ পরেন। শাড়ী পরেন। ভালোবাসার মানুষ তার। খুব ভালোবাসেন।
অবশ্য এখন ঐরকম টান নাই আর। আধাআবৃত দেখলেও এখন খাটে
টেনে নেন না খুব একটা। সেসব ঘরের কথা বাদ দেয়া যাক। মনে হয়
ছেলেটারে দেখেন না বহুদিন। অথচ কথা হয়েছে সকালেও। ছেলেটা
বেশ চমৎকার। অষ্টপ্রহর পড়াশোনা করে। কোন কোন প্রেসিডেন্টের
কপালের বা’ দিকটায় গুলি লেগে মৃত্যু হয়েছে, সেসব ঠোঁটের আগায়।
এর-ওর জন্মদিনও মুখস্থ। মেয়েটা আন্ধারের মতো সুন্দর। ভালো লাগে
অনেকের। আমি দেখি নাই, অবশ্য। অথবা বহুদিনের পরিচিত সঙ্গী। কী
জানি কী! পৌরসভার শেষ পথটায় ময়ুখ রায়ের সাথে দেখা হয়েছিলো
গতকাল। তাকে হুট করে দেখে মনে হলো পাখি। দুই পাশে দুইটা ডানা।
মুখে হাসি৷ একটা সুন্দর মায়াবী পাখি। জানালেন, তিনি ভালো আছেন।
তাই অস্বস্তি বোধে চারদিক তাকিয়ে দেখলাম সেনাসৈন্যের মতো চোখে।
তারপর কিছুক্ষণ
অবাক বিস্ময়ে
অবাক বিস্ময়ে
অবাক বিস্ময়ে
তাকিয়ে থেকে
দরদী কণ্ঠস্বরে
ঢের মায়া মেখে
খানিকটা কানে কানে বলার মতো
বললাম, “কেনো, ভালো আছেন কেন?”
মরিয়ম, মরিয়ম
মাঠ বেয়ে চলে গেছে স্কুলপালানোআনন্দ
আর ছোটো নদীটির মাতৃগর্ভজলগন্ধ
মাঠ বেয়ে চলে গেছে চাঁদ হারানোর ধন্দ
আর পুরোনো কালের স্মৃতির পীত আকন্দ
মাঠ বেয়ে চলে গেছে সেই নিওলিথ যুগ
চলে গেছে পৃথিবীর সব কালের অসুখ
..
..
মাঠ বেয়ে চলে গেছে কত কী, কত কত কী!
মাঠ তবু মানুষের মতো বড়ো যে একাকী!
মাঠে বেয়ে চলে গেছে বিশ্বাসপথের রাস্তা
ধুলো হয়ে পড়ে আছে মানবীর দেয়া আস্থা
মাঠ বেয়ে চলে গেছে শত আযানের স্রোত
মাঠে মাঠে পড়ে আছে অট্টহাসির আড়ত
মাঠ তবু কাঁদে শুধু— মাঠ বড়ো অসহায়
মাঠ তবু চুপ-চাপ— রোদে পুড়ে মরে ঠায়
মাঠ তবু কেঁদে উঠে মুজিবের ধ্বনি বুকে
মাঠ তবু কাঁদে শুধু রূঢ় অসুখের সুখে
মাঠে মাঠে মিশে আছি— আমি ও দেবতা যম
মাঠ তবু ডাকে শুধু— মরিয়ম, মরিয়ম..
জীবন-যাপন
১.
গাছের কাণ্ড ধরে নাড়া দিলে যেমন বৃক্ষপত্র ঝরে— তেমনি একবার আমাদের
গাঁয়ে মানুষের জীবন ঝরেছিল। আমি চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে ছিলাম
সাজিয়ে রাখা মৃত দেহগুলোর দিকে আর অনুভব করছিলাম তাদের প্রিয়জনের
আকাশ-ছোঁয়া বিলাপের অন্তর্বেদনা। ঠিক তখনই কোনো এক ভাষাহীন নিথর
দেহের উত্তরসূরী আমাকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করল— এ কেমন ঘুম ঘুমুচ্ছে
তারা, চাচাজান? আমি ছোটো ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরতেই সে হাউমাউ করে
কাঁদতে শুরু করল।
২.
বেলা পড়ার গতিতে সেখান থেকে প্রস্থান করে কবর যেখানে
খোঁড়া হচ্ছিল, সেখানে গিয়ে দেখলাম— কয়েকজন গল্প
করতে করতে কবর খুঁড়ছে। যুদ্ধদিনের রোমাঞ্চকর গল্প।
পুজোর আমেজ চারদিকে;
পাড়ায়-পাড়ায়।
ব্যাঙের ছাতার মতো এক কোণে পড়ে রয়ে পদদলিত হচ্ছিল যে মন, তা যেন
আজ শাদা বকের মতো উড়ে উড়ে দেশান্তরে যায়।
আকাশ রাঙা হয়, মুছে যেতে শুরু করে ধীরে ধীরে..
পাড়ার প্রান্তে ছোটো ঘর— জাঁকজমকহীন, আলোহীন;
শান্ত-হাস্যপ্রদীপ্ত একজন মানুষ থাকেন সেখানে;
সেখানে তাঁর জীবন, সেখানে ঘুমান তিনি।
প্রতিদিনের শেষে ঘরে-ফেরা পাখির দিকে চেয়ে চেয়ে থাকেন
অতঃপর পশ্চিমমুখী হন;
মানুষকে ডাকেন তিনি—
‘হাইয়্যা আলাস সালাহ, হাইয়্যা আলাল ফালাহ।’
উচ্চকণ্ঠ— তবুও শোনে না পায়ের কাছে দিয়ে চলে যাওয়া পিপিলিকার দলও।
চারিধারে পুজোর ডাক-ঢোল, দেবী দুর্গার পুজো..
তবুও নিত্যদিনের মতো দু’জন লোক আসে; চলে যায় তারা আবার।
দেবী দুর্গা শান্ত মানুষটিকে ডাকেন;
তবু তিনি শুনেন না— বধির যেনো!
ঘুমিয়ে যান— ঘুম ভেঙ্গে তাজা সকালের দেখা পান।
মন চায়
গোপনপাড়ায় বেড়ে ওঠা
যে মনমরা কিশোরীর
দু’টি চোখ, কোনো অপ্রেমিকের অশ্লীল কামড়ে ফুলে ওঠা ওষ্ঠাধর,
উর্বর শরীরের
সুডৌল শ্যামলা দু’টি স্তন
আর শত বাপ-ছেলের লালসামাখা নিটোল নিতম্বের
পাশাপাশি যে একটা ব্যক্তিগত হৃদয় আছে— যেখানে ছলনা নয়, প্রেম বাস করে;
তারে নিয়ে গড়াই নদীর তীরে দু’রাত জ্যোছনা খেতে
মন চায়;
তারে বুকে নিয়ে— তারে বুকে ধরে— তারে সঙ্গে করে— তার হাত দুটি ধরে— তারে উষ্ণ বাহুডোরে পেছন থেকে জড়িয়ে
তার চুলের ঘ্রাণ নিতে নিতে মিশে যেতে মনে চায় রবীন্দ্রনাথের গান আর দূরের কোনো স্বরাজ-কন্ঠ মুয়াজ্জিনের আযানে।
এক বিকেলে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে দুজনে
চলে যাওয়া যেতে পারে দূরে কোথাও: গোপনপাড়ায় বেড়ে
ওঠা কোনো সুন্দর হৃদয়িনীর
অসহায় পৃথিবীর অশ্লীল নারীদের মতো
প্রতারণা শিখে ওঠার আগে— বেশ আগেই— অনেক অনেক আগেই—
মানুষ আসলে যেমন
শূন্যতার মাঝে অন্ধকারে ডুবে আছি;
সে নাই, আমি নাই;
চাঁদ নাই আর অন্ধকারও নাই..