[একটা শিশু এবং আরো একটা শিশু, দু’জন বসে বসে কাঁদছিল মোড়ের উপর দোকানটার পাশে। সেখান দিয়ে একটা লোক হেঁটে যাচ্ছিল। হেঁটে যাবার সময় শিশু দু’টিকে দেখে তার মায়া হয় এবং ‘তারা কেন কাঁদছে?’ এই প্রশ্নটি করে। তখন একজন শিশু বলে — ‘পোকামাকড়ের কারণে আমার মা আমাকে দু’টা পয়সা দিয়েছিল বিষ কিনে নিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু পথে কোথায় যেন একটা পয়সা পড়ে গেছে। এখন আমার হাতে মোটে একটা পয়সা আছে।’ সে আবার কাঁদতে শুরু করে। অন্য শিশুটিকে লোকটি জিজ্ঞাসা যখন করল, তখন সে বলল — ‘আমার মা আমাকে একটি পয়সা দিয়েছিলো চিনি কেনার জন্য, কিন্তু পথের ভেতর কোথায় যেন পয়সাটি পড়ে গেছে। এখন আমার হাতে কোন পয়সা নেই।’ বলে শিশুটি আবার কাঁদতে থাকে। তখন লোকটি তার আলখেল্লা থেকে দু’টি পয়সা বের করে দু’জনকে দিয়ে দেয়। শিশু দুটি তাদের কান্না থামায়। লোকটি চলে যেতে উদ্যত হলে এবং কয়েক ধাপ চলে গেলে, শিশু দুটি আবার কাঁদতে শুরু করে। তখন লোকটি ঘুরে এসে ‘তারা আর কেন কাঁদছে?’ এই প্রশ্নটি করে। তখন বিষ কেনা শিশুটি বলে — ‘আগের পয়সাটিও যদি থাকতো তবে এতক্ষণ তিনটি পয়সা হয়ে যেত।’ লোকটি তখন বলল— ‘ঠিক আছে চল দেখি তোমরা কোন পথ দিয়ে এসেছো।’ তখন তিনজনে হাঁটতে থাকে। কিছুদূর যাবার পর একটা পয়সা পড়ে থাকতে দেখে লোকটি কিন্তু কাউকে কিছু না বলে অন্য পয়সাটিও খুঁজতে থাকে। অল্প একটু দূরেই এক জায়গায় একটা পিঁপড়ার স্তূপ দেখতে পায়। সেখানে গিয়ে খেয়াল করে দেখে একটা পয়সার উপর পিঁপড়ের স্তূপটি বসেছে। তখন লোকটি প্রথম দেখা পয়সাটির কাছে এসে বলে — ‘এই যে তোমার পয়সা, এটি নিয়ে নাও।’ বিষ কেনা শিশুটি ভীষণ খুসি হয় কারণ তার হাতে এখন তিনটি পয়সা। পরে দ্বিতীয় পয়সাটির কাছে যায় এবং চিনি কেনা শিশুটিকে বলে — ‘এই যে তোমার পয়সা নিয়ে নাও’। তখন শিশুটি একটা সরু কাঠি দিয়ে পিঁপড়াদের জটলা ভেঙ্গে দেয় এবং অবাক হয়ে যায়, তার পয়সাটি পিঁপড়েরা খেয়ে ফেলেছে অর্ধেকেরও বেশি। পয়সাটি আর চলবে না সুতরাং তার হাতে সেই একটি পয়সায় থাকলো। লোকটি তার আলখেল্লা থেকে একটা কলম আর একটা ডায়েরি বের করে এবং লেখে — ‘পৃথিবীতে যারা বিষ কিনে তাদের হাতে তিনটি পয়সা থাকে আর যারা চিনি কেনে তাদের হাতে থাকে একটি পয়সা’।]
ইলিশ মাছের ঝোলের মত জোছনা নেমেছে। যদি কিছু ভাত থাকে তবে এই জোছনা মেখেও খাওয়া যাবে বেশ স্বাদ করে। আকাল যেহেতু পড়েছে সেহেতু রাত বা দিন বলে কথা নেই। যে কোন সময়েই এখন গল্প ঘটে যাচ্ছে, যখন মানুষের প্রাণ চলে যাচ্ছে বা প্রাণ চলে আসছে। দিনের বেলা প্রচণ্ড রোদ থাকে। ঘাস শুকনো থাকে। মাঠ আর পুকুরগুলো শুকনো। কেউ যদি ঢোল বাজাতে চায় আর ঢোল না থাকে তবে এখানকার শুকনো গরুগুলোকে ঢোলকাঠি দিয়ে ঢোলের মত করে মেরেই বেশ বোল তুলতে পারবে। রংপুর শুধু নয় পুরো উত্তরবঙ্গের গ্রামগুলোরই এমন অবস্থা। আনেস বিচ্ছু চাক চাক কাদা খেয়েছিলো ক্ষিধের জ্বালায়। তখন অবশ্য ঠিক মঙ্গা ছিলো না। মালিকের জমিতে কামলার কাজ করছিল। একেবারে ভোর সকালে মাঠে এসে, সূর্যটা পূবপাড় থেকে উঠতে উঠতে তিনচার ধাপ উঠে আসলেও মালিকের বাড়ি থেকে কোন খাবার আসেনি। তখন পুকুরের পাড় থেকে এক দলা কাদা তুলে ছোট ছোট সন্দেশের আকারে চ্যাপ্টা করে গিলে খেয়ে ক্ষিধে মেটায় আনেস বিচ্ছু। এখন অবস্থাটা খারাপ, কাদা খেয়ে মানুষ কাদা হজম করতে পারে না, যা আনেস বিচ্ছু পেরেছিল। আনেস বিচ্ছু আরো বিশ বছর বেঁচে ৭৫ বছর বয়সে মারা যায়। এখনকার মানুষ লেজুকা, কলার থোড় আর কচুর জড়ও হজম করতে পারে না। ডায়রিয়া হয়ে মারা যাচ্ছে। কিন্তু কেউ কেউ তো ঠিকই উপায় বের করে নিয়েছে নিজের মত। এ উপায় হিসেবে কেউ ঠিকই মরে যাচ্ছে। কেউ খেতে পাচ্ছে তার উপায়ের কৌশলেই। দেশে যে খাবার নাই এমন কিন্তু নয়। আছে ঠিকই। শুধু উপায় দিয়ে বের করে আনার অপেক্ষা। মঙ্গলা চোর কেমন করে বেঁচে আছে। কিন্তু কেউ কিছু বলতেও পারে না, ধরতে পেরেছে কী কোন ধানের গোলার মালিক তাকে? ধরতেও পারবে না সুতরাং তার বেঁচে থাকাটা একরকমের পরিশ্রমেরই বেঁচে থাকা। কিন্তু এই বিদ্যা যার জানা নাই অন্য বিদ্যা তো কিছু থাকতে হবে।
আজ ভোরে সূর্যটা একখণ্ড নরম প্যাড়ার মত হয়ে উঠেছিলো। অল্প একটু দূরে এক পীরের মাজার, জঙ্গলের ভেতর, মাজারটা প্রায় সারা বছর ফাঁকা থাকে কেউ আসে না, শুধুমাত্র বর্ষার সময় এখানে এসে কারা যেন খিচুড়ি ভোজ করে কয়েকদিন। জঙ্গলের মাঝখানে বিশাল এক তেঁতুল গাছ, এতবড় তেঁতুল গাছ সারা দেশ জুড়ে আর একটাও আছে কি না সন্দেহ। গাছটার একটা বড় ফাঁকের কাছে প্যাড়াটা আটকে গেছে। ‘নরম এবং বেশ সুস্বাদু হবে খেতে’ এই ভেবেই হাল খুলে রেখে তেঁতুল গাছটাতে উঠে বসে এবং লক্ষ করে প্যাড়াটা আসলে অনেক দূরে এবং আকাশের সাথে লেপ্টে আছে। এটাকে খাওয়া যাবে না। এটাকে প্রতিদিন মানুষ সূর্য বলে। যখন দেখল, প্যাড়া মনে করে গাছে উঠে সেটা হয়ে গেল একটা সূর্য তখন তার পেটের ক্ষুধাটা হঠাৎ করেই বোকা বনে যায় এবং স্তম্ভিত হয়ে যায়। তারপর অনেকক্ষণ ক্ষিধে লাগেনি। আর এখন, এই যে চাঁদনি রাত, চাঁদ থেকে চুঁয়ে পড়া জোছনাগুলো ইলিশ মাছের ঝোলের মত। ভাবতেই জিভ জুড়ে বান নামছে জলের। চিন্তার ভেতর হায়দরের শুধু খাওয়া-খাওয়ির ব্যাপার বলেই মনে হয় সবকিছুকে। মানুষ যেমন ভাত খায়, গাছ যেমন পানি খায়, গরু যেমন ঘাস খায় তেমনই। একজন আর একজনকে খেয়ে ফেলে। মানুষ মরে যাচ্ছে মানে শুধু মরে যাচ্ছে এমন ভাবতে পারে না হায়দর। সে ভাবে মানুষকে ভাত খেয়ে ফেলছে। আর ঐ যে ভাঁটের ঝোঁপটা পার হয়ে পুকুর, সে পুকুরের কাদা শুকিয়ে ঠিক রিলিফের বিস্কুটের মত — ফাটা মাটির শুকনো কাদা। হায়দর যদি আনেস বিচ্ছুর মত হতো তবে খেয়ে ফেলতো এতক্ষণ। এছাড়া তার বসে থাকার কারণটা এখন অন্য। একটা গোপন খবরের ভিত্তিতে সে বসে আছে। খবরটা গোপন এবং আপন। তার মনে কোন ক্ষোভ-খেদ কিছু নাই। শুধু ব্যাপারটা একটু দেখতে চায়। একটা আম গাছের জড় ঠিক একটা চেয়ারের মত কিন্তু নিচু হয়ে আছে, সেখানেই সে বসে আছে। লোকজন চলাচল করছে না। লতিবদের কুকুরটাও কু-ুলি পাকিয়ে শুয়ে আছে অথচ অন্য সময়ের জোছনা রাতগুলোতে কী তার তোড় জোড় করে হল্লা-হক্কা করে বেড়ানো। কার্ত্তিক মাস এলে দিনদুপুরের কোন ঠিক নাই, আজিজ বিশ্বাসের মাদিটাকে পথে ঘাটে ‘শুরু করে দেয়’। আজিজ বিশ্বাস খানদানি লোক তার কুত্তিটাকে লতিবের মত একলোকের কুত্তায় এসব করছে দেখলে বুকের ভেতর খারাপ লাগে। এ ব্যাপারে কেউ তাকে ইঙ্গিত করলে খারাপ লাগা চেপে রেখে বলে— ‘অবলা জীবের কি আর জ্ঞান আছে?’ কিন্তু বাচ্চা হবার পর সব বাচ্চাগুলোকে অনির্ণীত কারণে সবাই দুএকদিনের ভেতরেই পথে মৃত হয়ে পড়ে থাকতে দেখে। মানুষেরা চিন্তা ভাবনা করেও এই মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করতে পারে না। হায়দর বুক পকেটে হাত দিয়ে বিড়ির মজুদটা দেখে নেয়। থাক। দু’টা মাত্র বিড়ি, খেলেই শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু কতক্ষণ তাকে অপেক্ষা করতে হবে নিজেই বুঝতে পারছে না। এদিকে মশা দেখ ভ্যান ভ্যান করছে। আর সে কী কামড়, পা এতক্ষণ ফুলে গেল মনে হয়। প্রথমে দুএকবার চড় থাপড় দেয় নিজের পায়ে, পিঠে, গালে কিন্তু বুঝতে পারছে না মরছে কি না। ‘এটা একটা মশার সমুদ্র, মশা মেরে কূল পাওয়া যাবে না’ ভাবলো। আর মশার লাশই তো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না, মশা মেরে মশার লাশ দেখতে না পেলে ভাল লাগে না, মনে শান্তি আসে না। সুতরাং সে পা, হাত, মুখ নাড়িয়ে ঝাঁকিয়েই বসে থাকল। মুকতারার সাথে কথা হয়েছে সামনে ধান উঠলেই বিয়ে করবে, বাড়িতে বলে। মন বিনিময় হয়েছে মাস ছয়েক আগে থেকে। চেনা জানা অবশ্য অনেক আগের। চেনা জানা হবে না! একই গাঁয়ের মানুষ। আর মুকতারাই তো ওর বাপকে মাঠে খাবার দিতে যেত। কোন সমস্যাই ছিলো না এর ভেতর। মাসখানেক আগের হাটেওতো তরকারী একটু কম কিনে গোলাপি একজোড়া ফিতে আর লিপস্টিক কিনে দিয়েছে। কিন্তু খবরটা পাওয়া গেছে আজিজ বিশ্বাসের এক কামলার কাছে থেকে। আজিজ বিশ্বাসের বেটা মুকতারাকে ধান দিতে চেয়েছে কিন্তু ধানের বদলায় একরাত ‘ঐটা’ দিতে হবে। মুকতারাও নাকি শর্তে রাজি হয়েছে। গত মঙ্গায় ওর বাপ-মা দুজনই কলার থোড় খেয়ে পাতলা পায়খানায় মারা যাবার পর ওর দাদিকে নিয়ে থাকে। মুকতারা, দাদি ঘুমিয়ে গেলে আজিজ বিশ্বাসের মেজ ছেলে মিঠুর কাছে যাবে বলে কথা দিয়েছে। মাথার ভেতর বিড়ির আগুন দিয়ে কে যেন ছ্যাঁক দিয়েছে। খবরটা শোনার পরপরই এমনভাবেই জ্বলে উঠেছিল হায়দর। খুন করতে ইচ্ছে হয়েছিলো মুকতারাকে কিন্তু পরে মাথা ঠা-া হলে, মুকতারার শীর্ণশরীর চোখে ভেসে উঠলে, মায়া হয়। কী আর করবে মেয়েটা! আবার, এই খবরটা মিথ্যেও হতে পারে। সেটাও যাচাই করা প্রয়োজন। হায়দর বসে আছে। একটা ছুঁচো পায়ের উপর উঠতেই চমকে উঠে সে। পা হাত জ্বলছে মশার কামড়ে। বিড়িটা ধরাতে খুব ইচ্ছে করছে কিন্তু ধরায় না। কারণ খেয়ে ফেললেই শেষ হয়ে যাবে। মশার গান শুনে তার মনে হলো, মানুষ কোকিলের চিকন কণ্ঠ শুনে মুগ্ধ হয় কিন্তু মশার শব্দে খুব বিরক্ত হয় কেন? মশার শব্দতো খুব খারাপ নয়। তবে কোকিলে কামড়ায় না, মশাতে কামড়ায় এজন্যেও হতে পারে। এবার ধান উঠলে একটা মশারি কিনবে ভাবলো। তাহলে মশারির ভিতরে নিজে থাকবে আর বাইরে মশা ঘুরে বেড়িয়ে গান করবে। তখনই পরীক্ষা হয়ে যাবে মশার গান কেমন। শেষ পর্যন্ত সে প্রস্তুতই হয়ে গেল বিড়ি ধরার জন্য। বুক পকেটে হাত দেবার আগেই সে তার শোনা খবরটাকে সত্য হয়ে হেঁটে আসতে দেখলো। খুব সতর্ক পায়ে এদিক ওদিক হাঁসের মত দেখছে আর আসছে এদিকেই। হায়দর মশার কামড় খেয়ে ভালোই ছিলো এবং ভেবেছিলো খবরটা মিথ্যা হবে। কিন্তু চাঁদের আলোতেও সূর্যের আলোর মত একটা খবর এভাবে সত্য হয়ে দেখা যাবে বুঝতে পারেনি। গাছের নিচের অন্ধকারে আসতেই হায়দর ঠাণ্ডা গলায় বলে — ‘মুকতারা দাঁড়া’। মুকতারা চমকে দাঁড়ায় — ‘কে?’ হায়দর বলে ‘কোথায় যাস?’ থতমত মুকতারার মনে পড়ে এই লোকটার সাথে ওর বিয়ে করার কথা আছে। এটা জানলে সে বিয়ে কি আর হবে? পাল্টা প্রশ্ন করে ভীত কণ্ঠে — ‘তুমি কী কর এখানে?’ ‘আমি খবর পাইয়াই আসছি এখানে’। মুকতারা ফুঁপরে কেঁদে ওঠে – ‘তবে তো জানই আর কেন জিজ্ঞেস করছ?’ শাড়ির আঁচলটা বুকে মুখে ভালমত টেনে নিয়ে হাঁটার উদ্যোগ করতেই হায়দর বলে —‘থাম। বাড়ি যা’। তারপরেও দাঁড়িয়েই থাকে মুকতারা। এবার হায়দর দু’হাত সোজা করে তার ঘাড়ের উপর রেখে মুখোমুখি দাঁড়ায় — ‘চিন্তা নাই, বাড়ি যা’। এবার সতর্ক আর নিঃশব্দ কান্নায় হায়দরের বুকের উপর ভেঙ্গে পড়ে মুকতারা। কিছুক্ষণ এভাবে কাটে। চাঁদটা মাঝ আকাশের দিকে উঠে আসে। মুকতারা আর হায়দরের আনাড়ি ধরণের চুমোচুমি চলে। মশাগুলোর কথা খেয়ালই নাই। মুকতারা বাড়ি ফিরে আসলে, হায়দর আজিজ বিশ্বাসের বাড়ির দিকে হাঁটা দেয়। একবস্তা ধান চুরি করে নিয়ে আসে মুকতারার বাড়ি। ‘এই নে ধান, তোর সাথে এখনই বিয়ে হয়ে গেল আমার। এটা তোর দেনমোহর।’ ধানের বস্তা ধরে দুজন খোলা আকাশের নিচে দূর চাঁদের দিকে তাকিয়ে দেখে, একটু কালো মেঘ আড়াল করেছে ছোট নরম কচি চাঁদটাকে। আর শান্ত নরম অন্ধকারগুলো গাছগুলোর উপর দিয়ে জলের ধারার মত নিঃশব্দ গড়িয়ে পড়ছে। তারা ঘনিষ্ঠ হয়, ঘনিষ্ঠ হয়, তারা আরো ঘনিষ্ঠ হয়, তারা সম্পূর্ণ ঘনিষ্ঠ হয়। ঘনিষ্ঠ হওয়া শেষ হলে আরো কিছুক্ষণ তারা বসে থাকে অফুরন্ত রাতের ভেতর আর মেঘের ভেতর থেকে ছোট কচি, নরম চাঁদটা বের হয়ে আসলে — ‘আমাদের ছেলে হলে খাবে, রোজ খাবে’ — বলে উঠে দাঁড়ায় হায়দর। আবার আজিজ বিশ্বাসের বাড়ির দিকে পা বাড়ায় আরো এক বস্তা ধানের জন্য।
খ.
সম্ভবত মুকতারার দেরি দেখে বাইরে বেরিয়ে ছিলো মিঠু। কে একজন আসছে দেখে তার শিশ্ন প্রথমে সাড়া দিয়ে উঠলেও পরক্ষণেই বুঝতে পারে এ যেই হোক মুকতারা নয়। সে একটু আড়ালে দাঁড়ায়। হায়দর যখন গোলা ঘরে ঢুকল তখন মিঠুর বুঝতে অসুবিধা হলো না এ ধান চোর। ধান চুরি করতে এসেছে। সে গোলাঘরের দিকে না গিয়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকল। গোলা ঘরের গুমোট অন্ধকার ভেদ করে যখন বের হলো তখন কাঠের ফেরেস্তার মত দাঁড়িয়ে রয়েছে তিন চার জন। কাঠের ফেরেস্তার মধ্যে হঠাৎ একটা ফেরেস্তা সচল হয় এবং কিছু বোঝার আগেই পেটের উপর একটা লাত্থি খেয়ে ‘ওক্’ শব্দ করে উঠলো হায়দর। কোন শব্দ করতে না পারে যেন, গামছা দিয়ে বেঁধে দেয়া হলো মুখ। এবার আজিজ বিশ্বাসের গলা শোনা গেল ‘নিয়ে আয় কুকুর মারা খাবার, এই কুকুরের বাচ্চাকে শিখিয়ে দিই ধান চুরি করার ফল।’ এতদিন পর হায়দর বুঝতে পারল কুকুরের বাচ্চা মরার কারণ। কে একজন মুখ খুলে আর কয়েকজন হাত পা চেপে ধরে খাওয়ে দিল ধানের পোকা মারা তরল বিষ। হায়দর চিন্তা করল কুকুরগুলো কীভাবে মারা গেল এই প্রশ্ন মানুষদের মনে প্রশ্ন হয়েই থেকে যাবে। কেন কুকুরের বাচ্চা মরেছিল কেউ জানবে না।
গ.
পরদিন যখন ঝোঁপের ভেতর হায়দরের ঝুলন্ত লাশ পাওয়া গেল তখন মুকতারা ক্ষীণ কণ্ঠে উচ্চারণ করল — ‘এ লোকটার ফাঁসিতে মৃত্যু হয়নি।’ আজিজ বিশ্বাসের বাড়ি থেকে আজিজ বিশ্বাস আর পুলিশেরা বেরিয়ে এলো আর সমবেত লোকজনদের আজিজ বিশ্বাস বলল — ‘এই লোকটা খেতে পেত না, ক্ষুধার জ্বালায় নিজেই মারা গেছে। থানা পুলিশের দরকার নেই, কি বলেন আপনারা?’ লোকজন বলল ‘হ্যাঁ।’ পুলিশেরা যুক্তি দিয়ে বুঝতে পারল এবং বোঝাল — ‘কেউ যদি ক্ষুধার জ্বালায় কলার থোড় খেয়ে মারা যায় তবে পোস্ট মর্টেমের প্রয়োজন হয় না। এখন কেউ যদি ক্ষুধার জ্বালায় ফাঁসি খেয়ে মারা যায় তবেও পোস্টমর্টেম করার প্রয়োজন নাই। তোমরা লাশ দাফন করে দাও।’ মুকতারা পুলিশদের পকেটের দিকে দেখে প্রচুর সাপ এবং সে মনে মনে বিকট শব্দে চিৎকার করে ওঠে — ‘এ লোকটার ফাঁসিতে মৃত্যু হয়নি।’
ঘ.
তিন মাস পর মুকতারা বুঝতে পারল তার পেটে আরো একটা ক্ষুধা গজিয়ে গেছে। তার রক্ত টেনে টেনে ক্ষুধাটা বেড়ে উঠছে।