পর্ব-১০
অস্পষ্টভাবে হলেও এই ইবনে বতুতার বর্ণনাতেই কেবল প্রাচীন ভারতের সাধারণ জনতার জীবনের গল্প পাওয়া যায়। যাদের বর্ণনা তিনি দিয়েছেন তারা ছিল, হয় তার ভূমিদাস অথবা ক্রীতদাস (শাসকের কাছ থেকে পাওয়া উপহারের ভেতর এইসব দাসেরাও অন্তর্ভুক্ত ছিল)। ইবনে বতুতা ক্রীতদাসীদের নিয়ে ভ্রমণ করতে পছন্দ করতেন। এইসব দাস-দাসীদের ধর্ম বিশ্বাস বতুতার কাছে খুবই অদ্ভুত লাগত। শুধু এটুকু ছাড়া তাদের নিয়ে আর তেমন কোন মানবিক অনুভূতি বতুতার হতো না। দিল্লীর শাসকেরা ঐ সব দাস-সম্প্রদায়ের মূর্তিপূজার ধর্মীয় রীতিগুলো আক্ষরিক অর্থেই ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। স্থানীয় লোকজন তাদের ভূমির মালিকানা হারিয়েছিল আর বিদেশি শাসকদের কাছে দেশটির কোন পবিত্রতা ছিল না।
বতুতার বর্ণনা থেকে ভারতের দুর্দশাগ্রস্থ চিত্রের শুরুর দিকটা খুঁজে পাওয়া সম্ভব। সপ্তদশ শতকের ইউরোপীয় পর্যটকদের ভেতর থমাস রো এবং বারনিয়ের ভারত ভ্রমণ করেছেন। তারা সেসময় নিজের চোখে সাধারণ মানুষের দুঃখ দুর্দশা দেখেছিলেন। সেসময়কার ভারত সম্পর্কে তাদের বর্ণনাগুলো প্রকারান্তরে তখনকার ভারতীয় শাসকদের প্রতাপশালী ভূমিকাকে নানা মাত্রায় কটাক্ষ করে। তাদের বর্ণনা থেকেই আমরা জানতে পারি যে মুঘলদের আলিশান প্রাসাদের বাইরের জনতা বাস করতো ছোট্ট ছোট্ট কুঁড়েঘরে। উইলিয়াম হাওয়ার্ড রাসেলের লেখা ভ্রমণ কাহিনীতেও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার বর্ণনা পাওয়া যায়। ১৮৫৮ এবং ১৮৫৯ সালে টাইমস পত্রিকায় ভারতের বিপ্লবের উপর লিখেছিলেন রাসেল। কলকাতা থেকে পাঞ্জাবের পথে ভ্রমণ করার সময় ভারতের সাধারণ মানুষের দুর্দশার চিত্র তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন। তার মতে ভারতের সবখানেই পুরাতন ধ্বংসস্তুপ। সাধারণ মানুষগুলো পেট ভরে খেতে পায় না। হাড় জিরজিরে দুর্বল শরীর নিয়ে তারা, বৃটিশদের আগে আসা অন্য সব শাসকদের জন্য যেভাবে খেটেছিল সেভাবেই বৃটিশ শাসকদের জন্য পরিশ্রম করে যাচ্ছে।
প্রকাশ করার ভাষা জানা না থাকলেও ছোটবেলা থেকেই আমি ভারতের সামগ্রিকতায় বিশ্বাস করতাম। ত্রিনিদাদে আমাদের ছোট্ট মফস্বল শহরটির বাইরের খোলা মাঠে রামায়ন’র গল্প নিয়ে যে রামলীলা পালা হতো সেটাও এই সামগ্রিকতারই একটি অংশ। আমাদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান আর পারিবারিক ব্যক্তিগত ছোটখাট উৎসব-পরব সবই সামগ্রিক ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই ভারতকেই আমরা পেছনে ফেলে এসেছি, ভুলে গেছি- অতীত সম্পর্কে নতুন করে অনুধাবন করলাম আমি। এই উপলব্ধিটুকু হতে বছরের পর বছর সময় লেগে গিয়েছিল। তবে এই অনুধাবন শক্তিই আমার সামনে প্রাচীন ভারতের রোমান্সকে প্রকাশ্য করে তুললো। দেখালো কীভাবে আমাদের ছোট্ট মফস্বল শহরের ভারতীয় সমাজ তার প্রাচীন সভ্যতার প্রতি নানা উৎসবের মাধ্যমে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতো। ওই প্রাচীন সভ্যতা আমাদের কাছে ছিল অবিনশ্বর। এই অবিনশ্বরতার ভাবনা থেকেই আমি বুঝতে পারলাম যে স্প্যানিয়ার্ডদের সামনে মেক্সিকান এবং পেরুভিয়ানরা যেমন অসহায় ছিল মুসলিম আক্রমণকারীদের সামনেও আমাদের সভ্যতা ঠিক একইরকম ছিল। আক্রমণকারীদের ঐ সব সভ্যতার প্রায় অর্ধেক যেভাবে খানখান হয়ে গিয়েছিল ভারতের সভ্যতাও মুসলমানদের হাতে সেভাবে ধ্বংস হয়ে যায়।
২.
প্রত্যেকটি অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট পন্থা থাকে। কিন্তু আমি বুঝতাম না যে, ভারত নিয়ে ঠিক কী ধরনের উপন্যাস লেখা যায়। উপন্যাস সবসময় নৈতিক বা সাংস্কৃতিক গণ্ডির ভেতরেই সবচেয়ে ভালোভাবে ফুটিয়ে তোলা যায়। ঐ গণ্ডির নিয়মগুলো সাধারণত লেখকের জানা থাকে ফলে নিজস্ব সীমানার ভেতরের আবেগ, অনুভূতি আর নৈতিক ভীতি নিয়ে উপন্যাস তার নিজস্ব নিয়মে এগিয়ে যায়। সাহিত্যের অন্য ধারাগুলোতে এসব বিষয়ের উপস্থিতি মোটামুটি অধরা বা অসম্পূর্ণই বলা চলে।
ভারত সম্পর্কে যে অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল তা খুবই সুস্পষ্ট। ঐ অভিজ্ঞতা নিয়ে উপন্যাস লিখতে হলে আমাকে যা করতে হতো তা হলো- আমাকে আমার নিজের মতোই একটি চরিত্র সৃষ্টি করতে হতো যার অতীত জীবন এবং পূর্বপুরুষদের সাথে আমার অতীতের মিল আছে। ঐ চরিত্রটিকে ভারতে ফিরিয়ে নিয়ে গেলে কী কী ঘটনা ঘটতে পারতো তা আমাকে অনুমান করে নিতে হতো। ব্যাস এভাবে আমার অভিজ্ঞতাকে কম বেশি এদিক সেদিক করেই আমি উপন্যাসটি দাঁড় করিয়ে ফেলতে পারতাম। কিন্তু এতে করে উপন্যাসটিতে বাড়তি কোন বাস্তব অভিজ্ঞতাই যোগ করা হতো না। টলস্টয় পর্যন্ত পাঠকের সামনে খানিকটা বাড়তি বাস্তবতা তুলে ধরার প্রয়াসে উপন্যাসের সাহায্য নিয়েছিলেন। আর এভাবেই সেবাস্তপোল নগর দখলের ঘটনা খুব কাছ থেকে তিনি উপস্থাপন করতে পেরেছিলেন। এ থেকেই আমি পরিষ্কার বুঝতে পারলাম যে, প্রয়োজনীয় সব কিছু খুঁজে বের করে ভারতকে বিষয়বস্তু বানিয়ে কোন উপন্যাস লিখতে গেলে তা হতো বাড়তি এবং বাস্তবতাবিহীন কোন কিছু যেখানে আমার অমূল্য অভিজ্ঞতায় আমি হয়ত শেষ পর্যন্ত মিথ্যার ছাপ ফেলে দিতাম। আমার অভিজ্ঞতার মূল্য লুকিয়ে আছে এর স্বকীয়তায়। তাই ভেবে দেখলাম যে, যতোটা সম্ভব বিশ্বস্ততার সাথে এই অভিজ্ঞতা উপস্থাপন করাটাই আমার একান্ত কর্তব্য হওয়া উচিত।
শহর কেন্দ্রিক উপন্যাসগুলো অনুকরণ করা যতোই সহজ হোক না কেন ওসব সাহিত্যে সমাজকে শহরকেন্দ্রিক ধ্যান ধারণাসহই উপস্থাপন করা হয়েছে। শহরকেন্দ্রিক উপন্যাসের সমাজে তাই ব্যাপক শিক্ষার ছড়াছড়ি, ইতিহাসের ধারণা আর আত্মজ্ঞান সম্পর্কে সচেতনতার ভাব সুস্পষ্ট। যে সমাজে ঐ সব ধ্যান-ধারণা ভুল, যেখানে ব্যাপক শিক্ষার সুযোগ ত্রুটিপূর্ণ অথবা অনুপস্থিত, সেসব সমাজ সম্পর্কে শহর কেন্দ্রিক উপন্যাসগুলো অল্প কিছু বাহ্যিক বিষয় ছাড়া আর কোন গভীর চিন্তা তুলে ধরতে পারে কীনা সে ব্যাপারে আমার যথেষ্ঠ সন্দেহ রয়েছে। জাপানিরা নিজেদের সমৃদ্ধ সাহিত্য আর ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের সাথে বর্হিবিশ্ব থেকে আনা উপন্যাসের ধারাকে যথার্থভাবে সংমিশ্রণ ঘটিয়েছে। কিন্তু ভারত তো আর জাপান নয়। ভারতের অতীতের বর্ণনা ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। ভারতের ইতিহাস হয় অজানা নয়তো জানা সম্ভব নয় অথবা অস্বীকৃত। সেই ভারতকে নিয়ে লেখার জন্য যদি আমি উপন্যাসকে বেছে নেই তবে তা আংশিক সত্যের চেয়ে বেশি কিছু প্রকাশ করতে পারবে কীনা তা আমার জানা ছিল না। আমি সন্দিহান ছিলাম যে, এভাবে লেখা উপন্যাস হয়তো বিরাট অন্ধকারের পথে কোন জানালা দিয়ে আসা নিভু নিভু আলোর মতোই কেবল আংশিক একটা পথ দেখাবে।
চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগে বিশ্বসাহিত্য অঙ্গনে ভারতীয় লেখকদের তেমন কোন পরিচিতি ছিল না। সে সময়ে আমাদের (আমার ও আমার বাবা) কাছে আর.কে.নারায়ণ ছিলেন এমন এক ভারতীয় লেখক যার লেখা আমাদের উৎসাহ যোগাত। নারায়ণ ভারতীয় জীবন সম্পর্কে ইংরেজিতে লিখেছেন। কাজটাতে অনেক বাঁধা-বিপত্তি ছিল। নারায়ণ ঐ সব বাধাকে যেন উপেক্ষা করেই লিখে গেছেন। তার লেখার ধরন সোজাসাপ্টা, হালকা। সামাজিক অবস্থার ব্যাখ্যা সেখানে নেই বললেই চলে। নারায়ণের ইংরেজি খুবই সহজ এবং ব্যক্তিগত প্রকৃতির। তার লেখার এই বৈশিষ্ট্য ইংরেজদের সামাজিক সাহচর্য থেকে অনেক দূরে হলেও সে ভাষা পাঠকের কাছে একটুও অস্বাভাবিক বলে মনে হয় না। এর আরেকটি কারণ হতে পারে যে নারায়ণের লেখা সবসময়ই তার নিজস্ব সংস্কৃতির ভেতর থেকে লেখা হয়েছে। তার গল্প জুড়ে রয়েছে দক্ষিণ ভারতের এক ছোট্ট শহরের অধিবাসীরা যারা নিম্নবর্ণের মানুষ হলেও বড় বড় কথা বলতে পটু আর কাজ করে ছোট ছোট। এই কাহিনী দিয়েই তিনি শুরু করেছিলেন; আর সেই একই কাহিনী তিনি পরবর্তী পঞ্চাশ বছর ধরেই লিখে গেছেন। (চলবে)