আমার পড়ালেখা । ভিএস নাইপল ।। ভাষান্তর : মূর্তালা রামাত ও শারমিন শিমুল ।। ৬ষ্ঠ পর্ব

               পর্ব ৬

৫.

লেখক হবার কল্পনার যে জগতে আমি বাস করতাম সেখানে সত্যিকারের বই লেখার ব্যাপারে কী করতে হবে সেটা সম্পর্কে কোন ধারণাই আমার ছিলো না। তবে মনে হয়, আমি ভেবেছিলাম কোন রকমে প্রথম বইটা লিখে ফেলতে পারলেই পরেরগুলো আপনাতেই লেখা হয়ে যাবে।

 

কিন্তু বাস্তবে দেখলাম ব্যাপারটা এতা সহজ নয়। আমার লেখার বিষয়বস্তু বা উপকরণ এতে বাধ সেধে বসলো। লেখক জীবনের শুরুর দিকে নতুন একটা বই লিখতে বসলেই পুরোনো সেই শূণ্যতা আমাকে ঘিরে ধরতো। তারপর আবার সেই শুরুতে ফিরে যেতে হতো। পরের বইগুলো লেখার সময় প্রথমটার মতোই ঘটনা ঘটলো। নাছোড়বান্দার মতো একটা বিষয়বস্তু বা ধারণাকে ছেলেমানুষের মতো আমি আঁকড়ে ধরলাম। সেই উপকরণ কোথায় গিয়ে শেষ হবে সে ব্যাপারে স্বচ্ছ কোন ধারনাই আমার ছিল না। এভাবে লিখতে লিখতে একসময় আমার জ্ঞান বাড়ল। প্রতিটা বই লেখার অভিজ্ঞতা আমার বোঝার ক্ষমতা আর অনুভূতিবোধকে আরো গভীর করে তুললো। ফলে একসময় আমি ভিন্ন ধারার লেখা শুরু করার ক্ষমতা আবিষ্কার করতে সমর্থ হলাম। লেখার ধারা আবিষ্কার চক্রে প্রতিটা বই-ই এক একটা ধাপ, কোন ধাপেরই পুণরাবৃত্তি ঘটে না। আমার লেখার বিষয়বস্তু হল আমার অতীত, যা ভিন্ন পরিবেশে আমার কাছ থেকে আজ পৃথক আর এই বিষয়বস্তু স্থির ও স্বয়ংসম্পূর্ণ। ঠিক আমার ছেলেবেলার মতোই এর সাথে নতুন কিছু যুক্ত করার উপায় নেই। আমার লেখার এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে পাঁচ বছর ধরে একই বিষয়বস্তু ব্যবহার করে লেখার পর একসময় আমার লেখার সব উপকরণ ফুরিয়ে গেলো। আমার লেখার কাল্পনিক ক্ষমতা যেন একটি চকে লেখার ব্ল্যাকবোর্ড, প্রতিটা ধাপ লেখার সময় মুছে পরিষ্কার করে ফেলতে ফেলতে শেষে আবার শূন্য হয়ে যায়- ল্যাটিন ভাষায় যাকে বলে ট্যাবুলা রাসা বা শূন্য স্লেট।

 

ফিকশন আমাকে যথাসম্ভব এগিয়ে নিয়ে গেছে। তবে কয়েকটা ব্যাপারে আমার গদ্য লেখার ক্ষমতা একেবারেই নেই। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, ইংল্যান্ডে যে ক’বছর ছিলাম ঐ সময়ের সামজিক অভিজ্ঞতায় কোন গভীরতা ছিলো না। তাই সে কটা বছর নিয়ে লেখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ওটা নিয়ে লিখলে কেবল আত্মজীবনী লেখা সম্ভব। সেই আত্মজীবনীর বিষয়বস্তু হবে বৃহত্তর জগত সম্পর্কে আমার ক্রমবর্ধমান জ্ঞানের বিস্তার। ফিকশনের প্রকৃতি অনুসারেই আমার উপন্যাস লেখার ক্ষমতা কেবল একটা নির্দিষ্ট সামাজিক পরিসরেই কাজ করতে পারছিল। ফলে আমার গদ্য লেখার ক্ষমতা আমাকে কেবলই পেছনের দিকে, বিশেষত দ্বীপের ঔপনিবেশিক জীবনে অথবা আমার ছেলেবলার জগতে ঠেলে নিয়ে যেত। তাই বর্তমানের বিশাল জগত থেকে ক্ষুদ্রতর পরিসরেই আমাকে গদ্য লিখতে হতো। যে ফিকশন একদা আমাকে শূন্যতার হাত থেকে মুক্তি দিয়ে নতুন পথের আলো দেখিয়েছিল, সেই ফিকশনই আমাকে তখনকার বর্তমান সত্তার চেয়ে ছোট হতে বাধ্য করেছিল। প্রায় তিন-চার বছর এই একই গণ্ডিতে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। কীভাবে আরো সামনে এগুনো যায় সেটা আমি কিছুতেই ঠাওর করতে পারছিলাম না।

 

প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের অধিকাংশ সময়টাই আমি আগন্তুকের মত এমন সব দেশে কাটিয়ে দিয়েছি যেখানে আমি একজন শিকড়বিহীন মানুষ। আমার লেখক সত্তা এই অভিজ্ঞতার গণ্ডির বাইরে কিছুতেই বের হতে পারছিল না। বারবারই আমি সেই আগন্তুক অভিজ্ঞতাকে ফুটিয়ে তোলার জন্য এমন সব চরিত্র সৃষ্টি করতাম যারা আমার মতোই শিকড়বিহীন আগন্তুক জীবন কাটিয়েছে। এ ধরনের লেখা সৃষ্টির পথ আমি সহজেই খুঁজে পেতাম; তবে এটিকে আমি কখনোই আমার সীমাবদ্ধতা হিসেবে অনুভব করিনি। এটা ঠিক যে, কেবল উপন্যাসের ওপর নির্ভর করে লেখালেখি চালিয়ে গেলে অল্প সময়ের ভেতরই আমার লেখার উপকরণ ফুরিয়ে যেতো। অনেক আগে থেকেই এ বিষয়টি নিয়ে আমি ভেবেছিলাম। সেজন্যই নিজে নিজে বর্ণনামূলক গদ্য লেখার অভ্যাস গড়ে তুলেছিলাম। সেই সাথে মানুষের জীবন আর পুরো পৃথিবী সম্পর্কেও নিজেকে ভীষণ কৌতূহলী করে গড়ে তুলেছিলাম।

 

সৌভাগ্যবশত, এই সময়টাতেই আমি প্রাচীন স্প্যানিশ ভূখণ্ড এবং ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে দাসপ্রথা প্রচলিত ছিল এমন সব এলাকায় ভ্রমণের সুযোগ পেয়ে গেলাম। ভ্রমণকাহিনী লেখার কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকার পরও, ভ্রমণের আনন্দ পাওয়া যাবে কেবল এটি ভেবেই আমি প্রস্তাবটি লুফে নিলাম। আর এভাবেই লেখালেখির অন্যান্য ধারাগুলোতেও আমার বিচরণ শুরু হয়ে গেল।

 

আমার ধারণা ছিলো যে, নিবেদিত প্রাণ লেখকদের জন্য ভ্রমণ কাহিনী লেখাটা একটা চমৎকার অবকাশের মতো। কিন্তু যেসব লেখকদের ভ্রমণ কাহিনী পড়ে এই ধারণাটা আমি আত্মস্থ করেছিলাম তারা সকলেই ছিলো শহুরে জীবনের মানুষ। যেমন- হাক্সলি, লরেন্স, ওয়াহ্। আমি ব্যক্তিগতভাবে এদের মতো নই। এরা সবাই লিখেছেন সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শাসানামলে। বাড়িতে তাদের চরিত্র যেমনই থাকুক না কেন, ভ্রমণের সময় তারা আধা-ঔপনিবেশিক হয়ে গিয়েছিলেন। ভ্রমণের সময় ঘটমান দুর্ঘটনাগুলো তারা এমনভাবে বর্ণনা করেছেন যাতে তাদের শহুরে ব্যক্তিত্বের উন্নাসিক মেজাজ বিদেশের পটভূমিকায় অক্ষুন্ন থাকে ।

 

আমার ভ্রমণটা তাদের মতো ছিল না। আমি ঘুরতে গিয়েছিলাম নতুন পৃথিবীর আবাদী এলাকায়। আমি নিজেও ওরকমই একটা জায়গায় বড় হয়েছি। নতুন পৃথিবীর রোমান্টিক আবহাওয়ার ভেতর লুণ্ঠিত কোন দেশের পরিত্যক্ত সমাজব্যবস্থাকে একজন দর্শনার্থীর চোখ দিয়ে দেখতে দেখতে আমি যেন আমার নিজের ছেলেবেলার সমাজটাকেই একটু দূর থেকে দেখতে পেলাম। ব্যাপারটা ঠিক উপন্যাসের আরেকটি উপাদান খুঁজে পাবার মতো। নিজের বর্তমান পরিস্থিতি আর নিজেকে ভুলে গিয়ে নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ছোটবেলার সেই চিরপরিচিত সমাজব্যবস্থাকে দেখার সুযোগ পেয়ে আমি যারপরনাই পুলকিত হলাম। ঔপনিবেশিক পরিবেশের ভেতর মানুষের জন্ম ও বেড়ে ওঠার চিত্র আমাকে সমৃদ্ধ করল। ঔপনিবেশিক যাঁতাকলে পিষ্ট মানুষের জায়গায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে আমি বহুদিন আগের ঘটে যাওয়া পরিচিত ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো নতুন ভাবে মনের পর্দায় দেখতে পেলাম।

 

লিখতে বসে, ভ্রমণকাহিনী লেখার কাঠামো নিয়ে আমি সমস্যায় পড়ে গেলাম। বই লেখার উদ্দেশ্যে কীভাবে ভ্রমণ করতে হয় তা আমার জানা ছিলো না। ছুটি কাটাতে আসা মানুষের মতোই আনন্দ উল্লাস নিয়ে ভ্রমণ শেষ করলাম। তারপর একদিন লিখতে বসে বর্ণনামূলক লেখার কাঠামো নিয়ে ভাবতে ভাবতে দিশেহারা হয়ে পড়লাম। ভ্রমণ কাহিনীর লেখক হিসেবে ‘আমি’ সর্বনাম কীভাবে ব্যবহার করবো, তাই নিয়ে ভাবনার সাগরে হাবুডুবু খেতে লাগলাম। একবার মনে হল যে বর্ণনাকারী লেখক নিজেই ভ্রমণকারী হওয়াতে তার ক্ষমতা অসীম এবং তাকেই গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিচার বিবেচনা করতে হবে। আবার মনে হল ভাবনাটা সঠিক হচ্ছে না। (চলবে)



পঞ্চম পর্ব

শেয়ার