অজ্ঞাতনামা কুকুর ।। হাসিবুল আলম

সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যবস্থা হচ্ছে এই কুকুর। জিনিসটার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ছেলেবেলায়। আমি এটাকে একটা খেলার সামগ্রী ভেবেছিলাম। কত লোম আর রং! একবার ওর লেজ নিয়ে বেশ হৈ চৈ জমিয়ে ফেলেছিলাম। অনেকবার শক্ত করে চেপে ধরেছি লেজটা সোজা করতে। অনেকবার। আমার হাত শক্ত হওয়ার পেছনে কুকুরের লেজের বেশমাত্রার একটা অবদান রয়েছে। এখন এই হাতটা বেশ শক্ত একটা গ্যাং চালানোর পক্ষে। এবং তাতেই আমার অবলম্বন। কুকুর’ই আমাকে জীবন ও জীবিকা দিয়েছে।

তখন বয়স বড় জোর পাঁচ। আমার খেলবার সামগ্রী শুধু কুকুর। বাবা একটা নীল হাফপ্যান্ট আর শাদা শার্ট বানিয়ে দেওয়ার জন্য আমাকে দর্জিঘরে নিয়ে এলেন। বললেন- এখন কুকুর ছেড়ে দাও। এই পোশাকটার দিকে মনোযোগী হও। একগজ কাপড়ের দাম কত জানো!তো আমি পোশাকটির দিকে মনোযোগী হই। বয়ঃসন্ধিকালটা স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরি। প্রতিদিন এক একটা পৃষ্ঠা উল্টাই।

সেদিন সকালবেলা কুকুরটি বাসার সামনে বসা ছিল (কুকুরটি নাকি আমার জন্মের আগে থেকেই ওভাবে বসা আছে)। মা প্রতিদিনকার মতো গমের রুটি বানাচ্ছিলেন। ডায়াবেটিস আক্রান্ত মা একটা পোড়া রুটি ছুড়ে দিলেন। কুকুরটি প্রথমে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল। ছুঁড়ে দেওয়া জিনিসটা গ্রহণীয় না বর্জনীয় কিংবা এর প্রভাবটাই বা কেমন হবে তা ভাবতে ভাবতে উঠে দাঁড়ালো সে। আরে ভাই, ক্ষুধা তো সবার’ই আছে নাকি? তো ভোগ করবে না ছেড়ে দেবে এটা ভাববার অবকাশ কোথায়! সুতরাং দাঁত দিয়ে সরলতার সাথেই ও গ্রাস করলো মায়ের বদান্যতাটুকু। মা-ও তৃপ্তি নিয়ে দেখলেন কুকুরটার তৃপ্ত দাঁতগুলো! ওইদিনকার মতো সকালের কাজ-বাজ শেষ। শাদা শার্ট, নীল প্যান্ট। কাগজ দিয়ে নৌকো বানানোর কারুকাজ শিখছিলাম। কুকুরটা খুব মনোযোগ দিয়ে আমার নৌকো বানানো দেখছে। আমি কিছু না বলেই মেনে নিলাম সব। কী এক খেয়ালে কুকুরটার পিঠে হাত বুলানো শুরু করলাম। শক্ত করে কুকুরটার লেজ টেনে সোজা করার চেষ্টা করতে লাগলাম।

দুপুরবেলা। কিচ্ছু করার নেই। ভোজনের পর অংক করতে বসলাম। পরিমিতি, একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি। ছায়া দিয়ে পিরামিডের উচ্চতা নির্ণয়। তখন জানালা দিয়ে বাতাস ও কুকুরের গোঙানি ঢুকে পড়ছে পিরামিডের ভেতর। পিরামিডের ভেতরে বসে কাঁদছি- আমি ও ঈশ্বর ‘আটুম’। প্রচলিত আছে- এই ‘আটুম’ নাকি নিজের ছায়ার সঙ্গে সঙ্গম করে বংশবৃদ্ধি করেছিল। পরিমিতি রেখে আমারও ইচ্ছে করছে নিজের ছায়ার দিকে তাকিয়ে হস্তমৈথুন করি। একদম নিজের মতো কাউকে এনে নিজেকে সঙ্গ দিই।

ঘেউ! ঘেউ!! ঘেউ!!!

এখন সন্ধ্যাবেলা। কুকুরটা খুব উচ্চাঙ্গে ডাকছে। আমি পরিমিতি ও পিরামিডের বাইরে বের হলাম। কুকুরটার সঙ্গে একটু ঘন হতেই পাশের বাসার জানালায় কয়েকটি উৎসুক চোখ ‘ছিঃ ছিঃ’করে উঠলো। কিন্তু আমার আর তাদের দিকে মনোযোগ দেওয়া হয়ে উঠলো না। পরিতৃপ্ত-পরিশ্রান্ত হয়ে উঠে আসলাম। ফেরার সময় শাদা শার্ট, ব্লু প্যান্ট পরা ক’জন ঘিরে ফেললো আমাকে। কতগুলো ইটের টুকরো ছুঁড়ে ওরা শায়েস্তা করতে চাইলো আমাকে। আমি দৌঁড়ে ঘরে ফিরতে চাইলাম, পরিমিতি ও পিরামিডের ভেতরে, গমের রুটির পাশে। কিন্তু উপর‌্যুপরি আক্রমণে দিশেহারা হয়ে আমি পালিয়ে গেলাম। আরো কয়েকটি কুকুর পেয়ে গেলাম পালানোর পথে।

কুকুরগুলোকে নিয়ে একটা গ্যাং দাঁড় করিয়েছি আমি। আমাদের মধ্যে অনেক বিরোধ থাকা সত্ত্বেও আমরা একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম যে- আমাদের বেঁচে থাকতে হবে!

প্রথমে আমরা একটি বেকারিতে হামলার পরিকল্পনা করলাম। অনেক বিচার-বিশ্লেষণ শেষে একটা নকশা তৈরী হলো। নকশাটি নাকের সামনে নিয়ে ভাবছি- সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যবস্থা হচ্ছে এই কুকুর। জিনিসটার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটেছিল ছেলেবেলায়। আমি এটাকে একটা খেলার সামগ্রী ভেবেছিলাম। কতো লোম আর রং! একবার ওর লেজ নিয়ে বেশ হৈ চৈ জমিয়ে ফেলেছিলাম। অনেকবার শক্ত করে চেপে ধরে লেজটা সোজা করতে চেয়েছি। অনেকবার। আমার হাত শক্ত হবার পেছনে কুকুরের লেজের বেশমাত্রার একটা অবদান রয়েছে। এখন এই হাতটা বেশ শক্ত একটা গ্যাং চালানোর পক্ষে, যারা বেঁচে থাকতে চায় তাদের  জন্য।

কিন্তু তারপরেও কিছু সীমাবদ্ধতা থেকে যায়। সেদিন একজন কিছু না জানিয়েই দ্রুতগামী একটি ট্রাকের নিচে ঝাপ দিয়েছে।  প্রত্যক্ষদর্শীর সিদ্ধান্তে একটি অজ্ঞাতনামা কুকুর মারা গেছে। তাঁর অনুপস্থিতি সত্য। কিন্তু আমরা তার মরে যাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত নই।

শেয়ার
সর্বশেষ সংখ্যা