হিজল জোবায়েরের ‘জলপাই পাতার নিশান’— শান্তি ও মানবিকতার গান | উপল বড়ুয়া

‘কবিতা একটি জীবিত ফলের প্রক্রিয়ার ফল, এবং সে স্বয়ং প্রচণ্ডভাবে জীবন্ত’। হিজল জোবায়েরের ‘জলপাই পাতার নিশান’ পড়তে পড়তে মনে হলো কবি মণীন্দ্র গুপ্তের উপরোক্ত কথাখানা শতাংশে সত্যি। শিল্প জীবন্ত হয়ে উঠতে না পারলে তার কদর থাকে না কোনো কালে। জীবন্ত বিধায় লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ষোড়শ শতকের কীর্তি ‘মোনালিসা’ এখনো হাসে; ভ্যান গগের ‘সানফ্লাওয়ার’ সুবাস ছড়ায়। জীবনানন্দ দাশের ‘চিল’ ডিগবাজি খায় মগজে।

হিজল জোবায়ের আমাদের সময়ের অন্যতম কাব্য প্রতিভা। তাঁর কবিতা জীবন্ত। জীবন্ত বিধায় তাঁর কবিতা আরেকটি প্রাণকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত। ‘প্রাণে প্রাণ মেলাতে’ চায়। হিজলের ‘আদিম পুস্তকে এইরূপে লেখা হয়েছিল’ থেকে ‘ধুলা পবনের দেশ’ ঘুরে ‘জলপাই পাতার নিশান’— তিন কিতাবে তিনি স্বতন্ত্র কাব্যভাষা নির্মাণ ও মেজাজ তৈরির পরিচয় দিয়েছেন ইতোমধ্যে।

বস্তুত ইতিহাস চেতনা ও শষ্যক্ষেতের ভেতর দিয়ে হেঁটে একেকটি মিথকে তুলে এনেছেন হিজল। কিন্তু তার ব্যবহার ফুটিয়েছেন একটু ভিন্ন ধাঁচে। এটাই তাঁর কবিতার বৈশিষ্ট্য। আর সব ছাপিয়ে ‘জলপাই পাতার নিশান’ উড়িয়ে হিজল দিয়েছেন মানবিকতা ও শান্তির পরিচয়।

‘জলপাই শাখা’ শান্তির প্রতীক। তারও ধর্মীয় মিথ রয়েছে। জাতিসংঘের পতাকায় শান্তির মনোগ্রাম হিসেবে রয়েছে জলপাই পাতা। কেবল জাতিসংঘ নয়; একজন কবিও চান বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা হোক। গ্রাম থেকে শহরে, শহর থেকে আজ দেশে দেশে যে যুদ্ধ তার করাল গ্রাস থেকে মুক্ত হোক বিশ্ব। হিজলের ভাষায় বলা যাক, ‘সেনাছাউনির বাইরে— বয়ে যাবে অনিঃশেষ জলপাই বনের বাতাস’।

জলপাইরঙা সেনাবাহিনী যতটুকু না শান্তির, তারচেয়ে আজকের সময়ে সবচেয়ে ভীতির নাম। তারপরও যখন হিজলকে বলতে দেখি, ‘বৃষ্টি পড়ছে, বৃষ্টি। অব্যাহত বৃষ্টিপতনের নিচে ভিজে যাচ্ছে মিলিটারিদের মাঠ ও জঙ্গল’, তখন সেনাবাহিনী আর অস্ত্রধারী থাকেন না। সৈনিকরাও হয়ে উঠেন পোশাকের বাইরের মানুষ। এই যে মিলিটারি মাঠেও নান্দনিকতা-দ্যোতনা তৈরি, এ তো কবিরাই পারে।

হিজলের কবিতার ভাষা মাপা-মাপা। ছন্দোবদ্ধ। বাহুল্যবর্জিত। নির্মেদ। সমকালীনতা ছুঁয়ে রয়েছে একটা গন্তব্যে পৌঁছানোর যাত্রা। ‘রিহার্সেল’ কবিতাটা নিঃসন্দেহে তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। রূপকের ভেতর দিয়ে নিদারুণ সত্যকে উপস্থাপন।

এই উদাহরণে ‘জলপাই পাতার নিশান’ থেকে ‘বেথলেহাম’ কবিতার কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া যাক— ‘এখানে ওখানে/কসাই-দোকানে/ঝুলিয়ে রেখেছি/তোদের মাংস,/সিনা আর হাড়/কচি-কলিজার/টকটকা লাল/শ্রেষ্ঠ অংশ’।

হিজলের ভাষাভঙ্গিমা এমন যে, আপনি কখনো একটা কবিতার আধেক পড়ে উঠে যেতে পারবেন না। ‘জলপাই পাতার নিশান’ খুলে প্রথম যে কবিতাটি চোখে পড়ল, তা ‘রাক্ষস’। আর তাতেই আমি ভক্ষণ হয়ে গেছি। চলুন কয়েক লাইন পড়া যাক—

সবাই ছিল ঘুমে

খরদুপুরের দিকে

 

বসন্ত মরশুমে—

জন্মাল রাক্ষস

ফুলের গর্ভ থেকে

প্রকাশকঃ বাতিঘর

হিজল ছন্দে সিদ্ধহস্ত। ওস্তাদ লোক। তাঁর যাবতীয় কিছু ছন্দে পড়তে ভালো লাগে। গদ্য ঢঙেও ‘ছন্দের বারান্দা’ দিয়ে হাঁটেন। আমি যেহেতু এই বিষয়ে কম জানাশোনা লোক, তার আলোচনা আর নাই-বা করি। বরং ছন্দে পড়ে আমার মাথা দোলানোর আনন্দটুকুই থাক। আর ফুলের গর্ভ থেকে রাক্ষস কীভাবে জন্মায় তা নিয়ে চিন্তা যাক।

অবশ্য তার কবিতা হৃদয় দোলায় বেশি। কখনো জখম করেন, সারানও তিনি। ‘পিকেটিং’ নামে ছোট্ট একটা কবিতা আছে ‘জলপাই পাতার নিশান’-এ। কয়েকলাইনের কবিতা, কিন্তু তীব্র। পুরোটাই এখানে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। আশা করি, তাতে আলোচনার ব্যাঘাত ঘটবে না।

‘হামিদ, তোমার পানের দোকান আজ বন্ধ—কদিন আগেই তোমার বাবা মারা গেছে—তোমার পানের দোকান আজ বন্ধ—এইটুকু ব্যথা বুকে বড় হয়ে ওঠে—এইটুকু ব্যথা নিয়ে আমি আজ মরে যেতে পারি।’

হিজল অন্যের ব্যথায় পাশে দাঁড়াতে পারেন। অন্যের কষ্টকে স্পর্শ করতে পারেন। তাঁর নিজের ব্যথাও কী কম! এই কিতাবের ‘মায়ের দোয়া গোশত বিতান’, ‘নওফিয়া’ ও ‘শবাধার পাঠে বেদনাবোধ উস্কে দিতে পারে পাঠককে।

‘শবাধার’ কবিতায় ঢাকার মতো জনাকীর্ণ এক শহরের বাসিন্দাকে কবির প্রশ্ন, ‘ম্যাচবাকশের মতো ঘরগুলো কার?/এ শহরে তমি থাকো, নুরুন নাহার?’ কিংবা ‘পুঁজ’ কবিতায় আত্ম-অভিমানে বলেন, ‘চাল খাব না, পাথর খাব, গোগ্রাসে দুই হাতে/ভাত খাব না, ভাত খাব না, বিষ্ঠা দিয়ো পাতে’।

হিজল হুটহাট চমকে দেওয়ার মতো কবিতা লেখেন না। তার যাত্রা টোটালিটির দিকে। অনেকটা ক্ল্যাসিক রক ও ব্লুজের ড্রাম বিট মনে হতে পারে। আর সেই গান তিনি সাজিয়েছেন বিভিন্ন উপাদানে। এসেছে ইসলামিক অনুষঙ্গ, সমকালীন রাজনীতি। আর বিশেষ করে মানবতার গান। তবে তার কোনোটাই চর্বিতচর্বন নয়। এখানেই তিনি অনন্য। এছাড়া পূর্বজ দুই শক্তিমান কবি শহীদ কাদরী ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত দুই কবিতাকে নতুনভাবে তার আখ্যান প্রবণতা নজর কাড়ে।  

বুদ্ধদেব বসু তাঁর বিখ্যাত ‘কবিতা’ পত্রিকায় সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘অর্কেস্ট্রা’ কাব্যগ্রন্থের আলোচনায় লিখেছিলেন ‘কবিদের মধ্যে দুটো জাত আছে; যাঁরা ঝোঁকের মাথায় কবিতা লেখেন, আর যাঁরা ভেবেচিন্তে লেখেন’ … তীব্র আবেগেই হচ্ছে প্রথম জাতের কবিদের চিরন্তন উৎস, দ্বিতীয় জাতের কবিরা বুদ্ধিনির্ভর।’

হিজল জোবায়ের তীব্র আবেগী নন, তবে আবেগী। আবেগ না থাকলে কবিতার বেগও যে থাকে না! আবেগকে সংযত করে চলতে পারেন তিনি। বুদ্ধিনির্ভর তো বটেই। আর ‘জলপাই পাতার নিশান’ দিয়ে তার সেই চরিত্রকে আরেকবার প্রমাণ দিলেন।


বই: জলপাই পাতার নিশান

প্রচ্ছদশিল্পী: সব্যসাচী হাজরা

প্রকাশক: বাতিঘর

প্রকাশকাল: ২০২২

মূল্য: ২০০ টাকা

শেয়ার