শিশির ভট্টাচার্য্য-এর সাক্ষাৎকার ।। আলাপকারী: শরীফা বুলবুল

শিশির ভট্টাচার্য্যের কার্টুন যেদিন পত্রিকায় ছাপা হয়, সেদিন সে-পত্রিকাটি একটি বিশেষ সংখ্যায় পরিণত হয়। আগেকার দিকে কার্টুন ছাপা হতো পত্রিকার নিচে বা কোন কোণায়, কিন্তু শিশিরের কার্টুন প্রকাশিত হয় পত্রিকার একেবারে উপরের দিকে বিশাল জায়গাজুড়ে। পাঠক পত্রিকা হাতে নিয়েই ঝুঁকে পড়েন কার্টুনের দিকে। কারণ তিনি জানেন শিশিরের কার্টুনে চলমান আলোচিত ইস্যুটি তার মনের মতো করেই আঁকা হয়েছে। অর্থাৎ চলমান ব্যক্তি বা রাষ্ট্রীয় জীবনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ বা জিজ্ঞাসা একটি কার্টুনেই নির্ঘাত প্রকাশিত হয়ে যাবে, এ প্রতীতী এতদিনে জন্মে গেছে পাঠকের। শিশির কার্টুনকে নিয়ে গেছেন শিল্পের দরজায়। তার কার্টুন রাজনৈতিক প্রতিবাদ, ব্যক্তিগত ও সামাজিক শ্লেষ, ক্ষোভ, ঘৃণা – সবকিছু। সবার উপরে এটি একটি শিল্প, যে শিল্প দীর্ঘদিনের চর্চা ও অভ্যাসে শিশির অর্জন করেছেন যুদ্ধাস্ত্রের মতো। শিশির যে কার্টুন আঁকেন এটি আমাদের বড় ভাগ্য। এমন পোড়ার দেশে একজন শিশির কীভাবে জন্ম নিলেন সে এক বিস্ময়! আশির দশকে স্বৈরাচারি শাসক যখন এ দেশে অনাচারের মহাতাণ্ডব চালাচ্ছিল, তখন শিশির তার যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে এগিয়ে এলেন। একাই তিনি লড়াই করলেন তখনকার তিনজোটের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সমান। জনগণের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ ও প্রতিবাদ তার কার্টুনে উদ্ভাসিত হয়ে উঠতে থাকলো। দেশবন্ধু, পূর্বাভাস, একতা, আজকের কাগজ প্রভৃতি পত্রিকায় ক্লান্তিহীন কার্টুন এঁকে তিনি স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনকে উসকে দিতে থাকলেন। এরশাদের শাসনের বিরুদ্ধে তার ক্ষোভ এতোটাই ছিলো যে, সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, এরশাদ ৯ বছর ক্ষমতায় না থাকলে তিনি হয়তো কার্টুনিস্ট হতেন না। শিশির শুধু রাজনৈতিক সমস্যা নিয়েই কার্টুন আঁকেননি, তার কার্টুন কথা বলেছে নানা সামাজিক অসঙ্গতি নিয়েও। কার্টুনিস্ট হিসাবে শিশিরের খ্যাতি ছাড়িয়ে গেছে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে এমনকী মহাদেশেরও বাইরে। তাকে নিয়ে বলাকা পত্রিকায় একটি বিশেষ সংখ্যা করার পরিকল্পনাও অনেকদিনের। গত ২৫ জুন ২০০৬ অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে শিশির ভট্টাচার্যকে পেয়ে যাই শিল্পী ঢালী আল মামুনের বাসায়। তাকে পেয়ে আনন্দে বিহ্বল হই এবং সাক্ষাৎকার নেয়ার সুযোগটাকে হাতছাড়া করতে চাইনি। দ্বিধা ও সংকোচকে পাশে ফেলে বলেই ফেলি। সাক্ষাৎকারের কথা শুনে লাজুক, বিনয়ী শিশির দা না, না, না বলে অসম্মতি জানালেন। ঢালী ভাই তখন আমার পক্ষ নিয়ে বললেন, “দাও না, কী হবে!” শিশিরদা অপ্রস্তুত স্বরে বললেন, “আমি এমন কী হয়েছি যে সাক্ষাৎকার দেবো!” কিছুক্ষণ নীরবতার পর বললেন, “আচ্ছা, ঠিক আছে। কাল আসুন”। পরদিন ২৬ জুন ২০০৬ বিকেল ৫টায় হাজির হই চট্টেশ্বরী রোডের কনকর্ড টাওয়ারস্থ শিল্পী ঢালী আল মামুনের ফ্ল্যাটে… অতঃপর …

ins02


আঁকার মাধ্যমে আমার পছন্দ দ্বিমাত্রিক চিত্র, অর্থাৎ ড্রয়িংপ্রধান ছবি। আমি এর প্রতিই বেশি ফেসিনেটেড বলা যায়। নানা মাধ্যমে এক্সপেরিমেন্ট আমি ঠিক পারি না – সম্ভবও হয় না।


শরীফা বুলবুল: প্রথমেই আপনার কাছে জানতে চাচ্ছি, কার্টুন করার কথা কিভাবে মাথায় আসলো?

শিশির ভট্টাচার্য্য: এরশাদের মতো লোক যদি আমাদের দেশে নয়টা বছর শাসন না করতো, তাহলে বোধ হয় আমি কার্টুনিস্ট হতাম না। কেননা সেই সময়টা ছিলো স্বৈরাচারী সময়। সে সময় ৮৭ এর শেষদিকে ভারতের বরোদা থেকে মাস্টার্স কমপ্লিট করে ঢাকায় এলাম। তখনও স্বৈরাচারী শাসন চলছে। স্বৈরাচার সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ টাইপের অনেক কার্টুন আমার সাধ্যমতো করতাম। আমার পেইন্টিংয়ের মধ্যে এগুলো আসতো। স্বৈরাচারি শাসন ব্যবস্থাকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে করা আমার সিরিজ পেইন্টিং ছিলো – ‘নায়কের গল্প হতে পারতো’ নামের। সেখানে শিল্পী হিসাবে আমার ডিকটেটরশিপ ছিলো কাউকে নায়ক বানানো – কাউকে খলনায়ক বানানো। যাই হোক, ঢাকায় আসার পর, আমার কিছু বন্ধু-বান্ধব পত্রিকা বের করার চিন্তা করলো এবং সেটার কভার কার্টুন দিয়েই করবে এরকম সিদ্ধান্ত হলো। পত্রিকার নাম দেশবন্ধু (সাপ্তাহিক)। দশটা সংখ্যা বের হয়ে এগার নম্বরে বাজেয়াপ্ত করা হয়। কভারে এবং ভেতরেও কার্টুন থাকতো। সব মিলে ‘যায়যায় দিন’ এবং ‘বিচিন্তা’ দুটি জনপ্রিয় পত্রিকার মধ্যেও ‘দেশবন্ধু’ জনপ্রিয় ও আলোচিত হয়ে ওঠে। কার্টুনের একটা ভূমিকা ছিলো সেজন্য। এরপর কমিউনিস্ট পার্টির সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘একতা’য় কার্টুন দেয়া। মনে আছে – আদমজী বাওয়ানী ঢাকায় আসছে; আবার ওরা! এই বিষয়েই প্রথম কার্টুন করি। একতায় প্রতি সপ্তাহে একটি কার্টুন দিতাম (পলিটিক্যাল) যা পত্রিকার ফ্রন্ট পেজে থাকতো। কার্টুন নিয়ে আলোচনা হতো। বিশেষ করে এরশাদ ও তার মন্ত্রীসভার সদস্যদের কার্টুনে দেখে অনেকেই মজা পেতেন। কেননা, হোমরা-চোমরাদের চেহারা বিকৃত করে এমন কার্টুনের চর্চাটা প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিল। একদল তরুণ সংবাদকর্মীদের পরিচালনায় শুরু হয় নতুন ধারার একটি দৈনিক পত্রিকা – আজকের কাগজ। রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বলে নেয়া ভালো – আজকে যেই জেনারেশন সব দৈনিক এবং স্যাটেলাইট মিডিয়াতে দাপটের সাথে কাজ করছে তাদের অধিকাংশের শুরু ঐ আজকের কাগজ থেকে। ‘একতা’র সম্পাদক মতিউর রহমানও শিং ভেঙে বাছুরের দলে মানে তরুণ সাংবাদিকদের দলে ভিড়লেন। যুক্ত হলেন আজকের কাগজের সঙ্গে। আমাকেও অনুরোধ করা হলো আজকের কাগজে কার্টুন দেবার জন্য। অনেক ভেবে-চিন্তে শুরুও করলাম। ইতিমধ্যে ‘পূর্বাভাস’ নামে এক পাক্ষিকে রঙিন কার্টুন করেছিলাম কিছুদিন। সেখানে এরশাদের শেষ সময় নিয়ে বেশ মজার এবং আলোচিত কিছু কার্টুন ছিলো। তবে হ্যাঁ, দৈনিক পত্রিকা হিসেবে আজকের কাগজই প্রথম যেখানে কার্টুন আঁকতে শুরু করলাম। বিএনপি তখন ক্ষমতায়। কার্টুনে তাদের চেহারা। প্রতিদিন না। সপ্তাহে অন্তত তিনদিন কার্টুন থাকতো। আজকের কাগজে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিলো ‘তুই রাজাকার’ নামে একটি কলাম। ওখানে প্রতিদিন একজন রাজাকারের ক্যারিকেচার থাকতো। সে সময় অদ্ভুত এক অনুভূতি হতে থাকলো। মূলত সে সময় ডিসেম্বরকে টার্গেট করে ওরা ডিসেম্বরের ১ তারিখ থেকে শুরু করে ‘তুই রাজাকার’ কলামটি। সেখানে রাজাকারদের মুখের বিকৃতি এবং তাদের কুকীর্তির বিবরণটাও থাকতো। এরকম করে ১৫ তারিখ পর্যন্ত বিভিন্ন রাজাকারের ছবি আসে এবং সেই সময় কিন্তু এরশাদ ক্ষমতায় না, সে সময় বিএনপি ক্ষমতায় চলে এসেছে এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সমস্ত কিছু করে। আব্দুর রহমান বিশ্বাস তখন দেশের রাষ্ট্রপতি। আব্দুর রহমান বিশ্বাসের ব্যাপারেও শান্তি কমিটির মেম্বার ছিল, বিতর্কিত লোক, অথচ তিনি একটা দেশের প্রেসিডেন্ট। সেটা নিয়ে কিন্তু অনেক সমালোচনা হয়েছে। তখন সবাই বললো যে, এতো জনকে ধরা হচ্ছে। আর দেশের প্রেসিডেন্টই তো শান্তি কমিটির মেম্বার তাকে কেন ধরা হচ্ছে না? এবং ওদের টার্গেটই ছিলো যে শেষেরটা প্রেসিডেন্টকে দেবে। কিন্তু কথা হচ্ছে যে, প্রেসিডেন্টকে নিয়ে তো সেভাবে কার্টুন করা যায় না। তো ১৬ তারিখের কার্টুনটা খুবই ইন্টারেস্টিং কারণ ওখানে কোন ছবি ছিলো না। কার্টুনে চেহারা ছিলো না। সেখানে লেখা ছিলো ‘তুই রাজাকার’ এবং লেখার ধরণটা এমন ছিলো – যে কেউ বুঝতে পারতো এটা কাকে মিন করা হচ্ছে। ‘আমাদের বিশ্বাসেই অবিশ্বাস’ এরকম একটা ক্যাপশন দিয়ে লেখা ছিলো। সবাই বুঝে ফেলেছে যে এটা কাকে মিন করা হয়েছে। মানে দুই কূলই বাঁচলো। আমাদের দেশে তো কিছু নিয়ম আছে যে এখানে রাষ্ট্রপতি, সংসদ ভবন, সংবিধান, সুপ্রিম কোর্ট এবং বিচার বিভাগ এগুলো নিয়ে ঠিক ব্যঙ্গাত্মক-বিদ্রুপাত্মক কিছু করা যাবে না। এবং হচ্ছে তবুও। এটা নিয়ে যদি কেউ আপত্তি করে তাহলে যে কেউ মানহানি মামলা করতে পারে। এইভাবে আজকের কাগজে কার্টুন করতে করতে দৈনিক আজকের কাগজের মাধ্যমে মোটামুটি দেশে আমার পরিচিতিটাও হলো। আমার একটা অবলিগেশনও তৈরি হয়ে গেলো।

– সেটা দায়বদ্ধতা, যার জন্য আমার কোন প্ল্যান ছিলো না – প্রস্তুতিও ছিলো না। মূলত : এই চিন্তা করেই কোন দৈনিক পত্রিকায় কার্টুন শুরু নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ছিলাম। যা হোক শুরু হয়ে গেলো। আজকের কাগজ থেকে ভোরের কাগজ এবং সেখান থেকে এখন প্রথম আলো। এবং যথারীতি আমিও মানে শিশির একজন কার্টুনিস্ট নামে পরিচিতি পেলো।

এখন বলি, কেন কার্টুন? আসলে বিশেষ করে রাজনৈতিক কার্টুন প্রতিবাদের একটা ভাষা। সাধারণ চিত্রকর্মে যা পারা যায় না, কার্টুনে তা সম্ভব। কামরুল হাসানের আঁকা ইয়াহিয়ার ব্যঙ্গচিত্র – ‘এই জানোয়ারকে হত্যা করতে হবে’ পোস্টারটি মুক্তিকামী বাঙালিদের উদ্দীপ্ত করেছিল। সেই সাথে কামরুল হাসানেরই আঁকা এরশাদকে নিয়ে – ‘দেশ আজ বিশ্ববেহায়ার খপ্পরে’ এই চিত্রটিও স্লোগানসমেত আলোড়িত করেছিল। কোন চিত্রশিল্পী সামাজিক বা রাজনৈতিক দায়িত্ব হিসেবে চিত্রকলার কোন মাধ্যমে যদি কিছু করতে চান, সেখানে কার্টুন একটা উপযুক্ত ভাষা। আমার চিত্রকর্মেও একইরকম প্রতিবাদী আচরণ ছিলো। কিন্তু চিত্রকর্ম তো ব্যাপক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছাচ্ছে না। তাই একটু-আধটু কার্টুন করে যখন দেখলাম এটার একটা প্রতিক্রিয়া হচ্ছে এবং আমিও দায়বদ্ধ তার প্রতিফলন ঘটাতে পারছি, তখন থেকে বলা যায় নিয়মিতই হয়ে গেলো। কখনো স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, আবার কখনো গণতন্ত্রের সর্বনাশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা মানুষ কিংবা নাগরিক হিসেবে মূল্যবোধের অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। এভাবেই চলছে।

তবে হ্যাঁ, যে কোন ব্যাপারে একটা ক্ষোভ থেকেই এর জন্ম। ক্ষোভ, বিরক্তি যতো তীব্র হবে কার্টুনও ততো তীক্ষ্ন হবে।

শরীফা: আপনি বললেন যে, ক্ষোভ না থাকলে কার্টুন করা যায় না। কিন্তু কেন কার্টুনকে বরাবরই বস্তুগত ধারণায় ও উপস্থাপনায় দেখা যাবে? ব্যাপারটা সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছেনা, ভালো অর্থে কী কার্টুন করা যায় না?

শিশির: এখানে পরিস্কার হওয়া দরকার – আমি আসলে পলিটিক্যাল কার্টুনের কথা বলছি। আমি এডিটোরিয়াল কার্টুনের কথা বলছি। এমন ধরনের কার্টুনের জন্মই হয়েছে অসঙ্গতিগুলো, ভুল-ভ্রান্তিগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো থেকে। সরকার বা বিরোধী দল বা প্রশাসনকে কতখানি প্রশংসাযোগ্য কাজ করলো তার ফিরিস্তি দেবার জন্য না। যেন তারা সচেতন হয় এবং ঠিক কাজ করে বা ঠিকভাবে চলে। ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের ছলে অনেক কড়া কথাও বলে ফেলা যায় পাঠক আনন্দও পায় এবং একটা ম্যাসেজও পেয়ে যায়। মিছরির ছুরির মতো। তবে হ্যাঁ, কার্টুনের যে ধরনের ড্রয়িং এর যে হাস্যরস বা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ -এগুলোর অনেক শক্তি। তাই ভালো অর্থেও এর ব্যবহার আছে বা হচ্ছে অনেককাল থেকে। যেহেতু জনপ্রিয় মাধ্যম এবং বাচ্চারা কার্টুন বলতে পাগল তাই তাদের জন্য অনেক কিছু এই কার্টুনের মাধ্যমে তৈরি। নিছক আনন্দ উপভোগের জন্য, শিক্ষামূলক বা কোন নীতিকথা প্রচার করার জন্য। তবে এসব কিছুতেই প্রখর বুদ্ধিদীপ্ততা এবং হাস্যরস থাকতে হয়। যেমন ‘টম অ্যান্ড জেরি’র কাহিনী অথবা আমাদের দেশে প্রচুর জনপ্রিয় ‘মীনা’র কাহিনী। এসবই কিন্তু এনিমেশন ফিল্মে প্রকাশ। এছাড়া তো রয়েছে কমিক স্ট্রিপ। কমিক্সের জন্য সবাই কেমন পাগল তা জাপানকে দেখলে বোঝা যায়। খাওয়া-পড়া অন্যচিন্তা সব বন্ধ হয়ে যায় কমিক্স শেষ না হওয়া পর্যন্ত। তাই কার্টুন যেমনি এক প্রতিবাদের প্রকাশ তেমনি এটা একটা এন্টারটেইনমেন্ট বা শিক্ষামূলক নানা প্রজেক্টেও ব্যবহার করা যায়। এখন যে যেভাবে করে আর কি।

শরীফা: কার্টুন তো চারুকলারই বিষয়, কিন্তু অন্যান্য মাধ্যমের সাথে এর বিষয়গত দূরত্বটা কোথায়?

শিশির: চারুকলার অন্যান্য মাধ্যমের কার্টুনের মূল দূরত্ব হচ্ছে কার্টুনের গ্রাফিক্যাল কোয়ালিটি। মানে কার্টুনটা কোথায় ছাপা হচ্ছে এবং সেভাবেই করা হচ্ছে সেটা পত্রিকা হোক, ম্যাগাজিন বা কমিক্স বই হোক অথবা এনিমেশন ফিল্মে হোক। তারপর রয়েছে কার্টুনের সহজ-সরল প্রকাশভঙ্গি যাতে সবাই সহজে বুঝতে পারে এবং এর মধ্যে বুদ্ধিদীপ্ত বা সরল হাস্যরস যা ব্যঙ্গাত্মক বা বিদ্রুপাত্মকও হতে পারে। চারুশিল্প যেমন ভিজ্যুয়াল আর্ট কার্টুনও তেমনি ভিজ্যুয়াল এবং পিকটোরিয়াল। চারুশিল্প এক ধরণের পরিশীলিত ব্যাপার, কার্টুনে এর বালাই নেই। তবে হ্যাঁ, ফাইন আর্টের গুণাবলীগুলো কার্টুনে থাকলে কার্টুনের জন্য তা প্লাস পয়েন্ট। অনেক সময় বিশেষ করে পলিটিক্যাল কার্টুনের সময় এর এক ধরনের প্রতিফলন হিসেবে বা ডকুমেন্ট হিসেবে যে মাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তা ফাইন আর্টের প্রায় অসম্ভব। কামরুল হাসানের করা ইয়াহিয়ার ব্যঙ্গচিত্র এর একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এমন অবশ্য অনেক আছে। যার মধ্যে একজন শিল্পীর শিল্পিত গুণাবলী যেমন আছে তেমনি এর সর্বসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্যতাও আছে।


গোলাম আযমকে নিয়ে দশটা কার্টুন করলাম সবাই খুব এনজয় করলো। বললো, আরে শিশির ফাটাফাটি হচ্ছে, ফাটাই দিচ্ছে ইত্যাদি। কিন্তু এতে করে পরোক্ষভাবে এরা খুব হাইলাইটেড হয়ে গেলো।


শরীফা: বিখ্যাত দু-একজন শিল্পীর নাম বলুন, যারা আপনাকে আচ্ছন্ন করেছে?

শিশির: শিল্পীর নাম বলবো, নাকি কার্টুনিস্টের নাম বলবো? কারণ এখানে একটা সমস্যা আছে। সমস্যা হচ্ছে আপনি কার্টুনিস্ট প্রসঙ্গ দিয়ে সাক্ষাৎকার শুরু করেছেন… আবার শিল্পীর …

শরীফা: আচ্ছা, কার্টুনিস্টদের নামই বলুন।

শিশির: আমার কিন্তু কার্টুনিস্ট হবার ইচ্ছা ছিলো না। হতেও চাইনি। কার্টুনটা একটা বাই-প্রোডাক্টের মতো হয়ে গেছে। মাছভাজা এবং মাথা দিয়ে মুড়োঘণ্ট আর কি। যেহেতু কার্টুনিস্ট হবার তেমন কোন মানসিকতা ছিলো না তাই এটা নিয়ে খুব বেশি নাড়াঘাটা করা তাও কিন্তু করি নাই। তবুও আমার কিছু বেশ পছন্দের কার্টুনিস্ট আছে যাদের কার্টুন দেখার সুযোগ হলে দেখি। যেমন ভারতের লক্ষ্মণ, আবু আব্রাহাম, মারিও মিরান্ডা, এখন অজিত নিনান।

khaleda-jamaat-by-shishir

গার্ডিয়ান পত্রিকায় কার্টুন করেন – স্টিভ বেল, লুরির অনেক কার্টুন। টরোন্টস্টার পত্রিকার বিখ্যাত কার্টুনিস্ট ম্যাকফারসন। ম্যাকফারসনের কার্টুন যখন দেখি খুব ইচ্ছা হতো একদম ওনার মতো করার। উনি তুলিতে আঁকতেন। আমি চিকন তুলিই ব্যবহার করি, তাই ম্যাকফারসনকে খুব কাছের মনে হয়। তবে ও ধরনের তীক্ষ্ন সমালোচনা আমাদের দেশে সম্ভব না। লারসন নামে একজন পকেট কার্টুন, স্ট্রিপ কার্টুন করেন। তার কার্টুন অনেক পরে দেখেছি। কিন্তু অপূর্ব সব আইডিয়া এবং খুব সহজ-সরল। সরলতার দিক থেকে অবশ্য আবু আব্রাহামের কার্টুনও অনবদ্য। ‘আবুস কলাম’ নামে হিউমারাস পলিটিক্যাল কলাম লিখতেন তিনি। তার কাছেই প্রথম শুনি – একজন পলিটিক্যাল কার্টুনিস্টের অবশ্যই জার্নালিস্টিক ভিশন থাকতে হয়। এটা অবশ্যই দরকার নানা ঘটনা বিশ্লেষণ এবং হিসেব করে নির্যাসটুকুই কার্টুনে সহজ ভাষায় প্রকাশ পায়। এছাড়া বাংলাদেশে কিছু অভিভাবক তো আছেনই – কাজী আবুল কাশেম, কামরুল হাসান, মোস্তফা মনোয়ার, রফিকুন নবী, নজরুল এবং হুদা। তরুণদের মধ্যে ডেইলি স্টারে কার্টুন করে শাহরিয়ারকে বেশ পছন্দ মূলত তার অপূর্ব হিউমার সেন্সের জন্য। এছাড়া বিপুল শাহ এবং কুদ্দুস, তুলি এদের অনেক কার্টুন বেশ ভালো লাগে। একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি অনেকে কার্টুন করলে কার্টুন মাধ্যমটাই বেশি শাণিত হয়, অনেক ভালো ভালো কার্টুন বেরিয়ে আসে। আহসান হাবীবের নাম বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। তিনি দীর্ঘদিন কার্টুন পত্রিকা ‘উন্মাদ’ নিয়ে আছেন। উন্মাদের মাধ্যমে অনেক কার্টুনিস্ট তৈরি হয়েছে যারা কিনা আর্ট ইন্সটিটিউটের না। এটা খুব ভাল লক্ষণ। কজনের নাম বলতে পারি, যাদের কার্টুন ভালো লাগে। যেমন – কিশোর, মেহেদী, মানিক, রতন…আরো অনেকে আছে যাদের নাম মনে করতে পারছি না। তবে হ্যাঁ, এখন পত্রিকাগুলো মূল পত্রিকার সাথে সপ্তাহে একটা হিউমার বা বিদ্রুপাত্মক একটা সংখ্যা বের করছে এবং তাতে অনেকে কার্টুন করার সুযোগও পাচ্ছে। এভাবে ভালো কার্টুনিস্টকে পাঠকই বেছে নেবে।

শরীফা: রাজনৈতিক ব্যক্তি – যেমন গোলাম আযম, এরশাদ এদেরকে নিয়ে যে ব্যঙ্গাত্মক কার্টুনগুলো করলেন, এসব কার্টুন করার পরে আপনি কোন সমস্যায় পড়েছেন বা হুমকির মুখে পড়েছেন?

শিশির: সমস্যা বলতে ওরকম সরাসরি কিছু না, তবে পরোক্ষভাবে কিছু তো হয়ই। সম্পাদকের উপর প্রেসার আসে। কার্টুনের উপরের তখন প্রেসার পড়ে। তবে হ্যাঁ, ফোনে কয়েকবার যে হুমকি-ধামকি হয়নি তা নয়। আমার মনে হয়েছে জামাত বা স্বৈরাচারী এরশাদ – এদের কাছে আমাদের কার্টুন গুরুত্বপূর্ণ ছিলো না। মাঝে-মধ্যে কোন কার্টুন নিয়ে সমালোচনা হয়েছে। প্রতিবাদ লিফলেটও হয়েছে। এমনও মনে হয়েছে বিতর্কিত ব্যক্তি নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করায় পরোক্ষভাবে তাদের পরিচিতিই বেড়েছে। এটা একটা সমস্যা। তবে আমি যে হিসেবের মধ্যে আছি এটা বুঝতে পারি। একবার অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান খুব ক্ষেপেছিলেন, তবে পত্রিকা থেকে রিজয়েন্ডার দিয়ে সেটা ম্যানেজ করা হয়েছে।

তবে কেন জানি আমার মনে হয়েছে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় ছিলো (৯৬-২০০১), তখন আওয়ামী লীগকে অনেক সমালোচনা করেছি ভোরের কাগজে এবং প্রথম আলোর শুরুর দিকে। সেই সময় দেখতাম আওয়ামী লীগের ওরা চট করে খুব রেগে যেতো এবং ছাত্রলীগের ছেলেদের আমি ভয়ই পেতাম সে সময়। আমার একটা হিসাব আছে সেটা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ তো বলা যায় সিভিল একটা পলিটিক্যাল পার্টি, একদম রুট লেভেল থেকে উঠে আসা দল, সমালোচনা ওদের প্রচণ্ড গায়ে লেগে যেতো। ওরা মনে করে যে আমাদের জনপ্রিয়তা শেষ হয়ে গেলো। এটা মাথায় রেখে ওরা ক্ষেপে যেতো। আর বিএনপির ওদেরকে নিয়ে আমি এমনসব কার্টুনও করেছি যেটাতে মনে করেছিলাম কার্টুনটা প্রকাশ হওয়ার পরদিনই আমাকে ধরে হয়তো মেরে ফেলবে অথবা কিছু একটা করবে। কিন্তু দেখলাম যে কিছুই হয়নি। তখন আমি মনে করেছিলাম বিএনপি এসব সমালোচনাগুলোকে পাত্তা দিতো না। এরশাদের সময় এরশাদ পাত্তা দিতো না। তারা ধরেই নিয়েছিল তাদের কোন ক্ষতি করবে না – এরকম ব্যাপারটা। আর মৌলবাদীরা এই নেগেটিভ রাইটিংসগুলোকে পজিটিভলি দেখে। এইটাই হয়তো সমস্যা। সবদিক দিয়েই ফাঁকতালে আমার উপর কোন প্রেসার আসেনি। যেমন ধরুন গোলাম আযমকে নিয়ে দশটা কার্টুন করলাম সবাই খুব এনজয় করলো। বললো, আরে শিশির ফাটাফাটি হচ্ছে, ফাটাই দিচ্ছে ইত্যাদি। কিন্তু এতে করে পরোক্ষভাবে এরা খুব হাইলাইটেড হয়ে গেলো। কার্টুন করতে করতে যেটা মনে হয়েছে – রাজনৈতিক দলগুলোর পাওয়ারের খুঁটি নিয়ে সমালোচনা করলে তখনই ক্ষেপেছে নতুবা এনজয়ই করে বলা যায়। তবে হ্যাঁ, ব্যক্তিবিশেষ নিয়ে কিছু করলে পত্রিকার স্পেশাল করেসপনডেন্টদের বেশ খেসারত দিতে হয়। এমন প্রায়ই হয়।

শরীফা: আপনি যে আজকের কাগজে কার্টুনগুলো করেছিলেন, ওই ধরনের ভূমিকা রাখতে পারছেন?

শিশির: মনে হয় রাখতে পারছি। সেটা অবশ্য আপনারাই বিচার করবেন। তবে সময়, অবস্থার পরিবর্তন তো হচ্ছে। আমার বাস্তবতারও পরিবর্তন হচ্ছে। এখন কে মিত্র, কে শত্রু আইডেনটিফাই করা কঠিন। তবে নিজস্ব আদর্শগত অবস্থানটা পরিবর্তন হয়নি। চাইলেই এখন দুঃসাহস দেখানো যায় না। তবে যতটুকু সম্ভব চেষ্টা করি। শুধু আমি চাইলেই তো হবে না, পত্রিকাকেও চাইতে হবে। পত্রিকারও নিজস্ব পলিসি থাকে এবং এটা একটা ব্যবসাও বটে। আমি লক্ষ্য করেছি ব্যবসার খাতিরে নিরপেক্ষতা এবং পক্ষপাতিত্ব। এর মধ্যেই কাজ করতে হচ্ছে।

শরীফা: কার্টুন সমাজ পরিবর্তনে কোনো ইতিবাচক ভূমিকা না শুধু পরিবর্তিত অবস্থার চালচিত্রন করে?

শিশির: শুধু পরিবর্তিত অবস্থার চালচিত্রন হলে তো কার্টুনিস্টের প্রয়োজন থাকতো না। সমাজ পরিবর্তনে কার্টুনিস্টের ভূমিকার কথা বলতে গেলে তো ইতিহাস বলতে হবে। সহজভাবে বলা যায় যে – কার্টুন তো মুক্ত মনের একটা প্রকাশ এবং এই প্রকাশের প্রয়োজনটা আসে ক্ষোভ, হতাশা, দুঃখ বা অসন্তোষ থেকে। যুক্তিসঙ্গত মুক্ত মনের প্রকাশ সব সময়ই মানুষ এবং সমাজের কাজে এসেছে, পরিবর্তনে সহায়তা করেছে। কার্টুন যদি এক ধরনের সোশ্যাল-পলিটিক্যাল ডকুমেন্ট হয়, সেই ডকুমেন্ট সঠিক ইতিহাস জানতে সাহায্য করেছে। আমরা জানি রাজা বা সম্রাটের তত্ত্বাবধানে তৈরি ইতিহাস সব সত্য না। রাজা বা সম্রাটের শাসন, ধর্মগুরুর প্রভাব এবং পুঁজিপতির শোষণ সাধারণ মানুষের কথা প্রচার করেনি। নির্যাতিত মানুষ যেভাবেই হোক তাদের নিজের কথা লিখেছে, বলেছে, এঁকেছে, সংগঠিত হয়েছে। মানুষ মানুষের পক্ষে এসেছে এভাবে তো সমাজে বিপ্লব হয়েছে, পরিবর্তন এসেছে। এখানে বলে নেয়া ভালো – শাসকের পক্ষের বা শোষকের পক্ষের কোন কার্টুনিস্ট হয় নাই, ছিলও না। যারা থাকে আমজনতা তাদের দালাল হিসেবেই চিহ্নিত করে। একটা সময় চিত্রকর্মই ছিল ডকুমেন্ট। ফটোগ্রাফি তো অনেক পরে। শিল্পকর্মের সাথে বিদ্রুপাত্মক চিত্রকর্মও হয়েছে। শিল্পী তার মনের ক্ষোভ, দুঃখ প্রকাশ করেছে নিভৃতে, লুকিয়ে মানুষকে দেখিয়েছে। বিক্ষুব্ধ মানুষ উত্তেজিত, আলোড়িত হয়েছে। নিজেরা সংগঠিত হয়েছে। প্রতিবাদ করেছে।

IMG_0005 (2)

বিপ্লবী এসব শিল্পী যখন ধরা পড়েছে, তাদের শাস্তি হয়েছে এমনও শুনেছি কার্টুনিস্টের তীক্ষ্ন-তীর্যক কার্টুনের জন্য সম্ভাব্য যুদ্ধ বন্ধ হয়ে গেছে। যেহেতু কার্টুনিস্ট সমাজের, রাজনীতির ভুল-ভ্রান্তি অসঙ্গতিগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যা কিনা অন্যান্য মাধ্যমেও সম্ভব এবং হয়েছেও, কিন্তু কার্টুনের মতো জনপ্রিয় এবং সবার মাঝে পৌঁছেনি। এক ঝলক কার্টুন দেখেই একজন অশিক্ষিত ব্যক্তি পর্যন্তও সহজে বুঝতে পারে। এটাই তো কার্টুনের বিশেষত্ব।

শরীফা: আপনি কিন্তু কেন্দ্রে আছেন বলেই প্রশ্নটা করছি – সমকালীন বাংলাদেশের আর্টের বিকাশ ও পশ্চাদপদতা নিয়ে আপনার মতামত…

শিশির: আর্ট নিয়ে সামগ্রিক কোন মন্তব্য বা সিদ্ধান্ত দেয়া জটিল। এজন্যই যে, একসময় যাদের পশ্চাদপদতা বলে গণ্য করা হতো সেগুলোই এখন মূল্যবান হয়ে সমাদৃত হচ্ছে। আবার যাদের মনে করা হতো বাংলাদেশের আর্টের বিকাশের পুরোহিত, তাদের আর্ট অন্ধকারে চলে যাচ্ছে। সেজন্যই বলছি জটিল। দিনে দিনে মানুষ পরিশীলিত হয়, মার্জিত হয় বা যাকে বলা যায় সভ্য হয় এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে সমাজ বা রাষ্ট্রে বাস করে। সবকিছুই মানুষ করে তার বুদ্ধিবৃত্তি ও যুক্তিবোধ থেকে। মানুষের স্বার্থ রক্ষা করে প্রকৃতি ও মানুষকে সম্মান দেখিয়ে যে কোন সৎ প্রকাশভঙ্গির মর্যাদা মানুষ দেয় – তা আজ হোক বা কাল হোক। মানুষের যুক্তিবোধ ও বুদ্ধির অপব্যবহার সভ্যতার বিকাশে সহায়ক হতে পারে না।


ধরা যাক একজন কবি কবিতা লিখলেন কিন্তু তার কবিতা কেউ বুঝলো না, কবি অনেক চর্চা করে একটা ভাষা তৈরি করলেন, শব্দচয়ন ঠিকমতো করলেন সেটা সাধারণ একজন লে-ম্যান বুঝলো না, এটা তো কবির ব্যর্থতা না। সেখানে বলবো যেই পাঠকগোষ্ঠী আছে তাদের ব্যর্থতা।


আমাদের শিল্পকলা চর্চা যেভাবে শুরু হয়েছিল সেভাবে অগ্রসর হয়নি। শিল্পীরা বিচার-বিশ্লেষণ করেননি যে সামাজিক সদস্য হয়ে তাদের দায়বদ্ধতা কতটুকু। ফলে শিল্পীরা গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষা করেছে এবং গোষ্ঠীরা শিল্পীস্বার্থ খেয়াল করেছে। ফলে জয়নুল, কামরুল, এসএম সুলতান প্রকটভাবে আলাদা হয়ে গেছে। এখন আবার তাদের শিল্পকর্ম সবচেয়ে দাম দিয়ে বিকোচ্ছে। যা হোক সবই সময়ের ব্যাপার। দীর্ঘ চড়াই-উৎড়াই বা সময় পার না হলে শিল্পকর্মের সঠিক বিচারটা করা মুশকিল। সব রকম ভালো কাজের জন্য যা যা গুণাবলী দরকার একজন ক্ষমতাবান, দক্ষ শিল্পীর যদি সে গুণাবলীগুলো থাকে এবং তার চিন্তা-ভাবনা প্রকাশের জন্যও যদি তার ঐকান্তিক ইচ্ছা ও সততা থাকে তবে সেরকম শিল্পকর্মের গুরুত্ব অবশ্যই আছে।

সমকালীন সময়ে গোটা পৃথিবী এখন চোখের সামনে। যোগাযোগ অত্যন্ত সহজ। একটা সৃষ্টিশীল একটা কিছু করতে গেলে কিসের অভাব তা জানাটা জরুরী। সেটা কেউ যদি জানতে চায় তবে এখন সে সুযোগ রয়েছে। এই সুযোগগুলো কাজে লাগিয়ে এখনকার কিছু শিল্পী যে কাজ করছেন না তা শুধু নয়, তারা নতুন প্রজন্মকে প্রভাবিতও করছেন। এখানেও ভয় সমকালীন করার জন্যই হয়তো চিন্তা-ভাবনা না করে অনেকে অন্যের ম্যানারটা নিয়ে কাজ করছেন। ফলে পুরনো সমস্যা ঘুরেফিরে আবার আসতে পারে। নিজের শিল্পকর্মকে সৃষ্টিশীল পর্যায়ে নিতে পরিশ্রম এবং অধ্যবসায় দরকার। শর্টকার্ট কোন পথ নেই। হাতে গোনা কেউ কেউ এমন কাজ করছেন – এটাই আর্টের বিকাশের লক্ষণ।

শরীফা: অনেকে তো বিমূর্ত ছবি আঁকছেন।

শিশির: অবশ্যই আঁকতে পারেন। শিল্পী যদি সেখানে শঠতা না করে সৎ প্রকাশভঙ্গি ঘটান তা অবশ্যই গ্রহণযোগ্য এবং সমাদৃত হবে। চিত্রকর্ম হচ্ছে ভিজ্যুয়াল এবং পিকটোরিয়াল। সবকিছুই তো আমাদের কাছে ভিজ্যুয়াল বা দৃষ্টিগোচর হয় না। যেমন – নস্টালজিয়া, আনন্দানুভূতি, দুঃখবোধ, একাকীত্ব, যন্ত্রণা, শব্দ, গন্ধ, এছাড়াও অসংখ্য অনুভূতি এগুলো কেউ বস্তু আশ্রয়ে বোঝাতে পারেন কেউবা নির্বস্তুকভাবে বোঝাতে পারেন। আমাদের বুঝতে হবে রঙ, টেক্সটার, রেখা এবং সামগ্রিক কম্পোজিশনের তো একটা ভাষা আছে। তবে ঠিক সাধারণ দর্শক হয়তো চিত্রকর্মে তার পরিচিত কিছু ইমেজই দেখতে চাইবেন এবং ওভাবেই বুঝতে চাইবেন।

ধরা যাক একজন কবি কবিতা লিখলেন কিন্তু তার কবিতা কেউ বুঝলো না, কবি অনেক চর্চা করে একটা ভাষা তৈরি করলেন, শব্দচয়ন ঠিকমতো করলেন সেটা সাধারণ একজন লে-ম্যান বুঝলো না, এটা তো কবির ব্যর্থতা না। সেখানে বলবো যেই পাঠকগোষ্ঠী আছে তাদের ব্যর্থতা।

তেমনি সবকিছুই নির্ভর করে শিল্পীর ওপর। তিনি কিভাবে প্রকাশ করে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন সেটা তার ব্যাপার। এ ধরনের শিল্পকর্ম উপভোগের একটা চর্চা আছে। যিনি দর্শক তাকে জানতে হবে শিল্পীর দেখা, জানা, বোঝা ক্যামেরা দিয়ে না।

শরীফা: Installation Art এর কথা ধরা যাক, এর কারণে রং রেখার স্বতঃস্ফূর্ততা কতটুকু থাকছে – তা স্বতঃস্ফূর্ততাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে না?

শিশির: স্বতঃস্ফূর্ততা এবং তার প্রয়োগ এগুলো অনেকভাবেই ব্যাখ্যা করা যায় – যা খালি দীর্ঘ হবে। আর শুধু স্বতঃস্ফূর্ততাই তো গুণাবলী নাও হতে পারে। ব্যাপারটা হচ্ছে সঠিক প্রয়োগ নিয়ে। ইন্সটলেশন বা স্থাপনা শিল্পকর্ম অনেকের কাছে নতুন মনে হলেও – নতুন তো না। এটা করারও তো প্রয়োজনীয়তা থাকতে হবে। আধুনিক হবার জন্য তো আর না। কেউ কেউ তো স্থাপনার সাথে ভিডিও ফুটেজ এবং পারফরম্যান্স ইত্যাদিও যুক্ত করছে – সবই করছে শিল্পীর চাহিদানুযায়ী ব্যাখ্যা করার জন্য। ব্যাখ্যার সূত্র বোঝার জন্য অথবা ব্যাখ্যার অংশ হিসেবেই টেক্সট বা লিখিত কিছুও রাখছে।

স্থাপনার বস্তুগুলো কেউ বাস্তব বস্তু রাখছে আবার কেউবা নতুন বস্তু বা মটিফ নির্মাণ করছে – যা সাজেসটিভ বা বাস্তব বস্তুকে ইঙ্গিত করে। ভিডিও এবং শব্দ বা মিউজিক এমনকী গন্ধও থাকছে যেন পরিপূর্ণ একটা আবহ, যেখানে একজন দর্শক প্রবেশ করলে সে যেন নিরাশ না হয়ে ফেরে, তেমন ব্যবস্থা। সুতরাং এখানে রং রেখার স্বতঃস্ফূর্ততার প্রশ্ন না, প্রশ্ন হচ্ছে যিনি শিল্পী তিনি প্রকাশে কতখানি সার্থক তাই দেখার বিষয়। রং রেখার মাধ্যম আলাদা সেখানে তাদের ক্ষমতা হুমকির সম্মুখীন হবে না বা হচ্ছেও না। সাধারণত বুদ্ধিবৃত্তিক কোন কাজে বা গবেষণা টাইপের কোন উপস্থাপনায় স্বতঃস্ফূর্ত প্রসঙ্গটা যুক্তিযুক্ত না।

IMG_0001

শরীফা: শিশিরদা, আমরা জানি আপনার কার্টুন কথা বলে, আপনার কার্টুনই বলে দেয় অনেক কথা, তবু জানতে চাই – সাম্প্রতিক বাংলাদেশ আপনাকে কতটা নাড়া দিচ্ছে?

শিশির: সাম্প্রতিক বাংলাদেশ নাড়া দিচ্ছে বেশ, কিন্তু কেমন যেন টের পাচ্ছি না। অপারেশন থিয়েটারে নেবার সময় যেমন অনুভূতি হয়, কেমন যেন শূন্য শূন্য লাগে সবই দেখি কিন্তু কোন এক্সপেশন থাকে না তেমন, জিভে সমস্যা হলে যেমন কোন খাবারেরই টেস্ট পাই না তেমন, অথবা রাস্তায় ভয়াবহ জ্যামে আটকে গেছি – যাবার উপায় নেই, তেমন। থমথমে অবস্থার মতো। কোন খারাপ বা ভয়ঙ্কর কোন ঘটনার আগে যেমন হয় আর কি। হীরক রাজার দেশে যন্তর মন্তর ঘরে মগজধোলাই করা মানুষজন যেন চারপাশে। চারপাশের মানুষজনের মধ্যে কে শত্রু কে মিত্র বোঝার উপায় নেই। তবে হ্যাঁ, কানসাট বা ফুলবাড়ির মতো ঘটনা যখন ঘটে, তখন মনে হয় – না, মানুষের এখনো হুঁশ আছে। যখন কোন অবস্থা একদম ‘ইয়েস’ অথবা ‘নো’ পর্যায়ে যায়, সে সময় মানুষ একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে। এমন একটা সময়, সবকিছু প্রকাশ করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। পত্রিকাকেও ব্যালেন্স করতে হয়, কম্প্রোমাইজ করতে হয়। কার্টুনে আমার স্বাধীনতা থাকলেও ‘সেলফ সেন্সর’ করতে হয়। আমি নিজে নিজেই ঠিক করছি – না, এটা করবো না, না করবো না। যেমন ধর্ম নিয়ে, ধর্মের বাড়াবাড়ি নিয়ে কিছু করতে পারি না। তেমনি নারীদের অনেক বিষয় নিয়ে কিছু করতে পারি না। অনেক ব্যক্তির স্পর্শকাতর ব্যাপারগুলো নিয়ে ক্রিটিসাইজ করতে পারি না। অনেক কিছুই আমাকে সেন্সর করতে হয়।

শরীফা: ধর্মের কথা বললেন তো, এ প্রসঙ্গে একটা কথা জানতে চাচ্ছি – আপনি কি ভাববাদী না বস্তুবাদী? অর্থাৎ জানতে চাচ্ছি, আল্লাহ কিংবা ঈশ্বরের কর্তৃত্ব আপনি মানেন কিনা?

শিশির: এটা খুব কঠিন প্রশ্ন। তবে আমি প্রকৃতিকে সাংঘাতিকভাবে একটা বিশাল শক্তি মনে করি। আমি প্রকৃতিবাদী এটা বলা যায়। সোজা কথা প্রকৃতিটাকে আমার কাছে একটা শক্তি মনে হয়।

শরীফা: আর ধর্ম নিয়ে ব্যবসাটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?

শিশির: একটা সুপার ন্যাচারাল পাওয়ারের উপরে ফ্যাসিনেশন আছে; যেটাকে মুগ্ধতা বা আচ্ছন্নতা বলে, আমার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়। অর্থাৎ ছোটবেলা থেকে আমিও তো একটা দেশ সমাজের পরিমণ্ডলের মধ্যে দিয়ে বেড়ে উঠেছি – এই মুগ্ধতা বা আচ্ছন্নতাও আমার ভেতর ছোটবেলা থেকেই গেঁথে গেছে। একটা সুপার পাওয়ার নিশ্চয় আছে। যেমন আমরা যেমন শিল্পী, আমরা যখন প্রকৃতি দেখি – আমি বারবার প্রকৃতির কথায় ফেরত আসছি – প্রকৃতিকে দেখি একটা বিস্ময়কর জগৎ হিসেবে। যেখানে একটা গাছের বিরুদ্ধে আরেকটা গাছ কিন্তু যুদ্ধ করে না, মারামারিও করে না। মানুষ মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, মানুষ পশুর চেয়েও হিংস্র কিন্তু পশু তো কখনো হিংস্র হয় না। কখনো কখনো পশু হিংস্র হয়, তা আত্মরক্ষার জন্য। প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্য অপার বিস্ময় মাঝেমাঝে শিশুর মতো মনে প্রশ্ন জাগে যে এটা কিভাবে সম্ভব! আমরা যদিও জানি যে বোটানিক্যাল সায়েন্স সৃষ্টিতত্ত্ব-টত্ত্ব…কিন্তু এই যে একটা গাছে যদি এক লাখ পাতা থাকে, এক লাখ পাতা এক লক্ষ রকম। আমরা শিল্পীরা আঁকতে গেলে দশটা মানুষ দশ রকম করা আমাদের কাছে কঠিন হয়ে যাবে, কিন্তু পৃথিবীতে যদি সাড়ে ছয়শ কোটি কিংবা ছয়শ কোটি মানুষ থাকে এই ছয়শ কোটি মানুষ ছয়শ কোটি রকম। তারপর দেখুন গাছপালা প্রকৃতি! একই আমগাছ নাম, কিন্তু আমগাছের সমস্ত পাতা একটার সাথে আরেকটা মিলে না। ফুল পাখি জীবজন্তু অর্থাৎ জগতের কথা কি বলবো – অপার অবিশ্বাস্য রকম ব্যাপার। এই অবিশ্বাস্য কথাটা বললাম, এইখানে কিছুটা ধোঁয়াশে ব্যাপার রয়ে যায়, তখনই একটা সারেন্ডার তৈরি হয় নিজের মধ্যে। নিজেকে সঁপে দেয়ার মতো একটা ব্যাপার হয়ে যায়। এই যে নিজেকে সঁপে দেয়ার মতো একটা ব্যাপার হয়ে যায়, এটা একটা রহস্য। আমি এটাকে বিশ্বাস করি, ভাববাদী, বস্তুবাদী যা-ই হোক।


ধর্মটা তো ব্যবসা করার জন্য না। ধর্মটা আধিপত্য বিস্তার করার জন্যও না। ধর্ম হচ্ছে মানুষের আচরণবিধি এবং মানুষকে একটা গাইডলাইন দেয়া। ধর্মটা মানুষের মঙ্গলের জন্যই কিছু গাইডলাইন। আমাদের যেমন কনস্টিটিউশন আছে, তেমনি ধর্মটাও অনেকটা সংবিধানের মতো।


শরীফা: স্প্যাসিফিক কারো প্রতি ফ্যাসিনেশন?

শিশির: আমি ডেফিনিট কাউকে মিন করছি না। কিন্তু খুব ন্যাচারালি একটা বিষয় আছে যে – তাহলে বোধহয় একটা বড় শিল্পী কেউ আছেন, যিনি সমস্ত কিছু করছেন। তিনি এমন এক সাংঘাতিক শিল্পী – যিনি নিপুণ হাতে সমস্ত কিছু সাজিয়েছেন।

শরীফা: তাহলে আপনার ভেতরে কোথায় যেন একটা বিশ্বাস আছে?

শিশির: হ্যাঁ, বিশ্বাস আছে। শরীর অবশ হয়ে যায়। অবচেতনে এক ধরণের বিশ্বাস লুকিয়ে আছে! অনেক সময় বিপদে পড়লে দেখা যায় কট্টর একজন- যিনি ধর্ম-টর্ম কিছুই মানেন না, কোনকিছু বিশ্বাস করেন না, অবচেতনে হাই তোলার সময় কিছু বলে ফেলেন নিজের অজান্তে। কিন্তু হয়তো বিশ্বাস করেন না। এইটা একরকম ব্যাপার। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে আমি খুব প্র্যাকটিক্যালি বললাম যে, যখন প্রকৃতির বিস্ময়টা দেখি তখন সত্যি সত্যিই ভাবিত না হয়ে পারি না। আমিও তো সৃষ্টি করি, সৃষ্টি করতে গিয়ে আমি জীবনেও পারবো না। আমার যদি আরো একশবার জন্ম হয় – তবু আমি পারবো না। যে সৃষ্টিকর্মগুলো আমরা দেখছি বিশেষ করে মানুষের তৈরি না, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যটা। আমি তো জীবনেও তা করতে পারবো না। এগুলো সমস্ত কিছু বিজ্ঞানের অন্তর্গত। কিন্তু এইখানে একটা রহস্য। সেখানে কনক্রিট বলা যায় না যে ভাববাদী বস্তুবাদী এরকম ব্যাপারটা।

IMG (2)

শরীফা: জানতে চাইছি ধর্ম নিয়ে যারা ব্যবসা করছে তাদের সম্পর্কে…

শিশির: ধর্ম নিয়ে যারা ব্যবসা করছে তাদের তো একটা খুব খারাপ উদ্দেশ্য আছে, না হলে ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করবে কেন? ধর্মটা তো ব্যবসা করার জন্য না। ধর্মটা আধিপত্য বিস্তার করার জন্যও না। ধর্ম হচ্ছে মানুষের আচরণবিধি এবং মানুষকে একটা গাইডলাইন দেয়া। ধর্মটা মানুষের মঙ্গলের জন্যই কিছু গাইডলাইন। আমাদের যেমন কনস্টিটিউশন আছে, তেমনি ধর্মটাও অনেকটা সংবিধানের মতো।

শরীফা: এরশাদ তো ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেছিলেন। এ ব্যাপারে…

শিশির: রাষ্ট্রের ধর্ম হবে কি করে! ধর্ম খুব ব্যক্তিগত। ধর্মকে রাষ্ট্রের সাথে মেলানো একদম উচিত না। রাষ্ট্রের সংবিধান আলাদা আছে। সেখানে ধর্মটা আসবে কেন? যেহেতু একটা সংবিধান আছেই রাষ্ট্র চালানোর জন্য, সেখানে ধর্মের গাইডলাইনের তো প্রয়োজন নেই। ধর্মটা হচ্ছে মানুষের শান্তি হোক এর উপরেই গাইডলাইন তৈরি হয়েছিল। সেখানে একটা রাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় ধর্ম ইসলাম – এটা হাস্যকর না! থাকে আছে, অনেকখানেই আছে, ব্যাপারটা আসলে আমি গ্রহণ করতে পারি না।

শরীফা: আপনার পঠন-পাঠন সম্পর্কে জানতে চাইছি।

শিশির: পঠন-পাঠনের দিকে আমার ঝোঁকটা একটু কম। বন্ধুরাই আমার পঠন-পাঠন। এই যে মামুন (ঢালী আল মামুন) ভাইয়ের কাছে এসেছি, তার কাছ থেকে জ্ঞান নিচ্ছি (হাসতে হাসতে)। আসলে পড়ার ব্যাপারে আমার ঠিক অনাগ্রহ না, আমি আসলে পড়ে উঠতে পারি না সময়ের অভাবে। প্রত্যেকেরই একটা না একটা দুর্বল দিক থাকে। আমি বলবো যে আমার একটা দুর্বল দিক হচ্ছে যে বই পড়ার অভ্যাসটা আমার কম।

শরীফা: চলচ্চিত্র দেখেন?

শিশির: ফিল্ম এক সময় খুব দেখতাম। এখন নানা কারণেই দেখা হয়ে ওঠে না।

শরীফা: উপন্যাস পড়েন কি, কার উপন্যাস?

শিশির: পড়েছি। তাদের উপন্যাসই আমার ভাল লাগে, যাদের লেখায় চিত্রকল্পময়তা বেশি। সিনসিয়ারলি বলি, আমি আমার গন্ডিকেই বোঝার চেষ্টা করি। তা আবার কোনকিছু চাপিয়ে দেবার চেয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কোনকিছুকে জানা বোঝার বিষয়টিকেই বেশি গুরুত্ব দেই।

শরীফা: আপনার ছেলেবেলার কথা জানতে চাচ্ছি।

শিশির: আমার জন্ম ১৯৬০ সালে, বাংলার ২ বৈশাখ, ঠাকুরগাঁও। সেখানে স্কুল, ম্যাট্রিক, ইন্টারমিডিয়েট শেষ করার পর ১৯৭৭ সালে ঢাকা আর্ট কলেজে ভর্তি হই। ছেলেবেলার বেশকিছু ঘটনা প্রায়ই মনে পড়ে। আমার কান তুলতুলে নরম থাকায় রজব আলী স্যার প্রায়ই কানমলা দিতেন, পড়া পারলেও এবং না পারলেও। ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় হাফিজ স্যার চক দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে তার ছবি আঁকতে বলেছিলেন। এঁকেছিলাম। কেমন হয়েছিল জানি না, তবে ক্লাসের সবাই হাততালি দিয়ে উঠেছিল। এরপর থেকে স্যার আমার দিকে বিশেষ নজর রাখতেন – উৎসাহ দিতেন। ক্লাস নাইনে পড়ার সময় – ৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুকে আমার আঁকা তাঁর প্রতিকৃতি উপহার দিয়েছিলাম। যেমন খুশি তেমন সাজোতে ভবঘুরে শিল্পী সেজে প্রথম হয়েছিলাম। ছোটবেলা থেকেই ছবি থেকে পোর্ট্রেট করতাম। বিশেষ করে কারো মা, বাবা, দাদা যাদের ছবি নষ্টপ্রায় সেখান থেকে উদ্ধার করে পেন্সিলে পোর্ট্রেট করতাম। ঠাকুরগাঁও এ অনেকের বাসাতেই এমন অনেক পোর্ট্রেট আছে যেগুলো – ৭৩, ৭৪, ৭৫ সালে আঁকা। ম্যাট্রিকের পর বাবার আয়ুর্বেদিকের দোকানের পাশে একটা আর্টের দোকান দিয়েছিলাম। যেটার নাম ছিলো রূপায়ন। তখন রিক্সার পেছনে যে বোর্ড, তা এঁকেছি প্রচুর। পরে তা বন্ধ করে দিই। ম্যাট্রিকের পর আর্ট কলেজে ভর্তি হতে না পেরে মন খারাপ হয়ে যায়। পরে ইন্টারমিডিয়েট শেষ করে ৭৭ সালে জোর করে এবং রিস্ক নিয়েই আর্ট কলেজে ভর্তি হই।

শরীফা: কার্টুন করার পাশাপাশি চারুকলায় আপনি কোন মাধ্যমে আঁকতে পছন্দ করেন?

শিশির: আঁকার মাধ্যমে আমার পছন্দ দ্বিমাত্রিক চিত্র, অর্থাৎ ড্রয়িংপ্রধান ছবি। আমি এর প্রতিই বেশি ফেসিনেটেড বলা যায়। নানা মাধ্যমে এক্সপেরিমেন্ট আমি ঠিক পারি না – সম্ভবও হয় না। তবে সম্ভব না বলে যে এটা করবো না, তা না। এটা হচ্ছে আর্টে নিজস্ব ডিমান্ড। আমার যদি মনে হয় বিশেষ কিছু বিশেষভাবে প্রকাশের জন্য সবচেয়ে উপযোগী কোন মাধ্যম হলে করতেও পারি।

শরীফা: সময় দেবার জন্য কৃতজ্ঞতা। দীর্ঘ শিল্পীজীবন কামনা করি আপনার।

শিশির: আপনাকে ধন্যবাদ।

575196_623822930984130_348257881_n

শেয়ার