এ পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচে পপুলার গ্রাফিতি কোনটা? হালের যারা তাদের সুবোধের কথা প্রথমে মনে আসতে পারে। কিন্তু আরো আগের যারা, যারা নব্বই দশকটা নিজ নজরে দেখেছেন, তারা জানেন আইজুদ্দিনের কথা। হ্যাঁ, যে আইজুদ্দিন কষ্টে আছে। আছে না ঠিক, ছিল। নব্বই বা তার পরেও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় লেখা দেখা যেত ‘ কষ্টে আছে আইজুদ্দিন’। আইজুদ্দিন কে? নামেই একটা আন্দাজ পাওয়া যাচ্ছে। আমরা জানি এই বাংলাদেশে কাদের নাম আইজুদ্দিন হয়, তারা কী করে, কই থাকে। তারপরও একজন আইজুদ্দিন যখন বলেন, কষ্টে আছে; তখন আরেকজন কামালউদ্দিন বা রইসউদ্দিন নিদ্বির্ধায় তাতে আশ্রয় পান। নানানভাবে। আইজুদ্দিনের মতোন কামালুদ্দিনও হয়ত না খায় আছে, থাকার জায়গা নাই তার এই ঢাকায় বা ঘরে অভাব বলে বউ বা প্রেমিকা অন্য কারোর সাথে ভাইগা গেছে অথবা আর কিছু , অন্য কোন একটা কষ্ট; যেইটা আজকের দুই হাজার একুশ সালের আমার মতোন জনৈক আরবান রাইটারের বোধের বাইরে রয়ে যাচ্ছে। আজকের এই ফেসবুক-ইউটিউবের যুগে, যেখানে চাইলেই নেত্রকোনার কোনো রিপন মিয়া লাইভে এসে তার লাভাররে কিছু শুনায়া যাইতে পারে, প্রেমিকার ফেসবুক ওয়ালে গিয়ে (আনব্লক থাকলে) লিখে দিয়ে আসতে পারে, সেখানে আইজুদ্দিনের দেয়ালে দেয়ালে কষ্টে থাকার কথা লিখে দেয়ার টাইম কী ফুরায়েই গেছে? এখনো কী কেউ বেড়াইতে গিয়ে পার্কের
বেঞ্চে বা গাছের গায়ে লিখে দিয়ে আসে অমুক প্লাস তমুক? কিংবা টাকার উপর লিখে দেয় ‘আসমা তোমারে ভুলি নাই’?
জানা নাই। জানার উপায়ও নাই কারণ এইসব মনস্তত্ব এখনো আমরা খতিয়ে দেখি নাই। তবে বোঝা যায়, এই লিখে দেয়া ব্যক্তির পিছনে কোন একটা অবদমিত মানস আছে। যার বলার জায়গা কম বা নাই-ই। সে কোথাও চিল্লায়া তারে জানান দিতে পারে না। রাষ্ট্র- সমাজের নানাবিধ চাপের মুখে কুঁকড়ায় যাওয়া সে তাই-ই হয়ত টাকার গায়ে, বাসের সিট বা টয়লেটে গিয়ে লুকায়া তার নিজেরে লিখে দিয়া আসে। তবে
মানি বা না মানি এই লিখে রাখাটাও গ্রাফিতি। গ্রাফিতির অন্য একটা ফর্ম। গ্রাফিতি নামটা হয়ত আমরা বিদেশ থেকে নিছি, কিন্তু স্টাইলটা পুরাপুরি এদেশিই। সবরকমভাবেই। তাই এই মুল্লুকের গ্রাফিতি নিয়া বলতে এদের কথাও আমলে নিতে হবে।
★
চিকা মারার ট্রাডিশনটা মনে হয় কমে আসতেছে এখন। বাম পার্টিগুলাও কম কম চিকা মারে এখন। সম্মেলন-টম্মেলনের সময় ঢাকা ভার্সিটির আশেপাশে কিছু মারে। অই রকম ছাত্রলীগ-যুবলীগও মারে। তারা টাকা দিয়ে মারায়। এইসব চিকা মূলত কৌটার রঙ দিয়ে হয়। প্লাস্টিক পেইন্ট দিয়ে। সাশ্রয়ের জন্য। স্প্রে পেইন্ট দিয়ে না। কিন্তু খেয়াল করলে দেখবেন, এখন কিছু চিকা স্প্রে পেইন্টে মারা হচ্ছে। এগুলা পাবলিক ভার্সিটিকেন্দ্রিকও না। মোর ক্রাউডি স্পেসে। এই চিকাগুলা নো ভ্যাট- রিফর্ম কোটা টাইপের। যেহেতু এইখানে টেক্সটটা ছোট, তাই ইজি হয় স্প্রে কালারে। তাৎক্ষণিকতার একটা বিষয়ও আছে। ট্র্যাডিশনাল চিকার মতোন এগুলা প্ল্যান মাফিক না। মানে আগে জায়গা ঠিক করে, কী লেখা হবে ঠিক করে এগুলা মারা না। বাম সংগঠনগুলার মতোন দাবিভিত্তিক হইলেও, ডেকোরেটিভ না ওদের মতোন। সুন্দর করার চেষ্টাই নাই তাদের। বলাটাই আসল। আরেকটা যেটা বড় পার্থক্য, বাম সংগঠনেরগুলা সংগঠনভিত্তিক, নাম ছাড়া কাম নাই টাইপের। কিন্তু যে চিকাগুলার কথা বলতেছিলাম, তারা যেহেতু সংগঠনভিত্তিক না, তাই এগুলাতে গ্রাফিতি’র স্বভাবটা বেশি। গ্রাফিতি যেমন মূলত এস্টাবলিশ কিছু না, আর্টিস্টও এনোনিমাস হয় সচরাচর, যেখানে-সেখানে লিখে। এগুলাও অইরকম অনেকটা। দোকানের শাটার, পার্ক করা গাড়ি, জ্যামে আটকা পড়া গাড়ি, এটিএম বুথ এরকম জায়গায় লেখা। এটা ঘটেছে, এরা যখন নো ভ্যাট, কোটা রিফর্ম- এই আন্দোলনগুলার জন্য রাস্তা ব্লক করতে গেছে, তখন আশেপাশে যা পাইছে, সবখানেই লিখছে। দ্রুতও লিখতে হইছে। স্প্রে কালার তাই বেস্ট অপশন। আরেকটা যেটা বড় দিক, এইসব চিকাঅলাদের ক্লাস; যেহেতু তারা মূলত প্রাইভেট ভার্সিটির, পয়সাঅলা ফ্যামেলির, তাদের ভিতর ইংলিশ মিডিয়াম পড়ুয়াদের কালচারও আছে। এই কালচারের ইমপ্যাক্টও তাদের চিকায় আছে। এ ইমপ্যাক্টটা ভাষাবাহিত তো বটেই, স্প্রে’র ক্যানবাহিতও। স্প্রের ক্যানের দাম আর প্লাস্টিক পেইন্টের দাম তুলনা করলেই বোঝা যাবে। খেয়াল করছেন কি না, গলিতে কিছু চিকা থাকে। আগে বেশি চোখে পড়তো। ইংলিশ স্ল্যাং, গ্রুপের নাম দিয়ে। এক্সবয়েজেস- কুল বেইবি টাইপের। গলিভিত্তিক পাড়ার ছেলেপিলেরা করে এসব। এদের এগুলা পিওর গ্রাফিতি। সব দিক থেকে। স্বভাবেও। এদেরই মোর ওয়াইড, মোর এক্সটেনডেড ভার্সন নো ভ্যাট টাইপের চিকাগুলা। (এরাই চিকায় প্রথম হ্যাশট্যাগ ঢুকাইল বা এরকম) তো বাংলাদেশের চিকা ইতিহাসে এইটাকে একটা চেঞ্জ বলতে পারেন।
উত্তরার গ্যাং গ্রাফিতি।
★
সুবোধ। সাম্প্রতিক সময়ের সবচে পপুলার গ্রাফিতি। প্রথম গ্রাফিতিও। কারণ, এর আগে এই মুল্লুকে ঠিক গ্রাফিতি কনসেপ্টটা ছিল না। যা ছিল, তা ছিল ‘চিকা’ নামে। বাইরের দেশে গ্রাফিতি বলতে যা বোঝায়, তার আমদানি সুবোধ দিয়ে এবং পপুলারও হয় প্রচুর। এত পপুলার হয়, মুলধারার মিডিয়া (টিভি এবং দৈনিক পত্রিকা) থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়া সবখানেই সুবোধে সয়লাব হয়ে যায়। এমনকি শাহবাগের আজিজের গেঞ্জি কোম্পানিদের কাউকে কাউকেও সুবোধের নামে গেঞ্জি ছাপাইতে দেখা গেছে। এছাড়া কলকাতার যাদবপুর বা কোথাও কোথাও সুবোধের প্রতিক্রিয়ায় গ্রাফিতিও করে। তারা সুবোধরে যেন না পালায়, যেন প্রোটেস্ট করে এরকম বলতে দেখা গেছে। এই সব সুবোধের পপুলারিটির নানান মাত্রা এবং শক্তিও। বিশেষ কোন শব্দ-ছবি ইত্যাদি যখন বিভিন্ন আলাপে-আন্দোলনে যখন ফিরে ফিরে আসে, বুঝতে হবে, তা এখনো জিন্দা আছে। তবে অনেক সময় ভূতও জীবিত থাকে। মনুষ্য জীবনের মাঝে।
সুবোধ কেমন? সুবোধকে আমরা দেখলাম লম্বা চুল- দাড়িঅলা। খালি গা, প্যান্ট পরা। আর হাতে একটা খাঁচা। খাঁচার ভিতর সুর্য। এসবসহ সুবোধের পালানোর একটা ভাব। পাশে লেখা : সুবোধ তুই পালিয়ে যা। এ দেশ তোর পক্ষে না। কোনোটাতে সুবোধ একটা বাচ্চা মেয়েরে যেন কিছু বলতেছে বা সান্ত্বনা দিতেছে এমন। সাথে লেখা: সুবোধ কবে হবে ভোর? কোনোটাতে সুবোধ জেলের ভিতর। কোথাও খাঁচা তারে ঝুলানো। বা একজোড়া কাক বসে আছে। ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব দিয়ে কী বলতে চায় সুবোধ? সুবোধদের অবস্থা ভালো না। তার পক্ষে কেউ নাই। তাই তারে পালায় যাইতে বলতেছে আর্টিস্ট। সুবোধও দৌড়ানি শুরু করছে। মাঝে মাঝে সে বসে এক বালিকারে (ধারণা করতেছি তারই মেয়ে) কিছু বলতেছে, এই দৃশ্য মনে হয় দৌড়ের আগের (কারণ দৌড়ানোর মাঝের দৃশ্য হলে তো সাথে মেয়েটা থাকতো না, না?)। আর তখনই আর্টিস্ট সুবোধরে পায়, জিজ্ঞেস করতেছে, কবে হবে ভোর? এই প্রশ্নের উত্তরেই মনে হয় মোরগটা, বাগ দিচ্ছে, ডাকতেছে। ভোরবেলা যেমন ডাকে। তার মানে ভোরের নিশানা সুবোধ জানে। যদি ভোর মানে যেভাবে নতুন দিন, নতুন সকাল, সম্ভাবনা- আশা ইত্যাদি হয়, যেভাবে এত বছর ধরে মার্ক করে আসা হইছে, তা হয়, তাহলে সুবোধের এত হতাশা কেন? সুবোধরে আমরা জেলখানার ভিতরে দেখতেছি কেন? এর একটা উত্তর হইতে পারে, এসব গ্রাফিতি একটা আরেকটার সাথে রিলেটেড না আসলে। আমিই জোর করে রিলেট করতেছি। মে বি। মোরগ বাদ দিলে সুর্যের খাঁচার ভিতর থাকাও আমার রিলেট করার বিরুদ্ধেই দাঁড়ায়। তো গল্প বাদ, সুবোধের সুর্য নিয়া কথা বলি। সুর্য, শুনলেই মনে আসে, বালক বয়েসে পড়া সেই ছড়ার কথা; সুয্যি মামা জাগার আগে উঠবো আমি জাগি। অই ছড়ারই আরেকটা লাইন ছিল; আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে। এমনই তো, না? তো বোঝা যাচ্ছে সূর্য নতুন দিনের প্রতীক। তবে পুরানা প্রতীক। এই ছড়ার আগে- পরেও মেলা ব্যবহৃত হয়ে গেছে এই সূর্য। বিশেষ করে বামপন্থীদের দ্বারা। তাদের পোস্টার লিফলেটে আগে সবখানেই সুর্য মোটামুটি অবধারিত ছিল। এখনও আছে। কমে গেলেও আছে। খালি বামপন্থী না, এইদেশের কথিত সবার্ধিক প্রচারিত দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলোর লগোতেও সুর্য আছে। প্রথম যে আলো, তার সিম্বল হিসাবে। তাই, এটা বলাই যায় সূর্য এজ অ্যা সিম্বল খুব ইউজ হয়ে গেছে। সুবোধের যে বেশ, একটা আউলা-ঝাউলা, ছিঁড়া কাপড়-চোপড়ের লোক মানেই সে সাফারার। সাথে এইটাও মনে করা হয়, এসব লোক মাস্ট কোনো একটা ক্রিয়েটিভ পারসন। যে তার ক্রিয়েটিভিটির তাড়নাতে কোথাও সফল হইতে পারে নাই। ফলে এই হাল। তাই এরকম ‘পাগল’ টাইপের ক্যারেক্টার দিয়ে আর্টে ‘মেসেজ’ দেয়ার অভ্যাসও পুরানাই। সুবোধও এজ অ্যা ক্যারেক্টার, তাই তেমন নতুন কিছু না। নতুন না তাদের টেক্সটের ভাষাও। কবে হবে ভোর বা এ জাতীয় কথাবার্তা, তথাকথিত ক্লিশে ঘুম ভাঙাইতে চাওয়া বা জাগাইতে চাওয়াও। বলা যায় এরকম ক্যারেক্টারের এটা লস্ট এবং লাস্ট ভিজুয়াল। তো, তারপরও কেন সুবোধ এত পপুলার? তার একটা কারণ মনে হয়, এই যে বললাম লাস্ট ভিজুয়াল, এ কারণেই। মানে লাস্ট হবার কারণে না, এই যে এতদিন ধরে এস্টাবলিশড, সাফারারের যে ইমেজ, তা লাস্ট যেমন, ফার্স্টও। এর আগে এত বড় কোন ইমেজ (প্রায় লাইভ সাইজে, তবে সবসময় না) রাস্তাঘাটে এইভাবে দেখা যায় নাই। সাথের ‘পালিয়ে যা’ বা ‘এখন সময় তোর পক্ষে না’ / মানুষ ভালোবাসতে ভুলে গেছে’ টাইপের যে টেক্সট, তা ঢাকার মধ্যবিত্ত মননকে ভালোই ইমোশনাল করতে পারছে। মধ্যবিত্তকে যেহেতু ভালোবাসার আসলে কেউই নাই, তার পক্ষেও কেউ নাই, ইভেন সিমপ্যাথিও নাই (গরীবের জন্য সিমপ্যাথি ব্যাপক), তাই তারা সুবোধে মোটামুটি সান্ত্বনা পাইল এক প্রকার। কিন্তু সমস্যা হইল সুবোধের মতোন এই মধ্যবিত্তের পলায়া যাওয়ার গোপন আকাঙ্ক্ষা থাকলেও, সাধ্য নাই। আর যাইতে পারলেও, যাবে কই? ইন্ডিয়া? অইদেশ তো হিন্দুর। হিন্দু সুবোধরা সেখানে ট্রাই দিতে পারবে বটে। কিন্তু মুসলিমরা? মালয়েশিয়া- দুবাই যাওয়া সহজ নাকি! তবে দুএকজন আইইএলটিএস দিয়ে-টিয়ে কানাডা পর্যন্ত ভাগে বটে, কিন্তু পারে ক’জন? তার ওপর সুবোধ মধ্যবিত্তের আরেকটা ব্যারাম ‘দেশপ্রেম’। এই দেশরে একরকম সে ভালোবাসে , এই প্রেমরে দেখাইতেও সে ভালোবাসে। এইটা একটু দেরিতে বোঝে সুবোধ। যেহেতু সুবোধও মিডলক্লাস, তাই সে দেশে ছেড়ে যাইতে চাইলেও, তার যে দেশের প্রতি প্রেম আছে, অইটা সপ্রমাণ দেশ ছাড়তে পারলে তার মনন পরিশুদ্ধ হয়। কোন গিল্টি থাকে না মনে, গোপনে। এই না থাকার প্রমাণ স্বরূপ, সুবোধকে পতাকাও হাজির করতে হল। সেই পতাকারে জড়ায়া ধরাও দেখাইতে হইল। উপায় ছিল না আসলে। কারণ সুবোধ ততদিনে পপুলার। নানান জন নানান কথা বলতেছে। মিডিয়া কাভারেজ দিচ্ছে। তার মানে, সে যাদের নজরে আসলে বাস্তবিকই জেলে ঢুকে যাইতে পারে, অই আশঙ্কাও তৈরি হচ্ছে। ফলে দেশদ্রোহী হিসাবে হাতকড়া না পরার আগেই হাতে পতাকা নেয়াটারে সুবোধের একটা টেকনিক্যাল এপ্রোচ হিসাবেও নেয়া যাইতে পারে। কিন্তু এসব গ্রাফিতি, সাথে তার ক্রমশ কাব্যময় হয়ে উঠতে থাকা টেক্সট, যেমন একটাতে বলতেছে: “সুবোধ এখন জেলে! পাপবোধ নিশ্চিন্ত করছে বাস মানুষের হৃদয়ে।” এটা কী ঠিক গ্রাফিতির ভাষা? সুবোধকে আগে পালিয়ে যা, পক্ষে না এটুক বলার ভিতর যে বোল্ডনেস ছিল, তা যেন এখানে হারায় গেল। সুবোধ যেন শিখাইতে আসা সাধু ; যে আমাদের পাপ- পুণ্য শিখাইতে চায়। ফলত যারা আগে সহজে কাছে গেছিল তারা মাস্টার সুবোধের কাছ থেকে খানিক পিছায় গেল। এটা সুবোধও ফিল করল। তাই হয়তো সামনে আসা কমায়া দিল। এটা জাস্ট ধারণামাত্র। অন্য কারণও থাকতে পারে। তবে বাংলাদেশের চিকা হিস্ট্রি ‘গ্রাফিতি’ হয়ে উঠবার পিছনে সুবোধের বড়সড় ভুমিকা আছে।
আর্টিস্ট: ক্রো-কাক, চট্টগ্রাম
★
সম্ভবত আগে ফেসবুকে দেখছিলাম, পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের চারুকলার ভিতরে দেয়ালে, ছোট- খাট একটা গ্রাফিতি, গৌতম বুদ্ধ। নিজের মাথায় নিজে পিস্তল ধরে আছেন। সাথে টেক্সট ‘লেট মি ডাই’। যে বুদ্ধ জীবহত্যার বিরুদ্ধে, সেই বুদ্ধ যখন নিজেই নিজেরে হত্যা করতে বন্দুক বাড়ায় দেন, ইন্টারেস্টিং লাগে। এরপর যে গ্রাফিতিটি চোখে আসে, অইটাও ফেসবুক মারফত। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। রবীন্দ্রনাথকে কেউ ধরে নিয়ে যাচ্ছে; হাত পিছ মোড়া করে। এখানে হাতপিছ মোড়া রবীন্দ্রনাথের যে ইমেজ, তা সত্যজিত রায়ের আঁকা। বহুল পরিচিত। সেই বহুল পরিচিত সত্যজিতের রবীন্দ্রনাথকে আর্টিস্ট কনটেক্সট বদলায় বাংলাদেশের হাইলি পলিটিক্যাল এক সিচুয়েশনে নিয়ে আসছেন। এ নিয়ে আসাটা চমৎকার হইছে।
এইরকম আরো কিছু গ্রাফিতি পাই আমরা ‘ক্রো- কাক’ (এটাই আর্টিস্টের নাম) মারফত। এরকম একটাতে ন্যাংটা ঠাকুর। মানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পাশে লেখা হেইট দ্য ড্রেস। রবীন্দ্রনাথ কেন? যে রবীন্দ্রনাথ দাড়ি জোব্বায় জব্বর ঢাকা, তারে কেন ন্যাংটা করতে চায় ক্রো-কাক? তার কী মনে বাঙ্গালী চেতনা নাই? সে কী মনে করে না বাঙালির ইজ্জত খাড়া হইয়া আছে টেগোর মারফত? মনে হয় না। হইলে পরের গ্রাফিতিতে ‘ক্রো-কাক’ ঠাকুর দিয়ে ঠাকুররে লাগাইতো না। এই লাগাইতে পারার হিম্মতটাই ‘ক্রো-কাক’। ক্রো-কাকের আরেকটা গ্রাফিতি টেস্ট দ্য ওয়ার। কান্নারত বাচ্চার মুখ দিয়ে। আরেকটা চ্যাপলিনের হাসতে থাকা মুখ। কিন্তু মাথা কাটা। রক্ত পড়তেছে। পুরাই কনট্রাস্ট। এত কনট্রাস্ট চ্যাপলিন কী আমরা আগে পাইছি? আরেকটা এমন, কমিউনিস্ট পার্টির কাস্তে হাতুড়ির যে মার্কা, তার হাতুড়ির জায়গায় কাটা চামচ। যেন খালি হাতুড়ি পিটাইলে হবে না, খাইতেও হবে; হাত দিয়ে খাইলেও হবে না, কাটা চামচ দিয়েই খাইতে হবে; এমন কিছু?
ক্রো- কাকের জীবনানন্দ এবং অভিজিত রায় নিয়েও গ্রাফিতি আছে। জীবনানন্দ তো শিক্ষিত লোকের কবি। পাঠ্যবই মারফত তারে পড়ছে বা পড়তে বাধ্য হইছে বটে লোকে, কিন্তু তার হাসপাতালের বেড নাম্বারের গ্রাফিতিতে কী বলতে চায় ক্রো-কাক? এটা কী ক্রো-কাকের সুবোধ সুলভ রোমান্টিক ভাবালুতা? তবে
অভিজিত মারা যাবার পর বাংলাদেশে নাস্তিক কতল যখন জায়েজ হয়ে উঠল প্রায়, অই সময়ে নিজেরে অভিজিত (আই এম অভিজিৎ) দাবির গ্রাফিতি সাহসীই বলা যায় । তবে এরকম কনটেম্পরারি ইভেন্টে ক্রো-কাকের রেসপন্স এটাই শেষ মে বি। পরে আর তেমন চোখে পড়ে নাই। এবার ক্রো-কাকরে একটু সুবোধের সাথে মিলায়া দেখি। সুবোধ যেখানে বড় রাস্তায়, ক্রো-কাক সেখানে গলি-ঘুপচিতে, সহজে চোখে পড়ে না। খুঁজে নিতে হয়। এই একটিভিটিরে গেরিলা প্রবণতা বলতে পারি বটে, তবে কি বিষয়, কি এপ্রোচে তার মধ্যবিত্ত মননের বাইরে যাবার ইচ্ছা বা চেষ্টা ছিল, এমনটা মনে হয় নাই। এটাই বড় মিল বা অমিল সুবোধের সাথে। মিল হচ্ছে যায় নাই। আর অমিল হচ্ছে ক্রো ট্রাই-ই করে নাই। সুবোধের অন্তত চেষ্টা ছিল। এমন না এ
চেষ্টারে আমরা মহিমান্বিত করতেছি। এটা শুধু সনাক্তকরণ জাস্ট। কাজের পালস বোঝার সুবিধার্থে। আরো একটা অমিল যেটা, তা বিষয়ে। সুবোধরে আর যাই হোক লোকের নৌন ঠেকে, না চিনলেও মনে হয় বাড্ডা না হইলেও মিরপুর থাকে লোকটা, বা আগাঁরগাও । কিন্তু চ্যাপলিন? তারে কেমনে চিনবে? বা জীবনানন্দের যে বিল নাম্বার, তা চিনতে তো তামাম সাহিত্যসমাজেও তো কুলাবে না, গবেষক লাগবে। ভুমেন্দ্র গুহ বা গৌতম মিত্র। তার মানে ক্রো’র আপাত মিনিংলেস একটিভিটির প্রবণতা ছিল বা এনার্কি এক প্রকার। তাই হয়তো সে পোশাকের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, যা আপাত অসম্ভবই এবং রোমান্টিক এক প্রকল্প। যেটারে বেয়ার বুবস মুভমেন্টের সাথে তুলনাই করতে পারি আমরা। বা ভাবতে পারি, ক্রো এর মানসে হয়ত প্যারিসের ন্যুড কলোনি বিরাজ করে, তাই এখানেও স্বপ্ন দেখতেছেন। কিন্তু শিল্প-সাহিত্য তো বটেই, সব জায়গা থেকেই প্যারিসের সেন্টার সরে গেছে। তাহলে ক্রো প্যারিসের ন্যুড কলোনিতে যাইতে চায় কেন? নাকি এইটা আমার কষ্ট কল্পিত?
*
এরপরের যে গ্রাফিতির ইতিহাস তা খুবই পলিটিক্যাল। হ্যাঁ, এত পলিটিক্যাল গ্রাফিতি আমরা আগে পাই নাই।এর আগে
আমরা চিকা পাইছি। তুমুল রাজনৈতিক সময়ে তুমুল রাজনৈতিক সব চিকা। প্রায় সব দলের। তখন রাজনীতি আরো সহজ ছিল, চিকাও সহজ ছিল। একটা আরেকটা পরিপূরক ছিল এক প্রকার। কিন্তু কালক্রমে আমরা এমন এক সময়ে ঢুকলাম, যেখানে রাজনীতি আর আগের মতন নাই। আগে দু-চাইরটা বিরোধী দল ছিল। তাদের রাস্তাঘাটে দেখা যাইতো। এখন কী আছে? যেহেতু নাই মূলত, তাই তাদের তল্পিবাহক চিকাও নাই। চিকা লিখতে গেলে যে আয়োজন লাগে, অই আয়োজন এখন কঠিন। নানান কারণে। আর চিকা মেইনলি দলের। দলীয় রাজনীতির। একা একটা লোক বের হয়ে রাস্তায় চিকা লিখতেছে, এমনটা আমার জানা নাই। চিকার যেহেতু সাংগঠনিক ইতিহাস আছে, সংগঠন বহির্ভূত ইহার অস্তিত্ব নাই। তো এ জায়গায় আসলো গ্রাফিতি। চিকা যেখানে দল নির্ভর, গ্রাফিতি অইখানে ব্যক্তিনির্ভর মূলত। ফলে ব্যক্তির রাগ-ক্ষোভ নানানভাবে গ্রাফিতি হওয়া শুরু হইল। সুবোধ দিয়ে শুরু হইল বটে। তবে ছড়ায়া-ছিটায়া গেল নানানভাবে। সম্প্রতি ফেসবুকেই দেখলাম, চিটাগংয়ের একজন ফিলিস্তিনের সমর্থনে এরাবিক গ্রাফিতি (খানিকটা ইংলিশও) করতেছেন। ছবি ভাইরাল হইল। বুঝলাম, যে পরিসরে-সময় নিয়ে , ডেকোরেটিভভাবে করা , তিনি কারও মাথাব্যথার কারণ হন নাই। কারণ হইলে পরে এত টাইম পাইতেন না। যে কারণে হেলমেট বাহিনী বা সহমত ভাইয়ের গ্রাফিতিঅলারা টাইম পান নাই। পান নাই বইলাই তা স্প্রে ক্যান-স্টেনসিলে, দ্রুত সময়ে করা। সুবোধসুলভ স্কিলও নাই। চারুকলাসুলভ বিউটিও নাই। তবে যেটা আছে তা তীব্র রাগ। যে কারণে মারার অনতিবিলম্বেই কর্তৃপক্ষের তা মোছা জরুরি হয়ে যায়। কিংবা ‘মাইকেল চাকমা কোথায়’ ’শরীয়ত বয়াতির মুক্তি চাই’ ‘জাস্টিস ফর আবরার’ বা এরকম আরো যেসব গ্রাফিতি, যেগুলার কথা বলার এনাফ সাহস আমার নাই; যেগুলা আলটপকা মাইরা ফুইটা যাইতে হয় আর্টিস্টরে; পুলিশের কাছে প্রথম রাতে বাধা পাইয়া, পরের দিন কমপ্লিট করার চান্স পান না, দিনকে দিন সেরকম গ্রাফিতি রমরমা হইয়া উঠল।এটা বড়ই পজেটিভ ঘটনা এখানকার গ্রাফিতি
ইতিহাসে। তবে, এমন না যে, সব গ্রাফিতিকে প্রতিবাদীই হইতে হবে, প্রতিবাদ বাদেও গ্রাফিতি হইতে পারে। নিছক এবসার্ড কথা-বার্তাও গ্রাফিতি হইতে পারে। সমাজে যুক্তি-কারণ ইত্যাদির যে শক্ত পাটাতন তাহাতে ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র ছেঁদা করে দেয়ার মাধ্যমে এবসার্ড কথাও অন্যভাবে পলিটিক্যাল হইয়া ওঠে। এ কারণে বাড্ডাতে লেকের পাশে যখন কেউ ভুল বানানে ‘বাগের দুদ খেয়ে তোমাকে ভালোবাশব’ লিখে রাখে, তা গ্রাফিতিই। দুধ চা খেয়ে গুলি করে দিব’ও গ্রাফিতি। ঢাকা ভার্সিটির বিজনেস ফ্যাকাল্টির দেয়ালে ‘জীবন বড় সুন্দর; চাপ নেয়ার কিছু নাই’ও গ্রাফিতি। বিসিএস প্রস্তুতির বিজ্ঞাপনের উপর ”পড়াশোনার মা’রে চুদি”-ও গ্রাফিতি। জেন্ডার পারস্পেকটিভ বা এরকম জায়গা থেকে আপনার তা নিয়ে সমালোচনা থাকতে পারে, তারপরও গ্রাফিতিই। বিদেশি গ্রাফিতির মতোন করে লেখা বেইলি রোডের ‘sorry for your wall’ বা অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড কৌট করে বা সিনেমা
বেইলি রোড। ছবি: রাজীব দত্ত
দেখে গুলশানের দেয়ালে লেখা ‘Follow the white rabbit-ও গ্রাফিতি। কেন গ্রাফিতি? কারণ তা নানানভাবে তার অনাস্থা আপনারে জানাইতে চায়। তার আপত্তির কথা সে জানাইতে চায়। সে বিদ্যমান শুনশান পরিবেশে একটু এনার্কি করতে চায় আর এই চাওয়ার সাথে সমাজ-রাষ্ট্রের নানাবিধ দ্বিমত; তাই তারে নিরালায়-অন্ধকারে সুযোগ করে কাজ করতে হয়। সে আপনার বাহবা সাথে নিয়া স্পন্সর সহযোগে ‘বিউটিফুল আর্ট’ ক্রিয়েট করতে চায় না। চায় না বলেই গ্রাফিতি।
আর টিএসসির রাজুর ম্যুরাল-সঞ্জীব চৌধুরী-ডিলানের’র মুখ গ্রাফিতি না। মাইকেল চাকমা’র চেয়ে চে’র মুখ এখন বেশি বিপদজনক না। এমনি কি কল্পনা চাকমার চেয়ে প্রীতিলতার মুখও না। তবে চে-প্রীতিলতার চেহারা নিশ্চয়ই আর্ট, ওয়াল পেইন্টিং-মুর্যালও বলতে পারি। বাট নট গ্রাফিতি। বরং আঁকার পর কেউ যখন বাহারি সঞ্জীব চৌধুরীর কপালে ব্যান্ডেজ বসায় দিয়ে তার কপাল যে ফাটা এইটা নজরে আনেন, তখন তা গ্রাফিতি হয়ে ওঠে। এ কারণেই জাহাঙ্গীরনগরের বিউটিফুল ওয়াল আমার গ্রাফিতি মনে হয় না। বুদ্ধিজীবি ভরা জা.বি.তে এফডিসির দিলদার-এটিএমের মুখ আঁকতে পারা আর্টিস্টের খানিকটা উদারতা বটে, বাট পলিটিক্যালি ঠিক গ্রাফিতি মনে হয় না। বা ঢাকা চারুকলার দেয়াল ভরতি নানাবিধ‘নন্দন’ও না। বরং এগুলা পাশের জয়নুল গ্যালারির ভিতরে যে বিদ্যমান আর্ট, তার এক্সটেনশন বলতে পারেন। অবশ্য, এই যে লাইন টেনে দিচ্ছি, এইটা এইটা গ্রাফিতি, এইটা এইটা না। এইটাও গ্রাফিতি’র সেন্সের বিরুদ্ধে একরকম। এবং এও সত্যি গ্রাফিতির আর্ট হওয়ারই দায় নাই। বরং তার দায় আমারে-আপনারে ধাক্কা দেয়াতে। আমাদের যে বিন্যস্ত সাজানো গোছানো গোলাপ বাগান, সেইখানে তার অমরণীর (ঢোল কলমি বলে বইবাদীরা) ডাল হওয়াতে। যে বাগানের পরিপাটি বিউটিনেসকে সমস্যায় ফেলে দিবে। আনন্দের কথা, এরকম গ্রাফিতি বাড়তেছে। সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিই মূলত এরকম গ্রাফিতিকে জরুরত করে তুলতেছে। কত আর চুপ করে থাকবেন! কথা তো বলতে হবে, না? তাই এসকল গ্রাফিতি এক প্রকার বলার ভাষা। কেউ বোঝে, কেউ বোঝে না।
উপরের এ তিনটা ছবির ফটো ক্রেডিট: শাওন চিশতী। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে।
“>