আমাদের স্ক্রিনময়ী জীবন অনর্গল ডিজি-ছবির বন্যায় চিন্ময়। এই নেটেড দর্শনের গ্লোবাল রাজত্ব শুধু আমাদের অবসরকেই শাসন করে না, কোন ছবির ঝাঁক কিভাবে ইন্টারনেট আর স্ক্রিন বেয়ে আমাদের চোখ ধাঁধায় আর মন মাতায়, তা দিয়ে গড়ে ওঠে আমাদের রোজওয়ারি গণদর্শন আর রাজনীতি। ভিসুয়ালের সেই সাইবারশাহীর নানা ঝাঁকিদর্শন নিয়েই এই কলামের নানান কিস্তি।
বয়স্ক ইন্টারনেটশিক্ষার তল-অতল-সুতল-বিতল-মহাতল-তলাতল-পাতাল
শিরোনামেই শব্দসীমার এক খাবলা খেয়ে নিয়ে এটাই বলতে চাইছি – এ কর্ম নহে নহে নহে আসান । এর তল পাওয়া মুশকিল, হাল ছাড়া বরং তুশ্চু। নব্বই-এর দশক থেকে যাঁরা যাঁরাই পূর্ণবয়স্ক বাবা-মা পাবার সৌভাগ্যপ্রাপ্ত হয়েছেন, তাঁরা তাঁরাই এই দুর্ভাগ্যপ্রাপ্ত হয়েছেন। কিন্তু বয়স্ক মানুষদের ডেস্কটপ , ল্যাপটপ, ট্যাবলেট বা স্মার্টফোনে ইন্টারনেট শেখা কেন কঠিন সে বিষয়ে নানা চেনা বিশ্লেষণের বাইরে গিয়ে তার চাক্ষিক নানান কারণ নিয়ে এই কিস্তি। নিজের মাকে দুই দশক ডেস্কটপ-ল্যাপটপ-ট্যাবলেট
হয়ে স্মার্টফোন শিক্ষা দিতে দিতে বুঝলাম, যে এই বয়স্কশিক্ষার ক্ষেত্রে বয়সই একমাত্র সমস্যা না। বয়স্করা কমবয়েসিদের মতই যে যে কাজে বা অ্যাপে তাঁদের আগ্রহ, সেগুলো কম পরিশ্রমেই শিখে ফেলেন, আর বয়সজনিত নানা কারণেই তাঁদের ইন্দ্রিয়শক্তি কমে যায়, নানা অবান্তর ব্যাপারে ভয় পান বা কম বোঝেন । কিন্তু বয়স্কদের শেখার পথে এক মূল বাধা হয়ে দাঁড়ায় নানা ভিজুয়াল জিনিসপাতি, যেগুলো নাকি ইন্টারনেটশিক্ষার জন্য সার্বজনীন এবং সহজতম। সেই ভুলভুলাইয়াগুলি নিয়েই এই কিস্তিতে আমাদের আলোচনা।
আমরা শুরু করবো একটি খিল্লিমূলক মিম দিয়ে। এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয় ‘pushes down hard on screen as if there are actual buttons’ বিষয়টি। টেলিফোন-ডেস্কটপ-ল্যাপটপ থেকে ট্যাবলেট-ফ্যাবলেট (ফোন প্লাস ট্যাবলেট) হয়ে স্মার্টফোনে অভিযোজনের একটি বড় লক্ষণ হ’ল বোতাম বা বাটন এক নিষ্ক্রিয় অঙ্গে ( Vestigial organ )পরিণত হওয়া। তার সাথে বয়স্করা যে মানিয়ে নিতে পারেন না আর বাকিরা মানিয়ে নিতে পারেন, তার মধ্যে ভালো আর কালো কি কি?

এখানেও বেঁড়েব্যাটা আইফোন। আলিসা বেরেজনাক ‘দ্য রিঙ্গার’ পত্রিকায় লেখেন যে আইফোনের বোতামবিরোধী ডিজাইন বাই তার অভূতপূর্ব সাফল্যের সাথে সাথে বাজারী ইলেক্ট্রনিক পণ্যের এক প্রাচীন অঙ্গের হানি করে। বোতাম শুধু তার সাবেকি গরিমার জন্যে বয়স্কদের কাছে জরুরি না, বোতামব্যবহার ইন্টারনেট চালনার জন্য আমাদের প্রয়োজনীয় একাগ্রতার কর্মভার দুটি ইন্দ্রিয়ের মধ্যে ভাগ হয়ে যায় – ত্বকের স্পর্শ আর চোখের নজর। কিপ্যাডে হাত বসে গেলে হাত হাতের মত চলে, চোখ শুধু কাজ করে স্ক্রিনে। কিন্তু বোতাম উড়িয়ে কিপ্যাড যখন স্ক্রিনের অংশ হয়ে যায় তখন চোখকে ডবল শিফটে কাজ করতে হয়। তার থেকেও মুশকিলের কথা, পুরো ইন্টারনেটচালন যন্ত্রটি নানা মসৃণ তলের এক মায়ামর্মরসরোবরে পরিণত হয়, যাতে বয়স্করা দুর্যোধনের মত পা পিছলে পড়েন।

ময়দানবের তৈরি এক মায়াপ্রাসাদের কথা মহাভারতে ছিলো। সেখানে মর্মরের মেঝে দেখে জলসরোবর আর জলসরোবরকে মার্বেলের মেঝে মনে হ’ত। অর্থাৎ চোখের গভীরতা বা দূরত্ব মাপার শক্তি (depth perception)-কে সাথে সেখানে ঠকানো হ’ত। স্মার্টফোনের নিকষ কালো আয়না যখন
শতদীপ-ব্রাইটনেসে জ্বলে উঠলেও তার ছুঁইপর্দায় – ডেস্কটপ-ল্যাপটেপের মত করে আগে-খোলা, পরে-খোলা উইনডোর মধ্যে আগু-পিছু করে খোলা-বন্ধ করতে গিয়ে – পিছলে যায় বয়স্ক চোখ।কারণ স্মার্টফোনের উইন্ডো একটি আরেকটির পিছে সাঁটা থাকে পুরোপুরি। ঘনত্ব (গাঢ়-হালকা) বা দূরত্ব (ছোট-বড়) -এর অনুভূতি দিয়ে সেগুলিকে আলাদা করা যায় না।
কিন্তু বোতামবিয়োগ আর টাচস্ক্রিনের ছোঁয়াছুৎ নিয়ে এত কথা বলার মানে এই নয় যে মাল্টিটাচ টেকনোলজি বয়স্কদের জন্য আদতেই অচল, তাঁদের সমবয়েসি পুশবাটন বা ক্লিকমাউস টেকনোলজিতেই তাঁরা বেশি স্বচ্ছন্দ। এই স্বতঃসিদ্ধ যে বেজায় ভুল তার পক্ষে ভূরি ভূরি প্রমাণকে বাজারি ধোঁকাবাজি বলে উড়িয়ে দিতে চাইলেও মাল্টিটাচ টেকনোলজি যে বয়স্কবান্ধব তার প্রমাণ এতটাই বেশি যে তার সবটা উড়িয়ে দেওয়া মুশকিল। তলিয়ে দেখলে ইস্কুলে মুশকিলের আসল জায়গা টাচস্ক্রিন নয়, তার সেন্সিটিভ অংশের বিন্যাস। সেই অংশগুলি যদি খুব গায়ে-গায়ে থাকে তাহলেই আনাড়ি-আঙ্গুলের দ্বারা কি-হইতে-কি-হইয়া-গেল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সেই সেন্সিটিভ অংশের বিন্যাস ডিজাইনে যেহেতু কমবয়েসি আঙ্গুলের প্রতি পক্ষপাত থাকে পরতে পরতে, বয়স্করা আরও পিছলে পড়েন।

‘ভিডিও’ আইকনকে ‘কাত হওয়া ঘটি’ আর ‘ট্র্যাশ’ আইকনকে ‘জেলখানার গরাদ’ বলে ভুল করতে দেখেছেন কি নিজের মা মাসিদের? এটা নিয়ে খিল্লি করা যেতেই পারে কিন্তু তার থেকে ভালো কাজ করেছেন ইজরায়েলের তেল আভিভ ইউনিভার্সিটির নেট্টা গানর আর ডভ টিনি। যেই আইকন-ছবি নাকি লেখার চেয়ে অনেক বেশি সার্বজনীন, সেই আইকন ছুঁয়ে ছুঁয়ে ইন্টারনেট চালাতে বয়স্কদের কি কি সুবিধা-অসুবিধা হয়? গানর আর টিনি আইকনের ব্যবহারযোগ্যতাকে চার ভাবে বোঝান – তা কতটা নিরেট (মানে যে জিনিস বা কাজকে সে দেখাচ্ছে, সেটার বাস্তব রূপের সাথে মিল কতটা, অর্থাৎ তার মূর্ত্ততা / বিমূর্ত্ততা, যেমন ডিলিট করা আর ডিলিট আইকন), কতটা চেনা (ঐ আইকন আগে কতবার দেখা হয়েছে), অর্থের ফাঁক (মানে বোঝার জন্য ভাবনায় কতটা পথ পেরোতে হ’য়), জটিলতা (আইকনের মধ্যে নকশার কারিকুরি কতটা, সরলতা)। এই চারটি ধারা আলাদা আলাদা আবার একসাথে যুক্ত-ও। যেমন আইকনের নকশার জটিলতা বাড়লে সেটা আরও নিরেট আর চেনা হয়ে উঠতে পারে। যেমন ভিডিও ক্যামেরার অতিসরলীকৃত আইকন (যাকে আমার মামি কাত করা ঘটি ভেবেছিলেন) যদি একটা ভিডিওক্যামেরার গোটা ফটো হয়ে উঠত তাহলে তার নিরেট ভাব বাড়ত আর অর্থের ফাঁক কমত কিন্তু যেটা মুশকিল হ’ত যে অত ছোট মাপে সেই আইকনকে বয়স্ক চোখে বোঝা মুশকিল হ’ত। আবার আমরা যদি ভাবি যে ‘ট্র্যাশ’ আইকন সেকেলে বিলিতি টিনের বালতির মত না করে কালো ট্র্যাশব্যাগের মত করলে ভালো হ’ত, তাতে জটিলতা আরও কমত, চেনা আরও বাড়ত কিন্তু সাথে বেড়ে যেত অর্থের ফাঁক। কালো-গোলালো-মাথায়-ঝুঁটি আইকন বোম বা কালো আঙ্গুরও হ’তে পারে। গবেষণার ফলাফল হিসাবে তাঁরা বলেন যে, বয়স্কদের জন্য আইকনের অতিসরলতা লাভদায়ক নয়, আইকনের অর্থের ফাঁক বাড়ানো বেশ মুশকিলের, অর্থের ফাঁক আর জটিলতা ঠিকমাপে কম ও বেশি করতে পারলে তা বয়স্কদের জন্য খুবই কাজের হয়।
শুভপ্রদা রবির গবেষণা এই সিদ্ধান্তে আসে সে বয়স্কদের অধীত বিদ্যা যা মূলত অক্ষরনির্ভর, ছবিনির্ভর নয় – তাকে ভুলে গিয়ে এগোলে বয়স্কদের বেঁধে রাখা হবে।
বয়স্ক ইন্টারনেট শিক্ষায় ছবির মুশকিল থেকে ছবিই মুশকিল এই প্রতিপাদ্যে পৌঁছনো এই কিস্তিলেখকের উদ্দেশ্য নয়।বয়স্কইন্টারনেটশিক্ষার এই ভিজুয়াল মুশকিল শুধু বয়স্কদের একার নয়, সব নতুন শিক্ষার্থীদের। বয়স্করা সেই প্রতিকূলতা বাকিদের থেকে অন্যভাবে কাটান। সেই সমাধানগুলো বাকিদের কাজে না লাগলেও জি ইউ আই-এর বিরাট বিরাট পোকা পাকড়ানো বা বাগ-ফিক্সিং-এ তাঁদের কুন্ঠাহীন ভাবে প্রকাশিত সমস্যার ফর্দ এক সোনার খনি।
নিজেদের সমস্যার কথা বলতে তাঁরা সদাই ক্লান্তিহীন ।
আরও পড়তে চাইলে:
https://www.theringer.com/tech/2017/9/11/16286158/apple-iphone-home-button
Is a big button interface enough for elderly users? Towards user interface guidelines for elderly users : A Master’s thesis, Tanid Phiriyapokanon , Mälardalen University 2011
Ganor, Netta, and Dov Te’eni. “Designing interfaces for older users: effects of icon detail and semantic distance.” AIS Transactions on Human-Computer Interaction 8, no. 1 (2016): pages 22-38.
Fluid and Crystallised Intelligence in Elderly People: Design Guidelines to Improve Web Usability, Shubapradha Ravi, A Masters Degree Research Report Submitted to The Wits School Of Arts, Faculty Of Humanities, University Of The Witwatersrand, Johannesburg, 2017

সৌরভ রায়
লেখক, সম্পাদক, অনুবাদক ও চিত্রগবেষক
বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের LGBTIQ+-সংক্রান্ত অনলাইন ভিসুয়াল কন্টেন্ট নিয়ে গবেষণা করছেন।