অর্ধশতাব্দীকালেরও বেশি সময় ধরে বাংলা কবিতার স্বতন্ত্র ধারার একজন চর্চাকারী হিসেবে কবি আল মাহমুদ আমাদের কবিতায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন। কেবল কবিতাতেই নয়, গদ্য সাহিত্যেও তিনি সমান পারঙ্গম ছিলেন। ১১ জুলাই, ২০০৫ ছিল কবি আল মাহমুদের ৭০তম জন্মদিন। জন্মদিনের প্রাক্কালে কবি আল মাহমুদ গুলশানের বাসভবনে শহীদুল রিপনের সঙ্গে অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় অংশ নেন। এখানে তার অংশবিশেষ পত্রস্থ হলো।
আমি স্বীকার করি আমাদের কবিতায় স্বপ্ন কম। আমি চেষ্টা করেছি। এই অভাব আমি একা পূরণ করতে চেয়েছি। আমি সবসময়ই বলি, একজন কবির প্রধান কাজ তার জাতিকে স্বপ্ন দেখানো।
শহীদুল রিপন: ১১ জুলাই আপনার সত্তরতম জন্মদিন। ৭০ বছর আগে তো আপনার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। আপনি ছিলেন আপনার পিতা-মাতার ইচ্ছার খুব গভীরে। এখন আকাশে জলভারে ফুলে ওঠা মেঘের আনাগোনা, প্রকৃতি বর্ষণসিক্ত। আমার প্রশ্ন হলো- আপনি জন্মানোর জন্য বর্ষা ঋতুকে কেন বেছে নিলেন?
আল মাহমুদ: জন্মটা যদি আমার নিজের ইচ্ছায় হতো তাহলে অবশ্যই আমি এই সময়টাকে অতিক্রম করে জন্মাতাম। হয়তো বসন্তকালে জন্মাতাম। গ্রীষ্ম আমাদের প্রধান ঋতু। গ্রীষ্মের পর আসে বর্ষা। বর্ষা অবসরের ঋতু। আমাদের গ্রামাঞ্চলের দিকে খেয়াল করলে দেখবে অত্যন্ত পরিশ্রমী কৃষক হয়তো বসে শিকে বুনছে বা জাল বুনছে। চতুর্দিকে পানিতে ডুবে গেছে। এই অবসর সময়টায় বাংলার সংস্কৃতির বিকাশও হয়েছে, মানুষ কল্পনাপ্রবণ হয়েছে। সব বড় কাজ এই সময়টায় হয়। বুদ্ধের জীবনী দেখলে দেখবে লেখা আছে- তখন তিনি বর্ষাযাপন করছিলেন। অর্থাৎ ধর্মপ্রবক্তাদেরও হয়তো আধ্যাত্মকিতা বা কল্পনাপ্রবণতা বাড়ে বর্ষায়। কবিদের ক্ষেত্রে তো কোনো কথাই নেই। কারণ সব বড় কবিই বর্ষার উপাসক। বর্ষা অংকুরোদগম করে। কাকতালীয়ভাবে এই ঋতুতেই আমার জন্ম। প্রত্যেক জন্মদিনেই এটা নিয়ে আমার ভেতর নানা প্রতিক্রিয়ার সঞ্চার হয়। জানা মতে, আমার পিতা-মাতা পরস্পরকে অত্যন্ত ভালবাসতেন। আমি তাদের প্রথম সন্তান। নিশ্চয়ই ভালবাসার সন্তান। বর্ষা ঋতুতে আমার জন্ম হয়েছে এটাকে খুব স্বাভাবিক ব্যাপার বলে আমার মনে হয়।
শহীদুল রিপন: ঢাকা শহরে যেসব কবির জন্ম তাদের জন্ম-পরিচয়-ঠিকুজি ইত্যাদি খুব সহজেই জানা যায়। কিন্তু আপনার কবিতায় নাগরিক জীবনযাপনের পাশাপাশি গ্রাম সংলগ্নতা, নিসর্গবর্তিতা খুব সহজেই ফুটে ওঠে। আপনার পারিবারিক জীবন, বেড়ে ওঠা, শৈশব ইত্যাদি সম্পর্কে কিছু জানাবেন?
আল মাহমুদ: প্রথম কথা হলো দরিদ্র পরিবারে আমি জন্মেছি। একসময় তারা ঐশ্বর্যশালী ও অভিজাত থাকলেও শেষদিকে, আমার বাবার সময়ে এসে আমাদের প্রায় নিঃস্ব অবস্থায় পৌঁছাতে হয়। তিনি বস্ত্র ব্যবসায়ী ছিলেন। তার দোকান-ব্যবসা সব ফেইল করে যায়। আমি শৈশবে দরিদ্র অবস্থার মধ্যে লেখাপড়া করেছি। আমার এক চাচী আমাকে লালন-পালন করেছেন। আমি ঠিক ঘরে থাকতে পারিনি। দারিদ্রের কারণে তো বটেই, রাজনৈতিক কারণও ছিল। ভাষা আন্দোলনের সময় আমি একটা কবিতা লিখেছিলাম- ভাষার লিফলেট। এটা ছাপা হওয়ার পর আমার বাড়িতে পুলিশ গেল। আমি পালিয়ে গেলাম। আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। সেই যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলাম আর আমি ফিরতে পারিনি। এটা হলো মূল কথা। আমার উন্মূল হওয়ার কথা। অনেক পরে আমি হয়তো বারবার ফিরে গেছি, কিন্তু সেটা অন্য কথা। যাকে বলে ফেরা – পরিবারের শেকড়ের সঙ্গে আর আমি যুক্ত হতে পারিনি। উদ্দেশ্যহীনভাবে সারা বাংলাদেশ ঘুরে বেড়িয়েছি। এই বিচরণশীলতাই হয়তো আমাকে কবি করে তুলেছে।
শহীদুল রিপন: এই আপনার জীবনের ইতিহাস?
আল মাহমুদ: আমার জীবনের ইতিহাস আমি যদি তোমাকে খোলাখুলিভাবে বলি, তো বলতে হবে, আমি কোনো অ্যাকাডেমিক ক্যারিয়ার সৃষ্টি করতে পারিনি। আমি অ্যাকাডেমি থেকে বিচ্ছিন্ন একটা লোক। কবিতা লিখছি, ঢাকার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই, আবার ওই সময় আমার কবিতা ছাপা হচ্ছে কলকাতার বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায়। এটা একটা অভাবনীয় ব্যাপার না? ঢাকাকেন্দ্রিক সাহিত্যে আমার পথের মাঝে তাই দেয়াল দেওয়া হয়েছে। অথচ অন্যদিকে একটা প্রবল পরীক্ষায় আমি উত্তীর্ণ হয়ে যাচ্ছি- ‘চতুরঙ্গ’, ‘নতুন সাহিত্য’, ‘পরিচয়’, ‘দেশ’ সব পত্রিকায় আমার কবিতা ছাপা হচ্ছে- আমি কে সেটা কেউই চেনে না। তো এ ধরনের একটি লোককে যে প্রতিবন্ধকতা ভোগ করতে হয় সেটা শিক্ষিত লোকের প্রতিবন্ধকতা। আমাকে কেউই মানতে চায়নি। ভেবেছে একটা অশিক্ষিত ছেলে। এটা সবসময় হয়েছে। সব বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্টস ফ্যাকাল্টিগুলোয় যারা সাহিত্য পড়ায়, ইংরেজি পড়ায় তারা কখনোই আমাকে স্বীকার করতে চায়নি। শুধু তাই নয়, আমি কলকাতায় যেখানে লিখতাম, সেখানে যোগাযোগ করে ওরা বলেছে, আল মাহমুদ তো একজন অশিক্ষিত লোক। ওখানেও তো তাদের মতো, তাদের মতের লোক রয়েছে। তখন আমার কোনো স্থায়ী ঠিকানাও ছিল না। তারা মানতে পারছিল না যে অ্যাকাডেমির বাইরের একজন লোক কেন ভালো লিখবে! আমি ছিলাম গ্রামে গ্রামে, রাস্তায় রাস্তায়। এরকম অবস্থার মধ্যে আমাকে পড়তে হয়েছিল।
শহীদুল রিপন: আরেকটু পেছনে যাই, আমি বলছিলাম শৈশব-কৈশোরের কথা। তিতাস নদী, গোকর্ন ঘাট, অদ্বৈত মল্লবর্মণ ইত্যাদি আপনার মানস গঠনে তো ভূমিকা রেখেছে। ওখানেই আপনি তো জীবনের পাঠ নিয়েছিলেন, নিসর্গ ও প্রকৃতির সাহচর্য পেয়েছিলেন।
আল মাহমুদ: শুধু জীবনের পাঠ নয়, অ্যাকচুয়ালি তাদের রচনাও অনেক ভূমিকা রেখেছে। আমাদের দেশে অসংখ্য বাউল ছিল, তারপর আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শ্রেষ্ঠ ওস্তাদরা- তাদের ঘরানা ছিল, তখন আমাদের শহরটি ছিল সঙ্গীতের আর সাহিত্যের শহর এবং বিপ্লবের শহর। লালমোহন পাঠাগার নামে একটা পাঠাগার ছিল। কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালনা করত। আমাদের শহরে যত বুদ্ধিজীবী , কবি-সাহিত্যিক, শিল্পী বেড়ে উঠেছে, তাদের প্রত্যেকেরই কোন না কোন সময় ওই পাঠাগারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। ‘জলসাঘর’ একটা বই ধরো তিন-চার দিন বাদে কমিউনিস্ট পার্টির কল্যাণে আমরা পেয়ে যেতাম। আমি লিখতে জানি, লিখি এবং সেটা ছাপা হয় এই খবর সবাই জানত বলে পাঠাগারের সবাই আমাকে স্নেহ করত। সুযোগ-সুবিধা দিত এবং একজন প্রগতিশীল মানুষের মানস গঠনে যা যা দরকার, ‘ছোটদের রাজনীতি’, ‘ছোটদের অর্থনীতি’, ‘সমাজ বিকাশের ধারা’ ইত্যাদি গাদা গাদা বই আমাকে বাসায় নিতে দিত।
শহীদুল রিপন: ব্রাহ্মণবাড়িয়া তো মূলত ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিকের পুরোধা খাঁ পরিবারের মূল ঠিকানা… আপনার কবিতার সংহতির পেছনে মিউজিকের কি ভূমিকা?
আল মাহমুদ: আমি যখন মধ্য ইংরেজি স্কুলে পড়ি তখন আমার সহপাঠী ছিল আজাদ হোসেন খান, দু’ক্লাস উপরে পড়তেন বাহাদুর হোসেন খান। এদের সঙ্গে সর্বদা আমার বন্ধুত্ব ছিল। আমি বসে বসে ওদের রেওয়াজ দেখতাম। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথের পাশেই একটি গৃহে এরা রেওয়াজ করত। কবিতা ও মিউজিকের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই। ওদের মিউজিক ছিল অসাধারণ- সহ্য করা যায় না। সেই সময়ের কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা অনেক। চন্দ্রনাথ দা, কানু ঘোষ, কমরেড কমলেন্দু, কমরেড অমূল্য এদের অনেক অবদান। অমূল্য বাবু অ্যাডভোকেট ছিলেন। খুব সুসজ্জিত মানুষ ছিলেন। জেল-জুলুম, হুলিয়া খেটেছেন।
শহীদুল রিপন: আর মল্লবর্মণরা?
আল মাহমুদ: অদ্বৈত মল্লবর্মণের সঙ্গে আমার কখনো দেখা হয়নি। মল্লবর্মণদের এলাকা ছিল গোকর্ন ঘাট। অ্যাকচুয়ালি লালপুরের যে মল্লবর্মণরা এরা অদ্ভুত। এদের সঙ্গে আমাদের মেলে না। এরা কৈবর্ত শ্রেণি। বিরাট লম্বা পুরুষ। মেয়েরা দীর্ঘাঙ্গি স্বাস্থ্যবতী। এক হাতে তাদের সন্তান, অন্য হাতে বৈঠা ধরে সাত মাইল দীর্ঘ নদী অবলীলায়, বড় বড় ঢেউ-তরঙ্গ বেয়ে ওপার থেকে চলে আসছে নিঃসঙ্গ, নিঃসঙ্কোচে। মল্লবর্মণরা নিশ্চয় এক সময় যোদ্ধা ছিল। মল্ল হলো যে যুদ্ধ করে। অদ্বৈত মল্লবর্মণের উপন্যাসের নারী চরিত্রদের আমি দেখেছি। সেন বংশের শাসকরা আমাদের মূল স্তম্ভ যে কৌম সমাজ, প্রাইমারি সমাজ সেটা ভেঙে দিয়েছে। সমাজের ভেতর ভেদরেখা তৈরি করেছে। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, শূদ্র, বৈশ্য ইত্যাদি শ্রেণিতে বিভক্ত করেছে। এসব কথা বললে তো আমাকে সাম্প্রদায়িক বলা হবে। সেন বংশ বাঙালি জাতির কোনো উপকারে আসেনি। বাঙালি জাতি গঠিত হয়েছে পালদের আমলে। পাল রাজা গোপাল, তারপর মহীপাল, দেবপাল- পালদের কয়েকশ’ বছরের শাসনে অসহিংস বাঙালি জাতি গঠিত হয়েছিল। পালরা বৌদ্ধ ছিল এবং কোনোদিন হিন্দু বা কারো ওপর অত্যাচারও করেনি। পালদের সময়ের অনেক শিল্পীর নাম জানা যায়। পালদের ইতিহাসে ধীমান বলে একজন শিল্পী ছিল, ছবি আঁকত। মিতপাল বলে একজন শিল্পী ছিল।
আমার জীবনটা হলো- আসলে একটা গ্রাম্য মানুষ, কবিতা লিখতে এসেছিল, তাকে বিশ্ববিদ্যালয় একটা অশিক্ষিত লোক ঠাউরে কোনো স্বীকৃতি দিলো না। আমি বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাস পড়ে দেখেছি, অনেক বড় সাহিত্যিকেরও একই পরিণতি হয়েছিল। তাই আমার লড়াইটা হলো একজন সৃজনশীল মানুষের, একজন কবির তথাকথিত শিক্ষিত শ্রেণির বিরুদ্ধে।
শহীদুল রিপন: আপনার জীবনে তো নানা কিছু হওয়ার সম্ভাবনা ছিল? কী কী ঘটনা ও ঘটনার অভিঘাত আপনাকে কবি বানিয়ে দিল?
আল মাহমুদ: যেহেতু ভাষা আন্দোলনের কবিতা লিখে আমাকে ঘর ছাড়তে হয়েছিল, কবিতার দিকেই তো আসব, সেটাই স্বাভাবিক। কবি কেন হয়েছি এই প্রশ্ন করো না। জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, সবাই তো কবি হয় না। কেউ কেউ কবি। মানুষ কিভাবে কবি হয়- এটা একটা আশ্চর্য বিষয়। কিছু কিছু লোক কল্পনাপ্রবণ থাকে একটু অধিক। এই ধরনের লোকেরা যখন ভাষাটা তাদের আয়ত্তে এসে যায় তখন তারা কবিতা লিখে।
শহীদুল রিপন: কবিতা লিখে আপনি ঘর ছাড়লেন। তারপর দীর্ঘ অর্ধশতাব্দীকাল কবিতার সঙ্গে বসবাস করার পর একটা পরিণত বোঝাপড়া হয়েছে, সেই শুরুর সময় আপনি কবিতাকে কিভাবে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন?
আল মাহমুদ: তখন তো লেখার জন্য পাগল। তখন তো আদর্শিক বিষয়, সুন্দর প্রাকৃতিক একটা কিছু, একটা ফুল, নদী, নারীদের প্রতি আকর্ষণ, আসঙ্গলিপ্সা সবকিছু নিয়ে লিখেছি। আমি লিখেছি, লিখতে লিখতেই কবি হয়েছি।
শহীদুল রিপন: মুসলমান পরিবারে বড় হয়ে উঠেছেন আপনি, এটা কিন্তু আপনার কবিতায় স্পষ্ট। আধুনিক কবিতা লিখতে মুসলমান অনুশাসন বা মুসলমানদের ঐতিহ্যগত যে উত্তরাধিকার সেটা পরিত্যাগ করেননি। অনেক আরবি ফারসি শব্দ হরহামেশায় আপনার লেখায় এসেছে।
আল মাহমুদ: এটা তো একটা বাস্তবতা। অনেকে এটা অস্বীকার করে। আমি খুব রক্ষণশীল ধর্মীয় পরিবারে জন্মেছি। কিন্তু আদিকাল থেকেই আমার পূর্বপুরুষ ওয়াজ-তফসির করত, তারা কবিতা আবৃত্তি করত। ফার্সি বয়াত আবৃত্তি করত অর্থাৎ কাব্য ছাড়া ধর্মও চলে না। তারা মাওলানা রুমি আবৃত্তি করছে, হাফিজ আবৃত্তি করছে, আবার রবীন্দ্রনাথেরও কিছু কবিতা আবৃত্তি করছে। এটা গোলমেলে মনে হতে পারে। কিন্তু মোল্লাদের ওয়াজ করতে গেলেও তো কবিতা আসে। এটা আমার মধ্যেও হয়তো কাজ করেছে। আমার দাদা ছিলেন বলা যায়, একজন ছোটখাটো কবি। তার অনেকগুলো শখের একটি কাব্য রচনা। তিনি জারি গান লিখতেন। একটা ধুয়া আমার এখনো মনে আছে। মহররম মাসে গাওয়া হতো, পত্র পাইয়া হানিফা শূন্যে দিল উড়া/ দুই ভাই মইরা গেল কবুতরের জোড়া। এটা নাচতে নাচতে তিনি যখন গাইতে শুরু করতেন আমাদের উঠোন ভরা মানুষ তখন কাঁদতে শুরু করত। এটা আমার দাদার লেখা। এসবও আমার মধ্যে কাজ করেছে। তার অসাধারণ সব গ্রন্থ ছিল। বাংলা গ্রন্থ কম। আরবি-ফার্সিসহ অনেক ভাষা তিনি জানতেন। তার ঘরে স্তুপাকারে বই জমা থাকত।
শহীদুল রিপন: আপনার কবিতার মধ্যেই অনেক উপমা এসেছে, যেমন- পিঠার মতো হলুদ মাখা চাঁদ বা নীল বইছা মাছের মতো চোখ ইত্যাদি। এসব তো পুরোপুরিই আমাদের গ্রামজীবনের অনুষঙ্গ।
আল মাহমুদ: তুমি তো বাংলাদেশের ছেলে, তোমার বয়সও তো কম। গ্রামবাংলার এসব দৃশ্য দেখেছ কি না জানি না। আমি দেখেছি। বর্ষার সময় মাছ ধরেছি, বইছা মাছ, নীল রঙের। এত সুন্দর সজ্জিত! মাছটাকে তুমি হাতের তালুতে নিলে দেখবে যে কী অসংখ্য কারুকাজ তার মধ্যে। তো আমি মেয়েদের চোখের সঙ্গে তার মিল দেখেছি। এসব অবশ্যই অভিজ্ঞতা থেকে এসেছে। তুমি যদি বাংলাদেশের অভ্যন্তরটা না দেখো তাহলে কী করে এই উপমা দিতে পারবে। পারবে না।
শহীদুল রিপন: প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল কবিতার সঙ্গে থেকে আপনার এখানকার মূল্যায়ন কি?
আল মাহমুদ: শুরুতে আমি কবিতা লিখতাম মনের আনন্দে, আস্তে আস্তে খ্যাতি, যশ, প্রতিপত্তি এসেছে। যেই ‘সোনালি কাবিন’টা বেরিয়ে গেল তখন যারা আমার ঘোর বিরোধী ছিল তারাও একটু কেঁপে গেল। ‘সোনালি কাবিন’ ছেপেছিলেন সিকান্দার আবু জাফর। ‘সমকাল’-এ দুই সংখ্যায় সাতটা সাতটা করে। আমি তখন চট্টগ্রামে অবস্থান করি। জালুয়াপাড়ায় থাকি। ইকবাল ম্যানশনের চারতলায় বসে কবিতাগুলো লিখেছি।
শহীদুল রিপন: ‘সোনালি কাবিন’ তো মূলত চৌদ্দটি সনেট। এর মধ্যে আমরা প্রেম, কাম, রাজনীতি ও ইতিহাসবোধ, পুরাণ-কোরআন, সাম্যের ধ্বনি ইত্যাদি দেখি।
আল মাহমুদ: আমি সাম্যবাদে বিশ্বাসী ছিলাম এবং মার্কসীয় দর্শনে সম্পূর্ণভাবে বশীভূত হয়েই তো আমি লিখেছি। লড়াই করেছি। তবে অনেকে স্বীকার করেছেন যে দুই বাংলায় বাংলা ভাষায় কোনো মার্কসিস্ট কবি এ ধরনের কবিতা লিখতে পারেননি। কলকাতায়ও স্বীকৃত হয়েছে। আমার দেশেও আমি অভিনন্দিত হয়েছি। আমার প্রথম বই ‘লোক লোকান্তর’, তারপর ‘কালের কলস’, তারপরে ‘সোনালি কাবিন’। ‘কালের কলস’ বেরনোর পর একটা কাণ্ড ঘটল। আমাকে বাংলা একাডেমি পুরস্কার দিয়ে ফেলল। এই স্বীকৃতিই আমার মেরুদণ্ডকে সোজা করে দিল। এটাই প্রথম অ্যাকাডেমিক স্বীকৃতি আমার। তবে এত দীর্ঘ সময় কবিতা চর্চার পরও আমার খানিকটা অপরিতৃপ্তি রয়েছে। কবিতা আমি লিখেছি প্রচুর। বাংলা কবিতার মোড় ফেরাতে না পারলেও আমি চেষ্টা করেছি ধারাবাহিকভাবে। আমার কবিতায় ‘সোনালি কাবিন’ পর্যায় পর্যন্ত ত্রিশ দশকের আবহ, প্রভাব, অভ্যাস বা আচরণগুলোকে পাবে। যেই মায়াবী পর্দায় আমি ঢুকে পড়লাম তখন আমার কবিতায় ত্রিশ দশকের আবহ আর থাকল না।
শহীদুল রিপন: ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’ গ্রন্থভুক্ত একটি দীর্ঘ কবিতা ‘চক্রবর্তী রাজার অট্টহাসি’।
আল মাহমুদ: ‘চক্রবর্তী রাজার অট্টহাসি’তে ত্রিশ দশকের কোন গন্ধ আছে, নেই। একটা নতুন জিল…। ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’, ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ থেকে শুরু করে অতি সাম্প্রতিক আলোচিত গ্রন্থ ‘বিরামপুরের যাত্রী’ পর্যন্ত বলতে পারি তুমি ত্রিশ দশকের কোন আবহ পাবে না।
শহীদুল রিপন: বাঙালি মুসলমান কবি হিসেবে কিভাবে ত্রিশ দশকের প্রভাব কাটিয়ে স্বাতন্ত্রের কথা ভেবেছিলেন? তখন তো দুই বাংলাতেই ত্রিশের পঞ্চপাণ্ডব এবং ইউরোপীয় আধুনিকতার অনুকরণে কবিতা লেখার হিড়িক চলছিল।
আল মাহমুদ: আমি বিনয়ের সঙ্গে একটি কথা বলতে চাই। ব্যাপকভাবে রবীন্দ্রনাথ পড়া ছিল আমার। নজরুলের ডেভলপমেন্ট খুব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি আমি। রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা কবিতায় নজরুলের আগমন এবং কী কী জিনিস দিয়ে তিনি হঠাৎ বাংলা কবিতার মূলধারা থেকে সরে গেলেন এ সম্পর্কে ভেবেছি। তখন একটা রবীন্দ্রবলয় ছিল, খুব শক্তিশালী এবং ইন্টেলেকচুয়াল কবিরা সেখানে ছিলেন। যতীন্দ্র মোহন বাগচী, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, গোলাম মোস্তফা প্রমুখ। এরা কিন্তু তাদের কালের খুব শক্তিশালী কবি। এই প্রেক্ষাপটে একজন মিলিটারির লোক, ব্রিটিশের সেনা এসে কিছু কবিতা লিখলেন যা রবীন্দ্র অভ্যাসের সঙ্গে মেলে না। বিদ্রোহী কবিতার একটা লাইন আছে, ‘আমি পিনাক পানির ডমরু/ ত্রিশূল, ধর্মরাজের দণ্ড,’ এটা কোনো ব্রাহ্মণ সন্তানও লিখতে পারেনি। কাজী নজরুল কোত্থেকে লিখলেন? তাছাড়া ভাষার ইন্টারাকশন যেটা হয়- আরবি, ফার্সি শব্দ অবলীলায় ব্যবহার করলেন বাংলা ভাষায়। আমি বলেছি, যদি রবীন্দ্রনাথ হয়ে থাকেন আধুনিক বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠাতা, তাহলে বলতে হবে নিঃসন্দেহে কাজী নজরুল ইসলাম- কত বড় কবি সেটা বলছি না- দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাতা, পুনর্জন্মদাতা। তিনি না এলে ‘কল্লোল’ কালের উৎপত্তি হতো না। ‘কল্লোল’ যুগের উৎপত্তি হয়েছে বলে ত্রিশের কবিরা আসতে পেরেছেন। আমি আরো বলেছি, ত্রিশের কবিরা না এলেও বাংলা কবিতার যে অগ্রগতি ও বিবর্তন সেটা অবশ্যম্ভাবী ছিল। ত্রিশের কবিরা এমন কী কাজ করেছেন! তারা কিছু ইউরোপীয় কবিতার জানালা খুলে দিয়েছেন। তারা কি বড় উপন্যাস অনুবাদ করে বিশ্ব সাহিত্যের সঙ্গে আমাদের পরিচিত করেছেন? না করেননি। শুধু কতগুলো জানালা খুলে দিয়েছেন। ফরাসি কবিতা, বোদলেয়ার, র্যাঁবোর কবিতার নির্যাসটুকু পেয়েছি তাদের হাত দিয়ে। ধরলাম এটা বড় কাজ। কিন্তু উপমহাদেশে অন্যান্য ভাষা ও সাহিত্যের দিকে তাকালেও বোঝা যায়, ত্রিশের দশকের কবিরা না এলেও বাংলা কাব্যের যে বিবর্তন পঞ্চাশের দশকের কবিরা করেছেন, শামসুর রাহমানরা, আল মাহমুদরা করেছেন, ওপারে শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শরৎ, সুনীলরা করেছেন- সেটা ঘটতই। পঞ্চাশের দশকে এসে বাংলা কবিতায় এমন কিছু অন্যরকম বিবর্তন ঘটল, যা রবীন্দ্র-অভ্যাসের সঙ্গেও আর মেলে না।
ত্রিশ দশকের কবিদের কোনো দেশ ছিল না। এটা স্বীকার করতে হবে। এটা ঘটার কারণে পঞ্চাশ দশকের কবিরাই প্রথম বাঙালি কবি হতে পারলেন। আমি দাবি করি যে আমি, শক্তি, রাহমান এ অঞ্চলের প্রথম বাঙালি কবি যাদের দেশ ছিল, সমাজ ছিল, জাতি ছিল, বিপ্লব ছিল।
শহীদুল রিপন: আপনার লেখায় পড়েছি, বলার চেষ্টা করেছেন ত্রিশের কবিদের ঐতিহ্য বিচ্ছিন্নতা ও ইউরোপীয় আধুনিকতার অনুসরণের কথা। অনেক সময় আপনি ত্রিশের কবিদের অবদানকে খুব বেশি গুরুত্ব দেন না বলে আমার মনে হয়।
আল মাহমুদ: দ্যাখো, আমি তোমাকে খোলাখুলি বলি, ডোন্ট টেক ইট আদারওয়াইজ। ত্রিশের দশকের কবিদের কি কোন দেশ ছিল, ছিল না। বুদ্ধদেব বসুর নেই দেশ, ত্রিশের দশকের সবচেয়ে শক্তিশালী কবি বলা হয় জীবনানন্দ দাশকে। তার আগে বিষ্ণু দে। মার্কসবাদী কবি। আমি জীবনানন্দ দাশকে আপাতত আলাদা রাখছি। আধুনিক কবিতা এবং প্রগতিবাদী আদর্শে বিশ্বাসী কবি বিষ্ণু দে স্বীকার করেছিলেন- আমার খুবই প্রিয় কবি- যখন তার ষাট পেরিয়ে গেছে, ‘আমরা খুঁজেছি হরেক বইয়েতে আপন দেশ/ দেশের বদল ঘুরিয়েছে ডাইনে-বাঁয়ে’। বিষ্ণু দে ষাট পেরিয়ে বুঝেছিলেন একজন কবির একটা দেশ লাগে। তার পরের লাইনগুলো মনে নেই। শেষ লাইনগুলো হচ্ছে- ‘হতাশায় ভাবছি শেষ/ এখন আমি ফিরব মূল ও শেকড়ের গাঁয়ে’। তিনি অবশ্য ফিরলেন। কোথায়? উপনিষদে। একজন মার্কসবাদী কবির শেষ গতি হলো উপনিষদে। ষাট বছর বয়সী বুদ্ধদেব বসু তো ইয়েটস আর অ্যালেন পো’র দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত ছিলেন। লাইন ধরে বলে দিচ্ছি। অ্যালেন পো হেলেন সম্পর্কে বলেছেন- ‘ও হেলেন দ্যাটস ফেস দ্যাট ক্ল্যাসিক ফেস…’। জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’-এ কি তার অনুকরণ নেই? কিন্তু ‘বনলতা সেন’-এ কী হয়েছে- একটা আশ্চর্য দেশের ঐতিহ্যগুলো তিনি চিহ্নিত করেছেন। ‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি, পৃথিবীর পথে/ সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে/ অনেক ঘুরেছি আমি বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে/ সেখানে ছিলাম আমি- আরও দূর অন্ধকার বিদর্ভ নগরে/ আমি ক্লান্ত প্রাণ এক- চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন’। অবশ্য এই কবিতাকে আমি মনে করি অ্যালেন পো’র হেলেন কবিতাটির চেয়েও গৌরবান্বিত কবিতা। তার শক্তিমত্তা, উপমা-উৎপ্রেক্ষা এবং অনুপ্রাস- ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার দিশা’- সব মিলিয়ে দারুণ এক আবহ তৈরি হয়েছে। কিন্তু তুমি শিক্ষিত মার্কসবাদী তরুণ, তুমি চিহ্নিত করবে না যে শেকড়টা কোত্থেকে আসছে? তারপর আরেকটি কথা, জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ বই হলো ‘রূপসী বাংলা’। তারিখ দেখলে দেখা যাবে তিনি অনেক আগে এটি রচনা করেছেন, কিন্তু তিনি ছাপালেন না কেন? তিনি কেন চাটাইয়ের ভেতর লুকিয়ে রাখলেন? হীনম্মন্যতা? তার ত্রিশ দশকের বন্ধুরা ইউরোপীয় আধুনিকতার চর্চা করছেন। ফলে তিনি এটা ছাপতে চাননি। কেননা তাকে জসীম উদ্দীন বলা হবে। বইটা তার মৃত্যুর পর ছাপা হয়েছে। ত্রিশ দশকের কবিদের কোনো দেশ ছিল না। এটা স্বীকার করতে হবে। এটা ঘটার কারণে পঞ্চাশ দশকের কবিরাই প্রথম বাঙালি কবি হতে পারলেন। আমি দাবি করি যে আমি, শক্তি, রাহমান এ অঞ্চলের প্রথম বাঙালি কবি যাদের দেশ ছিল, সমাজ ছিল, জাতি ছিল, বিপ্লব ছিল।
শহীদুল রিপন: সেই সময় দেশভাগ, রাজনৈতিক ঘটনাবলি, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি তো নিজের ভূখণ্ড, তার মানুষ, তার রাজনৈতিক পরিচয়ের অনুসন্ধানে বাধা করল।
আল মাহমুদ: আমরা চাই বা না চাই, আমাদের সময় দেশটা ভাগ হলো। আমার তো তখন বয়স কম। ভাতৃহত্যা, হিন্দু মুসলমানকে মারছে, কলকাতায় রক্তগঙ্গা বয়ে গেল, এদিক থেকে ছিন্নমূল মানুষ, রিফিউজি ওপারে যাচ্ছে উদ্দেশ্যহীন- এসব আমরা দেখেছি। আমরা দেখেছি যুদ্ধ-পরবর্তী ১৩৫০-এর দুর্ভিক্ষ। না খেয়ে শুকিয়ে রাস্তায় মানুষ মরে যাচ্ছে। এ নিয়ে কাজ করছে জয়নুল আবেদিন। এমনকি শেষপর্যন্ত আমরা ভাষা আন্দোলন দেখেছি, মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি। এসব আমাদের বুকের ওপর দিয়ে রেল চালিয়ে দিয়েছে। আমরা পঞ্চাশ দশকের কবিরা, এই যে রাজনৈতিক ঘটনাবলি এসব কিছুর প্রভাব আমাদের কবিতায় আছে। তুমি বলতে পার যে আমাদের কবিতায় স্বপ্ন নেই। হ্যাঁ, আমি স্বীকার করি আমাদের কবিতায় স্বপ্ন কম। আমি চেষ্টা করেছি। এই অভাব আমি একা পূরণ করতে চেয়েছি। আমি সবসময়ই বলি, একজন কবির প্রধান কাজ তার জাতিকে স্বপ্ন দেখানো।
শহীদুল রিপন: বিশ্ব সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে আমাদের বাংলা কবিতার অবস্থান কোথায়? আপনার কি মনে হয়, গত পঞ্চাশ বছরের কবিতা চর্চা সম্পর্কে?
আল মাহমুদ: বাংলা কবিতার চরিত্র আসলে তো রবীন্দ্রনাথই পাল্টে দিয়েছেন। তারপরও অনেক বড় কবি বাংলা ভাষায় এসেছেন। আবার শুধু কবিতা দিয়ে বিচার করলেই তো হবে না, সঙ্গে সঙ্গে দেখতে হবে উপন্যাসও। যদি তারাশঙ্কর দেখো, ‘হাসুলিবাঁকের উপকথা’, ‘কবি’ এরপর বনফুল, তার ‘দ্বৈরথ’- ইউরোপীয় সাহিত্যে খুব কম এই মাপের উপন্যাস আছে। তারপর বন্দ্যোপাধ্যায়রা- মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, অকল্পনীয় সাফল্য বাংলা সাহিত্যে। শেষদিকে এসে সমরেশ বসু, ‘কালকূট’, শীর্ষেন্দুর ‘মানবজমিন’। আমি সমরেশ বসুর ভক্ত। এই সব মিলিয়ে যদি দ্যাখো, আমাদের সাহিত্য আশেপাশের যেকোনো দেশের সাহিত্যের তুলনায় যেকোনো বিচারে উন্নত। নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় যেকোনো অনুন্নত সাহিত্যকেও। ইউরোপীয় সাহিত্যের তুল্যমূল্য লেখা বাংলা ভাষার কাব্যে এবং গদ্যে রয়েছে।
শহীদুল রিপন: কিন্তু একই সময়কালে পৃথিবীর অনেক দেশের সাহিত্যে বিশেষ করে উপন্যাসে উপনিবেশের ফলাফল বা শোষণ-বঞ্চনার সূত্র ধরে অনেক পরীক্ষা-নীরিক্ষা হয়েছে। অন্যরকমভাবে উপন্যাস লেখা হয়েছে। অনেক অনুষঙ্গ, অনেক মতাদর্শ- যেমন ম্যাজিক রিয়ালিজম ইত্যাদি উপন্যাসে এসেছে। সেই তুলনায় মূল ধারার যেসব লেখকের কথা বললেন তাদের লেখায় এসব কমই এসেছে।
আল মাহমুদ: হ্যাঁ, কাজ কম হয়েছে। কিন্তু ওখানে হয়েছে। ইউরোপের কথা বললে, ইউরোপীয় দর্শনের পরিবর্তনের জন্য- যেমন: এক্সিসটেনশিয়ালিজম- অস্তিত্ববাদের দর্শন সোরেন কিয়ের্গেগার্দের দর্শন বা তার পরবর্তী যুগের দর্শনের প্রেক্ষাপটে উপস্থিত হয়েছেন জাঁ পল সার্ত্র। তার বন্ধু আলবেয়ার কামু- তারা দর্শনকে সাহিত্যের বিষয় করে তুলেছেন। কামুর ‘আউটসাইডার’ বইটা অসাধারণ- সহ্য করা যায় না। তারপর ‘দি ফল’, আসলে মানব জীবনের কাহিনীর চেয়ে বেশি দর্শন দিয়ে মানব জীবনকে বিচার করা। ‘আউটসাইডার’ শুরু হয়েছে এভাবে যে, আমার মা মারা গেছেন, এটা কালও হতে পারে, পরশুও হতে পারে। কী একটা উদাসীনতা। মা মারা গেছেন কিন্তু তাতে কিছু এসে-যায় না। কাফকা আবার অন্য জিনিস। ‘মেটামরফসিস’ কল্পনার বিস্তারের এক বিস্ময়কর পর্যায়। একটা মানুষ সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে দেখল সে আরশোলা হয়ে গেছে। পুঁজিবাদি সমাজে ব্যক্তিমানুষ এমন উপলব্ধির দোরগোড়ায় পৌঁছাতে পারে। এসব আমি ভালভাবে পড়েছি। এখন আমি প্রায় অন্ধ। পড়তে পারি না। কিন্তু একসময় এসব আমি পাগলের মতো পড়েছি। যেহেতু আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িনি সেহেতু সে অভাব পূরণ করার জন্য আমি একটু বেশিই পড়েছি। তারপর দেখেছি যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের যারা শিক্ষক, তারা অনেক বিষয় আমার চেয়ে কম জানেন। আমার জীবনটা হলো- আসলে একটা গ্রাম্য মানুষ, কবিতা লিখতে এসেছিল, তাকে বিশ্ববিদ্যালয় একটা অশিক্ষিত লোক ঠাউরে কোনো স্বীকৃতি দিলো না। আমি বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাস পড়ে দেখেছি, অনেক বড় সাহিত্যিকেরও একই পরিণতি হয়েছিল। তাই আমার লড়াইটা হলো একজন সৃজনশীল মানুষের, একজন কবির তথাকথিত শিক্ষিত শ্রেণির বিরুদ্ধে।
শহীদুল রিপন: সম্প্রতি প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে আপনি বলেছেন, আধুনিক কবিতা খুব বেশি আধুনিক নয়…
আল মাহমুদ: এই কথা আমি বলেছি বর্তমান বিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতে। বিশেষ করে ৯/১১-এর পরে। তুমি যদি আমাকে চ্যালেঞ্জ কর তাহলে আমি এর প্রমাণ দিতে পারব। আফগানিস্তান, ইরাকে এখনো যুদ্ধ চলছে। কমিউনিস্ট পার্টিগুলো, প্রগতিবাদী আন্দোলনগুলো সংহত হয়ে এর বিরুদ্ধে পরিকল্পিত প্রতিবাদ করতে পারেনি। আমাদের দেশে মৌখিক প্রতিবাদ হয়েছে ঠিকই কিন্তু তারা একটি আন্দোলন সৃষ্টি করতে পারেনি। এখন এই যে অবস্থা বদলে যাচ্ছে, আমাদের অধিকাংশ লেখকই মার্কসবাদী, তাদের কবিতায়ই এটা আসেনি। বর্তমান কালখণ্ডের যে রাজনীতি, ইতিহাস-চেতনা সেটা আধুনিক কবিদের রচনায় অনুপস্থিত। আমি একটা কবিতা লিখেছিলাম আফগানিস্তানের ঘটনার ওপর ‘ইতিহাস থাকবে না, ঈগল থেকে যাবে’- হৈচৈ পড়ে গিয়েছিল। বাম রাজনীতির একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি আমাকে প্রেসক্লাবে পেয়ে দু’হাতে জড়িয়ে ধরেছিলেন। শেষ পর্যন্ত ‘সোনালি কাবিন’-এর পর আল মাহমুদ বেচারাই এ রকম একটি কবিতা লিখল, তিনি আমাকে বললেন, কি সব ধর্ম-টর্ম করেন- ছাড়েন এইসব। ভালোবাসার জায়গা থেকে বলা। আমি ধর্ম করি বিশ্বাসের জায়গা থেকে। আমি কোনো ধর্মীয় রাজনীতি করি না। যে সব সভায় আমাকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় তার খবর পত্রিকায় পড়লে দেখবে বক্তৃতায় আমি আমার কথাই বলেছি। আমি কখনো ধর্মীয় রাজনীতির কথা বলি না। আজ পর্যন্ত আমি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নই। এসব কথা আমি খোলাখুলি সাক্ষাৎকারে বলেছি। কোনো বিশেষ দল আমার পৃষ্ঠপোষকও নয়। কেউ আমাকে আর্থিক সাহায্যও করে না। আমি দখিনা বাতাস খেয়ে বেঁচে আছি। তারা মনে করে কবিরা বাতাস খেয়ে বাঁচে।
শহীদুল রিপন: বর্তমানের এককেন্দ্রিক বিশ্বের প্রেক্ষাপটে কবিতার রাজনীতির রূপরেখা কেমন হবে? সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের বিপর্যয়ের পর ওয়ার্ল্ড অর্ডারের যে একমুখিনতা তা ১১ সেপ্টেম্বরের পরে আরো শার্প হয়েছে।
আল মাহমুদ: আমি আমার নিজের কবিতায় বিশ্বব্যাপী যে লড়াই চলছে তার একটা চিত্র দেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু আমি সবসময় এখানে থাকি না। আমি যেহেতু আধ্যাত্মবাদে বিশ্বাস করি, সুফিজমে বিশ্বাস করি, আমি সুফিতাত্ত্বিক মানুষ। ফলে আমি প্রেমের কবিতা, ইশকের কবিতা, ধ্যানের কবিতা, নারীর প্রতি প্রেমের কবিতাও লিখব। কবিতার চরিত্র ফলে পাল্টে যায়। তুমি বিশ্বাস করো আর না-ই করো বাংলাদেশে বর্তমানে আমিই কবিতার আঙ্গিকগত কিছু পরিবর্তনের সূচনা করেছি। কেনই-বা স্বীকার করবে, তুমি তো একজন মার্কসিস্ট। কিন্তু তুমি এটা লুকিয়েও রাখতে পারছ না। এজন্য তোমাকে জোর করে আমার কবিতা না ছেপে শামসুর রাহমানের কবিতা ছাপাতে হচ্ছে, সামনে রাখতে হচ্ছে। এটা তোমাদের এক ধরনের পরাজয়। তোমরা জানো যে আমার কবিতা ছাপা হলে শামসুর রাহমানের কবিতার সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনা হয়ে যায়। এটা তোমরা চাও না। তাই বলে কি আমি কবিতা লেখা বন্ধ করব? এখন আমার লড়াইটা কি- তোমরা চাও যে লোকটা তোমাদের পক্ষে কথা বলে তার কবিতা ছাপতে। কিন্তু তার কবিতা তো হচ্ছে না। দশ বছর আগে তিনি কবিতা থেকে সরে এসেছেন। কিন্তু তোমরা তাকে জিতাতে চাও, আমাকে হারিয়ে একধাপ নিচে রাখতে চাও। আমার নামটা একসময় উচ্চারিত হতো শামসুর রাহমানের পরে আরও ত্রিশজন কবির শেষে। কখনো হতো, কখনো হতোই না। আজকে তোমরাই বলো শামসুর রাহমান-আল মাহমুদ। আজকে দুইয়ে চলে এসেছি। কিন্তু আমার কবিত্বকে কি আটকানো যাবে? সব প্রগতিশীল শক্তি, অ্যাকাডেমিক শক্তি দিয়ে আমাকে ঠেকিয়ে রাখতে চাও কেন? আমি যদি বলিও পরাজয় মেনে নিলাম, তাহলেও কিন্তু আমি পরাজিত হচ্ছি না। মহাকাল আমাকে জিতিয়ে দেবেই।
তোমার প্রশ্নের উত্তরে আসি। সারাবিশ্বের কবিকূল বিবেচনায় রেখে বলা যায়, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বলার মতো বড় মাপের কবি বর্তমান দুনিয়ায় নেই। এটা একটা ভ্যাকুয়াম, কবিতার জন্য একটা দুর্ভাগ্য। ফিকশন লেখক আছেন, উপন্যাসিকও আছেন। বাংলাদেশে আমি আছি, প্যালেস্টাইনে আছেন মাহমুদ দারবিশ, লেবানন ও মিসরে কয়েকজন আছেন। খোদ ইরাকেও আছেন কিন্তু এক্সাইলড। আমি সাম্রাজ্যবাদী লুণ্ঠন, আরো এক শতাব্দীর জন্য গোটা বিশ্বকে গোলামে রূপান্তরিত করার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করছি। তুমি চাও বা না চাও এ সত্য স্বীকার করতে হবে যে এর বিরুদ্ধে ইসলাম লড়াই করছে। আমাদের দেশে প্রগতিশীল শক্তি লড়ছে, তাদের সমর্থনও দরকার। এখন যে দৈত্য জেগে উঠছে এই দৈত্যকে রুখতে হলে, নিশ্চিহ্ন করতে হলে কোনো ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, সম্প্রদায়, মতাদর্শ নির্বিশেষে এক লাইনে দাঁড়িয়ে লড়াই করতে হবে। সেক্ষেত্রে আমার লড়াইয়ের প্রধান হাতিয়ার কবিতা। তুমি যদি এই দানবকে হত্যা করতে আরো পারমাণবিক অস্ত্র আনো তবে পৃথিবী ধ্বংস হবে। লড়াই করতে হবে আদর্শিক ঘৃণা দিয়ে। মার্কসিস্টরা এটা করার চেষ্টা করছে। আমি তাদের সমর্থন করি। তারা তো করছে।
এই মুহূর্তে আমার ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ কবিতাটির কথা মনে পড়ছে। ওর মধ্যে ছিল ‘জেহাদ জেহাদ বলে ডেকে ওঠে’। আমি এখনও স্বপ্ন দেখি। এই বইটি কমিউনিস্ট পার্টির ‘পরিচয়’ পত্রিকার সম্পাদক পড়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন। আমার কবিতায় কিন্তু রাজনীতি সবসময় থাকে। অথবা ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’র কথা বলি। ওখানে কোরআন হাতে আমি ঘুমিয়ে পড়ে স্বপ্নে একটা মৃত নগরীর মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। আজকে সমাজে মানুষের জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই। স্বস্তি নেই। আইন ও বিচার ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, রাষ্ট্র ব্যর্থ হতে চলেছে। কবিতাটিতে আমি হাইকোর্ট গম্বুজ ধসে পড়ার কথা বলেছিলাম। আর এই কবিতাগুলো আমি দু’-তিন দশক আগে লিখেছি। কবিরা কিন্তু ভবিষ্যত দেখতে পান। আমিও দেখেছিলাম। বাংলা কবিতা কিন্তু এরকম ছিল না। আমিই লিখেছি। আমার মায়াবী পর্দা নিয়ে কিন্তু ফিল্ম বানানো যায়। ফরাসিরা এরকম ছবি বানিয়েছে।
শহীদুল রিপন: আপনি তো কাব্য চর্চার পাশাপাশি দু’হাতে গদ্য রচনাও করেছেন।
আল মাহমুদ: দ্যাখো, আমার গদ্য শক্তি প্রবল। আমি একেবারে প্রথম থেকেই গদ্য লিখছি। কিন্তু আমার কবিখ্যাতি বেশি হওয়াতে আমি প্রলুব্ধ হয়ে কবিতা রচনা করেছি বেশি। আমি যদি শুধু উপন্যাসই লিখতাম তাহলেও সফল হতাম। আমার গল্প নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকে একটি বই বেরিয়েছে। সেখানে আবুল বাশার লিখেছেন, আল মাহমুদের এই গল্পগুলোর কোনো বাংলা সহোদরা নেই। ‘দেশ’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছে।
সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের কারণ তার চর্চার মধ্যে মারাত্মক গলদ ছিল। সপ্রাণ ছিল না। নিপীড়ণমূলক ছিল- মধ্যবিত্ত ও সৃজনশীল বুদ্ধজীবীদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে। সমাজতন্ত্রের ধ্বংসের পেছনে পুঁজিবাদী ষড়যন্ত্রের অবদান খুব কম, যতটা না নিজেদের ব্যবস্থার সংকট অবদান রেখেছে। আমি মার্কস-লেলিন-মাও প্রচুর পড়েছি। জগৎ জীবন বিশ্লেষণের যে দৃষ্টিভঙ্গি আমার রয়েছে, সেই দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে এই পুস্তকগুলোর ভূমিকা অপরিসীম। আমি মানুষে-মানুষে সাম্যের পক্ষে।
শহীদুল ইসলাম: আপনার তিনটি গল্প সম্পর্কে আমার জানার আগ্রহ আছে। দুটি ছোটগল্প- পানকৌড়ির রক্ত ও জলবেশ্যা, তৃতীয়টি একটু দীর্ঘ, একে হয়তো উপন্যাসিকাও বলা চলে- পুরুষ সুন্দর। আপনি গল্পগুলোতে পুরুষের প্রবৃত্তির জান্তব বর্ণনা দিয়েছেন। পুরুষ সুন্দরে তিনজন লেসবিয়ান অবশেষে পুরুষের কাছে ফিরে যায়- যাকে আপনি মানব-মানবীর ন্যাচারাল সম্পর্ক বলে মনে করেছেন। আর পানকৌড়ির রক্তে দেখা যায় নতুন স্ত্রীর প্রতি কাম লিপ্সা জাগ্রত হচ্ছে, এর সঙ্গে মিল রেখে একটি পানকৌড়ি শিকার করা হচ্ছে যা আরেকটি প্রেক্ষাপট নির্মাণ করছে।
আল মাহমুদ: পানকৌড়ির রক্ত পাঠ করে হাশেম খান বলেছিল, এ ধরনের গল্প আর্টিস্ট ছাড়া লিখতে পারবেন না। আমারো পরে তাই মনে হয়েছিল। এটা এমন এক ধরনের ছবি তৈরি করে যা কেবল পেইন্টিংয়ের সঙ্গে তুলনা করা চলে। আমি খুব স্বাভাবিকভাবেই গল্পগুলো লিখেছি। আমার পর্যবেক্ষণের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে কবির দৃষ্টিভঙ্গি। আমি কবিতার দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই ছোটগল্প লেখার চেষ্টা করেছি, কিন্তু গদ্য যে ডিভাইসটা তৈরি করে কোনো আবেগ-টাবেগ নেই। আমার গল্প নিবিড়ভাবে পাঠ করলে দেখবে আমি গল্পে কবিতার কাজ করেছি, কিন্তু গদ্য কি কবিতা? আমি নিখাদ গল্পই লিখেছি। পানকৌড়ি, জলবেশ্যা তাই। পৃথিবী জুড়ে আমার আরেকটি গল্প আলোচিত হয়েছিল- কালো নৌকা। ফরাসি ভাষায় অনূদিত হয়েছিল এবং এশিয়া-ওশেনিয়া বলে একটা বই বেরিয়েছিল, সেখানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বইয়ে বাংলা সাহিত্যের একটামাত্র গল্প নেওয়া হয়েছিল। ভেবেছিলাম রবীন্দ্রনাথের কোনো গল্প নেওয়া হবে। কিন্তু ওরা আমার গল্পটি নিয়েছিল।
শহীদুল রিপন: আপনার গদ্যভাষা নির্মাণের পেছনে কি কি উপাদান-অনুষঙ্গ কাজ করেছে?
আল মাহমুদ: বাংলা গদ্য সম্পর্কে আমার পাঠ নেহাৎ কম নয়। যে ক’জন গদ্যশিল্পী শ্রেষ্ঠ গদ্য রচনা করেছেন, তাদের রচনা আমি গভীরভাবে মনোযোগসহ পাঠ করেছি। আমার গদ্যভাষা নির্মাণ করেছি সেভাবেই। আমার একটা স্বতন্ত্র গদ্যভাষার পরিচয় করানোর ইচ্ছা ছিল বাংলা সাহিত্যে। আমি ঠিক বুদ্ধদেব বসুর মতো লিখব না, হুমায়ূন কবিরের গদ্যও আমি লিখব না, জসীম উদ্দীনের একটা গদ্য আছে- ভারি মিষ্টি, সেটাও এড়িয়ে গেছি, গিয়ে আমি সব মিলিয়ে একটা গদ্য তৈরি করেছি। মাণিক বাবুর গদ্য, বিশেষ করে ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র গদ্যকেও আমি ফলো করিনি।
শহীদুল রিপন: আপনার উপন্যাস ‘উপমহাদেশ’ সম্পর্কে বলি, মুক্তিযুদ্ধ- অর্থাৎ ইতিহাসের অস্থির সময়ে দেশপ্রেম এবং ব্যক্তিমানুষের প্রেম- মোটা দাগে বিষয় হিসেবে নির্মিত হলেও উপমহাদেশ জুড়ে তৃতীয় একটি শক্তি যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে এবং তারা আছে সর্বত্র।
আল মাহমুদ: সোজা কথা তারা হলো সমাজতন্ত্রী। তারা আছে, কাজ করছে, সংগঠিত হচ্ছে সর্বত্রই। নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা নেই কিন্তু সবখানে আছে। আমি যে উপমহাদেশ লিখেছি, একটা কথা বলি, উপমহাদেশ কোনো কল্পিত ঘটনা নয়। ঔপন্যাসিকরা সাধারণত কল্পনা করেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকালীন আমি যা দেখেছি, উপন্যাসের মতো করে সাজিয়েছি। আমাদের সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কেউই ভালো কোনো উপন্যাস লিখতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধের আগে বাংলাদেশে যে পরিস্থিতি ছিল তা আমি লিখেছি ‘কাবিলের বোন’-এ। আমি ট্রিলজি করতে পারিনি। কিন্তু এই দুটি বই ছিল মুক্তিযুদ্ধের ওপর।
যে শক্তি উপমহাদেশ জুড়ে ছিল তার আর স্বাভাবিক বিকাশ হলো না। কিন্তু আমি ছিলাম সহানুভূতিশীল। আমি ধার্মিক মানুষ, আমি সুফি মানুষ। আল্লায় বিশ্বাস করি। কেউ কেউ করে না। তাতে আমার কিছু যায় আসে না। পৃথিবীতে সবসময় তাদের মতো এবং আমার মতো মানুষ ছিল।
শহীদুল রিপন: আপনি যৌবনের প্রথমভাগে সাম্যবাদে আস্থাশীল ছিলেন। এখন কি সেই বিশ্বাস একেবারে বিসর্জন দিয়েছেন? অনেকে তো বলেন, হাতের পাঁচ আঙুল সমান হয় না। আপনি কি বলেন?
আল মাহমুদ: আমি সাম্যবাদে বিশ্বাসী। যারা বলে পাঁচ আঙুল সমান হয় না, তারা ধর্মের যে সাম্য, ইসলামে যে সাম্যের কথা বলে সেটা বুঝতে পারেনি। মোহাম্মদ (সঃ) একজন নিরক্ষর লোক ছিলেন, এতিম ছেলে মক্কার। ৪০ বছর বয়সে তিনি নবী হন। তার কাছে ধনী-নির্ধন, উঁচু-নিচু, সাদা-কালোর কোনো ভেদাভেদ ছিল না। ইসলাম শান্তি এবং মানবতার ধর্ম। সাম্যের ধর্ম। ইসলামে মানুষের, তার সৃষ্টিশীলতা ও সম্ভাবনার জয়গানই গাওয়া হয়েছে।
এখন এর বাইরে থেকে যারা সাম্যের কথা বলছেন, যারা মার্কসিস্ট, তাদের প্রতি আমি সহানুভূতিশীল। বিশ্বজুড়ে তাদের যে আত্মদান তাকে আমি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। মার্কস-লেনিনের তো দোষ নেই। তারা মানুষের কথা, সাম্যের কথা বলেছেন। লন্ডনে যে ঘরে বসে মার্কস ‘ডাস ক্যাপিটাল’ লিখেছেন, সেখানে বেড়াতে গিয়ে আমি শিহরিত ও রোমাঞ্চিত হয়েছি। সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের কারণ তার চর্চার মধ্যে মারাত্মক গলদ ছিল। সপ্রাণ ছিল না। নিপীড়ণমূলক ছিল- মধ্যবিত্ত ও সৃজনশীল বুদ্ধজীবীদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে। সমাজতন্ত্রের ধ্বংসের পেছনে পুঁজিবাদী ষড়যন্ত্রের অবদান খুব কম, যতটা না নিজেদের ব্যবস্থার সংকট অবদান রেখেছে। আমি মার্কস-লেলিন-মাও প্রচুর পড়েছি। জগৎ জীবন বিশ্লেষণের যে দৃষ্টিভঙ্গি আমার রয়েছে, সেই দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে এই পুস্তকগুলোর ভূমিকা অপরিসীম। আমি মানুষে-মানুষে সাম্যের পক্ষে। পৃথিবীর তাবৎ মহা মনীষীরাও সাম্যের জয়গানই গেয়েছেন।
শহীদুল রিপন: শওকত আলী, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস- আমাদের অগ্রগণ্য তিন কথাসাহিত্যিক। তারা কিন্তু শিল্পীর সামাজিক দায়বদ্ধতাকে কখনো অস্বীকার করেননি। তাদের রচনায় শ্রেণিসংগ্রাম, বুর্জোয়া ব্যবস্থার ক্ষত, মধ্যবিত্তের সুবিধাবাদিতা ও নিষ্ফল আস্ফালন ইত্যাদি ভালোভাবে এসেছে। তারা কিন্তু পরবর্তী সময়ের কথাকারদের প্রভাবিত করতে পেরেছেন। আপনি কিন্তু সাহিত্য রচনায় এই সচেতন প্রয়াস বিষয়ে উদাসীন।
আল মাহমুদ: আমার লেখা আর তাদের লেখা পরীক্ষা করে দেখো- তারা সবসময় যে কাজটা করতে চেয়েছেন, তা কিন্তু আমিও করেছি। কিন্তু আমি তাদের ডাইমেনশনে করিনি। তারা একটি আদর্শের প্রতি কমিটেড হয়ে করেছেন। আমার কাছে হাসান আজিজুল হকের গদ্যভাষা গ্রহণীয় নয়। আত্মজা ও একটি করবী গাছ, পাতালে হাসপাতালে পড়ে আমার প্রশ্ন জেগেছে তিনি তার গদ্যে এতো ডেথকে দেখেন কেন? জনগণের ভাষা, জনগণের জন্য লেখা, শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থে লেখায় এই গদ্য? এটা নকল গদ্য। হাসান আমার বন্ধু। আমাকে সে বই উৎসর্গও করেছে। হাসানের লক্ষ্য হলো ডেথ। একজন মার্কসবাদী লেখক সব সময় আশার সঞ্চার করবেন। কিন্তু তার সবকিছুর পরিণতি হচ্ছে মৃত্যু। একে অ্যানার্কিস্টও বলা যাবে না। অ্যানার্কিস্ট হওয়া অনেক বড় ব্যাপার।
ইলিয়াসও আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ইলিয়াসের কাজ অনেকটা পারফেক্ট। কতটুকু পর্যন্ত পারফেক্ট? ‘দোজখের ওম’ পর্যন্ত। আমি তার ‘চিলেকোঠার সেপাই’কে অনেক মহৎ উপন্যাস মনে করি। কিন্তু তার শ্রেষ্ঠ কাজ হলো ‘খোঁয়াড়ি’। এইরকম বই কেউ লিখতে পারেননি একালে। তারও একটা নিজস্ব গদ্যভাষা আছে, আমাদের বাংলা গদ্যভাষা যেভাবে বিকাশ লাভ করেছে, একজন ছোট গল্পকার, একজন অত্যন্ত ধীমান ও অর্ন্তদৃষ্টিসম্পন্ন মার্কসবাদী গল্পকার হিসেবে তার যে ভাষা সেটা নিছক বানানো হবে কেন- তা নিয়ে আমার মৃদু সমালোচনা আছে। অভিযোগ আছে। কিন্তু ইলিয়াসের কাজকে আমি অত্যন্ত শ্রদ্ধা ভরে সালাম জানাই।
আর শওকত আলী বেশি কল্পনাপ্রবণ। ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’-এর মতো রূপকথা শুনিয়ে আমাদের কোনো লাভ নেই। আমাদের দৈনন্দিন লড়াইয়ের কোনো কাহিনী লিখতে তারা ভয় পান কেন? কারণ এই লড়াইয়ে তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেননি। এখনকার তরুণরা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যে লড়াই করছেন, সমাজতন্ত্রীরা যে লড়াই চালাচ্ছেন তার সঙ্গে এদের কোনো সংযোগ নেই। যার জন্য ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ লেখেন। বলছি অসাধারণ সুন্দর বই কিন্তু তরুণরা এদের চেনে না। এই বইয়ের চরিত্রগুলোকে তরুণদের ইতিহাসের ধারায় কষ্ট করে খুঁজে বের করতে হয়।
শহীদুল রিপন: তাহলে প্রগতিশীল সাহিত্যের ধারাকে আপনি গুরুত্ব দিতে চাচ্ছেন না?
আল মাহমুদ: সোভিয়েত রাশিয়ার উত্থান থেকে পতন পর্যন্ত সত্তর বছরে যে সাহিত্য হয়েছে, সারা পৃথিবীতে মার্কসবাদী লিটারেচার, হাওয়ার্ড ফাস্টের একটা বই রয়েছে- ‘গ্লাডিয়েটর’- এই জিনিস তো নেই। আমাদের দেশে যে সাহিত্য হয়েছে, ‘কালের খেয়া’য় প্রকাশিত প্রবন্ধেও আমি বলেছি, গোপাল হালদার থেকে শুরু করে নরহরি কবিরাজ পর্যন্ত আলোচনা করেছেন সেই সাহিত্যের- যে সাহিত্য আমরা হাতের কাছে পাই- সেই সাহিত্যকে অ্যাকাডেমিকভাবে বিচার করলে প্রগতিশীল সাহিত্য বলে কি বিবেচিত হবে?
শহীদুল রিপন: আজকের তরুণ, যারা কথা ও কাব্য সাহিত্যে নিয়োজিত আছে তাদের কৃতকর্ম অগ্রজ হিসাবে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
আল মাহমুদ: তরুণদের সম্পর্কে আমি শ্রদ্ধাপূর্ণ উচ্চ ধারণা পোষণ করি। বিশেষ করে নব্বই দশকে অদ্ভুত কিছু কবি রয়েছে যাদের নাম আমি ঠিকভাবে চিনতে পারি না। সৃজনশীল এই তরুণদের নিয়ে আমার বিস্ময় রয়েছে। এদের চরিত্র আলাদা, উপমা-উৎপ্রেক্ষা আলাদা, বিষয় নির্বাচন পরীক্ষামূলক, ভাষাভঙ্গিও নতুন ও অভিনব। আমার তো মনে হয় আমাদের সরিয়ে দেবার জন্য এরা প্রস্তুত। তবে এরা ভবিষ্যতে কিভাবে কি কাজ করবে এ বিষয়ে এখনই শেষ কথা বলা যাচ্ছে না। আমি তো ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা জ্যোতিষি নই। আমি কানা চোখেও এদের লেখা পড়তে চাই। এরাই আমাদের সাহিত্যের মোড় ফেরাবে।
শহীদুল রিপন: শেষ প্রশ্ন- সত্তর বছর বয়সে এসে মৃত্যুচিন্তা কিভাবে আপনার ভেতর কাজ করে?
আল মাহমুদ: মৃত্যুচিন্তা আমার ভেতর এখন মাঝেমাঝে প্রবল হয়ে ওঠে। আমি জোর করে এটা সরিয়ে রেখে জীবনের অফুরন্ত সম্ভাবনার কথা ভাবি। জীব হিসেবে যখন জন্মেছি, তখন একদিন মৃত্যু হবেই। এই বাস্তবতাকে মেনে নেওয়ার জন্য আমি বোঝাপড়া চালিয়ে যাচ্ছি। কষ্ট লাগে এই ভেবে যে, এই যে আমি আল মাহমুদ কথা বলছি, কবিতা লিখছি, আমার ধ্যান-সাধনা-অর্জন-খ্যাতি সব মিলিয়ে যে অস্তিত্ব, আমার যে আত্মা, তার মৃত্যু হলে কেউ আর আমাকে আল মাহমুদ বলবে না, বলবে আল মাহমুদের লাশ। আজ সংসারে, পরিপার্শ্বে যারা আমাকে ঘিরে রয়েছে, আমার স্বজন সবাই ব্যতিব্যস্ত হয়ে হয়ে উঠবে আমাকে বিদায় করার জন্য। মাটিচাপা দেওয়ার জন্য।
৭ জুলাই, ২০০৫