‘আত্মানং বিদ্ধি’ থেকে নির্বাচিত অংশ ।। তন্ময় ভট্টাচার্য

…কারোর বাড়িতে যেতে গেলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আলপথ ভরসা। চাষের জমির মধ্যে দিয়ে, কখনও বা পুকুরের ধার ঘেঁষে এগোতে হচ্ছে আমাদের। অচেনা উঠোন, তোমার ওপর দিয়েও যাচ্ছি আমরা। হাঁস-মুরগি খুঁটে খাচ্ছে দানা, মাথায় ঘোমটা টেনে কাপড় মেলছে গৃহবধূ, জানলা গলে অবাক তাকিয়ে আছে ছেলেমেয়েরা – এ-সবই আমাদের চলার সঙ্গী। মতিচাচা আমাদের দফাদারবাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন। গ্রামে এখনও যে দু-চারঘর হিন্দু আছেন, দফাদাররা তাঁদের মধ্যে একজন। আমাদের পৌঁছে দিয়েই মতিচাচা চলে যাবেন ক্ষেতে। ধান বুনে এসেছেন, দেখভাল করতে হবে যে! সুঠাম শরীর – খালি গা, পরনে একটা লুঙ্গি আর কাঁধে গামছা, পায়ে জুতোর বালাই নেই – মতিচাচার এ-চেহারার পাশে আমাদের শহুরে পোশাক বড় বেমানান। যেন সত্যিই বাইরের লোক; গ্রামের মানুষ হলে কি আর এত আড়ষ্টতা থাকত চলনে!

হবে হবে… আস্তে আস্তে সবই সহজ হবে। এই তো, আমাদের দফাদারবাড়ির উঠোনে পৌঁছে দিলেন মতিচাচা, আলাপ করিয়ে দিলেন ও-বাড়ির ছেলের সঙ্গে। এবার যেতে হবে তাঁকে। ‘আবার আসবেন তো?’ – কাতর বেজে উঠেছি আমরা। মতিচাচা হাসলেন। ডানদিকের আল বেয়ে তাঁর চলে যাওয়া দেখতে দেখতে অন্য এক ছেড়ে যাওয়া মনে পড়ল আমার।

থাক সে-কথা। দফাদারবাড়ির সবার চোখেই জিজ্ঞাসা, আমরা কারা। পরিচয় দিলাম। চেয়ার এনে তড়িঘড়ি বসতে দিলেন তাঁরা। রোদের অজুহাতে এগিয়ে দিলেন জল। দফাদাররা এখন ‘সরকার’ পদবি ব্যবহার করেন। আমাদের খোঁজ, কোনও বৃদ্ধ ব্যক্তি আছেন কিনা বাড়িতে। ডাক গেল ভেতরে। অশীতিপর একজন, শীর্ণ চেহারা, বেরিয়ে এলেন। দীপকচন্দ্র সরকার। প্রণাম করলাম তাঁকে। বয়সের কারণে স্মৃতি অনেকটাই খুইয়ে বসেছেন দীপকবাবু। কথাও জড়ানো খানিক। …কথায়-কথায় জানতে পারলাম, আশেপাশের সব হিন্দুরা গ্রাম ছেড়ে চলে গেলেও, যাননি তাঁরা। এমনকি, ’৭১-এ রাজাকাররা দফাদারবাড়ির একজনকে মেরে ফেলার পরেও নয়। কেন? হাসলেন দীপকবাবু। মুখের সমস্ত কুঞ্চন চোখের পাশে জড়ো হয়ে অনন্তের রূপ নিল যেন বা। অস্ফুটে উত্তর দিলেন তিনি – ‘ভিটার মায়া…!’


আত্মানং বিদ্ধি / তন্ময় ভট্টাচার্য
প্রকাশক – ধানসিড়ি
প্রচ্ছদ – রাজীব দত্ত

শেয়ার