বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ আর অরুন্ধতি রায়ের ‘পরমানন্দ মন্ত্রণালয়’ (The Ministry of Utmost Happiness); কোথায় যেন একটা মিল আছে!
অরুন্ধতি রায়ের ‘ পরমানন্দ মন্ত্রণালয়’ (The Ministry of Utmost Happiness) দু’দিন হলো পড়ে শেষ করালাম। প্রথমেই যে কথা মনে হচ্ছে তা হলো ‘আনন্দমঠ’ ১৮৮২, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপধ্যায় ও বন্দে মাতরম্। বহুজাতীয়তাবাদী ভারত রাষ্ট্রকে দুর্গার প্রতিরূপ হিসাবে দেখার যে দেশাত্মবোধক চিন্তা তাতে রবীন্দ্রনাথেরও সায় ছিলো। ১৮৯৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে এই গান নিজে গান। ইতিহাস বলে, মুসলিম সংগঠনগুলো জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে পৌত্তলিকতার দায়ে এই গানের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করে। বিষবৃক্ষের বীজ দেখতে কেমন? বহুজাতি মিশ্রিত নৃতত্ত্ব নির্ভর ভারতের ইতিহাস ঐতিহ্যকে অগ্রাহ্য করে মিথলজি নির্ভর রাষ্ট্রচিন্তার ফল কেমন হতে পারে তা ভারত ঠিকই মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছে এখন। কাকে বলে ইতিহাস আর কাকে বলে পুরাণ তা রাষ্ট্রতাত্ত্বিকদের জানা দরকার। না হলে মাটির বুকে কান পেতে শুধু রক্তপাতের শব্দ শোনা যাবে। ইতিহাস নির্ভর ও বহুজাতি মিশ্রিত ভারতের স্বপ্ন দেখতে অরুন্ধতির জন্য ভারতকে ১৩৫ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। আনন্দমঠীয় বঙ্কিম-রাবীন্দ্রিক রাষ্ট্রচিন্তার বিপরীতে অরুন্ধতির ‘পরামানন্দ’ গড়ে উঠতে ১৩৫ বছর বড় বেশি সময়। বহু রক্ত ঝরে গেছে এর মধ্যে। বহু বহু প্রাণের ক্ষয় হয়ে গেছে। উপত্যকা ভরা লাশের মিছিলে The Ministry of Utmost Happiness হলো সুউচ্চ স্মৃতিসৌধ। ১৮৯৬ এ ভারত যেভাবে বিসমিল্লায় গলদ দিয়ে শুরু করেছিলো ঠিক সেইভাবে ২০১৭ সালে The Ministry of Utmost Happiness এরপর নতুন করে শুরু করতে পারে।
বিষয়টা শুধু ভারতের না। ভারত হলো এই উপন্যাসের একটা দেশ যা সকল দেশের প্রতিনিধিত্ব করে। পৃথিবীর যেখানেই ইতিহাসের ভুল ব্যাখ্যার উপর রাষ্ট্র পরিচালিত হয়েছে সেখানেই আপনি দেখতে পাবেন ডিভাইড এন্ড রুলিং-এর মত গণঅত্যাচার, হত্যা, ধর্ষণ। চীনের উইঘুর বা তিব্বত, পাকিস্তানের বেলুচ, ভারতের কাশ্মির, মিয়ানমারের আরাকান, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, শ্রীলঙ্কার উকুনের মত মানুষ হত্যার ইতিহাস— এ সমস্ত অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। এই অঞ্চলে জাতিগত ঘৃণার ফলাফল কত ভয়াবহ তার উদাহরণ ১৯৭১, পূর্ব পাকিস্তান বনাম পশ্চিম পাকিস্তান। ইতিহাসের এই শিক্ষার পরও কোন আশায় রাষ্ট্র সকল হত্যার পর হত্যা করে যাচ্ছে আমাদের?
গ্যেটের ফাউস্ট হলো সেই বই, যা মানবসভ্যতা বিলীন হয়ে গেলে একদল এলিয়েন যদি এসে বুঝতে চায় মানুষ কী? তবে তারা এই পুস্তক থেকে মানব চরিত্র ডিকোড করতে পারবে। আর অরুন্ধতির The Ministry of Utmost Happiness পড়ে যে কেউ ডিকোড করতে পারবে ভারত নামক রাষ্ট্রটি কী। ফাউস্ট পড়ে মানব সভ্যতা বিলীন হবার কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু ‘পরমানন্দ মন্ত্রাণলায়’ পড়ে জানা যাবে কেন ভারত বিলীন হয়ে যেতে পারে, কাঁচের বাসনের মত ঝনঝন গুলির শব্দে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরতে পারে এদিক-সেদিক। শুধু ভারত না যেকোন রাষ্ট্র বোঝার জন্য এই বই সংরক্ষণ করা যেতে পারে যাতে পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের রাষ্ট্রচিন্তকদের হা-মুখের মধ্যে কতগুলো হাঙ্গরের দাঁত আছে তা গুনে ফেলতে পারে।
এই উপন্যাস দক্ষিণ এশিয়ার যে কোন দেশের লেখক/ লেখিকা লিখলে তা ব্যান হতো। ধরুন, এই বইয়ের লেখক কোন চাইনিজ বা বাংলাদেশি বা পাকিস্তানি বা সিঙ্গাপুরী। ভাবা যায় কীই না হতে পারতো রাষ্ট্রের তরফ থেকে তার বিরুদ্ধে! ভাবা যায় দিল্লীর মসনদে ভারমিলিয়ন রেড পাগড়ি পড়া লাল্লা ও তার খোলা তারোয়াল, যোগাসন। তিনি ও তাঁর অনুসারীরা যখন ভাবছেন মোঘল আমলের পর এই প্রথম ভারত স্বাধীন হলো। স্বরাজ কায়েম হলো। ভারত মানেই হিন্দুত্ববাদ। সেই সময়ে এই বই প্রকাশিত হলো। ভাবা যায়! কতটা উদারচেতা এই ভারত। ভারতের লোহার বাসর ঘরের ফুটো হলো এই উদারতা। উদারতার হাত ধরেই বিজেপি দিল্লীর অধিপতি আজ। মানব রক্ষার থেকে গরু রক্ষার গুরুত্ব বোঝার মত উদারতা কয়টা রাষ্ট্র প্রধানের থাকে বলুন! উদারতাই ভারত গণতন্ত্রের বেহুলার বাসর। এই উদারতার নাম করেই কাশ্মির আজও জ্বলতেই আছে। এই উদারতার নাম ধরেই কর্পোরেটের হাতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে একরের পর একর জমি। এই উদারতার নাম করেই মানুষকে মানুষের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই উদারতার নাম করেই আমি হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম/ দলিত নিধনের কিছু অধিকার রাখি। এই উদারতার নাম করেই ভারত হজম করে The Ministry of Utmost Happiness. কিছুতেই তেমন সমস্যা হয় না। এই উদারতার নাম করেই রাষ্ট্র যা ছিলো এবং যা আছে, ঠিক সেই ভাবেই চালানো যায় বছরের পর বছর। এমনভাবে ভারতের রাজনীতির সংকট ও তার উত্তরণ নিয়ে অরুন্ধতি রায়ের মত ১৩৫ বছরে আর কেউ লেখেনি উপন্যাসে। ‘আনন্দমঠ’, রবীন্দ্রনাথ আর গান্ধির ব্যাপক প্রভাব আছে ভারতীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থায়। আনন্দমঠের পর এটিই দ্বিতীয় ভারতীয় জীবন্ত রাজনৈতিক উপন্যাস যা ভারতের সংবিধান থেকে শুরু করে রাষ্ট্রকাঠামোকে পরিবর্তনের অনেক অনেক সূচক দিতে পারে। এমন উপন্যাস পৃথিবীতে কয়টা? শুধু ভারত না, উদার গণতান্ত্রিক যেকোন দেশের স্বরূপ, সমস্যা ও সমাধান এই বই। ভারতের আয়নায় সবাই সবার গণতন্ত্রের মুখটা দেখে নিতে পারে।
দেশি-বিদেশি মিলিয়ে তো অল্প কিছু পড়লাম এই স্বল্প পড়ুয়া জীবনে। এমন উপন্যাস কি আমি আগে পড়েছি? উত্তর- না। এইটা উপন্যাসের কোন ফর্ম? খুব ট্রাডিশনাল ফর্ম। তেমন নতুন বা আলাদা কিছু না। কতটা শিল্পসম্মত? এই সমস্ত ম্যাড়মেড়ে ফিলিং নিয়ে এই উপন্যাসের কাছে গেলে এটা পড়া হযে উঠবে না। জ্যান্ত মানুষের ব্যথাতুর মন নিয়ে এই বইয়ের পাশে দাঁড়াতে হবে। এই বইয়ে লিখিত অধিকাংশ কাহিনীই আপনি জানেন পত্র-পত্রিকা মারফত। নতুন কোন খবর এগুলো না। খবর তো খবরই। সেই খবরের মানবিক উপলব্ধি ও ঘটনা থেকে জন্মানো সমস্যার ও তার সমাধান আর তারপর আনন্দযাত্রার পথের দিশা আছে এই বইয়ে। খবরকে খবরের অধিক কিছু করে তোলার বিরাট এক চ্যালেঞ্জ এই বই।
এই বই পড়ার পর আর একটা উপলব্দি আমার আছে। এইটাকে বলা যায় কম্পিটিটিভ স্টাডি অন বেঙ্গলি নভেল বেজড অন অরুন্ধতি রায়। আমাদের দেশের বোদ্ধারা উপন্যাস বলতে ভালো গল্প বলাকেই বুঝে থাকেন। গল্পটাই কথা। শেষ পর্যন্ত পাঠক গল্পটাই পড়তে চায়। আমাদের সবচেয়ে বড় গল্প বলা লোকটি হুমায়ূন আহমেদ। বাংলাদেশি সাহিত্যে তার মতো সরস গল্প আর কেউ বলেন নাই। কিন্তু গল্পে যে জনপদের রাজনীতিটা, ইতিহাসটা থাকা চাই তা তার গল্প-উপন্যাসে নাই। বিরাট লোক-আকর্ষী গল্প থাকার পরও হুমায়ূন রাজনীতিশূন্য। সেই কারণে বহুকিছু হয়েও তিনি কিছুই হয়ে ওঠেন নি, তিনি একটা বড় শূন্য। যে লেখককে ঘিরে প্রজন্ম বেড়ে ওঠে তিনি অবশ্যই লেখক হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেই রাজনীতিহীন হুমায়ূন প্রজন্মের জন্য অদরকারী। যারা আশাবাদী হুমায়ূনী গল্প-উপন্যাস নিয়ে, তাদের আশা ভেস্তে যাবে অচিরে। কেন হুমায়ূনকে এখানে স্যাম্পল হিসাবে নিলাম। কেননা প্রজন্মকে গাইড করার মতো সক্ষমতা কার ছিলো বাংলাভাষী সাহিত্যে তার সময়ে? শুধু শিল্পই সমাজে লাগে না। যারা প্রজন্মকে নির্দেশনা দেয় এমন লেখক আমাদের সমাজে চাই। কিন্তু হুমায়ূন এক বিরাট, বিপুল অপচয়। পাঠকনন্দিত ঔপন্যাসিকরা যেকোন রাষ্ট্রের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। যে লেখক পাঠকের বেডরুমে প্রবেশ করতে পারে না, সে বড়জোর ভালো লিখিয়ে, মহান লেখক না। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তো বেডরুমের লেখক না। তার রাজনীতি সচেতনতা খন্ডিত, শ্রেণিশত্রুময়, একশ্রেণির প্রতি প্রবল দোলায়িত। মানুষ মানুষ কে যেকোন শর্তে ঘৃণা করবে সেটা ভাবতেই আমার মন খারাপ হয়ে যায়। পন্থাবাদি লেথকরা সমাজকে বঙ্কিমের মতো শত বছর পিছিয়ে দেয়। পন্থাহীন নির্লিপ্তভাবে সময়কে কীভাবে গাইড করতে হয় তা অরুন্ধতির কাছ থেকে আমাদের ভাবী লেখকরা শিখতে পারেন। তাই এই বই উপন্যাস লেখকদের জন্য অবশ্য পাঠ্য।
আর একটা শেষ কথা, এই বইয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র মুসা। যে আফতাব সেই আঞ্জুম হলো বইটিকে প্রবেশের পথ, একটা উপলক্ষ্য। মুসা হলো গন্তব্য। এই বিষয়টা পাঠক লক্ষ্য করে দেখবেন। মুসাই আপনাকে Utmost Happiness এর দিশা দেবে। যে আফতাব সেই আঞ্জুম এই Utmost Happiness চিরস্থায়ী কিউরেটর। বিশ্ব সাহিত্যে The Ministry of Utmost Happiness একটা ঘটনা বটে। আপনার পড়া দরকার।