কনফুসিয়াস ফ্রম দ্য হার্ট । ইউ ড্যান ।। বাংলায়ন : নাঈম ফিরোজ ।। তৃতীয় অধ্যায়, তৃতীয় পর্ব

                    যাত্রা: পৃথিবীর পথে পথে

 

পৃথিবীতে কেউই অনুশোচনার দাওয়াই বিক্রি করে না। যখনই কোন মানুষজন জানতে পারে যে তারা কিছু একটা ভুল করেই ফেলেছে, সেইমাত্র তা হয়ে যায় fait accompli বা অমোঘ এবং স্বাভাবিকভাবেই সেসব শোধরাবার কোনো পথ বাকি থাকে না। যদি মানুষ দোষারোপ করা থেকে বিরত থাকে এবং যদি সে মুখ খুললেই কোনো না কোনো অভিযোগ জানানো থেকে নিরস্ত থাকে আর অনুতাপবিদ্ধ হতে হয় এমন অভিজ্ঞতাকে এড়িয়ে চলে তবে তারা আবশ্যিকভাবেই নিজের কর্তব্যে সফলতার দিন দেখে।

 

ইন্টারনেটে আমি একটা গল্প পেয়েছিলাম 

একদা একটা মাথা-খারাপ বালক ছিলো। যে ভয়াবহ একগুঁয়ে আর রাগের স্ফুলিঙ্গ ছিলো যেন, যাকে পেতো তাকেই লাথি-মুষ্টি হাঁকাতো সে। একদিন তার বাবা তার হাত ধরে তাদের বাড়ির বাগানের প্রান্তীয় প্রাচীরের কাছে নিয়ে যান আর বলেনঃ ‘পুত্র, এখন থেকে যখনই এই বাড়িতে বসে তুমি মেজাজ হারাবে, এই প্রাচীরে একটি পেরেক গেঁথে দেবে। যাতে একটা সময় তুমি বুঝতে পারো তুমি কতবার মেজাজ খারাপ করেছিলে, ঠিক আছে তো?’ বালক ভাবলো এতে আর ঘাবড়াবার কিইবা আছে? আমি তাই করবো না হয়। এরপর থেকে যখনি তার রাগের বাঁধ ভেঙে যেতো, সে প্রাচীরে একটি পেরেক গেঁথে আসতো। আর তারপর যেদিনই সে তা দেখতে আসতো সে একটু বিব্রতই বোধ করতোঃ ‘ওহহো! এতগুলো পেরেক! বড্ড বেশিই তো ওগুলো!’

 

তার বাবা বলতেনঃ ’তুমি কি খেয়াল করেছো? তোমাকে তোমার রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আর হ্যাঁ, যদি তুমি গোটা একটা দিন তোমার ধৈর্যচ্যুতি না ঘটিয়ে থাকতে পারো তবে প্রাচীরে গ্রথিত পেরেকের একটি তুমি তুলে ফেলতে পারবে।‘ বালক ভাবলো, যদি দিনে একবার মাত্রও আমি আমার মেজাজ হারাই তবে আমাকে একটা পেরেক গেঁথে আসতে হবে প্রাচীরে আর তা তুলতে হলে আমাকে পরে একটা সমগ্র দিন রাগ না করে থাকতে হবে- সেটা সত্যিই কঠিন ব্যাপার হবে। এবং এই পেরেকের গাঁথা ও পুনরায় তোলা থেকে উদ্ধার পেতে তাকে ক্রমাগত তার ধৈর্য অটুট ধরে রাখতে হবে।

 

প্রথমে তার কাছে এটা খুব কঠিন লাগলেও ধীরে ধীরে সে তার রাগ নিয়ন্ত্রণ করে একটা একটা করে পেরেক উত্তোলন করতে সক্ষম হয়। আর কালক্রমে সে উপলব্ধি করে, সে তার ক্রোধ ও মেজাজকে নিয়ন্ত্রণে নেয়া শিখে গেছে। সে সেদিন দৌড়ে তার বাবার কাছে গিয়ে খোশমেজাজে বলে- ‘বাবা, তারাতাড়ি এসো, দেখোই না, প্রাচীরে আর একটাও পেরেক গাঁথা নেই, আর আমি এখন আর মেজাজ হারাইও না।‘

 

বাবা ছেলের সাথে হেঁটে যান সেই প্রাচীর সমীপে, আর তার পাশে দাঁড়িয়ে ছেলেকে গুরুত্ববহভাবে কিছু কথা বলেন- ‘দেখো, পুত্র, প্রাচীরের সব ক’টা পেরেক তো তোলা গেছে, কিন্তু এইসব পেরেক যে গর্তগুলি তৈরি করেছে তা কিন্তু চিরদিনই থেকে যাবে। যতবার তুমি তোমার পরিবারের সদস্যদের সাথে তোমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটাও, তাদের অন্তরে কিন্তু এইরূপ ছিদ্র তৈরি হয়ে যায়। পেরেক তুলে আনলে তুমি ক্ষমা চাইতেও পারো, কিন্তু তুমি কখনোই ছিদ্র সারিয়ে দিতে সক্ষম হবে না।‘

 

 

এই গল্পটির মর্ম নিহিত আছে কনফুসিয়াসের এই বাণীতে 

‘তুমি যদি তোমার কথা-বার্তায় কম ভুল করো তবে তোমার কাজে তোমাকে কম পরিতাপ করতে হবে’।

 

যখন কথা বলি আমাদের সচেতন চিন্তা করা উচিৎ। আর আমাদের কাজে আমাদের অবশ্যি এর ফলাফল নিয়ে ভাবনা থাকা উচিৎ। এটা আমাদের যাবতীয় মিথোস্ক্রিয়ার ক্ষেত্রেই স্মরণে ঠাঁই পাওয়ার মতো সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

 

আমাদের জটিল ও বিচিত্র আধুনিক সমাজে বিভিন্ন ধরনের আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কে খাপ খাইয়ে নিতে হলে যেকোন বিষয়ের চাইতে বেশি জরুরি শিষ্টাচার কী তা শেখা।

তো এই শিষ্টাচারকে কীভাবে বুঝতে চেয়েছিলেন খোদ কনফুসিয়াস —

কোনো কাজ করার পূর্বে আমাদের ক্ষণিকের জন্য থেমে তার ফলাফল সম্পর্কে ভেবে নেয়া উচিত। ঠিক যেভাবে প্রাচীরে কোনো পেরেককে হাতুরি দিয়ে গেঁথে দেয়া হয়। যদিও তা পরে টেনে বের করে নেয়া যায়, প্রাচীর কভু আর তার পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে পারে না। যখন আমরা কোনো কাজ করবো, আমরা তার দূরবর্তী ফলাফল প্রত্যক্ষ করার চেষ্টা করবো, এবং দ্বিগুণ সজাগ থাকবো। এই প্রকারে আমরা অন্যের মনকে আহত করা থেকে বিরত থাকতে পারি, আর বিরত থাকতে পারি ভবিতব্যে পরিতাপ করা থেকেও।

 

কনফুসিয়াস তার জীবনে শিষ্টাচারের অনেক আনুষ্ঠানিক উদাহরণ সন্নিবেশ করেছেন। তিনি শিষ্টাচারকে সম্মান দেখাতেন, এবং সঠিক লোকাচার পালন করতেন, কিন্তু তা কখনোই লোক দেখানোর উদ্দেশে না, পরন্তু তা শুধু আত্ম পরিচর্যার মানসে। পদস্থ কর্মচারী, শোকসভার পোষাকে লোকজন ও অন্ধজন পাশ দিয়ে গেলেই তিনি দাঁড়িয়ে সম্মান দেখাতেন যদি সে ব্যক্তি তার চেয়ে বয়সে ছোট হয়েও থাকতেন কিংবা সামাজিক মর্যাদায় নিচেও অবস্থান করতেন। আর যদি তাঁকে এইসব লোকেদের সামনে দিয়ে যেতে হতো তবে তিনি ধীর পায়ে, সন্তর্পণে, ছোট ছোট কদমে সম্মান দেখিয়ে সম্ভবপর দ্রুত সময়ে পার হয়ে যেতেন।

 

এটাই শিষ্টাচার।

 

কনফুসিয়াস অন্যান্য পরিস্থিতিতেও এভাবেই শিষ্টাচার বজায় রেখেই চলতেন।

শেয়ার করুন

One thought on “কনফুসিয়াস ফ্রম দ্য হার্ট । ইউ ড্যান ।। বাংলায়ন : নাঈম ফিরোজ ।। তৃতীয় অধ্যায়, তৃতীয় পর্ব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading