ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক হো চি মিন, এই নামের সঙ্গে সারা বিশ্ব পরিচিত। তাঁকে এশিয়ার মানুষ এতটাই আপন ভাবতে পেরেছিলেন যে আদর করে তাঁকে ‘হো চাচা’ বলে ডাকতে ভালোবেসেছেন তাঁরা।
ভিয়েতনাম প্রথমে ফরাসি এবং পরে (উত্তর ভিয়েতনামের মুক্তির পরে) দক্ষিণে মার্কিনি সাম্রাজ্যবাদের হাতে দীর্ঘ সময় নিষ্পেষিত হয়েছিল। কিন্তু ভিয়েতনামের মুক্তিকামী মানুষ হো চি মিন এবং তাঁর কমরেডদের নেতৃত্বে এই দুই পরাশক্তিকে পর্যদুস্ত করে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী অবিভক্ত ভিয়েতনামের জন্ম দিয়েছিলেন।
১৯৪২ সালে হো চি মিন ভিয়েতনামের পিপলস ডেলিগেট হয়ে চীনে একটি সম্মেলনে যোগ দিতে যাবার পথে জাপানি সৈন্যদের হাতে বন্দি হন। জাপান তখন চীন আক্রমণ করেছে এবং ভিয়েতনাম দখল করে নিয়েছে।
এইসময় জেলে বসে তিনি বেশ কিছু কবিতা লেখেন। কিন্তু তাঁকে স্বভাষায় লিখতে দেওয়া হয়নি, কারণ তারা ভিয়েতনামি ভাষা জানত না। হো চি মিন কী লিখছেন তা পড়ে নিশ্চিত হতে চেয়ে জাপানিরা তাঁকে মান্দারিন ভাষায় (Tang dynasty কবিদের ধরনে 618-907) কবিতাগুলি লিখতে বাধ্য করে।
মর্মস্পর্শী এই ছোট ছোট কবিতাগুলিতে একজন রক্তমাংসের মানুষ এবং একজন মুক্তিসংগ্রামীর সম্মিলন লক্ষ্য করা যায়। জেলবাসের নিদারুণ যন্ত্রণা এবং মুক্তির তীব্র আকাঙ্ক্ষা গভীর দাগ কেটে যায় পাঠকের মনে আজও। কারণ আজও এ পৃথিবী মুক্ত নয়, এখনও মুক্তিসংগ্রামীরা পৃথিবীর নানা জেলে সুদিনের অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন।
অনুবাদগুলি করেছিলাম ২০০৬-০৭ সাল নাগাদ। তার মধ্য থেকে নির্বাচিত কয়েকটি দেওয়া গেল।
– মৃন্ময় চক্রবর্তী
জেলখানার কবিতা ( নির্বাচিত) ।। হো চি মিন
কমরেডদের জন্যে কাগজের কম্বল
নতুন বই পুরোনো বই
পাতাগুলো সব একসাথে গাদাগাদি হয়ে আছে।
কোনো কম্বল না থাকার চাইতে
একটি কাগজের কম্বল বরং ভালোই
এই শীতে যারা নিরাপদ আশ্রয়ে আছ
ঘুমিয়েছ রাজার ছেলের মত,
জান কি কত মানুষ কারাগারে আছে
ঘুমোতে পারছেনা সারারাত।
শরতের রাত
ফটকের সামনে একজন সান্ত্রি
রাইফেল কাঁধে দাঁড়িয়ে
আকাশে চাঁদ ডুবে যাচ্ছে
মেঘের আড়ালে।
অন্ধকারে কালো আর্মি ট্যাংকের মত
বিছানা আঁকড়ে ছারপোকারা হাঁটছে।
মশার ঝাঁক
যেন আক্রমণকারী তরঙ্গায়িত বিমানদল।
আমি ভাবি আমার মাতৃভমির কথা
আমি উড়ে যাই দূর বহুদূর আমার স্বপ্নের ভেতরে।
আমি স্বপ্ন দেখি পথ হারিয়ে
আটক হয়েছি বেদনার জালে।
এখানে শেষ হয়ে এল একটি বছর
কি অপরাধ ছিল আমার?
অশ্রুসজল লিখছি আমি
আরো একটি জেলের কবিতা।
পরিচ্ছন্ন সকাল
সকালের সুর্য
জেলখানার পাঁচিলে আলো ঢালছে,
দূরে ঠেলছে অন্ধকার
নিরাশার পচা দুর্গন্ধ।
জীবনদায়ী হাওয়া
বয়ে চলেছে পৃথিবীর বুকের উপর দিয়ে।
শত শত বন্দি মুখে
আবার হাসি ফুটেছে।
রাত শীতল
শরতের রাত
তোষকহীন। চাদরহীন।
বিনিদ্র। শরীর আর পা’গুলো
জড়োসড়ো,মাংসপেশীতে ব্যাথা।
কুয়াশায় মোড়া কলাপাতায়
জোৎস্না ঢালছে চাঁদ।
আমার গরাদের ওপারে
খুঁটির মাথায় দোল খাচ্ছে সপ্তর্ষিমণ্ডল।