লিখতে গেলে মাথায় কিছুই থাকে না। সাদা পৃষ্ঠার সাথে যুদ্ধ ছাড়া — অনুপম মণ্ডল

শিরিষের ডালপালার আয়োজনে দ্বিতীয় দশকের কবিদের সঙ্গে আড্ডার এবারের পর্বে আড্ডা হয়েছে কবি অনুপম মণ্ডলের সঙ্গে। আগের সব আড্ডার ধারাবাহিকতায় অনুপমের সঙ্গে আড্ডায়ও পিঠ চাপড়ানোর চেয়ে সমালোচনাই হয়েছে বেশি। যেটা আমাদের উদ্দেশ্য — আত্মসমালোচনার মাধ্যমে বাংলা কবিতায় নতুন কিছুর উদ্দেশ করা, অনুপমের সঙ্গে আড্ডাটা তারই চলমান প্রক্রিয়া। কবি অনুপম মণ্ডল খুলনায় থাকেন, সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক। তার প্রকাশিত বই ‘ডাকিনীলোক’; যা ২০১৬ সালে চৈতন্য থেকে প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় কবিতার বই ‘অহম ও অশ্রুমঞ্জরী, ২০১৮ বইমেলাতেই প্রকাশ হবে। এই আড্ডার তিন সপ্তাহ পর অনুপম আবুল হাসান সাহিত্য পুরস্কার পাবার খবর পেয়েছেন। অনুপমকে দিয়েই এই সাহিত্য পুরস্কারের যাত্রা শুরু হলো। অনুপমের কবিতার জগতের সঙ্গে পরিচিত হতে এই আড্ডা আপনাদের সহযোগিতা করবে।



মিউজিকের কিছুই বুঝি না তবু কবিতাকে আমি মিউজিক্যাল করতে চেয়েছি। আমি খুব বিনয়ীও না। পরিবারের উপর প্রচুর রাগ করি।


মোস্তফা হামেদী: শুভেচ্ছা, অনুপম।

অনুপম মণ্ডল: শুভেচ্ছা আপনাকেও।

হামেদী: আপনার কবিতায় এক ধরনের মন্ময় সুর দ্যোতিত হয়। আপনার কবিতার পঙক্তি ধরে বলি, ” গভীর কোনো সুষুপ্তির ব্যাপ্তি” যেন। এইভাবে লেখার প্রেরণা কোথা থেকে পেলেন?

অনুপম: আমি না পড়লে লিখতে পারি না। পড়তে পড়তে কোনো বা কিছু বই প্রভাব তৈরি করে। আর বাস্তব জীবনে আমি পালিয়ে বেড়ানো একজন মানুষ। নির্জনতাই প্রিয় আমার। দেখা যাচ্ছে ওই বই, মিউজিক বা মুভি আমার উপর প্রভাব ফেলছে যারা কোন না কোন ভাবে নির্জনতা থেকে উৎপন্ন।

রাজীব দত্ত: অামি একটু নাক গলাই। মন্ময় সুর, সুষুপ্তির ব্যাপ্তি এইগুলা কি জিনিস? অামি বোঝার জন্য।

অনুপম: এক তো নয়ই। তবে সুরের সাথে কোথাও লিংক আছে হয়ত। না হলে ঘুমপাড়ানি গানগুলো তৈরিই হতো না, হয়তো।মগ্নতার গভীরতর স্তরের ধ্বনিব্যঞ্জনা-নৈঃশব্দ্যের রূপায়ণ— এই রকম কিছু রাজীব দা। 

হামেদী: দুই একটা মুভি বা বইয়ের নাম কি আমাদের সাথে শেয়ার করবেন?

ফয়সাল আদনান: আচ্ছা। তো এই ধরনের শব্দগুলো ব্যবহারে আপনার অনুপ্রেরণা কি?

রাজীব: মগ্নতার গভীরতর স্তরের ধ্বনিব্যঞ্জনা-নৈঃশব্দ্যের রূপায়ণ অারো বিপদে ফেলে দিলেন।

অনুপম: লিপিকা, রসাতল, উপনিষদ, শ্রীগীতা, রামকৃষ্ণ কথামৃত, গল্পগুচ্ছ। মুভি ওইভাবে মনে নাই।

কোন ধরনের শব্দ? ফয়সালকে বলছি…

ফয়সাল: আমার আগের প্রশ্নটার উত্তর দেবেন একটু অনুপম, সাথে রাজীবকে মনে হয় আপনি নিজেই একটু ক্লিয়ার করেন। এই যে ধরেন ‘সুষুপ্তি’

অনুপম: কিছু কিছু শব্দ থাকে মাথার ভেতর ঢুকে গুনগুন করতে থাকে। আমি স্প্যানিশ কবিতার মুগ্ধ পাঠক। তাদের কাছে কিছু ঋণ থাকতে পারে।

ফয়সাল: সুষুপ্তি তো স্প্যানিশ না, তাই না?

অনুপম: না না তা বলি নাই। তাদের শব্দ ব্যবহারের কৌশল।

হামেদী: নির্জনতার কথা বললেন। হুম্, আপনার কবিতায় নিঃসঙ্গ কেউ যেন বোঝাপড়া করে চলেছে প্রকৃতির বিচিত্র ঘটনা ও দৃশ্যপুঞ্জের সঙ্গে। জীবনানন্দ দাশকে বুদ্ধদেব বসু ‘নির্জনতম কবি’ আখ্যা দিয়েছেন। আপনি সেখান থেকে নিজেকে আলাদা বিবেচনা করবেন কোন জায়গায়?

অনুপম: মগ্নতার গভীরতর স্তরের ধ্বনিব্যঞ্জনা-নৈঃশব্দ্যের রূপায়ণ… কি সব জটিল ব্যাপার স্যাপার। লিখতে বসে এইগুলা মাথায় থাকে না। আলাদা কি আলাদা নয়, এইটা তো আপনারা বলবেন।

হামেদী: ‘আপেলের শব্দহীন দেহ, ঝাপটানো ক্যাসিনো’, ‘ তুষার কাটার মউসুম’ , ‘ নিঃসঙ্গ অলিভের পাতা’, ‘ ঝরে পড়া জলপাই পাতার পাশে’, ‘ নিঃসঙ্গ ম্যাপল পাতার পাশে’ এই ধরনের ইমেজ কি স্প্যানিশ কবিতা পাঠের অভিজ্ঞতা থেকে উৎসারিত?

অনুপম: প্রথম বইটা লেখার সময় স্প্যনিশ পড়েছি বেশি। লোরকা। আরো একটা বই ছিলো সাতসমুদ্র সাত আকাশ। হ্যাঁ, স্প্যানিশ আমার প্রথম বইটা লিখতে সাহায্য করেছে।

হামেদী: প্রভাবিত হতে পারাটাও দারুণ ব্যাপার। আপনার কবিতার সাথে এই ধরনের ইমেজগুলো যদিও বেখাপ্পা মনে হয় না। তবু একটা প্রত্যাশা থাকে যে, একজন বাঙালি কবি কবিতায় তার প্রতিবেশকে ব্যবহার করবেন উত্তমরূপে। এই ধরনের প্রত্যাশা তথা নন্দন ভাবনার সাথে আপনার দ্বিমত আছে কি?

অনুপম: না! তবে আগেই বলেছি। লিখতে গেলে কিছুই মাথায় থাকে না। সাদাপৃষ্ঠার সাথে নিজের যুদ্ধ ছাড়া।

হামেদী: তার মানে কি আপনার কবিতা কেবল প্রেরণাজাত, ব্যক্তির সচেতন মস্তিষ্ক সেখানে সক্রিয় থাকে না?

অনুপম: প্রেরণা তো থাকেই! তবে অবচেতনে তো কিছু লেখা যায় না। আর হ্যাঁ, পারিপার্শিক পরিবেশ কিছু প্রভাব তৈরি করে! আর সব শব্দ আমি ব্যবহার করতেও পারি না। মন সায় দেয় না।

হামেদী: এটা বলছিলাম মূলত বিদেশি অনুষঙ্গ ব্যবহারের জায়গাটা ধরে। তার মানে আপনি সচেতনভাবেই এই ধরনের ইমেজ ব্যবহার করেছেন?

অনুপম: হ্যাঁ। ইউজটা সচেতনভাবেই। যেহেতু লেখা আমি এক বসায় লিখতেই পারিনি কোনদিন। এক লাইন লিখছি, তারপর বহুদিন পরে আবারও বসছি কবিতাটা নিয়ে। কোন ঘটনা হয়ত বসতে বাধ্য করেছে।

ফয়সাল: আমার আপনার কবিতা নিয়ে একটা অবজার্ভেশন এমন যে, আপনি আপনার প্রেরণা/স্টিমুলি এগুলোকে ছাপাই যান না। এমনকি আপনার কবিতা আপনার ব্যক্তিত্বের মতোই- মোলায়েম, বিনয়ী। ফলত আপনার কবিতা পাঠ এক ধরনের ব্যক্তিকে পাঠ করার মতোই, ব্যক্তিকে ছাপায়া, ব্যক্তির পাঠ, প্রশিক্ষণ, প্রভাব এসবকে ছাপিয়ে যাওয়া কোন এক্সপেরিয়েন্স আপনার কবিতা প্রোভাইড করে না। মানে এক অর্থে এই কবিতাগুলা ব্যক্তিগত আবেদনই রাখে কেবল। আপনার কি মতামত এ বিষয়ে?

অনুপম: ব্যক্তির পুরা অনুবাদ হয়তো না। আমার অবিশ্বাসেরও অনুরণন আমার কবিতায় আছে। মরতে আমার ভয় লাগে। তবু মৃত্যুর অনুসঙ্গে আমার কবিতা ভরা। মিউজিকের কিছুই বুঝি না তবু কবিতাকে আমি মিউজিক্যাল করতে চেয়েছি। আমি খুব বিনয়ীও না। পরিবারের উপর প্রচুর রাগ করি।

হামেদী: তবে এই ব্যক্তিগত আবেদন বেশ ভালোভাবেই ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ছড়িয়ে পড়তে সক্ষম। একাকীত্ব উদযাপনের শান্তি আছে অনুপমের কবিতায়। আমার এমন উপলব্ধি, ফয়সাল। অনুপম, আপনার প্রকাশিতব্য কাব্য ‘অহম ও অশ্রুমঞ্জরী’ সম্পর্কে আপনি প্রায়ই বলেন যে, প্রথম কাব্য ‘ডাকিনীলোক’ থেকে সরে এসে নতুন কিছু করতে চেয়েছেন এখানে। কোন কোন জায়গায়?

অনুপম: দ্বিতীয় বইয়ে বাস্তবতার কাছাকাছি থাকতে চেয়েছি। প্রথমটা পুরাই কাল্পনিক। জগৎটার কথা বলছি। ভাষাগত চেঞ্জও আছে। আপেলের হাড়, অলিভপাতা এইগুলা নাই। ওই ধরনের মুগ্ধতাও নাই।

হামেদী: হা হা হা। নির্লিপ্ততা আছে আগের মতোই।

অনুপম: পুরোটাই কি বদলানো যায় বলুন!

হুজাইফা মাহমুদ: অনুপম স্যার, আপনার বর্তমান লেখালেখির কী খবর বলেন?

অনুপম: হা হা হা! খবর খুবই খারাপ। গত দুই-তিন মাসে দেড়টা কবিতা লিখেছি।

হুজাইফা: এটা তো খুবই ভাল খবর! বড় কবি হওয়ার লক্ষণ! আমার মতো আরকি।আমি বড় কবি হতে হতে শেষমেশ লেখাই বন্ধ করে দিয়েছি! হা হা হা


আমি তাকে (কবিতাকে) তৈরি করি বা তৈরি হতে সাহায্য করি। কিছুটা মাটি খুঁড়ে কোন নিদর্শন বের করার মতোই।


অনুপম: টেনশান নিয়েন না। আমিও দিতেছি। তবে বড় কবি হওয়ার জন্য না। হচ্ছে না।

হুজাইফা: আপনার লেখার প্রক্রিয়াটা একটু বলবেন? কখন, কিভাবে, কোন ধরনের মানসিক অবস্থায় পৌঁছালে পরে আপনি লিখতে বসেন?

অনুপম: ধরুন একটা বই পড়ছি বা মিউজিক শুনছি বা মুভি দেখছি। কিছু শব্দ বা লাইন মাথার ভেতর গুনগুন করতে থাকে। আমি ওইগুলোকে টুকে রাখি। অনেক জমা হলে খাতাটা নিয়ে বসি। একবারে কিছুই হয় না। কয়েকবার বসার পরে হয়তো একটা কিছু তৈরি হতে চায় ওরা। একটা দুইটা লাইন লিখে বসে থাকি। বলা যায় ভুলেই যাই। পরে আবার বসা হয়। হয়তো অন্য কোনো পরিস্থিতি বাধ্য করে। এইভাবে এগোতে থাকে। ওরা নিজের মতো, মনে হয়। আমি শুধু অপেক্ষা করতে থাকি। এই তো!

হুজাইফা: তার মানে আপনি লেখা ব্যাপারটা আসা না আসায় বিশ্বাসী! এটা বললাম এই কারণে যে, আমি প্রচুর লোককে দেখেছি এই ধারণাটার সমালোচনা করতে। আমি নিজেও আপনার মতো।

অনুপম: আমি তাকে (কবিতাকে) তৈরি করি বা তৈরি হতে সাহায্য করি। কিছুটা মাটি খুঁড়ে কোন নিদর্শন বের করার মতোই। যেন তারা আগেই তৈরি ছিল। মনে হয় এমনটাই।

হুজাইফা: বাহ্ চমৎকার কথা বলেছেন! আমার কাছে যেটা মনে হয়, কবিতা আসলে অন্যান্য শিল্পকলার চেয়ে অনেক অনেক বেশি আলাদা! এখানে কলা-কৌশল, আইডিয়া ইত্যাদির চেয়ে মনোবৃত্তির প্রভাবই সবচেয়ে বেশি! অবশ্য সব শিল্পই তো মনোবৃত্তিকেন্দ্রিক।

অনুপম: হ্যাঁ।

হুজাইফা: আপনার কবিতার ব্যাপারে আমার একটা অবজার্ভেশন হলো, আপনি মূলত সুরকে কেন্দ্র করে কবিতার অবয়ব তৈরি করেন! এর পুরো থিমটা একটা সুরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে! এমনকি অধিকাংশ কবিতায় সরাসরি সুরের প্রসঙ্গটাও থাকে!

অনুপম: এই বিষয়টা বলেছি হয়ত। আগেই। যা কিছু কুৎসিত। কঠিন। তাকে এড়িয়েই লিখতে চেয়েছি।

হুজাইফা: এখানেই মূলত আপনার কাব্যভুবন আর আমার টুটাফাটা কিছু লেখার মাঝে একধরনের আত্মীয়তা তৈরি হয়েছে!এই আত্মীয়তা আরও বহু জায়গায় বিস্তৃত হয়েছে! এটা আমার মনে হয় আর কি! আচ্ছা, আপনার কবিতায় মানুষ নাই কেন? কিংবা মানুষ এতোটা গৌণভাবে উপস্থিত ক্যান? মানুষ কী সুন্দর, শুভ বা মঙ্গলজনক নয়?

অনুপম: এইটা কাকতকলীয়। হয়ত আমাদের রুচি, পড়াশোনা, নেয়ার ক্ষেত্র একই ছিলো বা কাছাকাছি। এ তো হতেই পারে। মানুষ আছে তো দেখাচ্ছি.. 

‘তার কেশভার, নত হয়ে আছে। শান্ত জলের ধারে

ঘাসের ফাঁক থেকে উঠে আকাশে; সন্ধ্যার আকাশতলে যে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই কানে তার বাণী শোনা যায়।’

আরো আছে। তবে প্রকৃতি আমাকে টানে বেশি।

হুজাইফা: হা হা হা হা ! একে বুঝি মানুষ থাকা বলে! এতো সন্ধ্যার মায়া আলোয় বিলীয়মান কোন ছায়ামূর্তির অস্পষ্টতর ইঙ্গিত মাত্র! আপনার কবিতার মানুষগুলির কেন এই লুকোচুরি অবস্থান সেটা আমার চেয়ে ভাল আর কে জানবে!

অনুপম: আমি আমার চারপাশের মানুষগুলো থেকে পালিয়ে বেড়িয়েছি। পরিচিত কেউ সামনে পড়ার আগেই রাস্তা ক্রস করে অন্যপারে চলে গেছি। এ নিয়ে বন্ধুরা হাসাহাসিও করেছে। তবু.. আমি মিশতে পারি না। এও কারণ হতে পারে।

হুজাইফা: আচ্ছা। এটা তাহলে আপনার ব্যক্তিস্বভাবের প্রভাব! এখানে আপনার সাথে আমার একটা পার্থক্য আছে।আমি ব্যক্তিজীবনে দারুণ ফুর্তিবাজ, মিশুক, আলাপি ইত্যাদি। কিন্তু কবিতা লিখতে বসলেই কিভাবে যেন অতিমানবীয় হয়ে যাই, মানবপ্রজাতিরে ঝেঁটিয়ে বিদায় করি! হা হা হা

অনুপম: হ্যাঁ। তাছাড়া মানুষ আমার প্রিয় কোন বিষয় না।

হুজাইফা: আমি বারবার আমার নিজের কথা বলছি! এতে কিছু মনে করবেন না! কবিতায় আমার সবচেয়ে নিকটতম মানুষটি যাকে মনে হয়, সে হলেন আপনি! আমাদের রুচি, ভাবনা, বোধ অনেক বিষয়েই মিল খুঁজে পাই! সেজন্য বারবার তুলনা করে কথা বলছি আর কি!

অনুপম: আমাদের কিছু মিল হয়তো আছে, কবিতার ইলিমেন্টসে। তবে কবিতায় আপনি অনেক এগিয়ে।


আমি পাঠককে পড়াই মানে, তার কথা ভেবে তো লিখি না। পাঠক বা সমালোচক বেশিরভাগ সময়ই ভুল।


হুজাইফা: আপনার কবিতায় কি রিপিটেশন আছে বলে মনে হয়? থাকলে সেটাকে কিভাবে দেখেন?

অনুপম: আছেই তো! রিপিটেশনে ভরা। প্রিয় বিষয় বেশি হয় না। আর সবকিছুই আমি কবিতায় লিখতে চাইও না। এই পাণ্ডুলিপি পাতা, ঝরা-ভরা। দ্বিতীয়টার কথা বলছি।

হুজাইফা: আরেকটু খোলাখুলি বলেন দয়া করে! রিপিটেশন হওয়া তো ভাল কিছু না! এর মানে হতে পারে, আপনি আসলে ফুরিয়ে গেছেন! নতুন কিছু ভাবতে পারছেন না!

অনুপম: অবশ্যই ভালো কিছু! এইটা একটা জগৎ তৈরি করতে সাহায্য করে। কথা হচ্ছে আপনি এক কবিতা কতবার লিখছেন। একটা গোধূলিকে আমি যদি একাধিকবার আলাদাভাবে প্রেজেন্ট করতে পারি, আমি কেনো অপরাহ্ণের কাছে যাবো। ও তো আমার প্রিয় বিষয় নয়। আর আমি পাঠককে পড়াই মানে, তার কথা ভেবে তো লিখি না। পাঠক বা সমালোচক বেশিরভাগ সময়ই ভুল।

হুজাইফা: দ্যাটস ইট! ঠিক এই কথাটাই আমি বের করে আনতে চাইছিলাম আপনার কাছ থেকে! এর মাধ্যমে আসলে একটা মৌলিক প্রশ্নের সমাধান হয়ে যায়, যে প্রশ্নের সামনে আমাদেরকে প্রায়ই দাঁড়াতে হয়! প্রশ্নটা হলো, কেন লেখি? নিজেই নিজেকে প্রতিনিয়ত প্রশ্ন করি! এর উত্তর যা আমি পাই, সেটা আপনি বলে দিলেন! একজন শিল্পীর কাছে সবচেয়ে বড় বিষয় তার বোধের জগৎটা! সেখানে পাঠক-সমালোচক একেবারেই গৌণ বিষয়, আলোচ্যই না!

অনুপম: আরে! নিজের কবিতা নিজেকেই তো ভুল ব্যাখ্যা দেয় কখনও কখনও! পাঠক সমালোচক তার কিই-বা বার করতে পারে বলুন!

হাসান রোবায়েত: অনুপম, তার মানে কি পাঠক কিছুই না? কাবাব মে হাড্ডি প্রজাতির?

অনুপম: না তা নয়! পরীক্ষা নেয়া। এইটাই বুঝতে চেষ্টা করা যে, দেখি তো আমার অনুভূতির কতখানি ধরতে পারলো! যদি কিছু পারেও আনন্দ হয়। তার মানে তো এই নয় তার কথা ভেবে লেখা

রোবায়েত: তাইলে কি আপনি পাঠকের জন্য লেখেন না একদমই?

অনুপম: নাহ্!

রোবায়েত: এলিয়েনরা পড়বে?

অনুপম: তবে এলিয়েনদের জন্য তো নয়ই। এ তো নিজের সাথেই বোঝাপড়া। লুকোচুরি। আচ্ছা রোবায়েত, একটা প্রশ্ন করি?

রোবায়েত: পাঠকের পরীক্ষা নিতে চান কেন?

অনুপম: কারো না কারো পরীক্ষা তো নিতে ইচ্ছে হয়। হয়তো জেনেটিক্যাল কোনো ব্যাপার। গাছপালা বুঝলে ওদের পড়াতাম। আমার ক্ষেত্রে আরো একটা ব্যাপার হলো, আমি কিছুই পারি না। কোন অর্জনই নাই জীবনে। ছোট হয়ে তো বাচাঁ যায় না। মানুষ পারে না। তাকে কিছু না কিছু আঁকড়ে ধরতে হয়-ই।

রোবায়েত: পাঠকের পরীক্ষা না। আসলে একটা টেক্সট যখন পাঠকের কাছে যায়, তখন পাঠকই লেখকের পরীক্ষা নেন আসলে।

হুজাইফা: কবি ও পাঠকের সম্পর্ক, এটা আসলে একটা কমপ্লেক্স মনে হয় আমার কাছে! কেন না, আপনি যদি পাঠকের রুচি ও অভ্যাসকে মাথায় রেখে লেখতে চান তাহলে আপনার নিজের শিল্পবোধ ও নিজের জগতের সাথে আপোষ করতে হবে! নতুন নতুন আইডিয়া ও কলা-কৌশল দিয়ে তাদের চাহিদা পূরণ করতে হবে! এটা না করেও অবশ্য চলতে পারেন, এমন সম্মানিত ব্যতিক্রম তো অবশ্যই আছেন!

রোবায়েত: সে ঠিক আছে হুজাইফা। কিন্তু পাঠক লেখকের চেয়েও স্বয়ম্ভু। তার আছে নিজের চিন্তাজগত এবং তা লেখকের থেকেও বিচিত্র। তাই তার পরীক্ষা নিতে চাওয়াটা বেশ কঠিন। আসলে পাঠক একটা অ্যাবস্ট্রাক্ট আইডিয়া মাত্র। কেউই পাঠক না সবাই ক্রিয়েটর।

অনুপম: পিছনে অস্ত-আকাশের দিগন্তরেখা। পাতা ঝরবার বেলা। নিভৃতে, সন্ধ্যা তার সন্ধানে ফেরে। পিছনে, অতি ধীরে কেউ জয়ধ্বনি ক’রে উঠলো। ক্রোধের আকার থেকে আরো দূরে; ওই রাত্রির পালক ভ’রে, অনাহত সেই ধ্বনি, গঙ্গাবক্ষ হতে যেন একবার মাথা তুলে চাইল।’

রোবায়েত, পাঠক এই কবিতার কি ব্যাখ্যা দিবে কন তো! আমি নিজে দুইভাবে দিতে পারি! মাঝেমাঝে মনে হয়! আরো কোন ব্যাখ্যা আছে হয়তো…

রোবায়েত: ঐ যে বললাম, পাঠক নিজেই ক্রিয়েটর। সে তার মতো করে টেক্সট রি-রাইট করে।

হুজাইফা: অনুপম ভাই, কবিতার ব্যাখ্যা-ট্যাখ্যা নিয়ে ইদানিংকার পাঠক আসলে এতোটা ভাবে না! তারা ধরেই নিয়েছে, কবিতার আসলে স্পেসিফিক ব্যাখ্যা হয় না। ব্যাপার আসলে অন্যান্য ক্ষেত্রে!

রোবায়েতকী যেন জিজ্ঞাসা করতে চাইছিলেন অনুপম?

অনুপম: রোবায়েত, আপনার সাথে তর্কে যাবো না! লেখার সময় একটা সুর আর তার কাঠামোটাই মাথায় থাকে! আমার মাথাটা মোটা হলেও কেনো জানিনা স্পেস কম। পাঠক ওইখানে থাকে না।

ভুলে গেছি, রোবায়েত। পরে মনে পড়লে বলব।

রোবায়েত: অনুপম, শ্রেষ্ঠা কেমন আছেন?

অনুপম: ভালো। ঘুমায়। আমার কাছেই।

রোবায়েত: বাহ্। শ্রেষ্ঠার যেদিন পৃথিবীতে নেমে এলেন। খুব আনন্দ পাইছিলাম। ওকে মনে রেখে চারটা লাইনও লিখেছিলাম।

অনুপম: জানি। ওর সবথেকে বড় গিফট ছিলো সেটা।

রোবায়েত: কী পড়ছেন ইদানিং? আপনার প্রকাশিতব্য বই ‘অহম ও অশ্রুমঞ্জরী’ নিয়ে আমার উচ্ছ্বাসের শেষ নেই। এমন শান্ত-শীতল বই সম্ভবত অনেক দিন বাংলা কবিতা দেখেনি।

অনুপম: কিছুই না। সত্যি বলতে কি, স্টপ হয়ে আছি। কিছুদিন হলো দুইটা বই পড়লাম। হেমন্ত বন্দোপাধ্যায়ের সমগ্র আর বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শ্রেষ্ঠ।

ধন্যবাদ। শঙ্কাগুলো বলুন।

রোবায়েত: এই বই নিয়ে সম্ভবত আমার সমালোচনাই সবচেয়ে তীব্র এবং নির্মমও বটে।

অনুপম: হতে পারে। আমি তো লিখিই। ওর পরিণতি আমার কাছে একই। সমালোচনা তো আপনারা করবেন।

রোবায়েত: আপনার এই পাণ্ডুলিপিটা কয়েক দফা পড়া হয়েছে। পড়তে গিয়ে বারবার মনে হয়েছে, যে নতুন ভাষায় আজকের কবিতা লেখা হতো অনুপম সে ভাষার একজন স্রষ্টা না হয়ে তিনি বরং পিছিয়ে গেছেন কম করে হলেও এক শতাব্দীকাল। ‘অহম ও অশ্রুমঞ্জরী’ লেখা হয়েছে কিছুটা রাবিন্দ্রিক ভাষায়। আর যে ভাষায় অনুবাদ হয়েছে গীতা-উপনিষদ এমন কি বিভূতিভূষণের স্টাইলে। এমন কেন ঘটলো?

অনুপম: এই প্রশ্নের উত্তর এইভাবেও দেয়া যায়- যখন তীর ছোঁড়া হয়, তখন জ্যা-টাকে টেনে আনতে হয়। বা ধরুন লাফ দেয়ার আগে পিছিয়ে আসা। এভাবেও বোঝাপড়া করা যায় এই ভাষাটার সাথে। তবে আমি বলবো, এই সুরটা আমাকে শান্তি দেয়। দিয়েছে।

রোবায়েত: যেমন ধরেন, উদাহরণ দিই। একটা কবিতার শুরু হচ্ছে এমন করে— ‘এই তোমার অসীমের পথ।’ যেন ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি’ টাইপের। এমন আরো কিছু উদাহরণ দেওয়া সম্ভব। তো, আজকের এই যুদ্ধকাল-অতিক্রমের কালে রাবিন্দ্রিক সৌন্দর্যবোধ ঠিক কতটুকু শান্ত করবে আমাদের? ওনার ঔপনিষদিক জগৎই বা কতটুকু প্রয়োজন আমাদের?


নতুন বলে কিছু নাই। আজ যা নতুন কাল তো তাই পুরাতন হবে। যদি চিরন্তন করে ফেলা যায়! ওইটাই উত্তম।


অনুপম: এইটা তো ঠিক, রুচিরও ব্যাপার থাকে। নিতে পারাটাও ঠিক ওইখান থেকেই উৎপন্ন। একখানা উৎপল সমগ্র থেকে যদি ক্ষুদ্র গ্রন্থ লিপিকা, পুনশ্চ, বা সমর সেনের কয়েকটি কবিতা আমাকে তৃপ্তি দেয়, তবে আমাকে তো উৎপল ত্যাগ করতেই হবে। আর প্রয়োজনীয়তা! সেটাও তো ব্যক্তিভেদে ভিন্ন।

রোবায়েত: কিন্তু এই যে পুরাতনগন্ধী ভাষা, তৃপ্তি কি শুধু ঐখানেই? আপনি কি বলতে চান নতুন ভাষায় আর তৃপ্তি পাওয়া সম্ভব নয়? তৃপ্তি বা মুক্তি পাইতে কেবল রাবিন্দ্রিক বা বঙ্কিমীয় ভাষার কাছেই ফিরতে হবে?

অনুপম: নিরীক্ষা তো অনেকভাবেই করা যায়, রোবায়েত। তবে এই ভাষাটা পুরাতনগন্ধ এইটা আমি নিজেও জানতাম না। জেনেছি পরে। এবং মানিনি। যদি মেনে নিতাম, তবে বলতাম নতুন ভাষায় লেখা অখাদ্যের থেকে পারাতনগন্ধি কিছুটা ভালোও ভালো!

অনুপম: “অস্তপারের বিভা জ্বল-জ্বল ক’রে জ্বলছে। নতশিরে। কারো খিন্ন জীবনের বাণীর মতো। এই ক্ষুদ্র, নিদ্রামগ্ন সংসারের ঊর্ধ্বে। ক্ষমাহীন, ওই তারার ডাল ছেড়ে ঝাঁপ দেয়া মেঘ-ভরা আভাটির কাছে।”

রোবায়েত, এই ভাষার প্রাচীনতাটা কোথায়?

রোবায়েত: উদাহরণ দিয়েছি উপরে।

অনুপম: নেচারের সাথে রিলেট করার আর কোনো পথ পাচ্ছিলাম না। আর কবিতাটাতে যদি কেশ, তটিনী, গৃহ প্রবলেম তৈরি করে থাকে (আপনাদের মতে) আমার এইখানে করার কিছুই ছিলো না। কেনো না এই পতন অনিবার্য ছিলো।

রুহুল মাহফুজ জয়: আমি রোবায়েতের সঙ্গে পুরোপুরি একমত নই। মনে হয় অনুপমের টোনটা অহম ও অশ্রুমঞ্জরীতে উপস্থিত আছে এবং কবিতাগুলোর প্রয়োজনেই ভাষা অত সান্দ্র।

হুজাইফা: আসলে কে কোন ভাষায় স্বস্তিবোধ করে, এবং সেই ভাষাকে নিজের মতো করে আপন করে নিতে পারে সেটা তো ভ্যারি করে পার্সন বাই পার্সন! যদিও এখানে চলতি ধারা বা চলমান কাব্যভাষা কী, এ জাতীয় ব্যাপার একটা থাকে। কিন্তু আমার মনে হয়, স্বয়ং কবি যদি এটাকে নিজের জগতের সাথে রিলেট করে নিয়ে থাকেন, তাহলে তার সে স্বাধীনতা থাকা উচিৎ! যেহেতু তিনি পাঠক বা সমালোচকের দিকটা চিন্তা না করে কেবল নিজের জন্যই একটি স্বস্তিদায়ক কাব্যভুবন নির্মাণ করতে চাইছেন!

রোবায়েত: হা হা। আসলে একটা ব্যাপারে আমি নিজেই আপনার পরামর্শ চাইছিলাম এর আগের একটা প্রশ্নে। যে, তৃপ্তির জন্য নতুন টাইপের ভাষা কি অগ্রহণযোগ্য ? যদি অগ্রহণযোগ্য না হয়, তবে আপনি কী ধরণের ভাষা-স্টাইল আশা করেন সেক্ষেত্রে?

অনুপম: রোবায়েত, নতুন বলে কিছু নাই। আজ যা নতুন কাল তো তাই পুরাতন হবে। যদি চিরন্তন করে ফেলা যায়! ওইটাই উত্তম।

রোবায়েত: ওকে। বিভূতিভূষণ আপনার বেশ প্রিয়। বইয়ের একটা অংশের নাম এবং কিছু লাইন উনার ডায়েরি থেকে নেওয়া। যেমন—শঙ্খ ও শোভা [নদীর নাম], ‘কোন অকরুণ কাল তোমাকে হরণ করে’, ‘তব আসন পাতা এ বনতলে’। এই যে বিভূতিপ্রিয়তা সেটা কি তার জগতের সাথে আপনার জগতের মিল আছে বলে নাকি অন্য কোনো কারণে?

অনুপম: বলতে পারেন ওইটাই। হ্যাঁ, আমার মনে হয় প্রকৃতির থেকে বড় শিল্পী আর নাই। ওর মতো ভাবুক, ধ্যানীও। তো ওর সাথে কম্যুনিকেশনের একটা পথ খুঁজতেছিলাম। বিভূতি, রবীন্দ্রনাথ, রামকৃষ্ণ, গৌতম বসু, কালীকৃষ্ণ গুহ এ ক্ষেত্রে সাহায্য করেছে। তাদের কাছে ঋণী আমি।

রোবায়েত: হুম। যেমন গৌতম বসু নিজেও রবীন্দ্রনাথের কাছে ঋণী।

অনুপম: আপনি তো জানেনই সেটা।

রোবায়েত: সম্ভবত, বিভূতিভূষণও ঋণী। কারণ উনার ভাষাও আমার রাবিন্দ্রিক লাগে।

হুজাইফা: যেমন জীবনানন্দ বিভূতির কাছে ঋণী, স্বীকার না করলেও!

রোবায়েত: এইবার একটু অন্য আলাপে আসি।
 
অনুপম: অবশ্যই।
 
হুজাইফা: বিভূতিকে রাবীন্দ্রিক লাগার কারণ তার গদ্যরীতি। অন্যথায় দুইজনের মাঝে বিস্তর ফারাক আছে।
 
রোবায়েত: আপনি ‘অহম ও অশ্রুমঞ্জরী’তে উপনিষদ, গীতা থেকে সরাসরি কোট করেছেন কিছু লাইন। যেমন: ‘প্রয়াণকালে তোমাকে জানাটিই বা কিরূপ’ [ উপনিষদ], ‘সে আকাশ রুদ্ধ হলে সকলি আকাশ’। [গীতা]।
 
এই টেক্সট যখন পাঠকের কাছে যায়, তখন কিন্তু গীতা বা উপনিষদের ব্যবহার নিয়ে কোনো ঝামেলা থাকে না। সবাই সেটাকে গ্রহণ করে, সেকুলার, নন সেকুলার সবাই। কিন্তু ট্রাজেডি হচ্ছে, আমি যখন আমি ‘পানাহ্’ বা অন্য কবিতায় কোরানের আয়াত ব্যবহার করি সেটাকে ধর্মীয় বলে অভিযুক্ত করবার এক ধরনের আলাপ করেন কেউ কেউ। আবার তারাই এলিয়টের এই টাইপের টেক্সট এর প্রশংসা করে।
এমন দ্বিচারিতা কেন তৈরি হয় সোসাইটিতে? আপনার কী মনে হয়?
 
অনুপম: এই ধরনের লোকদের কবিতা না পড়ানোই উচিত। এদের কোন উন্নতিই সাহিত্য করতে পারে না। দিন শেষে। গৃহ নির্মাণকালে বাবুই যার খোঁজ করে, তার খবর আমারা নিলেই কি আর না নিলেই কি! কবিতাও ত এক প্রকার নির্মাণ। ওই ঠিক করবে ট্যুলস। তার সম্পূর্ণতা। আমি অমন পাঠককে কবিতা পড়াই না।
 
হুজাইফা: শিল্প বিচারের ক্রাইটেরিয়া যাদের কাছে নিছক পলিটিক্স, নন্দন নয়; তারা এমনটা করতে পারেন!
 
অনুপম: আমি গীতা বা উপনিষদ (যদিও খুব কমই পড়েছি) থেকে উত্তম কাব্য পড়ি নাই।
 
রোবায়েত: অহম ও অশ্রুমঞ্জরী-র ভূগোল কি ভারতবর্ষ না কি বাংলাদেশ? অর্থাৎ আপনার পাতাগুলো যে মাটিতে ঝরে পড়ে তার ভূ-পরিচয় জানতে চাচ্ছি।
 
হুজাইফা: কিংবা আন্দালুসিয়ার অলিভ বনও হইবার পারে! হা হা হা
 
রোবায়েত: না না হুজাইফা। অনুপম এই টেক্সটে লোকালিটিকে ব্যবহার করেছেন।
 
অনুপম: এ ভূমি আমার মনোলোকের। এর অস্তিত্ত্ব খোঁজা বৃথা। গঙ্গা হয়তো এনেছি। ফর মিউজিক। ভারতবর্ষ আমি যাই নাই কোনোকালে। আন্দালুসিয়া হতে পারে । হা হা হা
 
রোবায়েত: কিন্তু এইখানে আমি ভারতবর্ষই পেয়েছি। ভারতবর্ষের লোকালিটি এখানে ব্যবহার করা হয়েছে।
 
অনুপম: পেতে পারেন! আচ্ছা রোবায়েত! প্রতিমা দেখেছেন? দেব-দেবীর কাঠামো আসলো কোথা থেকে? যাই হোক, জগৎটা কল্পনার। মিলে গেলে কি বা করার আছে!
 
হুজাইফা: অনুপম ভাই,আপনি পাহাড়ে গিয়েছেন কখনো?
 
অনুপম: পাহাড় বা অরণ্য কিছুই দেখি নাই আমি।
 
রোবায়েত : আচ্ছা। আমি আগে ভারতবর্ষ থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসি সবাইকে। এবং সেটা অনুপমের টেক্সট দিয়েই।
১.
‘রাজগিরির পাহাড়ে তখনও অস্তগামী সূর্যের শোভা।’
‘দেখা যায় ওই গঙ্গামাতা ফিরিয়ে নিচ্ছেন অমৃতের দীক্ষামন্ত্র।’
‘ক্রোধের আকার থেকে আরো দূরে; ওই রাত্রির পালক ভ’রে, অনাহত সেই ধ্বনি, গঙ্গাবক্ষ হতে যেন একবার মাথা তুলে চাইল।’
১-এ যে রাজগিরি পাহাড়ের কথা অনুপম বলছেন সেইটা মূলত ভারতের তামিলনাড়– প্রদেশে। ঐখানে তিনটা পাহাড় আছে। রাজগিরি, কৃষ্ণগিরি, চাক্কিদূর্গ। ২,৩-এ যে গঙ্গার কথা উনি বলছেন সেটা তো ভারতেরই নদী। পূন্যতোয়া গঙ্গা। ঠিক এই কারণেই, এই টেক্সটের লোকালিটিকে ধরে কেউ যদি ‘অহম ও অশ্রুমঞ্জরী’ কে কোলকাতার (মানে এমন কেউ এটি লিখছেন যিনি পশ্চিমবঙ্গ-নিবাসী, ভারতবর্ষ ঘোরার যার অভিজ্ঞতা আছে—বিভূতিভূষণের মতো) টেক্সট বলে মনে করে, সেক্ষত্রে আপনি কী বলবেন?

তিনটা বাছতে গেলে প্রথমে আসে ‘ঘুমন্ত মার্কারি ফুলের নাম’। সম্ভবত এই বইটা বাংলা সাহিত্যের জন্য এক শঙ্কার নাম।

অনুপম: গঙ্গা আর রাজগিরি দেখে ভাষা বা ভূগোল কোলকাতা পাঠালে তো মুশকিল রোবায়েত। ওইটা ঋণ ছাড়া আর কিছুই না। তবে রাজগিরিটা বদলাবো ভাবছি। গঙ্গা থাক।
 
রোবায়েত: আচ্ছা অনুপম, আমাদের সময়ের প্রিয় তিনটা বইয়ের নাম বলেন তো। প্রশ্নটা এই জন্য যে আমার জানতে ইচ্ছা করছে এই সময়ের টেক্সট আপনাকে তৃপ্তি দেয় কিনা!
 
অনুপম: আমার সময়ে অনেক বই-ই তো প্রিয় রোবায়েত! জয়ের (রুহুল মাহফুজ জয়) বইটা ভালো। শাহ মাইদুল, আল ইমরান সিদ্দিকী বা রাজীব দত্তের বইটাও ভালো লাগে। তবে তিনটা বাছতে গেলে প্রথমে আসে ‘ঘুমন্ত মার্কারি ফুলের নাম’। সম্ভবত এই বইটা বাংলা সাহিত্যের জন্য এক শঙ্কার নাম। কবিতা লিখতে সহজ করে দিয়েছে। গাছ থেকে পাতা ঝরছে এইটা না বলে পাতার থেকে ঝরছে গাছ। এই শিক্ষা পেয়েছে ওই বই থেকে। পাব্লিক এই বইয়ের শুধু অনুবাদই করেছে। ভেতরে পৌঁছাতে পারে নাই। যদি পারতো ভালো হত। দ্বিতীয়টা ‘আন্তোনিয়োর মেঘ’। অনেক একঘেয়েমি সত্ত্বেও এই বই আমাকে তৃপ্তি দেয়। এতো বিষণ্ন! আর মিউজিক্যাল! তৃতীয় বইটা এখনও বেরোয় নি। লেখা হচ্ছে। হয়তো লেখা হয়ে গেছে। সেটা লিখছেন হুজাইফা মাহমুদ।
 
রোবায়েত: কী বলেন! ‘ঘুমন্ত মার্কারি ফুলে’ বাংলা কবিতার জন্য শঙ্কার নাম! বইটার অনুবাদ বা বইটাকে ফলো করে টেক্সট লেখা হচ্ছে কিনা সেটা অবশ্য সময় ভালো বলতে পারবে। তবুও আপনার আশঙ্কা আমার ভালো লাগলো। হা হা হা
 
ফারাহ্ সাঈদ: কি এমন আছে নূপুর-ধ্বনিতে ? আপনার কবিতায় ‘নূপুর’ বেশ শব্দটির রিপিটেশন দেখা যায়? কোন বিশেষ কারণ ?
 
অনুপম: কোন কারণ নাই। নূপুর শব্দটাই মিউজিক্যাল। হয়তো ওই কারণেই। কেউ পায় দিলেই সুরেলা। না দিলে স্তব্ধ। এই ব্যপারটাই অদ্ভুত লাগে।
 
ফারাহ্: “ঐ ছিন্নভিন্ন সবুজ আপেলটি কেবল দুলতে থাকে” [অনুপম ম-লের কবিতা : গান, ২০১৫] অনেকের কবিতায় “আপেল” শব্দটির এইরকম খুব কাছাকাছি প্রয়োগ দেখা যায়। এই কবিতায় আপনি কি করে আলাদা করতে পেরেছেন বলে মনে করেন ?
 
অনুপম: আর কেউ কিভাবে ইউজ করছে দেখি নাই। চোখে পড়লে বলতে পারতাম। তবে আপেল আমার প্রিয় ফল না হলেও আপেলের বহু ব্যবহার ‘ডাকিনীলোক’ এ আছে।
 
ফারাহ্: আপনার কবিতা দ্বারা সম্পূর্ণ প্রভাবিত কোন লেখকের প্রতি আপনার অনুভূতি কী?
 
অনুপম: কোন অনুভূতি নাই। অমি নিজেও বহু দ্বারা প্রভাবিত। তবে আমি যা লিখে ফেলসি তা না লেখাই ভালো সেই চিত্রকল্প থিমটাকে অন্য আরো বেটার ভাবে ব্যবহার করাই উত্তম হবে তার জন্য।
 
ফারাহ্: অনুবাদ কবিতায় মূল কবিতার ভাব হারিয়ে যায় বলে যে কথাটি আলোচিত হয়, এ বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।
 
অনুপম: লেখক যদি না চান, পাঠক বা পাঠিকা এমনিতেই ভাব হারায়ে ফেলে। তো অনুবাদে হারালে দোষ দেখি না আমি। এইটা তো হারাতে বাধ্য। কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে। যত যাওয়া যায় ততই উত্তম।
 
জয়: অনুপম, যখন ‘শ্রেষ্ঠা’র বাপ হইলেন তখন ঠিক কোন ভাবনা মাথায় আসছিলো?
 
অনুপম: মাথা তো পুরাই ফাঁকা ছিলো। কবিতার শেষ শব্দটা বসানোর আগের মুহূর্তের মতই। তো, ওকে যখন বের করলো আমিই ছুটে গিয়েছিলাম প্রথম। আর সবাই অপারেশান থিয়েটারের বাইরে বসে ছিলো! ওকে কোলে নেওয়ার পরও। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আশলে কি ঘটেছে বা ঘটছে!
 
জয়: শ্রেষ্ঠারে তো কবিতা শোনান এখন। বড় হবার পরেও শোনাবেন? মেয়ে যদি কবিতা লিখতে চায়? ওর মাকে কখনো শুনাইছেন? আপনি কবি, এইটা নিয়া পরিবারের আচরণ কী রকম?
 
অনুপম: পরিবারের আচরণ বিরূপ। হ্যাঁ কবিতা ওকে পরেও শোনাব! আমার লাইব্রেরিটা তো ওর জন্যই গড়ে তুলছি। ও লিখুক না লিখুক, অন্তত পড়ুক ভালো বইগুলো। ওর মাকে শোনাই নি। তার কবিতায় আগ্রহ নাই।
 
জয়: আমাদের দেশে যে সাহিত্য পুরস্কারগুলা দেয়, এগুলা নিয়া আপনার মত কী? পুরস্কার কতটা জরুরি মনে করেন?
 
অনুপম: টাকার সমস্যা যদি থাকে পুরস্কার লাগতেই পারে। আমি তো ভাবছি ‘অহম ও অশ্রুমঞ্জরী’ সামনের বছর সব জায়গায় জমা দেবো। আমার টাকার দরকার। তবে কবিতার জন্য টাকার বা পুরস্কার দরকার নাই।
 
জয়: সাহিত্যের জন্য পুরস্কারের জরুরত আছে?
 
অনুপম: পুরস্কার সাহিত্যের কোন উন্নতিই করতে পারে না।
 
জয়: টাকা। টাকা আপনার কাছে কী? সাহিত্যের জন্য কোনটা বেশি জরুরি, টাকা নাকি সেক্স?
 
অনুপম: খাইসে! আমাকে কোনটাই সাহায্য করে নাই। না টাকা না সেক্স।
 
জয়: সেক্স নিয়া আপনার ট্যাবু আছে? যদিও ডাকিনীলোকে কিছু কবিতায় তীব্র যৌনবোধ আছে।
 
অনুপম: পুরাই বানানো! ধার করা। প্রেমের কবিতা আমি প্রেমে পড়ার আগে লিখছি। পরে লিখি নাই। ইচ্ছে করে না আসলে।
 
জয়: যদি আপনার কবিখ্যাতি আসে, সবসময় আশেপাশে সুন্দরী রমণী আর হাঁটুর বয়সী মেয়েরা ঘুরঘুর করে, আপনি কি করবেন?
 
অনুপম: কবিতা শোনাতে পারি দু-একটা। এর বেশি কিছুই নয়।
 
জয়: এসব কারণেই কী আপনার টোন এতটা নম্র, শান্ত?
 
অনুপম: হতে পারে। কোলাহল ভালো লাগে না। মানুষ থেকে পালাতে পালাতে ওইটাই অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে।
 
জয়: ধরেন, একদিন সকালে উঠে দেখলেন আপনি ব্রাত্য রাইসু হয়ে গেছেন। ব্যাপারটা কিভাবে সামলাবেন?
 
অনুপম: আবার ঘুমিয়ে পড়বো।
 
জয়: আপনি লিখছেন, কিছু খুচরো কয়েনে উইন্টার নুয়ে আছে। আপনাদের তুষারপাতের দৃশ্য দীর্ঘ হয়ে আসে… এই উইন্টার আর তুষারপাত কই পাইলেন?
 
অনুপম: ইংলিশ মুভিতে। এই দৃশ্য প্রচুর দেখা যায়।
 
জয়:
‘নিঃসঙ্গ একটা ব্রথেলের দিকেই
আসলে হেঁটে যায়
আমাদের ঈর্ষা’
এই ঈর্ষা কার প্রতি কার? কবির প্রতি কবির?
 
অনুপম: ব্রথেল আমি দেখিনি। পাশ দিয়ে গেছি। তো যারা যায় তাদের প্রতিই এই বোধটা। খুবই শাসনের ভেতর বড় হওয়া তো! হয়ত এই কারণেই।
 
জয়: মুভি ছাড়া আর কি কি দ্বারা আপনার কবিতাজগৎ প্রভাবিত হয়?
 
অনুপম: সংঙ্গীত, ধর্মগ্রন্থ, রবীন্দ্রনাথের কিছু লেখা, রামকৃষ্ণ আরো অনেক কিছুই।
 
জয়: একজন কবিকে কিংবদন্তী হতে হলে কি কি থাকা দরকার?
 
অনুপম: সে যে ট্যুলস নিয়ে কাজ করছে, তার সর্বোত্তম ব্যবহার। আপাতত আর কিছুই মাথায় আসছে না।
 
জয়: সাহিত্যে ধর্মের ব্যবহারকে আপনি কিভাবে দেখেন?
 
অনুপম: কোন দোষ তো নাই। বরং ভালোই আছে। যদি সে ঠিকভাবে অনুসঙ্গগুলোকে আনতে পারে।
 
জয়: আপনার এই যে নরম স্বর আর মিউজিক্যাল কবিতার দিকে ঝোঁক এটা কিভাবে তৈরি হয়েছিল? ঠিক কখন বুঝেছেন, এটাই আপনার কবিতার জগৎ?
 
অনুপম: মেয়েটাকে রোজ বিকেলে নিয়ে বেরোতে হয়। ও ঘরে থাকতেই চায় না। তো, বাইরের সবকিছুই ও চোখ ঘুরিয়ে দেখে। একটা কাক উড়ে কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছে দেখবে। একটা গাড়ি পাশ দিয়ে গেলে তাকাবে। তবে ও সব থেকে আগ্রহ নিয়ে দেখে ছোট ছোট বাচ্চাগুলোকে। ওদের দৌড়, খেলা। এই যে বাচ্চাদের সাথে ওর বোঝাপড়া কবে কিভাবে জানি না। তবে হয়ে গেছে। আমার ক্ষেত্রেও বিষয়টা অজানা।
 
জয়: শেষ প্রশ্ন। কবিতা নিয়া আপনার স্বপ্নটা কি?
 
অনুপম: তেমন কোন স্বপ্ন নাই যতদিন বেঁচে আছি অন্তত আরো একটা বা দুইটা বই লিখে যেতে পারলেই এনাফ। লিখছি এইটাই তো বড় রহস্য। ওর কাছে এর বেশি কিই-ইবা চাইতে পারি। তা অধিক হয়ে যাবে। চাইতে গেলে।
 
জয়: সময় দেবার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
 
অনুপম: আপনাদেরকেও ধন্যবাদ।

 

শেয়ার