বাংলা সাহিত্যের ড্যাশিং বুড়োর নাম শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর লেখা পড়ে ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে প্রেমে পড়ে যায়। নতুন লেখকরা তো খেই হারিয়ে ফেলে এই ভেবে যে, যা-ই লেখা বের হয় তাই রবি ঠাকুর লিখে গেছেন। লোকটা আসলেই ড্যাশিং। হেন কোন বিষয় নেই যা নিয়ে তাঁর লেখা নেই। জন্ম থেকে চিতা, খাতনা থেকে বিয়ে সবখানেই তিনি আছেন। অথচ তাঁর আরেকটি পরিচয় মানুষ জানেই না। তিনিই এই বঙ্গে ’গুম’ প্রথা চালু করেছেন। বিশ্বাস হচ্ছে না? চলুন তাঁর সাক্ষাৎকারটি পড়া যাক। রবি ঠাকুরের কোন এক জন্মদিনে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সদ্য বিলুপ্ত দ্রিঘাংচুর সম্পাদক ও লেখক নূর সিদ্দিকী।
নূর সিদ্দিকী: জন্মদিনে প্রথমেই আপনার কী বলতে ইচ্ছে করছে?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : বইলতে নয় হে ভ্রাত: আমার গাইতে ইচ্ছে কইরছে- তুমি কেমন কইরে গুম করো হে গুণী, আমি অবাক হয়ে গুনি কেবল গুনি তুমি কেমন করে গুম করো হে গুণী। (রবি ঠাকুর সুরে আছন্ন হয়ে মাথা দোলাতে থাকেন ওপর নিচে)
নূর সিদ্দিকী: কিন্তু গুরু গুম নয় গান করো হে গুণী এমনটাই তো লিখেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : আরে রাখো তোমার গান। গুমকে যেইভাবে তোমরা শিল্পের পর্যায়ে নিয়া গেছো তাতে গানের কথাগুলা বদলাইয়া না দিলে অপরাধী মনে হইচ্ছিল।
নূর সিদ্দিকী: তা অবশ্য ঠিক বলেছেন। আপনার একাধিক গল্পে অপহরণ বা গুমের বিষয়টি এসেছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : ঠিক বইলেছো আমার প্রথম গল্পটায় অপহরণের মামলা আছে। অপহরণকারীরা ৫০০ মুদ্রা চাইছিল দশ বছর বয়সের অপহৃতা নায়িকা কমলদেবীর মায়ের কাছে। আমার গল্পে যা হয়, দস্যুসর্দারের পুত্র অবশ্যই প্রেমিক হবে, যেমন ‘মুসলমানীর গল্প’, এখানেও তাই। সে কমলার সঙ্গে কোনো ফশ্টিনষ্টি করে না, বিয়ের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু মহীয়সী বালিকা তা প্রত্যাখ্যান করে। বনেদি ঘরের মেয়ে কমলা ঘটনাক্রমে ভিক্ষা করতে গিয়া অপহরণের শিকার হইছিল। তার মুক্তিপণের টাকা জোগাড় করতে গিয়া শেষে নায়িকার মা-ও ভিক্ষা করতে নামে। উপর্যুপরি ভিক্ষার কারণে এই গল্পের নাম হইছে ‘ভিখারিনী’। বড়ই রোমহর্ষক গল্প। তার চেয়েও বোমবর্ষক ব্যাপার হইল গল্পটি মুদ্রণকালে আমার বয়স আছিল মাত্র ১৬ বছর ৩ মাস।
নূর সিদ্দিকী: তার মানে, বাংলা ছোটগল্পের ইতিহাস অপহরণের ইতিহাস। অপহরণ আমাদের সংস্কৃতির অংশ। তবে এখন যারা গুম বা অপহরণ করছে তারা যদি বলে রবীন্দ্রনাথ আমাদের গুরু তার কাছ থেকেই আমরা গুমের কৌশল শিখেছি। তখন তো আপনাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : আমার মতো নিরীহ মানুষের বিচার করা খুব সোজা তাই না? সাহস থাকলে তাগোর সামনে গিয়া এই কথা কন যারা আমার বিদ্যারে মোডিফাই কইরা লইছে। পারবেন? আমার জন্মদিনে তাগোর একটা ইন্টারভিউ তো দূরে থাক বাণীও চাইতে সাহস পান নাই আপনেরা।
নূর সিদ্দিকী: কিন্তু আপনিই তো অপহরণকে ছড়িয়ে দিয়েছেন গল্পের ছলে…
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : গল্পটার নাম ভিখারিনী। এইটা গরীব মানুষের গল্প। ভিক্ষুক পর্যায়ের যারা পাঠক তারা এটা পড়বে এমনটাই ভাবনায় ছিলো। আর গরীব মানুষ কাউরে গুম করছে শুনছেন? তাইলে আমার দোষ কোন জায়গায়। আমার দাঁড়ি গোফ দেইখা যে আমারে আপনেরা শফি হুজুরের লোক ভাবেন নাই তাতে আমি ধইন্য।
নূর সিদ্দিকী: আপনি বোধ হয় রেগে যাচ্ছেন। রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : হারতে হারতেই তো জীবন শেষ হয়ে গেলো। শেষতক আমার নোবেলটাও হারাইয়া গেলো।
নূর সিদ্দিকী: হারিয়ে গেলো না কি নোবেলটা আসলে গুম হয়েছে?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : গুম বইললেই কি উহা ফির্যা আইসবে? অদ্ভুত আপনার প্রশ্নের ধরণ। দ্রিঘাংচু পড়ে লোকে?
নূর সিদ্দিকী: কিছু মানুষ পড়ে নিশ্চয়ই, আপনার লেখাগুলোও যেমন চলে শত বছর পরও।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : আমার লেখার সঙ্গে দ্রিঘাংচুর লেখাকে আপনি এক পাল্লায় মাইপলেন?
নূর সিদ্দিকী: না মেপে কি করবো? কারণ আপনি নিজেই তো নিজের লেখা নিয়ে সংশয়ে ছিলেন যে ১০০ বছর পর কেউ তা পড়বে কি না। কেন আপনি লেখেন নি- আজি হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি পড়িছ বসে….?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : লিখছিলাম। কারণ তখন সংশয় আছিল মনে। এখন নাই।
নূর সিদ্দিকী: আর কোন কোন বিষয়ে আপনার সংশয় নেই একটু বলবেন?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : চুরি হওয়া নোবেলটা ফিরে পাওয়ার ব্যাপারে। কারণ আমি র্যাবের সঙ্গে ছয় কোটি টাকার একটা চুক্তি কইরালাইছি। নারায়ণগঞ্জের ঝামেলা মিটলেই র্যাব আমার নোবেলডা ফেরৎ দেবে কথা দিছে।
নূর সিদ্দিকী: সাবাশ। আপনার মেধার প্রশংসা না করে আর পারছি না। আচ্ছা আপনার সঙ্গে এই বাহিনীর নামের একটা মিল পাওয়া যায়। অনেকে এই বাহিনীকে র্যাবইন্দ্রনাথ বলে ডাকে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : দারুণ ব্যাপার। অমন একটা বাহিনীর সঙ্গে আমার নামের মিল পেয়ে সম্মানিত বোধ করছি। কিন্তু বাহিনীটার সবগুলো ইন্দ্রিয়বোধ হয় লোপ পেয়েছে। নাহলে মাত্র ছয় কোটি টাকায় নোবেল উদ্ধারে শীতলক্ষ্যায় অভিযানে নামে? নোবেল চুরির অভিযোগে সাতজনকে খুন করে মাফ পাবে না বলে ভয়ে ভীত হয়? কালো সানগ্লাস কি তাহলে কাজেই লাগছে না?
নূর সিদ্দিকী: আপনার গানগুলো নিয়ে কিছু বলুন। গানগুলো নাকি কান্নার মতো করে গাইতে হয়, সবাই গাইতেও পারে না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : রাজনীতিকদের জন্য একজন রাজনীতিকে কঠিন কইরা দিছে মনে আছে? তারও আগে আমি গায়কদের জন্য গানরে কঠিন কইরা দিছি।
নূর সিদ্দিকী: এটা কি উদ্দেশ্যমূলকভাবেই করা?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : অবশ্যই। যেমন এখন যে হারে গুম হচ্ছে তাতে ভবিষ্যত গুমকারীদের জন্য গুম করা কঠিন হয়া যাইবো।
নূর সিদ্দিকী: গুম নিয়ে কথা বলতে বোধ হয় আপনার খুব ভাল লাগে? কিন্তু আমাদের তো লজ্জা লাগে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : অপেক্ষা করুইন ক’দিন পর আর লজ্জা পাবেন না। তখন গুমের খবর না পাইলে বাচ্চারা খাইতেই চাইবে না।
নূর সিদ্দিকী: সাহিত্যের কোন শাখায় বিচরণ করে আপনি সুখ পেতেন?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : আমাকে কি শাখামৃগ ভাবছেন?
নূর সিদ্দিকী: তা কেন হবে! আপনি মহান লেখক, যুগস্রষ্টা আপনি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : ত্যালের দাম কি কইমে গেইছে?
নূর সিদ্দিকী: আপনার মেজাজটা খিটখিটে মনে হচ্ছে। কিন্তু আপনার লেখায় তো তার প্রভাব পড়েছে বলে মনে হচ্ছে না। কিভাবে সম্ভব?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : গুম খুন অপহরণ ক্রসফায়ার লোডশেডিং সাংবাদিক হত্যার বিচার না হওয়া (৪৮ঘন্টার কথা বলছি) ইন্টার্ন ডাক্তারদের লম্বা হাত দেখার যুগে জন্ম নিতে না পারলে মেজাজ তো অমন হইবেই। মন্ত্রীগোর মুখে মধুময় ভাষণ শোনার অভিজ্ঞতা থিকা বঞ্চিত হওয়াও এর জন্য দায়ী হইতে পারে। র্যাবে চাকরি না পাওয়ায় মেজাজ তিরিক্ষি হইতেই পারে আমার। র্যাবে চাকরি পাইলে কি আর কবি হইতে পারতাম না? র্যাবে কি কবি নাই?
নূর সিদ্দিকী: যাক, আপনার শৈশবের ওপরে একটা প্রশ্ন করি। আপনার স্পিড কেমন ছিলো শৈশবে?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : রবি পরিবারে যোগ দিলেই বুঝতে পারতেন। জ্বলে উঠতে উঠতে ১০টি রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনে নিতে পারবেন। প্রথম গল্পেই গুম/অপহরণ ঢুকাইয়া দিছি স্পিড বোঝো না মিয়া?
নূর সিদ্দিকী: আপনি ঠাকুর পরিবারে কেন জন্ম নিয়েছিলেন?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : ঠাকুর পরিবারটি অনেকটা অন্ধকারেই ছিল, তাই রবি হয়ে সেখানে জন্মেছিলাম। কেন চৌধুরী পরিবারে জন্মালে কি এমন সুবিধা হইতো আমার? অবশ্য তাতে আত্মীয়তা সূত্রে ছয় কোটি টাকার ভাগ পাওয়া যাইতো।
নূর সিদ্দিকী: আপনি কবিতা লিখতে গিয়ে উপন্যাস লিখে ফেলেছিলেন- শেষের কবিতার কথা বলছি আর কি, এমন ভুল করে খুব লজ্জায় পড়িছিলেন তাই না?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : সেকথা মনে করিয়া দিয়া আর লজ্জা দিয়েন না, প্লিজ। বয়স হইছিল তখন কি লিখতে গিয়া কি লিখছি তা কি আর মনে আছিল? ওই বয়েসে অনেকেই তো এক করবো বলে দুই করে বসে।
নূর সিদ্দিকী: কোন আশাটি আপনার অপূর্ণই থেকে গেছে?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : দ্রিঘাংচুর সম্পাদক হওয়ার খুব সখ আছিলো কিন্তু আমাদের সময় ইন্টারনেট কেবল ইন্টার্নী ডাক্তাররাই ব্যবহার করতো বলে সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছি। তাই তো লিখেছি সহে না যাতনা….।