যেখানে ঝরাপাতা নিজের শব্দে বন
১০
হঠাৎ কোনো আলের ধারে, শামুকের ডিমের পাশে, একাকী একটি শিমগাছ যেমন লকলক করে বেড়ে ওঠে, আলোর আঙুল ধরে উঠে যায় সুবর্ণ রোদে, বাতাসের মিহিন ছায়ায় জিরিয়ে আবার তাকিয়ে থাকে ঊর্ধ্বের দিকে যেন সূর্যের সোনালী নগর হতে এক জোড়া অশ্বের লাগাম ধরে কেউ আসবেন; যার চোখভর্তি ফুল, বেগনী আভার ব্যস্ততা। একটি উড্ডীয়মান কুড়িসমেত দুইটি পাতা, ফাঁকা মাঠ আর চরাচরের উদ্বিগ্নতায় দাঁড়িয়ে আছে ঠাঁয়। না আছে ডানার বিস্তার না উড়ে যাওয়ার ভঙ্গিমা। মাঝে মাঝে সরু নালা দিয়ে যখন দুই একটা ছেঁড়া ফুল ভেসে আসে তার মাতৃস্তব্ধতায় ছলকে ওঠে ঢেউ যেন সমুদ্রপাড়ে দাঁড়িয়ে কোনো মা তার সন্তানের ডুবে যাওয়া মুখ ভেবে অন্ধ হচ্ছে ধীরে। আবার বিস্তীর্ণ কচুরি ফুলের দিকে তাকিয়ে পুনরায় হেসে উঠছে সে। একদিন ওই আল ধরে যেতে যেতে শিশুরা তুলে নিয়ে আসে তাকে, রুয়ে দেয় নিজেদের সবচেয়ে পরিচিত জায়গায়। কলার ঢোঙল কেটে হেলে দেয় কঞ্চিতে যেন দুপুরের রোদে ঝাউরে না যায়। ঘুম ভেঙে গেলে তাকেই দেখতে যায় প্রথম। নাওয়া-খাওয়া-স্কুল আর পড়তে বসার ফাঁকে ফাঁকে মনে পড়ে শিমগাছটির কথা। আমার অবস্থাও ছিল সেই শিমগাছের মতো।
খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে হাত-মুখ ধুয়েই মক্তবে যাই। দুই হাত জড়ো করে বুকের মধ্যে ধরে রাখি কায়দা। তখনো ঘুমিয়ে আছে এ গ্রামের অধিকাংশ পুরুষেরা, বউ-ঝিয়েরা রাতের বাসন-কোসন নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে পুকুরের দিকে। কোদাল আর মেছওয়াক নিয়ে কৃষকেরা মাঠে নামে নি তখনো। দরজা খুলে দিলে ফরফর করে উড়ে যাচ্ছে কবুতর। দোকানের ঝাঁপ নামানো—বাঁশের টঙে বসে দুই একজন রেডিয়ো টিউন করছে। বেলগাছের নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় পাশেই যে জঙ্গলাকীর্ণ নালা সেখানে হন্যে হয়ে বেল খুঁজি। তারপর ভাঙা ইটের দেওয়াল টপকে মক্তবের দিকে চলে যাই।
বাড়ি থেকে উত্তরে গিয়ে তারপর পশ্চিম দিকে যে বাঁক ডানে মোড় নিয়েছে সেখানে ছিল একটা আশ্চর্য ঘর। কাঁদা আর ইটের তৈরী। সবাই বলতো এ ঘর নাকি এক রাতে মাটি ফুঁড়ে বের হয়েছে। বড়ও না আবার বেশি ছোটও না। সে বোধ’য় অনেক কালের কথা। তখন কি পরশুরামের সৈন্যরা তাদের দুর্বিনীত ঘোড়ায় হেঁটে যেত এই পথ দিয়ে! চাবুকের শব্দে অন্ধকার চিড়ে চিড়ে হাহাকার উঠতো দাওয়ায়! তখনো কি শীলা দেবী তার আত্মহত্যার জারুল ভাসিয়ে দিয়েছেন বাংলায়! মাছের পিঠে চড়ে শাহ সুলতান বলখি (রহ.) কি তখনো কি এসেছেন পুন্ড্রনগরে! কেউই জানে না সেসব! শুধু মক্তবের মেঝেতে ঢুলতে ঢুলতে আমার মনে হয়—গোকুলে, বেহুলার বাসর ঘরে যে সাপ দংশন করেছিল লখীন্দরকে সেই সাপ কি এখনো লুকিয়ে আছে ওই ঘরে? চটের ছালায় বসে আমার চোখ চলে যেত ওইদিকে। মক্তবের লম্বা ঘরে দুই পাশে বিছানো চট, মাঝখানে হাতে বেত নিয়ে ঘুরছেন হুজুর তার চোখ ফাঁকি দিয়ে আমি দেখে নিই জালালি কবুতর বসে আছে আমগাছে, সাইকেলের পেছনে বসিয়ে কে যেন তার ছোট মেয়েটিকে নিয়ে যাচ্ছে দূরে, শীতের ছোট ছোট কুয়াশায় তখন রোদের আরাম, মানুষেরা জটলা পাকিয়ে রস কিনছে। আলিফ বে তে ছে—আচ্ছা, যখন এক রাতে ঘরটা হুট করে উঠে গেল তখনো কি এই পাড়ার নাম ছিল ধরমপুর? এমন ভাবনাতেই ডুবে থাকতাম বেশি।
তখনো বগুড়া রেল স্টেশনে যাওয়া হয় নি, গোবিন্দ ভিটার পাশে দাঁড়ানো হয় নি সে অব্দি, কেবল বাতাবি লেবুর গন্ধে উন্মন হয়ে ঘুরে বেরিয়েছি সুবিলের ঈদ গা’ আর চালতার বনে, টুটুলদের দারুচিনি গাছে বাবুই পাখির ঝাঁক উড়িয়ে বেড়াই, দুধ মালাই বেচতে আসে যে লোক তার পিছে পিছে বিশ্বরোডে যাই, বড় কুমড়ায় কিসের যেন টাওয়ার দূর থেকে আমাকে ডাকে—এইসব বেড়ানোর দিনগুলিতেই কায়দা শেষ করে সিপারা নিই আরও কিছুদিন পরে কুরআন শরিফ। যেদিন প্রথম কুরআন পড়তে দেন হুজুর কী যে আনন্দ হয়েছিল! মা সুন্দর একটা গিলাফ বানিয়ে দিয়েছিল, আব্বু বাতাসা আর মুড়কি নিয়ে এসেছিল, সেসব নিয়ে মক্তবে যাই আমি। সেদিন সকালের রোদ আর দুধেল বাতাস যেন আকন্দ ফুলের মতো শাদা। আমার ছায়া ভাঙলেই যেন গলগল করে বেরিয়ে আসবে তরু-ক্ষীর, অশ্রুত ধর্ম-সঙ্গীতের মায়া।
ধরমপুরে, মাঝে মাঝে নানী আসতো। পাকা ডেউয়া, তেঁতুল, আম, বড়ই এসব নিয়ে। ডেউয়া খুব প্রিয় ছিল আমার। খসখসে গা, কাঁঠালের রোয়ার মতো ছোট ছোট কোয়া, চাবিও থাকে তাতে। স্বচ্ছ হলুদ ওই ফল অনির্বচনীয় স্বাদের। কণা খালাও আসতো। কণা আমার সবচেয়ে ছোট খালা। খালারা সবাই আদর করতো আমাকে—বিলকিস খালা, বেলা খালা। মোমতুল পাখির মতো ছিল আমার খালারা। খালা-খালু আসলেই হৈ হৈ আনন্দ হতো, পড়তে বসতাম না তখন। শুধু রূপকথার গল্প আর তালতলার নানান উপকথায় কেটে যেতো সময়। রেক্সোনা আপা ছিল ভীষণ মায়াবী, ঠিক শিউলি ফুপুর মেয়ে শিলু আপার মতো। খালু আসলে গোল গোল সল্টেড বিস্কুট নিয়ে আসতো, আমরা বলতাম সল্টেস বিস্কুট। পানিতে চুবিয়ে চুবিয়ে খেতাম। খালুর ছিল একটা অষ্টধাতুর আঙটি, বেশ কয়েকটা পার্ট ছিল, এলোমেলো করে আবার সাজানো যেতো, একটা পান-পাতার মতো ছিল মধ্যিখানে।
সেবার অনেক দিন মাকে আর আগের মতো করে পাই না। নানীই তখন প্রায় সব কাজ করে। বাইরে থেকে দৌড়ে এসেই মাকে জাপটে ধরি, মা নাকি অসুস্থ। আমার কেবল মা’র ঘ্রাণ মাখতে ইচ্ছা করে। মাটি দিয়ে বানানো টিভি-ক্যাসেট নিয়ে বারান্দায় খেলতে বসি। মাঝে মাঝে আব্বুর স্টেথোস্কোপ দিয়ে পরীক্ষা করি মাকে। কিছুই বুঝতে পারি না। আগে যখন ঘুম থেকে উঠে মাকে খুঁজে না পেলে কাঁদতাম খুব তেমন কান্না পায় আমার। বুঝতাম না কী হয়েছে মা’র! সবাই শুধু বলতো মা’র অসুখ। সোহাগদের অর্জুন গাছের নিচে বসে দূরের অয়নপথের দিকে তাকাই, অন্ধকার ঘন হলে পাখিরা উড়ে আসে কামরাঙাসন্ধ্যার ভেতর, হাঁসেরা কলকল করে বাড়ি ফেরে তাদের বাচ্চাকে সাথে নিয়ে, পালকে ঠোঁট ঢুকিয়ে আদর করতে থাকে। আমার শুধু মনে হয়, মা কি মরে যাচ্ছে! আমাকে আর আগের মতন আদর করে না কেন! নামাজ পড়ে কুরআন তেলাওয়াত করে আল্লাহকে বলতাম—আমার মাকে ভালো করে দাও আল্লাহ। তখন কেমন যেন অনাহুত মনে হয় নিজেকে। এই সময়ে শিশুদের মনোস্ক্রিয়ায় বিপুল জটিলতা দেখা দেয়। সে তার অনেক দিনের অভ্যস্ত জগতে ঢুঁ মেরে দেখে, সবই কেমন এলোমেলো—বাবা তো আগে থেকেই বিচ্ছিন্ন, তার দায়িত্বপালনের ফাঁকে যেটুকু আদর সেও অপ্রতুল লাগে শিশুদের কাছে, গ্রামীণ জীবনে এ এক অবধারিত গল্প। শিশু তার মাকেই সেই নাড়িকাটার দিন থেকে জেনে আসে—সে মূলত মায়েরই আরেকটা অংশ, মা’র অন্য প্রত্যঙ্গের মতো শিশু নিজেও একটি প্রত্যঙ্গ। তাই তার ব্যথায় মা যেভাবে সাড়া দেয় বাবা তেমনটা পারে না। কিন্তু যখন সে বুঝতে পারে এই স্নেহগুল্মের ছায়ায় সে আর ছোট পাখিটি নয়, কোথাও অন্য পাখির অপেক্ষাতেও বসে আছে মা তখন তার মনে হয়—কূট অন্ধকারে একাকী দীঘির পাশে বসে আছে সে, চারদিক গাছও তারা পাতা গুঁটিয়ে চলে যাচ্ছে, যে চাঁদ জোছনা ঢেলে জোনাকির শরীর হয়ে উড়ে বেড়াত গাছে গাছে সেও কৃষ্ণপক্ষের পথে এগিয়ে দিয়েছে সফর। তখন সূর্য চুমুক দিয়ে উঠিয়ে নিয়েছে ঝিকিমিকি সমস্ত প্রজাপতির পাখা থেকে। সে শুধু স্নেহের হাহাকারে উতলা হয়। ভাবে, মা একদিন আগের মতই ডাক দেবে। তবুও এইসব একলাপনা কিছুতেই ছাড়ে না তাকে।
এমন সন্তাপের দিনেই স্বপ্না আপা দৌড়ে এসে খবর দেয়—’এই বিপু, তোর না একটা বোন হোছে, কী সুন্দর!’ সেদিনের কথা মনে পড়লে আমি কেবল আমার বোনকে ‘সুবর্ণাভ প্রজাপতির পাখাই’ বলতে পারি। কয়েকদিন মা’র ঘরে ঢুকতে পারি নি। দরোজার ফুটা দিয়ে বারবার দেখতে চাইতাম ওকে। পিটপিট করে তাকিয়ে আছে আমার বোন। গোধূলিস্নানের দেশ থেকে হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে এসেছে আমাদের হৃদপিণ্ডের পাখি। যেন ভেজা এক দ্রাক্ষাবনের কোকিল। আমি নাকি মাকে বলতাম ওকে কোথাও বিয়ে দেবে না। ও সারা জীবন আমাদের কাছেই থাকবে। ভাইয়ের সঙ্গেই বেশি মিল ছিল ওর। সারাদিন কোলে কোলে রাখতো বোনকে।
আমাদের ছোট্ট সেই ডালিম ফুলের দিনে যখন সকালের রোদ পড়তো বাবলা গাছের বাতাস এসে সে রোদ উড়িয়ে নিয়ে যেত দূরে। দোলনার ঝুমঝুমি বেজে উঠলে পৃথিবীর সমস্ত চারুপথ রিনরিন করতো মায়ায়। তখন পিতরাজবনের হাওয়ায় অন্ধ হাঁসেদের ডাকাডাকি নীল থেকে ক্রমনীল হয়ে মিশে যায় বহুদূর।
এখানে দরজাগুলো বোনের আলতা হয়ে লেগে থাকে কাঠে।