মোস্তফা হামেদীর ঋতুদের রঙিলা পাখনার গান | জহির হাসান

১.
মোস্তফা হামেদীর সহিত ব্যক্তিগতভাবে চিন-পরিচয় ২ দশকের কাছাকাছি। অনেক বিকাল-সন্ধ্যা আমরা এক লগে কাটাইছি। ফলে ওর সাহিত্যমানসটা কেন জানি কিছুটা বুঝি। আমার জীবন ও শিল্প, চিন্তা-ভাবনা প্রায়ই ওর সাথে শেয়ার করতাম। হামেদীও শেয়ার করছে। ওকে প্রায়ই কইতাম, হামেদী এই যে আমি যে ভাবধারায় কবিতা লিখতেছি যেইখানে কওয়া যায় একটা গ্রামীণ প্রাকৃতিক আবহ বিরাজ করে আমার কবিতার শরীরে। এইগুলা কী মানুষ আখেরে নিবে! ও কইত, নিবে, আমরা অনেকে যদি জোট বান্ধি তাইলে মানুষের নজরে আসবোই একদিন!
আর সান্ত্বনার জায়গা এই যে, এতদিনে বহু কবি এই এই ধারার সিলসিলায় যোগ হই ইহার দৈর্ঘ লাম্বা হইছে। মনের ভিতর কে যেন কহে, একা নহ তুমি। তোমারও আগু ও পিছু আছে। তুমিই এই গাঙে একা নৌকা বাইতেছ না! আমাদের কবিতার ভাববস্তু কী হইবে সে-বিষয়ে এইরূপ একটা আশাবাদ আমাদের ভিতর কাজ করতো। ওর সহিত আমার শৈশব ও কৈশোরের লগে কোথায় যেন একটা মিল আছে। আমার ছোটবেলাটা যেহেতু গ্রামে কাটছে সেহেতু তা আমার বুক পকেটে সদা জোনাকির মতো চমকায় । প্রান্তিকতার প্রতি একটা চির টান একটা ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ভিতর ঘরে পক্ষপাতদুষ্ট হয় সেইখানে অফুরন্ত হইক ওড়ে, ফুল-নদী, গাছ, মাঠঘাট, কাদামাটি, জলহাওয়া, আকাশ ও নক্ষত্রের অফুরন্ত ইশারার কমতি নাই। এক কথায় প্রকৃতি, মানুষ ও সমাজ ছানিয়া লীলা ও রহস্যঘোরে এক জীবনরে দু’জীবন বানাইয়া জড়াই-প্যাঁচাই পার করতে করতে হইতেছে! আমার ত্রিশ/চল্লিশ বছরের সাহিত্যজীবনে প্রকৃতি, মানুষ ও সমাজের পরিপ্রেক্ষিতটার একটা আবহ ঘোর হিসাবে রই গেছে। কেন জানি এর বাইরে নিরেট খটখটা আরবান একটা মানসরে সেই অর্থে আপন করি নিজঘরে লালন করতে পারি নাই! আরবান ঘরখানাতেও যেন বিশ্বাস হয় না!

হামেদীর ক্ষেত্রেও গ্রামীণ জীবন ও পরিমন্ডল ওর ভিতর এক অপার টান ও ঘোর তৈয়ার করছে। তা আজ ওর ’ঋতুরহস্যের ধারে’ নামীয় কবিতার বইখানা নিয়া আলাপ পাড়তে গেলে তা বাহির হই পড়বেনে, তাই এই যৌথ ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ না টানি পারলাম না! এইখানে বিস্তাারিত আলাপের সুযোগ নাই। আমি শুধু ওর এই বইয়ের কবিতার মাত্র কিছু দিক নিয়া এইখানে মোটাদাগে আলাপ তুলিব।

২.
ঋতুরহস্যের ধারে কবিতার বই হিসাবে হামেদীর ৫ম বই। বইখান ২০২২ সালের বইমেলায় ঐতিহ্য প্রকাশনী বাহির করছে। এই বইয়ে ৬খান লাম্বা কবিতা আছে। কবিতাগুলির নাম হইল: ঋতুরহস্যের ধারে, বিচ্ছুরিত লাল, গ্রহফুল, চাঁদোয়ার নিচে, হাওয়ার খাঁজে খাঁজে, মায়া-মীন। বইটার পাতা সংখ্যা ৪৮। গড়ে প্রতিটি কবিতা ষাড়ে ছয় পাতায় গিয়া দাঁড়ায়। ছোট কবিতা থাকি কবিরা কেন দীর্ঘ কবিতা লিখেন? কখন তিনি আর কবিতারে ছোট রাখতে পারতেছেন না! কখন কবিতা নিজেই নিজের কথা কই ফেলার লাগি উদ্যত হয়! বড় কবিতায় ছোট কবিতার চাইতে মন-মতি অতিরিক্ত হৃদয়ের আকুতি ও আখ্যান, ভাব ও বিলয়, লঘু ভাব ছাইড়া ঘনত্ব ও বহুমাত্রিকতার ভিতর উত্তরণ যেইরূপ ছোটগল্পের ছোট প্রাণ ঝাপাইয়া প্রজ্ঞার-আবেগের বহুরঙ ধারণ করি ডিটেইলে বড় গল্প হই ওঠে। বড় কবিতা যেন ধারাবাহিক এক উৎপাদন, অনেক নদীর মিলন যেন সমুদ্র-দ্যোতনায় কথা কয় উচ্ছ্বাসে গৌরবে, সে যেন একের ভিতর বহুর সাঁতরানোর আয়োজন। আমি সেই নিরিখেই ঋতুরহস্যের ধারে বইখানির কবিতাগুলিনরে ধরতে চাই। এইখানে তার বিচার বসাইবো না, সমালোচনা করিব না। শুধু এই কবিতায় চূর্ণ জীবনের অনুভব-বোধ জীবন ও প্রকৃতির আশ্রয়ে বড় একটা বোধের বিড়ম্বনা তৈয়ার করি মগ্নতা অতিক্রম করি সমর্পণ পর্যায়ে নিতে পারছে হামেদী । সেই চিহ্ন পাঠই বড় কবিতাগুলির আমি হই উঠে বড় আমিতে পৌঁছার অমর প্রলোভন বটে।

প্রকাশক : ঐতিহ্য

৩.
ঋতুর একটা অভেদ গোপন রহস্য আছে। তার অধীন কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ পটভূমিতে পোষ্য দৃশ্য, মাঠ, পুকুর, দিনরাত, ঝিঁঝিঁ পোকা, রূপ-বিভা, বনবীথিকা এক কথায় আমাদের জীবনসংহিতার নিচে কোথায় যেন চাবিকাঠি ঘুরাইতেছে ঋতু আর ঋতুর চিহ্ন ধারণ করার লাগি উদ্রগ্রীব প্রকৃতি ঋতুর অধীন চরকির মতো ঘুরতেছে। তাই গভীরে তার একটা ঘূর্ণি আসি লাগতেছে জীব, জড়-জীবনের চাকায়, মনের স্রোতে, রঙে, সুরে, ঘ্রাণে, গানে, রূপে প্রকাশ ঘোষণা পাইতেছে। আর এতসব ঋতুর গোপন ও প্রকাশ্য আয়োজনের বিপরীতে, অপরাজনীতি সামাজিক অবক্ষয় শত শত রাষ্ট্রীয় উদ্যাগের বিপরীতে, তলে তলে এসব প্রকৃতির খেলা কিন্তু বন্ধ ন রয়। প্রকৃতির ওপর সমাজ ও মানুষের ক্রমাগত মানবিকরণের দায়ে সৃষ্ট ক্ষতগুলি এই কবিতায় তেমন আসে নাই্। এই কাব্য-প্রেক্ষাপট অতীতায়ন বটে। ফলে তা রোমান্টিক আবহের বটে। তাই বলে তা নিছক কল্পনার সেই প্রকৃতি নহ। কিংবা পৃথিবীর যেই অংশে মানুষ ও প্রকৃতি যুদ্ধে লিপ্ত হয় নাই, মানুষ ও প্রকৃতি মায়া-স্নেহে আজ দিবালোকে প্রেম করে সেই জগৎসভার স্থানিকমাত্রার আবাহন এই কবিতাগুলিতে আছে। ফলে এইখানকার বয়ানে প্রকৃতি মানবসৃষ্ট ঝঞ্ঝাটের তোয়াক্কা করে না। তার কাজ সে করিই যাইতেছে সে সদা বাঙ্ময়তা ও রঙিলা আকাঙক্ষায় অভিভূত। সময় কয়ে যারে মনে লই সে তো এই ঋতুর গোপনতারে সামনে আনে না। ক্ন্তিু আমাদের চোখের আড়ালে রাখতে পারে না একেবারে। প্রকৃতির নিজের যে একটা নিভৃত যাপন থাকে তা কবির কাছে ধরা দেয়। কবির ঋতুর জালে ধরা জগৎকে আমাদের সামনে হাজির করে। ফাঁস করে তলে তলে যে অনেক কিছুর ঘটনপটিয়সী ঐ ঋতু । হামেদীর চশমার লেন্সে কিংবা দূরবীনে ধরা পড়ে প্রকৃতির ছোট-বড় বহু দৈনন্দিন লেনদেন। কিংবা ধরা পড়ে নিভৃত আড়ালে ঘটার ঘটনাগুলি ওর ‘ঋতু রহস্যের ধারে’ কবিতায়। ৫/৭টা উদাহরণ জড়ো করলে বুজা যাইবেক। যেমন,

ক)

মেঘের সাথে রঙের দেখা
তটরেখা ধরে ফুল হলুদ হলুদ !
রেণু উড়তেছে হাওয়ায়
যে জুনিপোকারা ওড়ে মাঠে, ঘুরে ঘুরে
রাতের গূঢ় শরীরে বুনে দেয় আলো

খ)

ঝিঁঝি গুঞ্জরন
অবনতপর ঘর
গুলগুলি বেয়ে চুয়ে পড়ে রোদ
সে কোনো সুবোধ সুকুমার মেয়ে,
খসা ঘোমটায় ঘরনি
ঘেমে ঘেমে ঝাড় দেয় তুলার তোশক
পুরান আলমারি,
চিনা ক্রোকারিজ ধুয়ে সাফ করে
রাখে তাকে।

গ)

ঘোরানো পথের ’পরে নিকেল গলিত
তেরচা হয়ে থাকা আলো,

ঘ)

যেন মহাপথ ছিঁড়ে ছুটে আসা দূর
ছোট ছোট শ্বাসে ঘুম যায়
এত হালকা আওয়াজ
মৃদু রিনিঝিনি
সাজসজ্জাহীন সরণি;

ঙ)

এ ভরা ভোরের রূপ এসেছে গাভীর
বাঁট বেয়ে
এসেছে ফুলের ঘ্রাণে নেয়ে
বনবীথিকার নিচে
আশ্চর্য সূর্যোদয়ের পিছে
কেউ যেন পিচকারিতে ছিটিয়ে দিয়েছে
কাঁচিচা হলুদের রঙ;

চ)

ওপারে পরম জমি, মাঝখানে খাল,
আয়ুর নরম ব্রিজ
লোকে পার হয় দুলে নিজ নিজ সীমা; ইত্যাদি ইত্যাদি।

৪.
‘মায়া-মীন’ ১ খানা সিরিজ কবিতা বা ৮ খানা ক্ষুদে কবিতার আসর। এইখানে হামেদী দম নিছেন একটু । কবিতাগুলিতে প্রচলিত ছন্দ, অন্ত্যমিল, শব্দ ও ধ্বনির অতিরিক্ত তরঙ্গ তুলি আমাদের আনন্দ দেয়। কবিতাচর্চায় বৈচিত্র অনুসন্ধান ভালো। অনুসন্ধানী কবিরা করেন এই কাজগুলি। নানা মাত্রায় নানা দিক দিয়া কবিতার তল বাড়াই থাকেন। একতারা অপেক্ষা যে বীণা কখনো কখনো ভালো তা তারের সংখ্যার মধ্যে সুরের ঐক্য তোলার ক্ষেমতার উপর নির্ভর করে। আর অনেক কবিই আছেন নানা তারে বাজানোর খাসিলত রপ্ত করেন। এ কবিতাখানায় ‘মীন’ এক কেন্দ্রীয় ভাবনামূলক রূপক। এই রূপকের তলে যে অধরা মানস-সুন্দরী লুকায় আছে নানা রঙ-তামাশায় তা আর কইতে বাকি না রহে! ঐতিহাসিকভাবে চন্ডীদাস রামীর অন্বেষায় ছিপ ফালাই মীন ধরার অপেক্ষার কথা আমরা তো এইখানে স্মরণ করতেই পারি। হামেদীও স্মরণ করছে।

’এই তো এই তো বার সন গেল/
আমার লগেতে বড়ু রামীরে পাইল’।

লোকজ মোটিফ হামেদী তাজা করি খাড়া রাখছেন ওর কবিতায়। এই একটা খুশ খবর বটে। এই কবিতাখানা দু-চার কথায়: গঠনে লিরিক্যাল, সমিল, পয়ার, স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্ত ছন্দের আশ্রয়ে লালিতপালিত তৎসহ জনমানসের কল্পনা, নৈমিত্তিক কথ্য-শব্দের যথাস্থানে আটকানো বাক্যে বাক্যে, অনির্বচনীয় দৃশ্য নির্মাণে মনোযোগী, ইমেজ সৃষ্টিতে চিত্রশিল্পীর মতোই যত্মশীল। একটা উদাহরণ তালাশ করতে পারি আমরা।

‘ডালিম-আনার পাকছে টিলায়
নদীর ওপরে প্রলেপ সরের,
হরেক রতন সাধনে মিলায়
দরজা মেলরে পুবের ঘরের।’

৫.
‘হাওয়ার খাঁজে খাঁজে’ কবিতাখানি গদ্য ফরমে লিখা একটি কবিতা। হাওয়ার অনেক অনেক কান্ডকীর্তন শিশুর মন নিয়া এই কবিতায় ধরা হইছে। হাওয়ার কাজ কী, কিছুকে ছড়ায়ে দেয়া, স্থির কিছুতে স্পন্দন তোলা, নিজে ঘুরপাক খাওয়া, আরও অগুনতি কান্ডকীর্তন! এই কবিতায় হাওয়া- কান্ড বসবাস গ্রামগঞ্জের প্রকৃতির ভিতরই সীমায়িত করছে। তাই সে ঘুরপাক খায় সেইখানে আর দেখায়ে দেয় কত না দৃশ্য মানুষদের জড়াইয়া প্যাঁচাইয়া সেলাই করি। আমাদের কবির সেসব দৃশ্যের লগে পরিচয় হওয়ায় নিজ চোখে আমাদের সকাশে চিনায়ে দিছেন এই কবিতায়। বিস্তারিত রসরাজি পাইতে কবিতা পাঠের বিকল্প নাই। এইখানে কিছু কিছু উদ্ধৃতি হাজির করাই সঙ্গত।
’হাওয়ার খাঁজে খাঁজে’ কবিতাখানির শুরু হইছে এইভাবে যে,

‘কোথাও হাওয়া ঘুরপাক খেয়ে খেয়ে মিইয়ে যাচ্ছে অভ্র গোলকের
ভেতর। পানিকে উড়িয়ে নিচ্ছে মেঘের গর্ভে। সন্তরণকে সহজ করে
দিয়ে পৌঁছে যায় ভূমণ্ডলের একেবারে নিকটে। পাতার নিবিড়
সমাজের ভেতর যোগাযোগক্ষম সে। আর শস্যের কাাঁদি ধরে বার্তা
প্রেরকের ভুমিকায় অবতীর্ণ।’

আমরা জানি ঋতুর অনুঘটক হিসাবে প্রকৃতিতে হাওয়া আমাদের ঘরজামাই। তার সদা উপস্থিতিতে কত কিছুই আমাদের গোচর ও অগোচরে ঘটে আর ঘটতেই থাকে। কবি এই কবিতায় হাওয়ার নানারূপ রসময় কান্ডকারখানা তুলি ধরছেন নানা পটভূমিতে। এইখানে প্রকৃতির সাথে কবির সরল একটা মনের খেলা ধরা পড়ে। আগেই বলছি কবিতাখানা টানাগদ্যে লিখা। এইটা ভাষার ভিতর ভাসার মাধ্যমে একটা কবিতার পরিসরকে বাড়ায়ে তোলা। কবিতার ভাষার সীমানা বাড়ানোর জন্য নানারূপ দায়িত্ব রহিয়াছে কবির, তা হামেদী এইখানে এই কবিতায় তার চাগান দিছেন। তো এই হাওয়াঘটিত আরও কিছু কান্ড হাজির করতে পারি পাঠকের সামনে। আসলে উদাহরণ দেওয়ার কারণ হইল, আরসব পাঠকও যেন বইটার কবিতাগুলিনের গুরুত্বপূর্ণ এ রকম কিছু কিছু মনে রাখার মতো পঙক্তিগুলিন মিস না করে।

ক) আর বিমূঢ় কোনো পাকুড়ের পাশে ছোট ছোট ইচ্ছাগুলি উড়ে বেড়াচ্ছে।

খ) শরীর ঘষে ঘষে তাপ নেয় । বাসনাগুলিকে রাঙায় শস্যের কাঁদিতে।

গ) শস্যের পরিণত ঘ্রাণে গ্রামগুলি ম-ম করে। পাতারা ঝুঁকে থাকে পাতার দিকে।

ঘ) কাঁচা ঘ্রাণ তটস্থ রাখে বাছুরগুলিকে।

ঙ) কৃষিজমির এ প্রান্তটা সরস। কালিজিরা ধানের ঘ্রাণে ভরে যেত অন্তস্থল।

চ) গ্রামধোয়া আলোয় ঝাঁপিয়ে পড়ছে দুপুর।

অবহেলায় আমাদের ঘরের আনাচে কানাচে ফুটি নীরবতার সম্মান বৃদ্ধি করতেছে আমাদের মনের এমন সব অনেক দৃশ্য শিকার করছে আমাদের হামেদী এই কবিতাতে। যেমন,

‘অপরাহ্ন ফুরিয়ে এল
ঘাসে ঘাসে বিচ্ছুরিত লাল।
সওদা কখনো শেষ হয় না,
দুনিয়া এক আচানক বাজার
দাঁড়িয়ে আছি পাবন্দ হয়ে
বটের ঝুরির নিচে;
বহু বিস্রস্ত পথ
এখানে মিলিত হলো।’

কিংবা,

‘আসমানের নিচে
তারা ফেরি করছে মিটিমিটি আলো,
শাদা পাগড়ির পবন’

অথবা,

‘অরণ্যের শীর্ষ ঘেঁষে
যেন কোনো আচানক বিমান
কাঁকিলা মাছের মতো লেজে
রাতের রুহের দিকে
ধীরে দেবে যায়।’ ইত্যাদি।

‘গ্রহফুল’ কবিতাখানিও একখানা লাম্বা কবিতা। কবিতাটি শাহ আব্দুল করিমের ‘কোথা হতে আসে নৌকা’ গানখানির উদ্ধৃতির মারফত হামেদী পাঠকরে সবার আগে স্মরণে আনার অনুরোধ রাখতেছে। এই কবিতায় নানা ছোট জিনিসের সাথে পাঠকের পরিচয় ঘটবে। পাঠক দেখতে পাবেন চিতল মাছের মতো পিঠ, চরের তরমুজখেত, বাঙ্গি ভুট্টার আবাদ, নাইওরের থই থই পথ, জঙ্গলার বায়ু, বাঁশ বেতের বন, সোনারঙ কড়াইয়ের ডাল, গুল্মের বন, মাফিয়া পবন, জাহাজ মজুর, শ্যাওলা ও শিশির, টলটলে নক্ষত্র, শুশুকের ভুশ ভাসা, ছইয়ের ভিতর ছানা কইতর, গভীর রাত, ছলাৎ ছলাৎ জলের শব্দ ইত্যাদি। কবিতার ভিতর এইসব বিশেষের আয়োজনরে নির্বিশেষ করা যায়, তার নন্দনতাত্ত্বিক মায়াময় চিতলে চিলতে ইমেজ পাওন যায়। যেইগুলারে গ্রহের ফুল কইতে অসুবিধা নাই।

‘চাঁদোয়ার নিচে’ কবিতার নামকরণ দেখিই বুঝা যাইতেছে রাতের ঘটনার ডালপালা বিস্তারিত হইবে এই কবিতায়। রাতের প্রকৃতিতে পাখি, চাঁদ, প্রাণিদল যেন রাতের মনুষ্যসমাজের যে প্রস্তুতি পরের দিন জাগি উঠার তার সহিত এক গোপন যোগাযোগ রাখতেছে। মোটকথা প্রকৃতি-মানুষ এই প্রত্যয় এই সম্পর্ক তুচ্ছ ন বরং গুরুতর নীরবে ও সরবে। মানুষ-প্রকৃতির প্রেম হৈতুকী ও নিহেতু প্রেমের নির্ভেজাল মিথষ্ক্রিয়া সম্পর্কগুলি পষ্ট করি তুলছে কবি এই কবিতায়। তাই শ্বেত-কাঞ্চনের নীরব নিহেতু কাজ-কাম আমরা দেখি এই রাতের প্রহর- ‘কলহ শেষে কেউ নত হয়/নিজের ভেতর/ পড়ে পাওয়া আধুলি মিলায়/আর যত শ্বেতকাঞ্চন/ফুটেছিল অজ্ঞাতে/ফুলের কুশনে শুয়ে/ঘ্রাণ নেয়/ সেসব মৌন প্রেমিকার।

রাতের সর্দার চাঁদ/নজর রাখছে/সমূহ ধ্বনি ও বস্তুপুঞ্জের ওপর; /কীভাবে তারা সমর্পণ করছে/ সীমার কাছে।’ রাতে প্রকৃতির ভিতর পৃথিবীর নানা বিশেষ ও সামান্যের ব্যঞ্জনা তৈয়ারকারীর গতায়ত খেয়ালে আসে হামেদীর ‘চাদোয়ার নিচে’ কবিতাখানি পড়লে। বুজা যায়, তার সূক্ষ্ণ দৃষ্টি অনেক আনুবীক্ষণিক জিনিস এড়ায়ে যায় নাই।

‘চাপা ফুটছে তখন বাগানে/ফুটফুটে পুষ্পের নিচে/কারা গায়/মাহুতের গান/যেন কারাবৃক্ষের পাশে /আতর দোকান,/ এসরাজের মোকাম।’
কিংবা ‘অনন্ত বাঁশপথে/ যাদের পিছমোড়া করে বেঁধে নিয়ে গেল/আশ্বিনে/বাতাসের ঝাপটায়/জানালা মুদে যায়/বনের ভেতর খঞ্জর ছোটে/আর সিসার ঘ্রাণ/মাটি ভিজিয়ে চলেছে। কিংবা ‘কবরখোলা থেকে ভেসে আসে/ঝুরঝুর মাটির ঘ্রাণ।/আবছা দেখা যায়/পোঁতা বরইয়ের ডাল/কাঁচা কারো প্রস্থানের স্মৃতি।’ এরকম অনেকানেক দৃশ্য, খন্ড দৃশ্য, ইমেজ যেন কবি নোট নিয়া রাখতেছেন, দেখতেছেন, ঘ্রাণ নিতেছেন, ইন্দ্রিয়ময় করি তোলার আয়োজন করতেছেন অটো, এই কবিতায়। এইখানে শুধু কিছু ইশারা দেয়া হইল মাত্র হামেদীর কাব্যকৃতকৌশলের।

৭.
প্রকৃতি রসিক খুব বেশি কবি আমরা পাই না। না রাষ্ট্র না ব্যক্তি। অল্প কিছু দায়িত্বশীল মানুষ প্রাণ ও প্রকৃতির ভান্ডারের প্রতি পুরানো পৃথিবীর লাগি হাহাকার তোলে। সভ্যতার বিস্তারে নগর এক বড় অনুঘটক। সভ্যতা ও প্রকৃতির পারস্পারিক সংরক্ষণের একটা মূলমন্ত্র থাকা দরকার আছিল। রেনেসাঁর বিস্তারের ভিতর তা আজ হারাই গেছে। তাই আজ দেখি যুগে যুগে দেশে দেশে শিল্পায়ন মানেই প্রকৃতি ও জীবের উপর চাপ বৃদ্ধি। সভ্যতা/প্রকৃতি যেন বাইনারি হই উঠছে আজিকার গোলকায়নের যুগে। পণ্য বেচাকেনার সুবিধা দেয়ানেয়ার বুজের ভিতর রাষ্ট্রীয় সফলতার ভিতর দিয়া জীবন ও প্রকৃতি যেন লুপ্ত হই উঠতেছে। কবিরাই ব্যবসাযুগের আগে জীবন আর প্রকৃতির প্রতি সংবেদনশীল। সেই সংবেদনশীলতার নানা মাত্রা আছে-নানা ভাব আছে। আধুনিক নাগরিক কবি প্রকৃতির সংরাগগুলি কবিতায় মিস করে। যে কবি ফেলি আসছে প্রকৃতি চুবানো জীবন তার কাছে প্রকৃতি হারানো সহোদরার মতো। সেই ফেলি আসা সহোদরার প্রতি কবির প্রবল আকুতি যেন অগোচরে থাকা কোনো নামকরা সংকলন হইতে বাদপড়া কবি ও কবিতার মতো। আমরা কেবলি হারাই। হারাই প্রকৃতি। হারাই আপনজন। হারাই মায়ার জগত। হারাই মানুষ ও মহাজগৎ।

হয়ত সকল জাতকবিরই প্রকৃতি-অনুরাগ থাকে। তারা অন্তর-প্রকৃতি আর বহিঃপ্রকৃতির সংযোগ ঘটায়ে একটা শান্ত স্বভাবের স্পিরিচুয়াল একত্বময় দশায় ধ্যান ধরতে চায় ভাষার ভিতর। কবিতার ভিতর সেই আকাঙক্ষা প্রচার করতে আসে। সেই আনন্দধাম কবিতা যেন এক ঘর কবির। সেই ঘর একান্ত। যেন এক জেন সাধুর বাগান আর আকাশ।

প্রকৃতির সাথে কবির আত্মা সেলাই করা নানা অর্থে নানা মাজেজায়, কৃতজ্ঞতায়। এই উপলব্ধি জাগায়ে রাখে হামেদীর কবিতা।


ঋতুরহস্যের ধারে

প্রচ্ছদশিল্পী : রাজীব দত্ত

প্রকাশকাল : বইমেলা ২০২২

প্রকাশক : ঐতিহ্য

শেয়ার