‘আমার জন্ম একটি শরণার্থীশিবিরে। কারণ, আমার মা-বাবা উদ্বাস্তু হয়ে ওই শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তবে এখন আমরা নিজ বাড়িতে থাকলেও সেটি যেন একটি কারাগার। কোনো জানালা নেই, দরজা নেই, কেবল অনাহূত অতিথির মতো আছে বোমার ধোঁয়া। এখানে ধ্বংসস্তূপের নিচে কাঁদছে মানবতা!’
গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিধ্বস্ত ফিলিস্তিনি উপত্যকাটি নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমসে এভাবেই লিখেছিলেন মোসাব আবু তোহা। শহরটির অবর্ণনীয় পরিস্থিতি নিয়ে গাজা থেকে ক্রমাগত লিখে গেছেন তিনি। তাঁর আশপাশে ইসরায়েলি বোমা হামলার বর্ণনা দিয়ে বিভিন্ন লেখায় ফুটে উঠেছিল তাঁর আর্তনাদ,‘আমিও কি তাহলে খবরের বর্ণনার সংখ্যা হয়ে যাব?’
মাহমুদ দারবিশ, গাসান কানাফানি থেকে শুরু করে হেবা আবু নাদা, মোসাব আবু তোহা—যুগে যুগে ফিলিস্তিনি কবিরা কবিতা ও ভাষা দিয়ে লড়ে গেছেন। মাহমুদ দারবিশকে গৃহবন্দী বরণ করতে হয় বছরের পর বছর, কানাফানিকে গুপ্তহত্যার শিকার হতে হয়। গত ২০ অক্টোবর গাজায় বিমান হামলা চালিয়ে হেবা আবু নাদার কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়। এরদিন কয়েক আগেই এই নারী কবি ও ঔপন্যাসিক লিখেছিলেন, ‘রকেটের আলো ছাড়া গাজা অন্ধকার, বোমার শব্দ ছাড়া গাজা নীরব, প্রার্থনা ছাড়া আর সবকিছুই ভয়ংকর, শহীদের আলো ছাড়া সবকিছুই কালো। শুভরাত্রি, গাজা!’
হেবা নিহত হওয়ার ঠিক এক মাস পর ২০ নভেম্বর আরেক কবি মোসাব আবু তোহাকে আটক করে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। দ্য গার্ডিয়ান, সিএনএন, নিউইয়র্কার এ খবর দেয়। পরিবার নিয়ে তিনি তখন গাজার উত্তর থেকে দক্ষিণে ছুটছিলেন। যেদিন গ্রেফতার হওয়ার খবর হলেন, সেদিনও নিউইয়র্কার তাঁর একটা লেখা ছাপিয়েছে এই শিরোনামে—‘দ্য ভিউ ফ্রম মাই উইনডো ইন গাজা’: কাগজে লিখে ইসরায়েলি সতর্কবাতা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে আকাশে। ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে। কারণ যেকোনো সময় বোমা হামলা হতে পারে। মা–বাবা, ভাইবোন, স্ত্রী–সন্তান নিয়ে বের হয়ে যান শরণার্থীশিবিরের উদ্দেশেই। বাইসাইকেল ঘুরিয়ে আবারও ঝুঁকি নিয়ে ফিরে আসেন কবি। ইসরায়েলি হামলা শুরু হওয়ার দুইদিন আগে পরিবারের জন্য কিছু রুটি কেনা হয়েছিল, সেগুলো নিতে। বাইসাইকেলে সেই ঘর ছাড়া আর ঘরে ফেরার বেদনাদায়ক দৃশ্যকাব্যময় বণর্না নিয়েই ছিল তাঁর এ লেখা।
প্রথম কাব্যগ্রন্থের জন্য প্যালেস্টাইন বুক অ্যাওয়ার্ড ও আমেরিকান বুক অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন মোসাব আবু তোহা। আর বর্তমান পরিস্থিতিতে পশ্চিমা শীর্ষ সংবাদমাধ্যমগুলোতে তো তিনি লিখছিলেনই। ফলে তরুণ এই কবির আটকের ঘটনা বেশ সাড়া ফেলে। কয়েকদিন পর ইসরায়েলি বাহিনী তাঁকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু এর আগে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে তাঁকে।
এবার দ্য নিউ ইয়র্কার পত্রিকা, শিকাগোভিত্তিক ম্যাগাজিন পোয়েট্রিসহ অনলাইন প্ল্যাটফর্মে প্রকাশিত মোসাব আবু তোহা’র কয়েকটি কবিতার ইংরেজি থেকে অনুবাদ পড়া যাক। বিশেষ এই আয়োজনে শিরিষের ডালপালার পাঠকের জন্য তোহা’র কয়েকটি কবিতা বাংলায় ভাষান্তর করেছেন কবি ও সাংবাদিক রাফসান গালিব।
ফিলিস্তিনের রাস্তা
আমার শহরের রাস্তাগুলোর নাম নেই,
যদি কোনো ফিলিস্তিনি নিহত হয়
স্নাইপারের গুলিতে বা ড্রোন হামলায়
আমরা তখন তার নামে
সড়কের নাম রাখি
আমাদের শিশুরা সবচেয়ে ভালো গুনতে শেখে,
ধ্বংস হওয়া ঘরবাড়ি বা স্কুলের সংখ্যা গুনতে গিয়ে
কত মা-বাবা হতাহত হলো বা জেলে গেল
সেই হিসাব রাখতে গিয়ে
আর আমাদের বয়স্করা তাদের আইডি কার্ড নিয়ে ঘোরে
যাতে তারা ভুলে না যায় তাদের পরিচয়
আমার দাদাজান ও তার বাড়ি
১.
আমার দাদা আঙ্গুল দিয়ে গুনতেন
ফেরার দিনগুলো
তারপর গুনতেন পাথর দিয়ে
তাতেও শেষ হতো না
এরপর গুনতেন মেঘ পাখি মানুষ দিয়ে
তার এ না ফেরার দিনগুলো আরও দীর্ঘ হয়
তিনি মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত ছত্রিশ বছর
আমাদের জন্য এটি এখন সত্তর বছরের বেশি
আমার দাদা হারিয়ে ফেলেছিলেন সমূহ স্মৃতি
ভুলে গিয়েছিলেন মানুষের সংখ্যা
তিনি ভুলে গিয়েছিলেন তাঁর বাড়ির কথাও
২.
দাদাজান, আমি যদি তোমার সাথে থাকতাম
আমি তোমাকে আবার লিখতে শিখিয়ে দিতাম
এর জন্য কবিতার বই বানাতাম
আর আঁকতাম আমাদের বাড়িটা
তোমার জন্য
আমি তোমার জন্য মাটি দিয়ে সেলাই করতাম পোশাক
যে লতাপাতা আর গাছ তুমি বড় করে তুলেছিলে
সেসব দিয়েই সজ্জিত করতাম
আমি তোমার জন্য কমলা দিয়ে বানাতাম সুগন্ধি
আর আকাশের আনন্দ অশ্রু থেকে বানাতাম সাবান
এর চেয়ে পবিত্র কিছু ভাবতে পারিনি
৩.
আমি প্রতিদিন গোরস্তানে যাই
বৃথাই খুঁজি তোমার কবরখানা
তোমাকে কি আসলেই তারা কবর দিয়েছিল?
নাকি তুমি একটি গাছ হয়ে গিয়েছ
নাকি কোনো পাখির সঙ্গে কোথায় উড়ে গিয়েছ তুমি
আমার কানের ভেতরে লুকানো যেসব জিনিস আপনি খুঁজে পেতে পারেন
১.
যখন আপনি আমার কান খুলতে যাবেন, আলতোভাবে তা স্পর্শ করবেন
কারণ আমার মায়ের কণ্ঠ ভেতরে কোথাও লেগে আছে
কোনো কিছুতে মনোযোগ দিতে গিয়ে যখন আমার মাথা ঘুরে ওঠে
তখন সেই কন্ঠ আমাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে
আপনি আচমকা মুখোমুখি হতে পারেন আরবি গানের
ইংরেজি কবিতার, যা আমি আবৃত্তি করে নিজেকেই শোনাতাম
অথবা আমাদের বাড়ির উঠোনে
পাখিদের কিচিরমিচিরের সঙ্গে গলা মেলানো একটি গান
আপনি কাটা জায়গা সেলাই করবেন
তখন এইসব জিনিস আমার কানে তুলে রাখতে ভুলবেন না
আগের মতো সেগুলোকে রাখুন একটার পর একটা
যেভাবে আপনার বইয়ের তাক সাজান
২.
ড্রোনের ভোঁ ভোঁ আওয়াজ
একটি এফ-সিক্সটিনের গর্জন
বাড়িঘর, ফসলের খেতে এবং মানুষের ওপর
বোমা পড়ার আর্তনাদ
দূরে উড়ে যাওয়া রকেট—
এসব থেকে আমার কানকে রেহাই দিন
কান সেলাই করার সময় আপনার হাসির সুগন্ধি সেখানে স্প্রে করুন
আমার শিরায় ইনজেকশন দিয়ে ঢুকিয়ে দিন জীবনের গান
সেটিই আমাকে জাগিয়ে তুলবে
আলতো করে ড্রাম বাজান, যাতে আমার মনটা নাচতে থাকে
আপনার সঙ্গে দিন রাত, ও আমার ডাক্তার।
রাফসান গালিব
কবি, সাংবাদিক