মৃত্যু সাম্প্রদায়িক | কুমার চক্রবর্তী


সংবেদ থেকে প্রকাশ হচ্ছে কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক কুমার চক্রবর্তীর নতুন গদ্যের বই ‘খেয়ালপাতার গান’। প্রকাশিতব্য বই থেকে দর্শনধর্মী একটি লেখা প্রকাশিত হলো।


মৃত্যু অনেককে, অনেক কিছুকে, চিনিয়ে দেয়। যে জীবন মিলে আর মেলানোর একাকারে মশগুল আর পার্থিব, মৃত্যুতে তাই যেন আলাদা, রিক্ত আর ঘোরতর অপার্থিব; এই অপার্থিবতায় অসুবিধা ছিল না যদি না তা পার্থিবতার কৌমুদিকে আচ্ছন্ন করত। মৃত্যু শুধু বিচ্ছেদরেখাই টানে না, সে সম্পর্ককে চুকিয়েও দেয়—পরিচিতকে করে তোলে অপরিচিত, আত্মকে করে পর। মৃত্যুতে ব্যক্তিটি প্রধানত বিশিষ্ট হয়ে ওঠে ধর্মীয় পরিচয়ের স্বাতন্ত্র্যে যা এতকাল ছিল প্রচ্ছন্ন। কিন্তু এই পরিচয় অনেকসময় আরোপিত, অর্থাৎ, মৃতের শেষ পরিচয় জীবিতরা আরোপ করে। যে যা ছিল না, তাকে তা-ই করা হয়—অবিশ্বাসীকে বিশ্বাসী আর বিশ্বাসীকে সন্ত করে তোলা হয়; বিপরীতটাও হয়। আর এ কাজটি করে তার চারপাশের মানুষজন, আরও স্পষ্ট করে বললে, তার আত্মীয়স্বজনরা, ধর্মপ্রতিষ্ঠানরা, ধর্মকর্তারা। মানুষটি যে জীবন যাপন করে গেছেন, যে জীবনে তিনি ছিলেন স্বস্থ আর চিত্তচমৎকারী, তার বাইরে অপরিচিত এক জীবনের গল্প যেন শুরু হয় ঠিক তার গতাসুর পর পরই। মৃত্যু মানুষের উন্মুক্ত জীবনকে মাটিচাপা দিয়েই তার কাজ শেষ করে না, এক অপরিচিত জীবনকে প্রকাশও করা হয়। গুণী মানুষের দোষকে আর দোষী মানুষের গুণকে সে প্রতিষ্ঠা করতে থাকে। আর যা সবচেয়ে বেশি করে, তা হল, তার ধর্মীয় পরিচয়কে করে তোলে উজ্জ্বল, নিশ্ছিদ্র আর খাদহীন।

কাভাফির একটি দীর্ঘ কবিতা পড়ে এ ধরনের একটি বিধারণার মুখোমুখি হই আমরা। কবিতাটি কাভাফির গড়পড়তা কবিতার চেয়ে বেশ দীর্ঘ, তাঁর প্রকাশিত কবিতার মধ্যে দীর্ঘতম। বেশ দীর্ঘ—প্রায় সত্তুর পঙ্ক্তির মতো। কবিতাটি একটি গল্পের ছায়ায় আধারিত। ভিন্ন এক সত্যকে তুলে ধরে তা।

কথক একজন প্যাগান, বলছেন তার এক বন্ধুর কথা যার নাম মাইরেস, যে একজন খ্রিস্টান। কথক বলছেন, ‘‘যখন আমি জানলাম সেই দুঃসংবাদটি যে মাইরেস মারা গেছে, আমি ছুটে গেলাম তার বাড়িতে; যদিও একজন খ্রিস্টানের ঘরে ঢোকার ইচ্ছা ছিল না আমার, বিশেষত শোকের মুহূর্তে বা খ্রিস্টীয় আচারাদি পালনের সময়ে। আমি তাই বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকলাম, আর এগোতে চাইলাম না, কারণ আমার মনে হল এতক্ষণে বন্ধুর আত্মীয়স্বজনরা সন্দেহ ও খারাপ চোখে আমার দিকে তাকাতে শুরু করেছে। তারা তাকে একটি বিশাল ঘরে রেখেছিল যা ছিল দামি কার্পেট আর মূল্যবান সোনারুপা জিনিসপত্রে সজ্জিত, ঘরটির কিছুটা আমি দেখতে পাচ্ছিলাম। বারান্দার একপাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার কান্না পাচ্ছিল, ভাবছিলাম যে এখন থেকে মাইরেসহীন আমাদের একসাথ হওয়া আর বাইরে ঘোরাঘুরি করা তেমনটা আর হবে না, আড্ডাও জমবে না। মনে হল, রাত্রিভর আমাদের উজ্জ্বল পানাহারের সময়টাতে তাকে আর পাব না; তার হাসিঠাট্টা আর মন্দ্রগভীর উচ্চারণে গ্রিক কাব্যপাঠ আর কখনও শোনা হবে না। দেখলাম, আমার কাছাকাছি দাঁড়ানো কয়েকজন বয়স্কা মহিলা নীচুস্বরে বলাবলি করছিল মাইরেসের শেষ দিনগুলোর কথা যখন তার মুখ থেকে অবিরল বের হত জিশুর নাম, তার হাতে ধরা থাকত ক্রস। এর পর ঘরে ঢুকল চারজন খ্রিস্টান পুরোহিত, তারা উদাত্ত স্বরে প্রার্থনা করে উঠল আর স্তবগান করল জিশু বা মেরির নামে (তাদের ধর্ম আমি ঠিকঠাক জানি না)। দুই বছর আগে মাইরেস যখন আমাদের দলে যোগ দিল সেই তখন থেকেই জানতাম যে সে ছিল একজন খ্রিস্টান। কিন্তু সে ঠিক আমাদের মতোই জীবনযাপন করত। আমাদের সবার মধ্যে সেই ছিল সবচেয়ে বেশি আনন্দউচ্ছ্বাসময় এবং বেপোরোয়া প্রকৃতির, কে কী ভাবে তা মোটেও পরোয়া করত না। শেষ রাতে পথে আমাদের প্রতিপক্ষ দলকে সামনে পেলে সে একহাত খিস্তিখেউর করেও উঠত। কখনোই নিজ ধর্মের ব্যাপারে সে কিছু বলত না। একবার তাকে মজা করে বললাম যে তাকে নিয়ে আমরা সেরাপিয়ামে যাচ্ছি। এখন মনে হচ্ছে যে, এই তামাশা তার ভালো লাগেনি। আরও একটি ঘটনা মনে পড়ল। একবার দেবতা পোসাইদোন-এর উদ্দেশে যখন আমরা মদ্য উৎসর্গ করছিলাম, সে তখন আমাদের চক্রের বাইরে গিয়ে অন্যদিকে তাকিয়েছিল। আমাদের মধ্যে একজন স্বতঃস্ফূর্তভাবে যখন বলে উঠল, আমাদের এই সঙ্গীদের যেন সকল বিপদ-আপদ থেকে মনোহর অ্যাপোলো রক্ষা করেন, তখন মাইরেস বিড়বিড় করে বলে উঠল: ‘আমাকে ছাড়া।’ কিন্তু কেউ তা শুনতে পেল না। খ্রিস্টান পুরোহিতদের কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হয়ে উঠল, তারা মৃত মাইরেসের আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনা করল। আমি দাঁড়িয়ে দাড়িয়ে দেখলাম তাদের ধর্মীয় আচার, তারা খ্রিস্টীয় প্রথানুযায়ী অন্ত্যেষ্টির সব কিছু করতে লাগল। আর হঠাৎ করেই আমার মনে এক বিশ্রদ্ধ ভাব এলো। আবছা-আবছা মনে হল, মাইরেস আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, মনে হল, এক খ্রিস্টান মাইরেসের জন্ম হচ্ছে আর আমি যেন তার কাছে অচেনা হয়ে যাচ্ছি, অতিশয় অচেনা হয়ে পড়ছি। বুঝলাম সন্দেহ আমাকে অধিকার করে ফেলছে, হয়তো আমি অন্ধ অনুভূতিতে আক্রান্ত হচ্ছি। তাদের খ্রিস্টানত্বে আক্রান্ত হওয়ার আগেই, বন্ধু মাইরেসের স্মৃতিকে হারানোর আগেই, আমি তাদের আশ্চর্য (অসম্ভব) ঘরটি থেকে ছুটে বেরিয়ে এলাম।’’

প্রচ্ছদশিল্পীঃ নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

কবিতাটির পটভূমি ৩৪০ খ্রিস্টাব্দ তা কবিতাটির শিরোনাম থেকেই বোঝা যায়: ‘‘মাইরেস: ৩৪০ খ্রিস্টাব্দে আলেকজান্দ্রিয়া’’। মাইরেস-এর মৃত্যুর সময় রোমক সাম্রাজ্য চলছিল কনস্তান্তিন দ্য গ্রেট-এর দুই ছেলে কনস্তান্স এবং কনস্তান্তিউস-এর দ্বৈত শাসনে। আমরা জানি, কনস্তান্তিন-এর মাধ্যমে রোমক সাম্রাজ্যে খ্রিস্টান ধর্মের রাজকীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে তাঁর সন্তানদের রাজত্বকালে প্যাগান এবং খ্রিস্টানদের মধ্যে এবং রাষ্ট্র ও চার্চের মধ্যে সাংঘর্ষিক একটি পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। সমাজে ধর্মীয় শ্রেণিবিভাজন এবং অসহিষ্ণুতা ছিল মারাত্মক। কবিতাটিতে কথক যিনি প্যাগান আর তার বন্ধু মাইরেস যিনি খ্রিস্টান, এই দুই ধর্মের ক্রমবর্ধিষ্ণু ঘৃণার দিকটি উন্মোচিত হয়েছে।

কবিতাটির মর্ম এমনটা যে, ধর্মীয় পরিচয় যখন প্রধান এবং সক্রিয় হয়ে ওঠে তখন চিরকালীন সম্পর্কের অন্য নিবিড়তাগুলো, গড়ে-ওঠা মর্ত্যবোধগুলো নষ্ট হয়ে যেতে থাকে। যাপিত জীবনে যে ধর্মীয় পরিচয় অস্পষ্ট হয়ে থাকে, মৃত্যুতে যেন সেটাই ফিরে আসে। কোনো ধর্মের একজন মানুষের অন্ত্যেষ্টি-অনুষ্ঠানে তার ভিন্ন ধর্মাবলম্বী বন্ধুদেরও অংশগ্রহণের সুযোগ নাই যদিও জীবৎকালে তারাই ছিল মৃত মানুষটির সুখ-দুঃখের একান্ত সাথি। মৃত্যুই যেন ধর্মীয় পরিচয়ের শেষ সিল মেরে দিয়ে তাকে পাঠায় অদৃশ্যলোকে। বর্ণিত কবিতাটির কথক একজন প্যাগান আর তার বন্ধু মাইরেস খ্রিস্টান। কিন্তু তারা একই দলভুক্ত ছিল, একসাথে চলত-ফিরত, একই ধরনের জীবন যাপন করত। তারা যখন জীবনলীলায় মশগুল ছিল তখন তাদের বড়ো পরিচয় ছিল মানুষ, বন্ধু —একসঙ্গে আনন্দহাসিগানে দিন কাটত তাদের। কেউ কারও জন্য বাধার তো ছিলই না বরং পরস্পর ওঠাবসা যেন অভিন্ন একটি অবস্থানকে খাঁটি করে তুলেছিল। যে উত্তাল সৌন্দর্যে ভরপুর ছিল মাইরেস-এর ব্যক্তিত্ব তা কথককে মোহিত করে রাখত, আর কথকও তার সুখস্মৃতিতে ভরপুর থাকত সদা। কিন্তু বন্ধু মাইরেস মারা গেলে কর্তব্যবশত মৃত বাড়িতে গিয়ে কথক টের পেলেন, কারা যেন তাকে ঘৃণা করতে শুরু করল। মৃত বন্ধুকে দেখতে গিয়ে তিনি বুঝলেন, মৃত্যু যেন বন্ধুকে খ্রিস্টান বানানোর মরিয়া চেষ্টায় রত। যে বন্ধুটি জীবনে ছিল মানুষ, ইহজাগতিক, মৃত্যুর পর তাকেই করে তোলা হচ্ছিল বিনীত খ্রিস্টান। এখানেই শেষ নয়, বন্ধুর মৃত্যু যেন তাকেও করে তুলতে লাগল সক্রিয় প্যাগান। কিন্তু একদা জীবন এই দুইজনের ধর্মীয় পরিচয়কে কমিয়ে তাদের করে তুলেছিল মানুষ। কথক তাই এই অসহনীয় অবস্থা থেকে মুক্তি পেল পালিয়ে এসে।

ইহজাগতিকতার সবচেয়ে বড়ো সার্থকতা হল, তা মানুষকে মেলানোর নানা পথ খুলে দেয়, সক্রিয় বাধাগুলিকে নিস্তেজ করে দেয়। ইহজাগতিকতা মুক্তহৃদয়িক। কিন্তু মানুষের জন্ম আর বিলয়-মুহূর্তে ধর্ম প্রধান হয়ে ওঠে যদিও তখন ব্যক্তিটির এ বিষয়ে কোনো ভূমিকাই থাকে না। আর এই দুইয়ের মধ্যবর্তী সময়টি যেহেতু ব্যক্তি কর্তৃক নির্বাচিত, নির্মিত এবং নিয়ন্ত্রিত, তাই এই সময়টাতে ব্যক্তি প্রায়শই এক ইহজাগতিক জীবন যাপন করে চলে যা তাকে মিলে আর মেলানোর এক নিরন্তর প্রাণখেলায় রত করে রাখে।

মানুষের জীবন মূলত ইহজাগতিক, কিন্তু তার জন্ম আর মৃত্যুটি যেন পারলৌকিকতার রূপকে উন্মোচিত।



কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক কুমার চক্রবর্তীর জন্ম ২ চৈত্র ১৩৭১ বঙ্গাব্দে, কুমিল্লায়। প্রধান পরিচয়ে কবি হলেও প্রবন্ধ ও মননশীল গদ্যে তিনি সিদ্ধহস্ত। বরং তাঁর গদ্যের শক্তি কবিপরিচয়কেও যেন ছাপিয়ে উঠতে চায়। কুমার চক্রবর্তীর কাব্যগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘লগপুস্তকের পাতা’, আয়না ও প্রতিবিম্ব’, সমুদ্র, বিষণ্ণতা ও অলীক বাতিঘর’, ‘পাখিদের নির্মিত সাঁকো’, ‘হারানো ফোনোগ্রাফের গান’, ‘তবে এসো, হে হাওয়া হে হর্ষনাদ’, এবং অবশ্যই কবিতাসংগ্রহ। প্রবন্ধ ও গদ্যগ্রন্থের মধ্যে বিশেষভাবে বলা যায় ‘আত্মধ্বনি’, ‘উৎসব: দেহ প্রেম কাম’, ‘পথিকমন’, ‘কবিতার অন্ধনন্দন’, ‘ঈশ্বর বিষয়ক বিপ্রতীপ চিন্তা’, ‘মাত্রামানব ও ইচ্ছামৃত্যুর কথকতা’ এবং ‘অস্তিত্ব ও আত্মহত্যা’র কথা। কুমার চক্রবর্তীর অনুবাদে প্রকাশিত হয়েছে ‘আমি শূন্য নই, আমি উন্মুক্ত: ট্রোমাস ট্রান্সট্রোমারের নির্বাচিত কবিতা’, ‘বৃক্ষের মতোই তুমি ফেলেছিলে নিশ্বাস: জর্জ সেফেরিসের কবিতা, সাক্ষাৎকার ও প্রবন্ধ’, এবং ‘বিশাল প্রশান্তি, প্রশ্ন আর উত্তরেরা: ইয়েহুদা আমিহাইয়ের নির্বাচিত কবিতা’।

শেয়ার