যারা তাদের চারপাশে কী হচ্ছে না হচ্ছে এটা দেখে জীবন যাপন করে, উত্থান-পতনে ভয় পায় এবং সহজ সমঝোতায় রাজি হয়ে যায়, তারা যে ক্ষেত্রেই কাজ করুক সৃষ্টিশীল হতে পারে না।
একজন ফিকশন লিখেন, অন্যজন অর্কেস্ট্রা পরিচালনা করেন কিন্তু উভয়েরই সঙ্গীতে একটি যৌথ সাধারণ ক্ষেত্র রয়েছে। তাঁরা সৃষ্টিশীলতা, সৃষ্টির পেছনের অনুপ্রেরণা এবং মাহলারের বিশ্বজনীনতা নিয়ে আলোচনা করেন।
এই সাক্ষাৎকারের আগে পর্যন্ত আমার সেইজি ওজাওয়ার সাথে সংগীত বিষয়ে সিরিয়াস কোনো কথাবার্তা হয়নি। যদিও ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত বোস্টনে থাকাকালীন আমি তাঁর পরিচালিত কনসার্টে নিয়মিত যেতাম কিন্তু তখন যেকোনো সাধারণ ভক্তের মতোই শ্রোতার সারিতে বসে তাদের শুনতাম। এরপর ঘটনাক্রমে আমার এবং আমার স্ত্রীর তাঁর মেয়ে সাইরার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে যায়, যার সূত্র ধরেই ওজাওয়ার সাথে দেখা হতো মাঝে মাঝে। ওজাওয়া এমন একজন ব্যক্তি যিনি তাঁর সমস্ত শক্তি, শ্রম ও চিন্তা সঙ্গীতের পেছনেই দিতেন তাই যেটুকু সময় বাকি থাকতো, আমাদের কথা হলেও আমরা এ বিষয় বাদ দিয়েই কথা বলতাম।
কিন্তু ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে তাঁর অন্ননালীর ক্যান্সার ধরা পড়লে স্বভাবতই তাঁর কাজকর্ম কমে আসতে শুরু করে। সেজন্যই হয়তো আমরা সঙ্গীতবিষয়ক কথা বলা শুরু করি। আমাদের এ আলোচনাই তাঁকে প্রাণবন্ত করে তুলতো এবং আমাদের পেশাগত কাজের ক্ষেত্র আলাদা হওয়ায় তিনি আমার কাছে বলতে আরামবোধ করতেন।
আমি প্রায় অর্ধশত বছর ধরে জ্যাজের প্রচণ্ড ভক্ত। একইসাথে ক্লাসিক্যাল মিউজিকও আমাকে সমানভাবে টানে। কেউ যদি আমাকে দুটোর মধ্যে যেকোনো একটাকে বেছে নিতে বলে, এর চেয়ে ভয়ংকর কিছু আমি ভাবতে পারি না। ডিউক এলিংটন এ ব্যপারে আমাকে সাহায্য করেছেন এটা বলে যে, ” সঙ্গীত মূলত দু’প্রকারই। এক উৎকৃষ্ট সংগীত এবং দ্বিতীয়টি এর বিপরীত।” এ হিসেবে জ্যাজ ও ক্লাসিক্যাল একই প্রকারে অন্তর্ভুক্ত।
আমার বাড়িতে ওজাওয়ার এক আগমনে আমরা যখন সংগীত বিষয়ে অগোছালো আলোচনা করছিলাম, তখন তিনি আমাকে নিউ ইয়র্কে ১৯৬২ সালে অনুষ্ঠিত “ফার্স্ট পিয়ানো কনসার্ট” নিয়ে এক দারুণ গল্প বলেন। আর তখনই আমার মাথায় আসলো এর মতো এতো চমকপ্রদ গল্পগুলো সংরক্ষণের অভাবে যদি বাষ্প হয়ে মিলিয়ে যায়, তাহলে কি বাজে ব্যপারই না হবে! কাউকে না কাউকে এগুলো সংরক্ষণ করা উচিত। এই কেউ-টা ওই মূহূর্তে যার হওয়া সবচেয়ে সহজ ছিলো সে নিঃসন্দেহে ‘আমি’।
আমি যখন ওজাওয়াকে এই ধারণাটি বলি তিনি পছন্দ করলেন এবং বললেন, ” কেন নয়! এখনতো নষ্ট করার মতো অফুরন্ত সময় রয়েছে আমার, চলুন করে ফেলি! “
কথা বলতে গিয়ে মনে হলো আমাদের মধ্যে অনেক সাদৃশ্য রয়েছে। মেধা, সৃজনশীলতা, খ্যাতি এসব কিছুর ব্যপারে আমি বলছি না, আমি যা বলতে চাইছি তা হচ্ছে একই ধরনের বোধ– যার উপর ভর করে আমরা আমাদের জীবন কাটিয়ে দিই। প্রথমত, আমরা আমাদের কাজকে প্রচণ্ড ভালোবাসি এবং যতক্ষণ কাজে থাকি, আনন্দই আমাদের একমাত্র সঙ্গী। যদিও পার্থক্য কেবল এটাই– একজনের কাজ ফিকশন লেখা ও অন্যজনের সঙ্গীত নির্মাণ। আমরা আমাদের নিজস্ব কাজে থাকাকালীন সময়ে এতোই সন্তুষ্ট ও মোহগ্রস্ততা অনুভব করি যে সময়ের মাপজোখ আমাদের কাছে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়।
দ্বিতীয়ত, আমাদের দুজনের হৃদয়েই প্রচণ্ড ক্ষিদে যার দরুন কাজ যতো ভালোই হোক আমাদের কাছে যথেষ্ট ভালো মনে হয় না। তৃতীয়ত, আমরা উভয়েই ভীষণ জেদি। আমরা একবার কিছু একটা করবো বলে ঠিক করে নিলে কিভাবে করা সম্ভব হবে, অন্যরা এ ব্যপারে কী বলবে এসব নিয়ে এতো মাথা ঘামাই না। আমরা কোনো অযুহাত ছাড়াই নিজের কাজের দায়িত্ব নিজেই নিই। ওজাওয়া এমন একজন ব্যক্তি যে কথায় কথায় কৌতুক জুড়ে দেয়, কিন্তু একই সাথে তিনি তাঁর চারপাশ নিয়ে যথেষ্ট সেনসেটিভ এবং তাঁর প্রায়োরিটি খুব স্পষ্ট।
সৃষ্টিশীল ব্যক্তিদের অহংবাদী হতে হয়। শুনতে খুব আত্মম্ভরী শোনালেও এটা সত্যি। যারা তাদের চারপাশে কী হচ্ছে না হচ্ছে এটা দেখে জীবন যাপন করে, উত্থান-পতনে ভয় পায় এবং সহজ সমঝোতায় রাজি হয়ে যায়, তারা যে ক্ষেত্রেই কাজ করুক সৃষ্টিশীল হতে পারে না। যা এর আগে কখনো ছিলো না এমন কিছু সৃষ্টি করতে প্রয়োজন হয় “একান্ত ধ্যানের”, এমন মনোযোগের যেটা কেবল এমন স্থানেই সম্ভব যেখানে এ আটপৌরে পৃথিবীর সাথে যোগসূত্র খুব কম।
এরপরও একজনের অহমকে “শিল্পী” হওয়ার দরুন বাড়তে দিলে তা তার সামাজিক জীবনকে ব্যাহত করতে পারে; যা এক পর্যায়ে আবার তার “একান্ত ধ্যান” এ ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। এই অহমকে উন্মোচিত করা উনিশ শতকে একরকম ছিলো, এখন একবিংশ শতকে আবার অন্যরকম, বলতে গেলে আরো জটিল। সৃষ্টিশীল পেশাগুলোকে তাদের ও তাদের পারিপার্শ্বিকের মধ্যকার বাস্তবিক সুতোটাও খুঁজে পেতে হয়। আমি যেটা বলার চেষ্টা করছি তা হলো আমি ও ওজাওয়া আমরা আমাদের সমঝোতার সেই সুতোটিকে ভিন্নপথে হলেও পেয়েছি এবং তাদের গন্তব্য একই দিকে। আমাদের প্রায়োরিটিগুলো ভিন্ন হলেও আমরা যেভাবে এটি নির্ধারণ করেছি সে পথটি একই। যেকারণে আমি যখন তাঁর গল্পগুলো শুনছিলাম সেটা সহানুভূতির চেয়েও বেশি কিছু ছিলো।
২০১১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আমরা মাহলারকে নিয়ে কথা বলছিলাম টোকিও অফিসে। কথা বলতে গিয়ে বুঝলাম ওজাওয়া মাহলার-সঙ্গীতের এক জীবন্ত কোষ। আমার নিজেরই মাহলারকে বুঝতে অনেক বছর ধরে কম কষ্ট পোহাতে হয়নি; কিন্তু এক পর্যায়ে তার সংগীত আমাকে নাড়িয়ে দিলো।
— হারুকি মুরাকামি
হারুকি মুরাকামি- যারা মাহলার পারফর্ম করতো কিংবা তাঁর শ্রোতাদের মধ্যেও অনেকে আছেন যারা শিল্পীর ব্যক্তিগত জীবন, অন্তর্দর্শন অথবা তিনি কোন শতক বা দশকের এসব নিয়ে খুব মাথা ঘামান। আপনার এ বিষয়ে অবস্থান কোথায়?
সেইজি ওজাওয়া- আমি আসলে এসব নিয়ে তেমন ভাবি না। আমি শুধু স্কোরগুলো খুব ভালোভাবে লক্ষ্য করি। তাছাড়া ত্রিশ বছর আগে আমি যখন ভিয়েনায় কাজ করা শুরু করি, নতুন নতুন বন্ধুদের সাথে প্রায়ই আর্ট মিউজিয়ামগুলোতে যেতাম। সেখানে ক্লিম্ট ও ইগন শিলার কাজ দেখে আমি প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছিলাম। তখন থেকে এটাকেই আমি আর্ট মিউজিয়ামে যাওয়ার কারণ বানালাম। আপনি যখন একটা নির্ধারিত সময়ের শিল্প দেখবেন, আপনি এর সঙ্গীত সম্পর্কে একটা ধারণা পাবেন। যেমন ধরুন, মাহলারের সঙ্গীত। প্রচলিত জার্মান মিউজিককে ভেঙেই এর যাত্রা শুরু হয়েছে। আপনি যখন এই ভাঙ্গন এবং সৃষ্টিটা উপলব্ধি করতে পারবেন, আপনি সহজেই বলতে পারবেন এটা কোনো কাঁচা জিনিস নয়।
হা. মু.- আমি বুঝতে পারছি আপনি কী বলতে চাচ্ছেন। গতবার ভিয়েনায় শিল্পকলা জাদুঘরে ক্লিম্টের প্রদর্শনী দেখে আমার বুঝতে বাকি থাকেনি যে শিল্প দেখে শিল্পটি যেখানে সৃষ্টি হয়েছে সেই স্থানকে চেনা যায়, অনুভব করা যায়।
সে. ও.- ক্লিম্টের কাজ চমৎকার আর তাঁর সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ডিটেইলিং সত্যিই নজরকাড়া। কিন্তু তা দেখে আপনার মনে হয় না এসবের থেকেও যা দৃষ্টি কাড়ে তা হলো একধরনের উন্মত্ততা, এর মধ্যে পাগল করে দেয়া একটা ব্যপার আছে।
হা. মু.- একদম। এটাকে নিঃসন্দেহে স্বাভাবিক কিছু বলা যায় না।
সে. ও.- তাঁর কাজগুলোর মধ্যে নিশ্চয়ই কিছু আছে, কী সেটা আমিও জানি না। কিন্তু এগুলো পাগলামির গুরুত্ব স্পষ্ট বলে দেয়, নিয়মনীতিগুলো ভেঙেচুড়ে দেয়। আর সত্যি বলতে ঐ সময়টাও ছিলো ভাঙ্গনের, চতুর্দিকে ছিলো বিশৃঙ্খলা।
আমাদের জাপানিদের আর অন্যান্য এশীয়দেরও নিজস্ব দুঃখবোধের ক্ষেত্র রয়েছে। আমার মনে হয় এই দুঃখগুলো ইহুদীদের দুঃখ অথবা ইউরোপীয় দুঃখ থেকে আলাদা।
হা. মু.- হ্যাঁ, চতুর্দিকে সিফিলিস। ভিয়েনার অলিগলি মানসিক এবং শারীরিকভাবে কম-বেশি আক্রান্ত হয়ে গিয়েছিলো। এটা ঐ সময়ের আবহাওয়া ছিলো। গতবার যখন ভিয়েনায় গেলাম আমার হাতে অনেক সময় ছিলো। তাই গাড়ি ভাড়া করে চার-পাঁচদিন চেকপ্রজাতন্ত্রের দক্ষিণাংশের আশেপাশে ঘুরছিলাম। সেখানে হুট করেই পুরনো এক অনুন্নত এলাকায় মাহলারের জন্মস্থান ছোট একটি গ্রাম ক্যালিস্ট পেয়ে গেলাম, যদিও এ গ্রামকে উদ্দেশ্য করে যাইনি মোটেও। গ্রামটি এতোই গ্রামীণ যে যতদূর পর্যন্ত চোখ যায় কেবল মাঠ আর মাঠই দেখা যায়। আমি একটু অবাকই হয়েছিলাম, ভিয়েনা থেকে খুব দূরে নয় এমন একটি স্থান এতো ভিন্ন। আমি মনে মনে ভাবলাম, “তাহলে মাহলার এমন একটি জায়গা থেকে এসেছে! ” তাঁর অভিজ্ঞতায় কতো ভিন্ন ভিন্ন পালকই না যুক্ত হয়েছে! তখন থেকেই ভিয়েনা শুধু অস্ট্রিয়-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যেরই নয়, ইউরোপিয়ান সংস্কৃতিরও একটি রঙিন ও পরিপক্ব কেন্দ্র। ভিয়েনার লোকজন নিশ্চয়ই মাহলারকে আদর্শ ভাঁড় হিসেবে নিয়েছে।
সে. ও.- তাই নাকি!
হা. মু.- সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে তিনি একজন ইহুদী ছিলেন। কিন্তু ভিয়েনা শহরটি তার আশেপাশের সংস্কৃতি থেকে সমৃদ্ধ হয়েছে। আপনি এটা অ্যান্টোন রুবিনস্টেইন এবং রুডলফ সার্কিনের জীবনী থেকেও জানতে পারেন। এভাবে দেখলে আসলে বোঝা সহজ কেন মাহলারের মিউজিকে হঠাৎ করে পপসঙ্গীত এবং ইহুদীদের ক্লেজমার সঙ্গীতগুলোর গম্ভীর সঙ্গীতময়তা ও নান্দনিক সুরমূর্ছনা দেখা যেতে শুরু করে। এই বৈচিত্রই মাহলারের সংগীতকে আরো আকর্ষণীয় করেছে। আমার সন্দেহ হয় ভিয়েনায় জন্মগ্রহণ করলে কিংবা বেড়ে উঠলে আমরা এই মাহলারকে পেতাম কিনা।
সে. ও.- সত্যিই।
হা. মু.- সেসময়ের সকল সৃষ্টিশীল ব্যক্তি- কাফকা, মাহলার, প্রুস্ট সবাই ইহুদী ছিলেন। তাঁরা প্রান্তিকে অবস্থান করেও বহুদিনের প্রতিষ্ঠিত সাংস্কৃতিক ধারাটিকে নাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এদিক দিয়ে চিন্তা করলে এটা গুরুত্বপূর্ণ যে মাহলারও গ্রাম থেকে আগত একজন ইহুদীই ছিলেন। বোহেমিয়ার আশেপাশে ভ্রমণ করতে গিয়ে এটাকে আরো সত্য মনে হলো। মাহলারের ‘ ফার্স্ট সিম্ফোনি’-র তৃতীয় মুভমেন্ট শুনলেই স্পষ্ট হয়ে যায় মাহলারের সঙ্গীতে বিচিত্র উপকরণ রয়েছে যার সবগুলো উপাদানই কম-বেশি গুরুত্বপূর্ণ আর কোনো যৌক্তিকতা ছাড়াই ব্যবহার করা হয়েছে। এমনকি মাঝেমাঝে একটি আরেকটির সাথে সংঘাত সৃষ্টি করেঃ প্রচলিত জার্মান সঙ্গীত, ইহুদীদের সঙ্গীত, ফিন ডি সিইচিকল, বোহেমিয়ান লোকসঙ্গীত, মিউজিক্যাল ক্যারিকেচারস, কমিক সাবকালচারাল উপাদান, গুরুগম্ভীর দার্শনিক উপাদান, খ্রিস্টীয় মতবাদ, এশীয় দর্শন- এসবকিছু এমনভাবে আছে যে কোনটা কেন্দ্র এবং অধিক গুরুত্বপূর্ণ বোঝার সুযোগ নেই। যেখানে একই সাথে একইরকম গুরুত্বে এতো এতো উপাদান রয়েছে, সেখানে কি আপনার মতো একজন পরিচালক যিনি পাশ্চাত্যের নন- তার জন্য প্রচুর বিকাশের সুযোগ রয়েছে না, যাতে তাঁর নিজস্বতার ছাপ রাখা যায়? অথবা মাহলারের সঙ্গীতে এমন কিছু কী পান না যা সার্বজনীন বা বহুজাতিক?
সে. ও.- যদিও এটা বলা খুব জটিল কিন্তু আমি অবশ্যই মনে করি এটা নিয়ে কাজের অনেক সুযোগ রয়েছে।
হা. মু.- আমার মনে আছে আমরা যখন বের্লিওজকে নিয়ে কথা বলছিলাম আপনি বলেছিলেন যে তাঁর সঙ্গীতে অনেক স্বাধীন জায়গা আছে, যা একজন জাপানি পরিচালক গোলমাল করে দিতে পারে কারণ এটাতে এক ধরনের ‘পাগলামি’ আছে। মাহলারের ক্ষেত্রেও কী একই কথা বলবেন?
সে. ও.- বের্লিওজ আর মাহলারের মধ্যে পার্থক্য হলো বের্লিওজ এতো বিস্তারিত নির্দেশনা দিতেন না।
হা. মু.- ও আচ্ছা।
সে. ও.- তাই আমরা কলাকুশলীরা বের্লিওজের কাজে অনেক বেশি স্বাধীনতা পাই যেটা মাহলারের এখানে পাই না। কিন্তু আপনি যখন সূক্ষ্ম ডিটেইলসহ শেষ পর্যন্ত যাবেন, আমার মনে হয় সেখানে সার্বজনীন ওপেনিংয়ে দু’জনেরই এক ধরনের মিল পাওয়া যায়। আমাদের জাপানিদের আর অন্যান্য এশীয়দেরও নিজস্ব দুঃখবোধের ক্ষেত্র রয়েছে। আমার মনে হয় এই দুঃখগুলো ইহুদীদের দুঃখ অথবা ইউরোপীয় দুঃখ থেকে আলাদা। আপনি যদি এইসব মনোজগৎ বোঝার চেষ্টা করেন আর কাজ করার আগে জেনে নিন তাহলে সঙ্গীত আপনার জন্য আরো সহজ হয়ে যাবে। এ কারণেই যখন কোনো প্রাচ্যের শিল্পী একজন পাশ্চাত্যের গীতিকারের গান গাইবে, এটার অন্য একটি বিশেষ অর্থ দাঁড় হবে আর হওয়াও উচিত।
হা. মু.- আপনি বলতে চাচ্ছেন হালকা জাপানীয় আবেগপ্রবণতা দিয়ে এটাকে বিচার করলে চলবে না, তা বুঝতে এবং আত্মীকরণ করতে গভীরে যেতে হবে?
সে. ও.- হ্যাঁ, সেটাই। আমি এভাবেই ভাবি- পাশ্চাত্য সঙ্গীতের একটি পারফরম্যান্স যেটা জাপানি চেতনাকে পুরোপুরি কাজে লাগায় সেই পারফরম্যান্স এমনি নিজের কারণেই চমৎকার হবে।
হা. মু.- আমি যখন মাহলারকে শুনি, আমি সবসময় ভাবি মনোজগতের গভীরসব লেয়ার তার সংগীতের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটা অনেকটা ফ্রয়েডীয়। বাচ, বিথোভেন কিংবা ব্রহ্মসের ক্ষেত্রে জার্মান ধারণা-দর্শনে ঢুকে পড়া যায়; যদিও সচেতন মনন সেখানে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে। মাহলারের ক্ষেত্রে মনে হয় তিনি যেনো ইচ্ছে করেই অন্ধকারে নিমজ্জিত করতে চাচ্ছেন, মনের সবচেয়ে গভীর স্তরে। যেনো আপনি একটা স্বপ্নে আছেন যার মোটিফগুলো একটা অন্যটার বিপরীত এবং আপাত দৃষ্টিতে একটা অন্যটার সাথে যায় না, অথচ তাঁর সংগীতে এগুলো এমনভাবে মিশে থাকে যে সবগুলোকে যমজ মনে হয়, আলাদা করা কঠিন হয়ে যায়। আমি জানি না এগুলো মাহলার সচেতনভাবেই করেছেন নাকি অসচেতনভাবেই হয়ে গেছে। কিন্তু এগুলো খুব অপরোক্ষ এবং সৎ।
সে. ও.- মাহলার এবং ফ্রয়েড একই সময়ের, তাই না?
হা. মু.- হ্যাঁ, দু’জনই ইহুদী আর যদ্দূর মনে পড়ে তাঁদের জন্মস্থানও পাশাপাশি। ফ্রয়েড বয়সে জৈষ্ঠ ছিলেন। শোনা যায় মাহলার তাঁর কাছে পরামর্শের জন্য এসেছিলেন যখন তাঁর স্ত্রী অ্যালমার অ্যাফেয়ার চলছিলো ( জার্মান স্থপতি ওয়াল্টার গ্রপিয়াসের সাথে যাকে তিনি মাহলারের মৃত্যুর পর বিয়ে করেন) । ফ্রয়েড মাহলারের প্রতি খুব শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, অবচেতনের গভীরে যাওয়ার জন্য এভাবে সরাসরি বলা যদিও স্থূল শোনায়, তবু আমার মনে হয় সম্ভবত এই সাক্ষাৎগুলো মাহলারের সঙ্গীতকে আরো বিশ্বমানের করে তুলেছে।
সে. ও.- এদিক থেকে চিন্তা করলে মাহলার শক্তিশালী মূলধারার জার্মান সংগীতের বিপরীতে বাচ থেকে শুরু করে হেডেন হয়ে মোৎসার্ট পর্যন্ত আবার বিথোভেন থেকে ব্রহ্মস পর্যন্ত- কমপক্ষে টুয়েলভ টোন মিউজিকের আবির্ভাবের আগে পর্যন্ত একাই লড়ে গেছেন।
হা. মু.- তাছাড়াও টুয়েলভ টোন মিউজিক দারুণভাবে লজিক্যাল, একইভাবে বাচের ‘ওয়েল টেম্পার্ড ক্ল্যাভিয়ার’-ও যথেষ্ট সচেতন- আর খোদ টুয়েলভটোনড সঙ্গীতও সেভাবে টেকেনি, যদিও এর কিছু উপাদান পরবর্তীতে অন্য রূপে টিকে গেছে। কিন্তু এটা সত্যিই অনেক ভিন্ন, যেভাবে মাহলারের সঙ্গীত পরবর্তী প্রজন্মকেও প্রভাবিত করে চলেছে। আপনিও হয়তো আমার সাথে একমত হবেন এ ব্যপারে, তাই না?
সে. ও.- নিশ্চয়ই।
হা. মু.- মাহলার আসলে একজনই হয়।
হা. মু.- আপনার কী ধারণা, রিচার্ড স্ট্রসের স্কোর আর মাহলারের স্কোরের মধ্যে পার্থক্য কী?
সে. ও.- খুব সহজভাবে বললে আপনি যদি জার্মান সংগীতের ক্রম-বিবর্তন লক্ষ্য করেন দেখবেন বাচ, বিথোভেন, ওয়াগনার, ব্রুকনার আর ব্রহ্মসকে বুঝতে পারলে আপনি রিচার্ড স্ট্রসকেও বুঝতে পারবেন কারণ তাঁরা মূলত একই পথের পথিক। অবশ্যই তিনিও নতুন নতুন পালক যুক্ত করেছেন কিন্তু আপনি সেই মূলধারার প্রবাহটাও দেখতে পাবেন। কিন্তু মাহলারের ক্ষেত্রে তেমনটি হয়নি। মাহলার আপাদমস্তকই নতুনত্বে ঠাসা। এটাই মাহলারকে আলাদা করেছে। মাহলারের সময়েও শেনবার্গ, অ্যালবান বার্গের মতোও সংগীতস্রষ্টা ছিলেন কিন্তু তাঁরা তা করেননি যা মাহলার করেছেন।
হা. মু.- যেমনটি আপনি আগে বলছিলেন মাহলার আসলে অনেকগুলো টুয়েলভটোন মিউজিকের নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি করেছেন।
সে. ও.- তিনিও বিথোভেন কিংবা ব্রুকনারের মতো একই উপাদান ব্যবহার করেছিলেন কিন্তু উপাদানগুলো মিলিয়ে যখন একক একটা ব্যপার দাঁড় হতো তখন সেটা খুব ভিন্ন হয়ে উঠতো।
১৯৬০ সালের দিকে জন কোল্ট্র্যান ফ্রি জ্যাজের কাছাকাছি চলে এসেছিলেন কিন্তু তিনি মূলত লুজ টোনালিটির মধ্যেই রয়ে গিয়েছিলেন যাকে মুড বলে। লোকজন এখনও তাঁর সঙ্গীত শোনে কিন্তু ফ্রি জ্যাজ হিস্টোরিক্যাল ফুটনোটের চেয়ে বেশি কিছু।
হা. মু.- তিনি নিজের যুদ্ধই করে যাচ্ছিলেন যখন একই সাথে টোনালিটি সংরক্ষণ করছিলেন?
সে. ও.- ঠিক। কিন্তু তবু প্রভাবের দিক থেকে তিনি এটুনালিটির দিকেই স্পষ্টত বেশি ঝুঁকে ছিলেন।
হা. মু. – আপনি কী বলবেন যে যতটুকু যেখান থেকে নেয়া যায় টোনালিটির বিভিন্ন সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করে তিনি মূলত টোনালিটির ধারণাটিকেই বিভ্রান্ত করেছেন?
সে. ও.- হ্যাঁ, সেটাই বলবো। তিনি নতুন ধরনের মাল্টিলেয়ারিং সৃষ্টি করেছিলেন।
হা. মু.- যেমন- নানারকমের অসংখ্য ‘কি’ একই মুভমেন্টের জন্য?
সে. ও.- একদম। তিনি তাঁর ধরন পরিবর্তন করতে থাকতেন। এবং তিনি দুটো ভিন্ন ‘কি’-কে যুগপৎ ব্যবহার করার মতো কাজও করেন।
হা. মু.- তিনি টোনালিটি নাকচ করেননি কিন্তু ভেতর থেকে দ্বৈত-দ্বিধা সৃষ্টি করতেন যা সমস্ত ব্যপারটাকে নাড়িয়ে দিতো এবং শেষ হতো এটুনালিটিতে গিয়ে। তিনি কী টুয়েলভটোন মিউজিকের এটুনালিটি থেকে ভিন্ন কিছুর খোঁজে ছিলেন?
সে. ও.- হ্যাঁ, ওটা ভিন্ন ছিলো। আমার মনে হয় তিনি যেটা করতেন সেটা এটুনালিটি থেকে পলিটুনালিটির বেশি কাছে। পলিটোনালিটি এটুনালিটি থেকে এক ধাপ আগে। যেকোন কারণেই হোক এটোনালিটি যেটা বের করে আনা মাহলারের লক্ষ্য ছিলো সেটা শেনবার্গ এবং অ্যালবান বার্গের টুয়েলভটোন স্কেলের চেয়ে অনেকটা ভিন্ন ছিলো। পরবর্তীতে চার্লস আইভেসের মতো আরো অনেকে পলিটোনালিটি নিয়ে আরো গভীর কাজ করেছেন।
হা. মু.- আপনার কী মনে হয় মাহলার নিজেকে অন্যান্যদের চেয়ে অগ্রগামী ভাবতেন?
সে. ও.- না, আমার তা মনে হয় না।
হা. মু.- শেনবার্গ এবং বার্গ তাঁরা তাদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে খুব সচেতন ছিলেন যদিও
সে. ও. – হ্যাঁ, অনেকটা এরকমই। তাঁদের নিজস্ব ম্যাথড ছিলো, মাহলারের এমন কিছু ছিলো না।
হা. মু.- তাহলে তিনি শৃঙ্খলহীনতাকেই বেছে নিয়েছিলেন, কোনো প্রক্রিয়া হিসেবে নয় বরং খুব স্বাভাবিক এবং সহজাতভাবেই। এটাই কি আপনি বলছিলেন?
সে. ও. – একদম, এটাই কী ঠিক তাঁর প্রতিভার সাক্ষ্য নয়?
হা. মু. – জ্যাজের মধ্যেও এ ধরনের একটা বিকাশ দেখা যায়। ১৯৬০ সালের দিকে জন কোল্ট্র্যান ফ্রি জ্যাজের কাছাকাছি চলে এসেছিলেন কিন্তু তিনি মূলত লুজ টোনালিটির মধ্যেই রয়ে গিয়েছিলেন যাকে মুড বলে। লোকজন এখনও তাঁর সঙ্গীত শোনে কিন্তু ফ্রি জ্যাজ হিস্টোরিক্যাল ফুটনোটের চেয়ে বেশি কিছু। আমরা যা নিয়ে কথা বলছি সেটা সম্ভবত এর ধারেকাছের কিছুই।
সে. ও. – দারুণ, জ্যাজের মধ্যে তাহলে এমনকিছুই ছিলো?
হা. মু. – তা বলতে গেলে আসলে মাহলারের পরে মাহলারের মতো আমরা কাউকে পাইনি। পেলেও তাঁরা জার্মান নন, সোভিয়েত রাশিয়ান যেমন শস্তাকোভিচ এবং প্রোকোফিয়েভ। শস্তাকোভিচের সিম্ফোনিগুলো খুব দূর দিয়ে হলেও মাহলারের স্মৃতিবাহী।
সে. ও. – হ্যাঁ, আমিও একমত। কিন্তু শস্তাকোভিচের সঙ্গীত খুবই সুসঙ্গত। মাহলারের উন্মত্ততা তাঁর মধ্যে পাওয়া যায় না।
হা. মু. – হতে পারে, রাজনৈতিক কারণে তাঁর পাগলামির মতো কিছু বের হয়ে আসা সহজ ছিলো না। অন্যদিকে মাহলারের সঙ্গীতে গভীর অস্বাভাবিক কিছু একটা ছিলো।
সে. ও. – এটা সত্যি। ইগন শিলার চিত্রকলাও অনেকটা এরকম। আমি যখন তাঁর ছবিগুলো দেখি, আমি দেখতে পারি সে আর মাহলার মূলত একই সময়ের, একই স্থানের। ভিয়েনাতে কিছু সময় পার করার জন্য এ ব্যপারটা আমার বুঝতে আরো সুবিধা হয়েছে। এ এক চরম অভিজ্ঞতা আমার জন্য।
হা. মু.- মাহলার তাঁর আত্মজীবনীতে বলেছেন, ভিয়েনা স্টেইট অপেরার পরিচালক হওয়া সঙ্গীত জগতের টপ পজিশনে থাকার মতো। এই স্থানে আসার জন্য তিনি ইহুদী বিশ্বাসকে দূরে সরিয়ে খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে এতদূর এসেছিলেন। তিনি মনে করতেন এই আসনটি এতটুকু বলিদান দেয়ার যোগ্যই। আমার মনে হয় আপনিও ঠিক একই জায়গায় আছেন।
সে. ও.- তিনি সত্যিই এমন বলেছিলেন? আপনি কী জানেন তিনি কত বছর ধরে স্টেট অপেরার পরিচালক ছিলেন?
হা. মু. – যদ্দূর মনে হয় দশ বছর।
সে. ও. – একজন ব্যক্তি যিনি এতোদিন ধরে অপেরা পরিচালনা করছিলেন, এটা কতো অদ্ভুত যে তিনি নিজেরটা নিয়ে কখনো লিখেননি। আমার খুব অবাক লাগে তিনি কেন করলেন না। যেহেতু তিনি গানও লিখেছিলেন এবং খুব সচেতন ছিলেন তাঁর শব্দ ও সুরের সমন্বয় নিয়ে।
হা. মু.- আপনি যা বললেন তা সত্যি কিন্তু তিনি যে ধরনের মানুষ ছিলেন একটি গীতিনাট্য বাছাই করা তাঁর জন্য কঠিনই ছিলো।
( “অ্যাবসলোটলি অন মিউজিক”, ২০১৬)