মিকেল্যাঞ্জেলো । গুলজার ।। ভাবানুবাদ : আন্দালীব

মিকেল্যাঞ্জেলো ফ্লোরেন্স থেকে বছর পাঁচেকের জন্য দূরে ছিল। রোমের বিষয়ে সে ক্রমেই ক্লান্ত হতে শুরু করেছে; আঁকার মত কোন জায়গাই এখানে খুঁজে পাচ্ছে না সে আর। কারও নিজস্ব কোন আদল নেই যেন, মুখগুলো দেখতে প্রায় একইরকম, ক্লান্তিকর। এ’কথাগুলোই সে পোপকে বলেছিল। পোপ প্রশ্ন করেছিল – “আমার মুখে কী দেখতে পাও তুমি?” উত্তরে মাইকেল বলেছিল – “একটা জ্বলন্ত মোমবাতি।” পোপ জুলিয়াস এ’কথা শুনে খানিকটা থমকাল, মৃদু হাসল। মাইকেলের এমন চাঁছাছোলা কথাবার্তার সাথে সে আগেই পরিচিত। “তুমি কী বলতে চাইলে, তা খানিকটা বুঝতে পেরেছি। বিপদে পড়লে লোকে চার্চে আসে, এসে বেদীর উপর যেই হাজারো মোমবাতি জ্বালায়, আমি আসলে তার একটার মতই।” উত্তরে পোপকে নিরবতা উপহার দিল মাইকেল।

“আমার অবাক লাগছে এই ভেবে যে, খোদার এই দুনিয়ায় যেখানে একজনের সাথে আরেকজনের চেহারার কোন মিলই নেই; সেখানে তুমি আঁকার জন্য একটাও মুখ খুঁজে পাচ্ছ না! একটা মডেলও না! চার মাস ধরে তুমি পড়ে আছ সেই এক জুডাসের…” পোপের কথা ফুরোবার আগেই সেইন্ট পিটার্স থেকে বেরিয়ে এল মিকেল্যাঞ্জেলো।

পোপ জুলিয়াস মিকেল্যাঞ্জেলোর মনমেজাজ বোঝে ভাল; রোমে মাইকেলের পঞ্চম বছর চলছিল। এই দীর্ঘ পাঁচটা বছর সে সিস্টিন চ্যাপেলের দেয়াল, সিলিং আর গম্বুজগুলোয় ওল্ড আর নিউ টেস্টামেন্টের নানান খণ্ডচিত্র আঁকার কাজ করে যাচ্ছে। এখন কাজটা যখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, তখন মাইকেলের সাথে নতুন করে আর কোন ঝামেলায় যেতে চাইল না জুলিয়াস। তার মনে পড়ল, মিকেল্যাঞ্জেলো যখন পবিত্র আত্মাদের চার্চে যীশুর অবয়বের কাঠখোদাই করছিল, তখন যীশুর মডেল হিসেবে আনা তরুণ লোকটা মনাস্ট্রিতে কী করে যেন হঠাৎ মারা গেল! কিন্তু মিকেল্যাঞ্জেলোর আঁকা তখনও শেষ হয়নি বলে তাকে কফিনস্থ করতে বার ঘন্টা সময় লেগেছিল তাদের। 

মিকেল্যাঞ্জেলো আসলে ব্রামান্তের মতন ব্যাকরণিক ঘরাণার বিশুদ্ধবাদী ভাস্কর বা স্থাপত্বশিল্পী না। সে কারণে ব্রামান্তের চরিত্রগুলো গঠন ও শৈলীর দিক থেকে প্রায় একই রকম। যদিও শাদা চোখে তাদের দুজনকেই একই ঘরাণার শিল্পী বলেই মনে হয়। কিন্তু মূলত বৈচিত্রের কারণেই ব্রামান্তেকে বাদ দিয়ে সে মিকেল্যাঞ্জেলোকে বেছে নিয়েছিল।

পাঁচ বছর আগে  মিকেল্যাঞ্জেলো যখন রোমে এল, তখন সে সেইন্ট পিটার্সের বিশাল গম্বুজগুলোর নিচে এসে শুতো, আর একা-একা কী যেন প্রলাপ বকত! তখন থেকেই তার মানসিক স্থিতি নিয়ে সন্দেহ ছিল জুলিয়াসের। তার অগোচরে একদিন পাশ দিয়ে যাবার সময় জুলিয়াস শুনতে পেল – মিকেল্যাঞ্জেলো একা-একা বাইবেলের স্তোত্র আওড়াচ্ছে।

“কী সব বকছ তুমি, মাইকেল!”

“ওহ” – মিকেল্যাঞ্জেলো পোপের দিকে যেন নতুন দৃষ্টি নিয়ে তাকাল। “আমি আসলে বাইবেলের ছত্রগুলোকে মুক্তি দিচ্ছি।” জুলিয়াস তার কথার গূঢ় মানেটা বুঝতে পারল। শাদা চুনকাম করা ইটের দেয়ালের গায়ে অ্যাঞ্জেলো আসলে তার না-আঁকা মুখগুলোকেই খুঁজছিল। যীশুর মুখ, মাতা মেরীর মুখ, জুডাসের মুখ। শরীরগুলো দেখা যাচ্ছিল পরিষ্কার, কিন্তু অবয়বগুলো যেন বাইবেলের পঙক্তির মধ্যে কোথাও লুকোন ছিল!

মিকেল্যাঞ্জেলো কাগজে অনেকবার জিব্রাইলের মুখাবয়বও এঁকেছিল। জুলিয়াস সকৌতুক জানতে চেয়েছিল, “জিব্রাইলের চেহারা তুমি আঁকলে কী করে! সে তো ভাই এই দুনিয়ার না।”

“আমি তাঁর কন্ঠস্বর শুনেছি। ওল্ড টেস্টামেন্টে।”

“তাহলে তো তুমি খোদার কন্ঠস্বরও শুনেছ।” জুলিয়াসের কন্ঠে আবারও প্রচ্ছন্ন কৌতুক।

“আমি তাঁর নিরবতা শুনেছি”

আর এই বিষয়টাই জুলিয়াসকে আশ্বস্ত করেছিল যে, শিল্পী চিনতে তার ভুল হয়নি। “সে আসলে উদ্ভট এক লোক” ভ্যাটিক্যান কমিটিকে বলেছিল জুলিয়াস; “কিন্তু সুবিশাল এই সিস্টিন চ্যাপেলকে একমাত্র সেই জীবন্ত করে তুলতে পারবে।”

মিকেল্যাঞ্জেলো তার মাকেই মাতা মেরির মডেল হিসেবে বেছে নিয়েছিল। যে’দিন সে তার মাকে একটা বাঁশের মাথায় দুই বালতি পানি অনায়াসেই নিয়ে যেতে দেখল, সেদিন সে এই সিদ্ধান্ত নিল; এমন একজন তেজস্বী মহিলাই কেবল যীশুকে গর্ভে ধারণ করার ক্ষমতা রাখেন। তার মা তার বাবার গোসলের পানি গরম করতে আগুন জ্বালিয়েছিলেন। সে তখন খুব কাছ থেকে সোনালী আগুনের আভায় মা’র মুখটি দেখল – স্বর্ণাভ, উজ্জ্বল আর প্রতিভার চ্ছটায় ভাস্বর। মিকেল্যাঞ্জেলো কাগজে ওই মুখটির অনেকগুলো ছবি আঁকল।

ওই রাতে যখন তারা উনূনের পাশে বসেছিল, মিকেল্যাঞ্জেলো তার মাকে প্রশ্ন করল – “মা, তুমি যীশুর জন্ম দাওনি কেন?”

“কারণ আমার সাথে তোর বাবার দেখা হয়েছিল। ওই দ্যাখ, বেহেড মাতাল লোকটা কীভাবে উপুড় হয়ে পড়ে আছে! যা, তার দেখাশোনা কর গিয়ে।”

সেটা না করে অ্যাঞ্জেলো কয়েকটা কার্ডবোর্ডে তার মদ্যপ পিতার মুখচ্ছবি এঁকে তার পাশেই ঝুলিয়ে রাখল; যেন নেশা কেটে গেলে সে তার মাতাল অবস্থার মুখচ্ছবিটি দেখতে পায়। ছবির নিচে সে লিখেছিল – “বাবা, তুমি এমন না হলে, মা ঠিক-ঠিক মেরি হত!”


“তুমি পাথর এত ভালবাস কেন? আর মোটেই রঙ ভালবাস না!”
“এক রঙ আরেক রঙের সাথে মিশে গেলে তার স্বাতন্ত্র হারিয়ে যায়, কিন্তু পাথরের বদল নেই, জুলিয়াস”


স্কেচটা তার মায়ের মনে ধরেছিল খুব; তিনি সবসময়ের জন্য এটা তার নিজের কাছে রেখে দিলেন। “তুই তোর বাবার এমন একটা ছবি কেন খোদাই করে দিচ্ছিস না; তাকে আমার নিষ্পাপ লাগছে দেখতে।” এই কথার জবাবে সে সবসময় মাকে পাশ কাটিয়েছে এই বলে যে – “এখনও এমন পাথর খুঁজে পাইনি মা, যাতে বাবার মুখটা আমি দেখতে পাই।” 

এইসব অবশ্য অনেক আগের কথা; তারা তখন বোলোনিয়াতে থাকত। বোলোনিয়ার এক তস্যগলির হতশ্রী শুঁড়িখানায় তার যাতায়ত ছিল বেশি। ওটা অবশ্য তার বাবারও প্রিয় জায়গা ছিল; তিনি সাধারণত শুঁড়িখানার ভেতরে বসেই পান করতেন। আর মিকেল্যাঞ্জেলো বোতল নিয়ে বাইরেই বসত। উল্টোদিকের এক বাদাম-বিক্রেতার কাছ থেকে সে বাদাম কিনত প্রায়ই। প্রতিবারই ওজন করার সময় কিছু বাদাম ছল্কে মাটিতে পড়ত; আর প্রতিবারই একটা ন্যাংটো ছেলে ওগুলো তুলত, একটা বাদাম মুখে চালান করে বাকীগুলো সে ঝুড়িতে ফেরত দিত; আর পরের কাস্টোমারের জন্য অপেক্ষা করত। মিকেল্যাঞ্জেলো শুধু এই দৃশ্যটুকু দেখার জন্যই প্রতিদিন বাদাম কিনত। যখন সে ‘ম্যাডোনা অফ ব্রুশ’ ভাষ্কর্যটা তৈরি করল, এই ছেলেটাকে ব্যামবিনোর (শৈশবের যীশু) মডেল হিসেবে ব্যবহার করেছিল সে।এর ঠিক পরই পোপ তাকে ওলা আর নিউ টেস্টামেন্ট থেকে বেশ কিছু খণ্ডদৃশ্য সিস্টিন চ্যাপেলের সিলিঙের গায়ে এঁকে দেখাতে বলে। পোপের সাথে দেখা করতে মিকেল্যাঞ্জেলোকে রোমে যেতে হয়েছিল; ইতালির সব আঁকিয়ে আর ভাস্করই এমন সুযোগ পাওয়ার জন্য নিজেদের আত্মা পর্যন্ত উৎসর্গ করতে প্রস্তুত ছিল; কারণ এই একটা বিষয়ই তাকে জগতে অমর করে রাখার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু মিকেল্যাঞ্জেলো এইসব অমরত্ব-টমরত্বকে পাত্তা না দিয়ে বরং এই মরনশীল জীবনের জন্য মালপানি সংক্রান্ত শর্ত জুড়ে দিল। আসলে মার্বেল পাথর কেনার জন্য তার টাকার দরকার হত। পোপ জুলিয়াস প্রথমে তার এই শর্তে রাজী হলেও পরে টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল।

“তুমি পাথর এত ভালবাস কেন? আর মোটেই রঙ ভালবাস না!”

“এক রঙ আরেক রঙের সাথে মিশে গেলে তার স্বাতন্ত্র হারিয়ে যায়, কিন্তু পাথরের বদল নেই, জুলিয়াস”

রঙের মত রোমের প্রতিও মিকেল্যাঞ্জেলো এখন বীতশ্রদ্ধ। চ্যাপেলের একটা প্যানেলই আর শুধু আঁকা বাকী তার, সেটা ‘দ্য লাস্ট জাজমেন্ট’ । কিন্তু জুডাসের মুখ কল্পনা করতে গেলেই সে খেই হারিয়ে ফেলে বারবার। জুডাসের মুখ কল্পনা করতে চাইলে তার অন্তর্দৃষ্টি যেন শূন্য হয়ে আসে– যীশুর ত্রয়োদশ শিষ্য; যে তিরিশটা মাত্র রৌপ্যমুদ্রার জন্য বিশ্বাসঘাতকতা করে মেসায়াকে রোমানদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল! তাঁকে ক্রুশবিদ্ধ করতে সহায়তা করেছিল, ওহ! আর ভাবতে পারে না মাইকেল। 

জুলিয়াস ক্রমে আরও অসহিষ্ণু হয়ে উঠল। আর মিকেল্যাঞ্জেলো দিনের পর দিন কেবল ছবিই এঁকে গেল। তার পুরনো ড্রইংগুলো নেড়েঘেঁটেও তার কাঙ্ক্ষিত মুখটি কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিল না সে। কিছুই সন্তুষ্ট করতে  পারছিল না তাকে। আর তারপরই হঠাৎ একদিন রোমের এক নোংরা, ঘিঞ্জি শুঁড়িখানায় ‘জুডাস’কে খুঁজে পাওয়া গেল। তার চোখ অপার্থিবরকম জ্বলজ্বলে, অস্থির এক লোক, ক্রমাগত হল্লা করে যাচ্ছিল সে। বয়েসের ছাপ পরতে শুরু করেছে লোকটার গায়ে। সে এত দ্রুত কথা বলছিল যে, শব্দগুলো একটার ফাঁক দিয়ে আরেকটা যেন মাটিতে পড়ে যাচ্ছিল, ছেঁড়া পকেট থেকে যেমন পয়সা গড়িয়ে পড়ে। লোকটা মিকেল্যাঞ্জেলোর কাছে এসে ভিক্ষা চাইল। এ’সুযোগে মিকেল্যাঞ্জেলো তাকে নিয়ে বোতলের ছিপি খুলে বসল। অ্যাঞ্জেলো শুঁড়িখানার বাইরে এল যখন, দেখল আরেকজনের কাছে ভিক্ষা চাইছে লোকটা। মিকেল্যাঞ্জেলো তাকে ডেকে একটা রফা করল এবার; খুলে  বলল আসলে কী চাইছে। লোকটাকে জুডাসের মডেল হতে বলল সে, বিষয়টা তাকে ইতিহাসে অমর করে রাখবে- এই প্রলোভনও দেখালো।

যেই ঝুলন্ত বিছানায় শুয়ে সে চ্যাপেলের সিলিঙে ছবি আঁকত, সেটায় করে লোকটাকে সে দেয়াল আর ছাদের ছবিগুলো ঘুরে-ঘুরে দেখাল। হতবিহবল হয়ে লোকটাও দেখল সব। তবে মওকা বুঝে চড়া পারিশ্রমিক হাঁকতে একদম ভুল করল না। কিন্তু অ্যাঞ্জেলো তার শর্তে রাজি হয়ে গেল। এবার বড় অংকের অগ্রিম বাগিয়ে নিল লোকটা। কিছুদিন  নিয়মিতই এল; সে এলে মিকেল্যাঞ্জেলো তাকে চ্যাপেলের দিকটাতেই বসতে বলত। একদিন লোকটা মিকেল্যাঞ্জেলোর পুরনো কিছু স্কেচ দেখতে-দেখতে একটা শিশুর ছবিতে এসে থমকে গেল; ছবিটা মিকেল্যাঞ্জেলো বোলোনিয়াতে থাকতে এঁকেছিল।

“বহুদিন আগে আমি বোলোনিয়ায় থাকতাম। এই শিশুর মুখটা আমি ব্যামবিনোর (শৈশবের যীশু) মুখ হিসেবে  এখানে এঁকেছি” – মিকেল্যাঞ্জেলো জানালো।

“তোমার কী শিশুটার নাম মনে আছে?” – তার প্রশ্ন।

“হুম… মার্সোলিনি।”

লোকটা স্মিত হাসল। তার জামার হাতা গুটিয়ে বাহুতে জ্বলজ্বলে একটা ট্যাটু দেখাল, লেখা – মার্সোলিনি।

“আমিই সেই যীশু, যাকে দেখে তুমি এই মুহূর্তে জুডাস আঁকছ।”               

শেয়ার