মাহমুদ মাসুদের গল্প ‘কতিপয় অসংজ্ঞায়িত স্বপ্নের ধারাবাহিক’

০১

আমি পড়ি ইউনিভার্সিটিতে। ইউনিভার্সিটির নাম নাই। আমার নিজেরও নাম নাই। টিউশনি থেকে ফিরছিলাম। টিউশনি থেকে ফেরা মানে বাসায় যাওয়ার আগে স্টেশনে যাওয়া, দুইটা পেঁয়াজু আর এক কাপ চা খেয়ে অন্ধকারের মধ্যে কোন একটা টুলে চুপচাপ বসে থাকা। স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দুইটা পাটনাইয়া ছাগল কলার খোসা খাচ্ছে আর এক কোণায় একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে একটা সাদা শার্ট, কালো গ্যাভাডিন প্যান্ট। শার্ট টাক ইন করা। পায়ে পুরনো স্লাইড অন। সেও হয়তো টিউশনি শেষ করে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছে।  হঠাৎ মনে হলো একটু মজা করি। তাকে গিয়ে বলি, তুমি আমার বাসায় যাও আর আমি ট্রেনে চড়ে তোমার বাসায় চলে যাই। একথা শুনে কেমন হকচকিয়ে যাবে তা চিন্তা করি আর মনে মনে হাসি। টুল থেকে উঠতে যাবো এসময় উল্টাদিক থেকে হই-হই করে একদল ছেলে এসে সাদা শার্ট পরা ছেলেটাকে রামদা, ছুরি, কিরিচ এসব দিয়ে কোপানো শুরু করলো। কোপাচ্ছে আর জোরে জোরে চিৎকার করছে। ছেলেটা হকচকিয়ে একবার ডানদিকে তারপর বামদিকে গিয়ে প্ল্যাটফর্মে পড়ে যায়। আমি কি করবো বুঝতে পারি না। কেবল তাকিয়েই থাকি। স্টেশনের দোকানিরা সব ঝাপ ফেলতে থাকে।  আমি দুই একজনকে চিনতে পারি। এরা ডগস পার্টির ছেলেপেলে। আমি কিছুদিন ডগসদের সাথে থাকায় এদের চেনা আমার জন্য সহজ হয়। একবার ভাবি যে যাই, কিন্তু পা নড়ে না। ততক্ষণে কোপানো শেষ করে সব হাওয়া। নিথর হয়ে পড়ে আছে সাদা শার্ট। আমি তখনও বুঝতে পারি না আমার কী করা উচিত। আমার পা দুটো কয়েকশ মণ ওজনের খাম্বা হয়ে মাটিতে গেঁড়ে থাকে। আমি সামনে এগোতে চাই, কিন্তু পা কিছুতেই নড়ে না। আমি নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি আমার পা দুটো মাটিতে দেবে যাচ্ছে।  আমি কিছু একটা বলার চেষ্টা করি। তখনই বুঝতে পারি যে আমার কোনো মুখ নেই।

০২

বাসা থেকে বের হয়ে কিছুদূর হাঁটলেই চোয়ানির খাল। তার উপর ব্রিজ। রাত একটু গাঢ় হলেই ব্রিজের উপর দুই পাশে বসে গাঁজা আর মদের আড্ডা। আমি এখন এই ব্রিজের রেলিং-এ বসে থাকি। স্টেশনে আর যাই না। আমার পাশে এসে কে একজন বসে। অন্ধকারে বোঝা যায় না কে।

বলে, “কি, আজ টিউশনি নাই?”

“আছে। যাই নাই, মামা। তুই যাস নাই?” আমি বলি।

আসলে আমি ভেবেছিলাম শেরিফ মামা। শেরিফ মামা হচ্ছে টিউশনি লর্ড। আমরা কয়েকজন আছি যারা ক’টা টিউশনি করে কোন রকম বেঁচে থাকি। সব এই মামার দান।

“আমি তো আর এখন টিউশনি করার অবস্থায় নাই।”

“মানে? বুঝলাম না।”

“বুঝলা না মানে। আমি না মইরা গেলাম? ওই যে, ওই দিন তোমার সামনে আমাকে কোপায়ে মেরে ফেললো”

আমি থতমত খেয়ে গেলাম। আমিতো কাউকে বলিনি যে আমি সেদিন সেখানে ছিলাম। হাত পা প্রথমে ঠান্ডা, তারপর শক্ত হয়ে গেল। ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম এ শেরিফ মামা না। এ হচ্ছে রূপাই। সেই সাদা শার্ট। এর ছবি আমি পেপারে দেখেছি। অসম্ভব রূপবান এক ছেলে। এর রূপের কাছে মেয়েরাও ফেইল। পেপারে লিখেছে অজ্ঞাত পরিচয় দুর্বৃত্তরা একে মেরে রেখে গেছে। আবার লিখেছে ধারণা করা হচ্ছে এ হগস পার্টির ছেলে অথবা ডগস পার্টির ছেলে। আরও লিখেছে, অজ্ঞাতরা ডগস হতে পারে অথবা হগসও হতে পারে। আরও লিখেছে যে সে তার বাবা মার একমাত্র ছেলে এবং আশা-ভরসার শেষ আশ্রয়স্থল ছিলো। আরও লিখেছে সে ছিল অনেক মেধাবী। আরও লিখেছে ওর খুনকে কেন্দ্র করে ডগসরা আর হগসরা ক্যাম্পাস উত্তপ্ত করে রেখেছে; ক্লাস, পরীক্ষা সব বন্ধ। যেটা লিখেনি তা হলো, ও যখন খুন হয় তখন আমি অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে সব দেখছিলাম। লিখেনি যে আমি সেদিনও চুপ করে তাকিয়ে ছিলাম, এখনও চুপ করে আছি। এটাও লিখেনি যে আমি এখন স্বাভাবিক হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, যেন কিছুই হয়নি।

“মিয়া। তোমার সামনে আমারে মেরে ফেললো আর তুমি দাড়ায়া দাড়ায়া দেখলা। মরার আগেতো মানুষ পানি হলেও দেয়। নাকি?”

আমি ঢোঁক গিললাম। ইনিয়ে-বিনিয়ে যা বললাম তার সারাংশ এই যে আমি যেতেই চেয়েছিলাম কিন্তু আমার পা দুটো হয়ে গিয়েছিলো কয়েক শ মণ পাথরের খাম্বা। আবার আমার পা যাচ্ছিল মাটিতে দেবে। তখন আমার মুখটাও ছিল না। কিন্তু রূপাই এসব শুনতেই চাইলো না। সে বললো যে আমাকে ব্রিজ থেকে গু, মুত, ময়লা আর দুর্গন্ধঅলা খালের পানিতে ফেলে দেবে। তারপর আমার ডুবে যাওয়া দেখবে। আমি অনেক কাকুতি-মিনতি করলাম। কিন্তু সে আমাকে সত্যিই খালের মধ্যে ফেলে দিল আর যত গু, মুত আর ময়লার মধ্যে আমি ডুবে যেতে থাকলাম। রূপাই আমার ডুবে যাওয়া দেখছে আর আমার দিকে তাকিয়ে অট্টহাসি দিচ্ছে। তার পাশে দাঁড়িয়ে একই রকম হাসি দিচ্ছে আরেকটা আমি। আমি অবাক হতে হতে ডুবে গেলাম।

০৩

ঘুমিয়ে আছি। হঠাত ধাক্কাধাক্কিতে জেগে উঠলাম। রূপাই আমার বুকের উপর বসে আছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো। এ সময় ও আমার গলা চেপে ধরলো আর বলতে লাগলো, “আমি কী করেছি বল। বল, আমি কী করেছি? ওরা আমায় কেন মেরে ফেললো? না বলতে পারলে আজ তুই শেষ।” আমি রূপাইর হাত দুটো ছাড়ানোর প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু হাত একটুও নড়লো না, যেন আমার শরীরে একটুও শক্তি নেই। আমার দম বন্ধ হতে থাকলো।

০৪

থানার বিপরীত পাশে একটা ছোটো চায়ের দোকান। তার সামনে দু’টা বেঞ্চ। একটা কাঠের, নড়বড়ে আর একটা লোহার। আমি কাঠেরটাতে বসে আছি আর লোহারটাতে বসে আছে কনস্টেবল হোসেন। তার নেমপ্লেটে বড় বড় করে লেখা ইমাম হোসেন AB- । পুলিশ ব্র্যান্ডের সানগ্লাস পরে আছে। আমি দোকানদারকে বললাম এক প্যাকেট শেখ হোয়াইট দাও। প্যাকেটটা নিয়ে ইমাম হোসেনের হাতে দিলাম। ইমাম হোসেন বিনীত হয়ে নিলো। তারপর বললো যে সে এসব কখনোই করে না। তার নাম যেরকম কাজও সেরকম। চাকরির বয়স প্রায় ২৩ বছর। এর মধ্যে কেউ তাকে জোর করেও এককাপ চা খাওয়াতে পারেনি। আজ যেহেতু আমি আগ্রহ করে দিচ্ছি তাই নেয়া। তার সাথে অনেকে দুই-তিন তলা বিল্ডিং-এর মালিক এসব আরো কি কি বললো। আমি অভিভূত হয়ে শ্রদ্ধাবনত চোখে তাকিয়ে থাকলাম। ইমাম হোসেন আমাকে জিজ্ঞেস করলো যার মার্ডার হইছে সে আমার কি হয়। আমি বললাম যে পরিচিত। এবার জিজ্ঞেস করলো যে তার মার্ডারের কারণ জেনে আমি কি করবো। বললাম দরকার আছে।  সে বলতে শুরু করলো, “ঘটনা হইলো ওই পোলা সুবিধার না। সে করে হগস পার্টি। ডগস পার্টির পোলাপানদের সাথে বেয়াদবি করছে আর দিছে মাইরা। এইগুলা ভেতরের কথা। আর কেউ যেন না জানে। আরে বাবা তোরা আসছস পড়তে এত পার্টি-মার্টি করে কি হবে। তুমি আবার কোন পার্টি কর নাতো?” আমি বললাম যে করি না। ইমাম হোসেন বললো তার চায়ের বিল দিয়ে দিতে। আমি বিল দিতে গেলাম আর দোকানদার বললো যে বিল হয়েছে সাতাত্তর হাজার সাত শত সাতাত্তর টাকা। এগুলো গত সাত মাসের বাকি খাওয়ার বিল। আমি থ মেরে গেলাম। আমার পকেট হাতড়ে দেখি সাত টাকা আছে। আমি করুণ দৃষ্টিতে ইমাম হোসেনের দিকে তাকালাম। সে দাঁত খোঁচাচ্ছে। আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “বিল দে শালা।” আমি বললাম যে আমার কাছে মাত্র সাত টাকা আছে। সে সর্বশক্তি দিয়ে একটা চড় দিলো। উলটে পড়ে গেলাম আর মাথা ঘোরা শুরু হলো। অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ালাম। চোখ গেল ইমাম হোসেনের নেমপ্লেটের দিকে। সেখানে লেখা আছে ইয়াজিদ AB+ । কিরে বিল দে, খেঁকিয়ে উঠে ইমাম হোসেন, মানে ইয়াজিদ। আমার ঝেড়ে দৌড় দিতে ইচ্ছে করলো। কিন্তু পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি ডান্ডাবেড়ী দেয়া। “তোর পকেটে ইয়াবা পাওয়া গেছে, বারো বছর জেল, বিল দিয়ে দিলে ছয় বছর।”, চোখমুখ শক্ত করে বলে ইয়াজিদ। আমি ঘামতে শুরু করি। বুঝতে পারি প্রেসার বেড়ে যাচ্ছে। ১৪০,১৫০,১৭০, ১৮০,২০০। আমার নাক থেকে রক্ত পড়ছে। এক ফোঁটা, দুই ফোঁটা, গলগল।

০৫

দুপুরবেলা। আমি স্টেশনের ভেতর দিয়ে শর্টকাট নিচ্ছি। শূন্য প্ল্যাটফর্ম। এর মাঝে একজন বসে আছে। একটু কাছে যেতেই দেখি রূপাই। ঠিক যে জায়গায় খুন হয়েছে সেই জায়গায় বসে আছে। তার সমস্ত শরীরে রক্ত। তার বসার ভঙ্গিতে মনে হচ্ছে সে ধ্যান করছে। আমাকে বসতে বললো। আমি তার মতো করে ধ্যানের ভঙ্গিতে বসলাম। অনেকটা সময় ধরে আমরা চুপ করে বসে থাকলাম। তারপর সে বলে উঠলো যে তার অনেক শীত লাগছে। শীতের কথা আসলেই তার মায়ের কথা মনে পড়ে। সে বলে মা তার জন্যে প্রতি বছর একটা করে সোয়েটার বোনে। শীত এলে তাকে দেয়। সে এও বলে প্রতিবারই সোয়েটারটি হয় লাল রঙের। আমাকে জিজ্ঞেস করে আমার মা আমাকে শীত এলে কি দেয়। আমি একটু ভেবে বলি মা আমাকে পিঠা বানিয়ে দেয়। আমার প্রিয় হচ্ছে গরম গরম ভাঁপা পিঠা। মা ভাঁপা পিঠা বানায় আর আমি চুলার পাশে বসে খাই। তখন রূপাই বলে সে আমার মায়ের হাতে ভাঁপা পিঠা খাবে আর আমাকে তার মায়ের বোনা একটা সোয়েটার দেবে। লাল সোয়েটার। তারপর সে জিজ্ঞেস করে যে ওরা তাকে কেন মারলো। আমি সব বলে দিলাম। সে যে হগস পার্টি করতো আর ডগসদের সাথে বেয়াদবি করেছিলো, আর এজন্য যে ডগসরা তাকে মেরে দিলো এসব। রূপাই আমার দিকে আগুন চোখে তাকিয়ে বললো যে সে কোনকালেই হগস পার্টি করতো না, বরং কিছুদিন ডগসদের সাথে ওঠাবসা ছিল। আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। মনে হলো সে এক্ষুনি আমার গলা চেপে ধরবে। সে হেসে দিলো। তারপর বললো সে আমার মায়ের হাতের ভাঁপা পিঠা খেতে চায়। আমি বললাম, আচ্ছা। তখন দেখি রেললাইনের ওপরে বসে মা পিঠা বানাচ্ছে। তারপাশেই আরেকজন বসে  সোয়েটার বুনছে। রূপাই বললো তার মা আমার জন্য সোয়েটার বুনছে। এসময় একটা ট্রেন এলো। ওইদিকে লাইনের ওপর আমার মা আর রূপাইর মা। আমি চিৎকার করে তাদের সরতে বললাম। তারা যেন কিছুই শুনছে না। একমনে তাদের কাজ করে যাচ্ছে। রূপাইর দিকে তাকিয়ে দেখলাম সেও রেললাইনে গিয়ে বসেছে। আমি দৌড়ে গিয়ে তাদের সরিয়ে দিতে চাইলাম। কিন্তু আমার পা কিছুতেই নড়লো না। ওইদিকে ট্রেন তাদের দিকে ছুটে আসছে।

০৬

আমি ফালতুর মেসে বসে আছি। ফালতুর আসল নাম কি জানি না। সে এই জগতের সব দোকানে বাকিতে খায়। কোন এক দোকানি তার নাম দিয়ে দিয়েছিল ফালতু। এরপর থেকে তার নাম ফালতু। ফালতু তার খাটে বসে হাত চুলকাচ্ছে। হাত চুলকাতে চুলকাতে বললো, “তোর কাছে বিশ টাকা হবে?” আমি বললাম, “হবে।” তারপর গায়ে একটা টিশার্ট চড়িয়ে বললো, চল। আমি ওর পেছন পেছন স্টেশন পর্যন্ত গেলাম। সে একটা গলিতে ঢুকলো। গলির মাঝখানে লন্ড্রি দোকান থেকে কি জানি নিলো। তারপর স্টেশনে গিয়ে বসলাম আমরা। আমাকে বললো, “যা, এক প্যাকেট শেখ হোয়াইট নিয়ে আয়।” আমি আনলাম। সে খুব যত্ন করে দু’টা গাঁজার স্টিক বানালো। সে একটা ধরালো, অন্যটা আমাকে দিল। গাঁজা শেষ করে আমরা দম ধরে বসে রইলাম। সুযোগ বুঝে ফালতুকে বললাম, “তোরা রূপাইকে কেন মারলি?” তার কোন ভাবান্তর হলো না। সে যেন আগে থেকেই জানে যে রূপাইকে খুন করতে আমি তাদের দেখে ফেলেছিলাম। সে চুপ করে থাকলো। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম। এবার সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “ওই পোলার জন্য আমারও খারাপ লাগে রে, বেচারা বাটে পড়ে গেছিলো। অনেকদিন ক্যাম্পাসে কোন ঝামেলা হইতেছিল না। আমরা আসছিলাম হগসদের কাউরে পাইলে ফালায় দিয়া একটা ঝামেলা লাগাইতে। কিন্তু দেখি কেউ নাই এই পোলা ছাড়া। সবগুলা মাল টেনে আসছিলাম। কাউরে না কাউরে ফালাইতে হবে। পরে এরেই ফালায়া দিতে হইলো। ভালো হইছে। এই বালের দুনিয়ায় থাইকা কি হবে। তাওতো আমাদের একটা কাজে লাগলো। ” এক টানে কথাগুলো বলে সে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে থাকে। হাসতে হাসতেই বলে, “এখন তোর একটা গতি করতে হবে। তুই শালা দেখে ফেলছস। খুন আর ধর্ষনের কোন সাক্ষী রাখতে নেই।” এই বলে জাপটে ধরে। আশপাশ থেকে কয়েকজন ছুটে এসে আমাকে ধরে শুইয়ে ফেলে আর একজন একটা গরু জবাইয়ের ছুরি দিয়ে আমার গলায় পোঁচাতে থাকে। ছুরিটা ভোঁতা। তাতে তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। সে পোঁচ দিয়েই যাচ্ছে। গলা একটু একটু করে কাটছে আর আমি গরুর মতো তড়পাচ্ছি।

০৭

আমি আর রূপাই দাঁড়িয়ে আছি, ওভারব্রিজে। অনেকক্ষণ চুপ থেকে রূপাই বলে, “কি জন্য মারছে আমাকে?” আমি যন্ত্রের মতো সব বললাম আবার।

“মানে কি? ক্যাম্পাসে ঝামেলা পাকানোর জন্য একটা লাশ দরকার ছিল? আর সেই লাশ আমি?”,

রূপাইকে হতবিহবল মনে হয়। আমি চুপ করে থাকি। চুপ করে থাকা ছাড়া কোন গতিও নেই আমার। অস্বস্তিকর এক নীরবতা আমাদের ঘিরে থাকে। আমার বারবার মনে হতে থাকে রূপাই আমার গলা চেপে ধরবে। সে গলা চেপে ধরে না। তার পকেট থেকে দুই বোতল কেরুর ভদকা বের করে। একটা আমাকে দেয়।

তারপর বলে, “ কি আর করা। চলো আমার নামে এক পালা হয়ে যাক”। বোতলের ছিপি খুলে “টু মি” বলে পেটে চালান করে দিতে থাকে। তার দেখাদেখি আমিও ছিপি খুলে বোতলের মুখে মুখ লাগাই। তারপর আমরা খেতেই থাকি আর খেতেই থাকি। কিন্তু ভদকা আর ফুরায় না। মনে হয় যেন পৃথিবীর সব ভদকা এই দুই বোতলেই আছে। আমরা অনেকক্ষণ ধরে ভদকা গিলি। একসময় আমার বমি পায়। আমি বলি যে আমার বমি পাচ্ছে। রূপাই বলে, তারও বমি পাচ্ছে। সে আরও বলে তার নামে পান করা হলো, এখন কারো নামে বমি করতে হবে। আমার মাথায় একটা আইডিয়া আসে। আমি বলি  আমরা ডগস আর হগসদের নামে বমি করে দেবো। রূপাই বলে শুধু ডগস আর হগস না, ডগস এর উপরে ডগস, তারও উপরের ডগস, তারও উপরের ডগস। আমি মজা পেয়ে যাই। আমি বলি হগসের উপরে হগস, তারও উপরের হগস, তারও উপরের হগস। এই বলে আমরা বমি করতে থাকি। বমির সাথে বের হয়ে আসে তাজা তাজা রক্ত, পুরনো হয়ে যাওয়া চাকা-চাকা রক্ত। আমরা বমি করতেই থাকি। আমাদের বমিতে ভেসে যেতে থাকে স্টেশন, ক্যাম্পাস, এইসব নোংরা নোংরা শহর নগর সবকিছু। একসময় বমি আমাদেরও ডুবিয়ে দিতে থাকে। বমি আমাদের গলা পর্যন্ত উঠে যায়। আমি ভয় পেয়ে যাই। বমি থামানোর প্রাণপণ চেষ্টা করি। রূপাইকে ডাকি। সে কোথাও নেই। আমি একা একা বমি করে যাচ্ছি। আর আমার বমিতে আমিই ডুবে যাচ্ছি। আমার সাথে সাথে ডুবে যাচ্ছে সবকিছু।

০৮

আমি ডাক্তারের সামনে বসে আছি। ডাক্তার আমার স্বপ্নগুলোর বর্ণনা লেখা কাগজটি পড়া শেষে ভাঁজ করতে করতে জিজ্ঞেস করলো, “আর স্বপ্ন দেখেননি?”

আমি বললাম, “না”।

“শেষ স্বপ্ন কবে দেখেছেন?”

“গত বৃহস্পতিবার রাতে।”

“আচ্ছা, কিছু ওষুধ লিখে দিচ্ছি। আই হোপ আর এ ধরনের কোন স্বপ্ন দেখবেন না।”

“ঠিক আছে, স্যার।” এই বলে আমি উঠে দাঁড়ালাম।

“একটা কথা। আপনার স্বপ্নের রূপাই দেখতে কেমন ছিল?”

আমি মনে করতে পারছিলাম না। শুধু মনে পড়ছিলো সুদর্শন ছিল।

“পুরো চেহারা ঠিক মনে করতে পারছি না। তবে সুদর্শন ছিল। আর লম্বা চুল ছিল।”, বললাম।

ডাক্তার তার মুখের মাস্ক খুলে বললো, “দেখুনতো এরকম কিনা?”

আমি চমকে উঠে পেছনে সরে এলাম। ডাক্তার মুচকি হাসছে। আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম। ডাক্তারের এসিস্ট্যান্ট এসে বললো, “স্যার, ভিজিটটা?”

আমি তার দিকে তাকালাম। আবার চমকালাম। রূপাই হাত বাড়িয়ে আছে। এবার ছুটে রাস্তায় এলাম। একটা সিএনজিতে লাফিয়ে উঠলাম।

সিএনজি ড্রাইভার পেছনে তাকিয়ে বললো, “কোথায় যাবেন স্যার?”

এবার আমার চোখ বেরিয়ে আসতে চাইলো। এ যে রূপাই! আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সিএনজি থেকে নেমে গেলাম। কিন্তু একি! রাস্তায় অসংখ্য রূপাই। কেউ হেঁটে যাচ্ছে। কেউ চায়ের দোকানে চায়ে বিস্কুট ডুবিয়ে খাচ্ছে। কেউ অযথা দাঁড়িয়ে আছে। কেউ বাইকে চড়ে আরেকটা রূপাইকে পেছনে বসিয়ে চলে যাচ্ছে। আমার মাথা আর কাজ করছে না। একবার মনে হচ্ছে আমি আরেকটা স্বপ্ন দেখছি। আবার মনে হচ্ছে তা কি করে হয়, আমিতো ঘুমাই-ইনি। আবার মনে হলো হয়তো ঘুমেই আছি কিন্তু বুঝতে পারছি না। মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। এক কাজ করা যায়, স্বপ্নের মাঝে বিপদ হলে আমি নড়তে পারি না, পা দু’টা পাথর হয়ে যায়। সেটা টেস্ট করা যায়। কিন্তু রিস্ক আছে। তবুও সিদ্ধান্ত নিলাম এটাই করবো। আমি রাস্তার মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালাম। একটা বাস দ্রুতগতিতে ধেয়ে আসছে আমার দিকে। আরেকটু কাছে এলেই আমি লাফ দিয়ে সরে যাবো। বাস খুব কাছকাছি চলে এসেছে। এক্ষুণি প্রমাণ হয়ে যাবে এটা স্বপ্ন না বাস্তব।

শেয়ার