মাহমুদ দারবিশ ১৩ মার্চ, ১৯৪১ সালে ফিলিস্তিনের আল বিরওয়েহ শহরে এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময়, তার গ্রাম ধ্বংস হয়ে যায়। তার পরিবার লেবাননে পালিয়ে যায়। পরের বছর তারা ফিরে আসেন। গোপনে স্বদেশে পুনরায় প্রবেশ করেন।একজন যুবক হিসেবে, দারবিশ তার রাজনৈতিক সক্রিয়তা ও প্রকাশ্যে কবিতা পড়ার জন্য গৃহবন্দি ও কারাবরণ করেন। তিনি ১৯৬০-এর দশকে রাকা রাজনৈতিক দলে যোগ দেন। ১৯৭০ সালে তিনি রাশিয়া চলে যান। যেখানে তিনি এক বছরের জন্য মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন।পরে কায়রোতে চলে যান। তিনি ২৬ বছর নির্বাসিত জীবনযাপন করেন। থাকেন বৈরুত ও প্যারিসে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত। তারপর তিনি পশ্চিম তীরের রামাল্লায় বসতি স্থাপন করেন।
ফিলিস্তিনের সবচেয়ে বিশিষ্ট কবি হিসেবে বিবেচিত, দারবিশ তার প্রথম কবিতার সংকলন, জলপাই পাতা(১৯৬৪) প্রকাশ করেছিলেন যখন তার বয়স মাত্র বাইশ।তারপর থেকে দারবিশ কবিতার বই এবং গদ্য সংকলন মিলিয়ে প্রায় ত্রিশটি বই প্রকাশ করেছেন, যা বাইশটিরও বেশি বিদেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।এক কথায় মাহমুদ দারবিশকে বলা যায় ফিলিস্তিনি জনগণের অপরিহার্য শ্বাস। তিনি ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি। সারা বিশ্বের পাঠক নন্দিত এক কবি মাহমুদ দারবিশ, একই সাথে যার কবিতায় নন্দন, গণচিন্তা ও মানবমনের গভীর ভাববৈচিত্র্য শৈল্পিক দক্ষতায় নিপুণ হয়ে ধরা পড়েছে।দারবিশ ৯আগস্ট, ২০০৮-এ হার্ট সার্জারির জটিলতায় হিউস্টনে ইন্তেকাল করেন। বর্তমান কবিতাটি কবির ’Silence for Gaza’ Sinan Antoon ও Adib S. Kawar-এর করা ইংরেজি অনুবাদ থেকে বাংলায় করা। গাজা নিয়ে দারবিশের এ কবিতায় তার ভাবচিন্তা বর্তমানে চলমান আগ্রাসন ও গণহত্যা, পশ্চিমাদের ফিলিস্তিন নিয়ে অতীত-বর্তমান যে রাজনৈতিক চাল তাও উঠে এসেছে।
গাজা অর আত্মীয়দের থাকি বহুত দূরে রয়
গাজা দুশমনের কোলে চড়ি রয়,
কারণ যহনই গাজা ফাটে,
তহনই অ একখান দ্বীপ হই উঠে
আর অ কহনই ফাটতে জিরায় না।
অ দুশমনের মুখ আঁচড়াই দিয়া
তার খোয়াব তছনছ করি ছাড়ে
তার সময়ের আরামরে হারাম করি ছাড়ে।
কারণ গাজায় সময়টা অন্যরকম।
কারণ গাজায় সময় নিরপেক্ষ কিছু ন।
গাজা মানুষরে গভীর চিন্তায় সান্ধাইতে বাধ্য করে না
বরং ফাটানো আর বাস্তবতার লগে সংঘর্ষে
শিক্ষা দিয়া ছাড়ে।
সেইখানে সময় শিশুদের শৈশব থাকি বুড়ায়
বুড়ায়ে দেয় না,
বরং দুশমনের লগে তাগেরে
পহেলা ডলায় পুরুষ করি তোলে।
গাজায় সময় মানে বিশ্রাম ন,
বরং তা জ্বলন্ত দুপার বেলা ঝড়ের কবলে পড়া
কারণ গাজার বুজ ভিন্ন,
ভিন্ন, ভিন্ন।
দখলের কবলে পড়া লোকদের এক নম্বর বুজ
হইল দখলের বিরুদ্ধে
অর প্রতিরোধের ঝাজ।
সেইখানে এইডাই একমাত্র প্রতিযোগিতা।
এ নিঠুর, মহান বুজরে জানার নেশা হইছে গাজার।
বই, তাড়াহুড়ো করা স্কুলের সেমিনার,
চড়াস্বরের মেগাফোন বা গান থাকি অ শিখে নাই।
এইটা অ একার অভিজ্ঞতা, কাজ আর শ্রমের মাধ্যমে শিখছে
অ বিজ্ঞাপনচিত্রের জন্য শিখে নাই
অস্ত্রের অহংকার
বিদ্রোহী ভাবসাব আর বাজেট
দেখানোর লাগি অ শিখে নাই
অর তিতা গোস্ত অরে তুলি ধরে
স্বেচ্ছায় অ রক্তে ভিজে
গলা ফাটানোই গাজা ওস্তাদ ন
অর কোনো গলা নাই
অর গলার চামড়ার ছিদ্রগুলি কথা কয়
ঘামে, রক্তে আর আগুনের ছিদ্রগুলা দিই কথা কয়।
তাই দুশমনরা এইখান হইতে খুনখারাবি শুরু করতে ঘিন্না করে
ভয় পায় খুন করতে
আর তাই তারা সাগরে মরুভূমি বা রক্তে ডুবায়ে মারার
চেষ্টা করে।
আর তাই এর কুটুম স্বজন বন্ধুরা
অরে এমন এক নম্রতার সাথে ভালোবাসে
যা কভু হিংসা আর ভয়ের সমান,
তাই গাজা হইল নৃশংস পাঠ
দুশমন আর দোস্তদের লাগি
একইভাবে চকমকি নজির।
গাজা সবচাইতে সুন্দর শহর ন।
অর সাগরতীর আরব শহরগুলির তীরের চাইয়ে নীলা ন।
আর অর কমলা ভূমধ্যসাগরীয় অববাহিকায় সবচাইতে সুন্দর ন।
আর গাজা সবচেয়ে ধনী শহর ন।
আর অ সবচাইতে আগানো কোনো শহর ন,
তয় অ পুরা জাতির ইতিহাসের সমান,
কারণ অ দুশমনের চোখে চরম কুৎসিত,
চরম দরিদ্র, চরম দুর্দশা চরম দুর্ধর্ষ।
কারণ অ দুশমনের লাগি চরম এক শিক্ষা
কারণ অ দুশমনরে ঝামেলায় ফালানোই ওস্তাদ
কারণ অর কমলারা হইল বুবি ট্রাপ
কারণ অর শৈশবহীন শিশু, বুড়া বয়স ছাড়া বুড়া
অর কামনাহীন নারী
এইসব কারণেই অ আমাদের মইধ্যে সবচাইতে সুন্দর,
সবচেয়ে খাসা আর ধনী আর পুরাই ভালবাসার যোগ্য।
গাজারে আমরা অবিচার করি
যহন আমরা অর কবিতা খুঁজি,
কারণ যে কবিতা অর নাই সেই কবিতাই
তারে সুন্দরের সুন্দর বানাইছে
তাইলে আসেন আমরা গাজার সৌন্দর্যরে বিকৃত না করি
এর মধ্যে সবচাইতে সুন্দর যেইডা
তা হইল অ এমন একটা সময়ে কবিতাবর্জিত
যহন আমরা কবিতা দিয়া দুশমনরে হারানের কোশেস করছি
আর দুশমনরা আমাদের গান গাইতে দেখি খুশি হইছে
আমরা তাদেরে বিজয়ী হইতে দিছিলাম,
যহন আমরা আমাদের কবিতারে
ঠোটের উপর পড়তে গিয়া শুকাইছি
আমরা যে দুশমনদেরে রাখি গেছি তারা শহর, দুর্গ আর
রাস্তাগুলি তৈয়ার শেষ করছে।
আমরা গাজার প্রতি অবিচার করি
যহন আমরা অরে একটা মিথে হাজির করি,
কারণ আমরা অরে ঘিন্না করি যেই
আমরা সত্যিই দেখিছি যে
এইটা একটা ছোট গরিব শহর ছাড়া কিছুই না
আর অ প্রতিরোধ করে
আমরা যহন জিগাই
কি এইটারে মিথ বানাই ছাড়ছে?
যদি আমাদের কোনো মর্যাদা থাকত,
তবে আমরা আমাদের সমস্ত আয়না ভাঙি ফেলতাম
আর কানতাম বা অভিশাপ দিতাম অরে
আমরা অরে বাদ দিতাম
নিজেগের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করি।
আমরা গাজার প্রতি অবিচার করি
যদি আমরা অরে গুণমুগ্ধ প্রশংসা করি,
কারণ মন্ত্রমুগ্ধতা আমাদেরে
অপেক্ষার এক কিনারে ফেলায়ে দেয়
তহন গাজা আর আমাদের কাছে আসে না
গাজা আমাদের মুক্ত করে না
গাজার নিজের কোনো ঘোড়া নাই, বিমান,
জাদুর কাঠি বা রাজধানী শহরে অফিস নাই।
গাজা সাথে সাথে আমাদের সব গুণগুলি থাকি
তার নিজেরে মুক্ত করে
আমাদের ভাষা
সহজাত সব কিছুর থাকি
গাজা আমাদেরে মুক্ত করে
যহন আমরা অর লগে দেখা করি স্বপ্নে –
সম্ভবত অ
আমাদেরে চিনতে পারে না,
কারণ গাজা আগুন থাকি জন্মিছিল
যহন আমরা হারানো ঘরগুলির জন্য অপেক্ষা
আর কান্দি আমরা তন আমরাও জন্মাইছিলাম
এইটা সত্য যে গাজার নিজের বিশেষ পরিস্থিতি আছে
নিজস্ব প্রকৃতি আছে
বাট অর সিক্রেট কোনো ধাঁধা ন:
অর প্রতিরোধ জনপ্রিয়
শক্ত রকমের
আর অ জানে এইটা কী চায়
অর পোশাক থাকি দুশমন বার করি নিতে চায়
(অ তাড়াইতে চায়)
গাজার মানুষের প্রতিরোধ
চামড়ার সাথে হাড়ের মতন যে সম্পর্ক সেরকম,
ছাত্রদের সাথে শিক্ষকের সম্পর্ক ন
গাজায় প্রতিরোধ বেতনখাটা চাকুরেদের মতো ন
কোনো প্রতিষ্ঠানের মতোও ন
অ কারও কর্তত্ববাদীতার পাত্তা দেয় না
অর ভাগ্য কারও স্বাক্ষর বা
হস্তচ্ছাপের লাগি আটকাই থাকে না
আমরা যদি আর নাম, ছবি বা বাগ্মীতা হিসাবে জানি
তবে অ তারে এতটা গুরুত্ব দেয় না।
অ বিশ্বাস করে নাই যে অ
মিডিয়ার লাগি কোনো উপাদান আছিল।
অ ক্যামেরার লাগি প্রস্তুত ন
আর মুখে হাসির পেস্ট দেয়া হয় নাই
অ এইটা চায় না আর আমরাও না
তাই, গাজা বণিকদের জন্য একটি খারাপ ব্যবসা
আর তাই গাজা আরবদের কাছে
একটি অতুলনীয় নৈতিক ধন।
গাজা নিয়া যা সুন্দর তা হইল
আমাদের গলা সেইখানে পৌঁছায় না
কিছুই বিভ্রান্ত করে না
কিছুই দুশমনের মুখ থাকি খাবার কাড়ি নেয় না।
ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রূপ নয় আমরা চাঁদের পূর্ব দিকে,
বা মঙ্গল গ্রহের পশ্চিম দিকে
তা অন্বেষণ করার সময় প্রতিষ্ঠা করব।
গাজা নাকচে ওস্তাদ
খিদা আর নাকচ, তৃষ্ণা আর নাকচ,
বাস্তুচ্যুতি আর নাকচ,
নির্যাতন আর নাকচ
অবরোধ আর নাকচ,
মওত আর নাকচ,
দুশমনরা গাজার উপর বিজয়ী হইতে পারে
ঝড়ো সাগর একটা দ্বীপের উপর বিজয়ী হতে পারে…
তারা তার সব গাছ কাটি টুকরাটুকরা করতে পারে
তারা অর হাড় ভাঙি দিতে পারে
তারা অর শিশু আর
মহিলাদের ভিতরে ট্যাঙ্ক বসাইতে পারে
তারা গাজারে সমুদ্র, বালি বা লহুতে ফেলি দিতে পারে।
বাট অ মিথ্যারে ঘুরাইঘারাই কইবে না
আর আগ্রাসীগোরে “হ্যাঁ” কইবো না
গাজা ফাটাইতে থাকব
অ মওত ন,
আত্মহত্যাও ন
এইডা গাজার নিজস্ব স্টাইলে ঘোষণা
অর বাচি থাকার যোগ্য
অ ফাটাইতে থাকবো
এইটা মৃত্যুও নয়, আত্মহত্যাও নয়।
এইটা গাজার ঘোষণার উপায় যে
অ বাঁচি থাকার যোগ্য।
জহির হাসান
কবি, গদ্যকার ও অনুবাদক