মাহমুদ দারবিশ। ফিলিস্তিনের গালিলি প্রদেশের আল বিরওয়াহ গ্রামে কবির জন্ম, ১৯৪২ সালে। ১৯৪৮ সালে ইসরাইলীদের আক্রমনের ফলে মাত্র ছয় বছর বয়সে সপরিবারে লেবাননের পথে রওয়ানা করেন, গভীর রাতে। পেছনে ফেলে যান উপত্যকার উপর সবুজ সুন্দর গ্রাম, শৈশবের সোনামাখা দিনগুলির স্মৃতি। সেই থেকে শুরু তার উন্মূল উদ্বাস্তু জীবনের। আমৃত্যু কোথাও স্থির হতে পারেননি। ২০০৮ সালের ৮ আগস্ট চিরতরে বিদায় নেন কবি। কিন্তু তাঁর কবিতা, তাঁর প্রিয় দেশ, দেশের জন্য সংগ্রাম, সবই রয়ে গেছে। দারবিশের আফসোস, প্রিয় মাতৃভূমিকে স্বাধীন-শৃংখল-মুক্ত দেখে যেতে পারেননি। হুজাইফা মাহমুদের অনুবাদে ফিলিস্তিনি জাতিসত্তার কবি দারবিশের পাঁচটি কবিতা।
ফিলিস্তিনি ক্ষতের দিনলিপি
আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে নাঃ কার্মেল পাহাড় রয়েছে আমাদের মাঝেই,
আর আঁখিপল্লবে গালিলির তৃণভূমি।
এমনটা বলো নাঃ যদি ছুটে যেতে পারতাম তার কাছে, নদী যেমন বয়ে যায়!
এমনও বলো নাঃ আমরা আর আমাদের এই দেশ একই অস্থিমজ্জা।
জুন মাসেও তো আমরা সদ্য পাখা গজানো ঘুঘু ছিলাম না যে, আটকে রাখলেই হৃদয়ে ভালবাসা মরে যাবে!
বোন আমার, শোন, এই বিশটি বছর তো আমরা কবিতা লিখে কাটাইনি! প্রাণপনে লড়ে গেছি।
তোমার চোখের উপর এই যে ছায়া পড়েছে, এটা ঈশ্বর নামধারী শয়তান এক
যে, গেল জুন মাসেই আস্তানা ছেড়ে বেড়িয়েছে
আমাদের মাথা চারদিকে সূর্য দিয়ে মুড়ে দেবে বলে।
ওর রং হল শহীদানের প্রার্থণার স্বাদ।
কী চমৎকার ভাবেইনা সে খুন করে, আর কী চমৎকারভাবে সে ফের বাঁচিয়ে তোলে
তোমার আঁখিপল্লবে সূচনা হয়েছিল যে রাত্রির,
আমার আত্মায় তা ছিল এক দীর্ঘ রজনীর সমাপ্তি।
অনাবৃষ্টির কাল পিছনে ফেলে
ফিরে যেতে হলে আমাদের প্রয়োজন পড়ে যাত্রাসঙ্গী।
আমরা তো জেনে গেছি দোয়েল কি করে শিস বাজায়, আর শত্রুর চোখে-মুখে ছুরি ঝিলকায়।
আমরা তো জেনে গেছি কীভাবে গোরস্থানের নির্জনতা পরিণত হয় ঝলমলে উৎসবে..এই জীবনের ফলোদ্যানে!
তুমি গেয়ে শুনিয়েছ তোমার গান, আর আমি দেখেছি ঝুলবারান্দা কেমন দেয়াল ছেড়ে পালায়, নগরচত্বর বেড়ে গিয়ে ঠেকে পাহাড় অবধি।
আমরা যা শুনেছি তা সুমধুর কোন সঙ্গীত ছিল না।
আর যা দেখেছি তাও ছিলনা কোন শব্দের বর্ণালি।
কক্ষের ভিতর ছিল কয়েক লক্ষ বীরপুরুষ!
শহীদের অস্থিমজ্জা গিলে ফেলেছে এই মাটি।
এই মাটিই দিয়েছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে শস্যদানা ও তারকাপুঞ্জের।
অতএব তাকেই পুজা দাও,
আমরাই তো তার লবণ ও পানি, আমরাই তার শরীরের ক্ষত, যে ক্ষত লড়াই করে
বোন আমার শোন, কন্ঠ বুঁজে আসে কান্নায়,
এবং দৃষ্টিতে অগ্নিকণা,
আমি মুক্ত স্বাধীন!
নগর তোরণে আমি আর প্রতিবাদ করতে যাব না,
যারা মরে গেছে, আর যারা মরে যাবে দিবসের দ্বারপ্রান্তে, সকলে আলিঙ্গন করে আমায়, আমাকেই বানিয়ে তুলছে এক শানানো অস্ত্র!
ওহ্ -হো, আমার ক্ষতটা কোথায়, খুঁজে পাচ্ছি না;
আমার দেশ তো আর তল্পি-তল্পা নয়, আর আমিও নই কোন আগন্তুক, আমি একজন সাচ্চা প্রেমিক, আর এই ভূমি আমার প্রেমিকা।
প্রত্নতাত্ত্বিক ব্যস্ত রইল নুড়ি পরীক্ষায়।
কিংবদন্তির স্তুপের ভেতর খোঁজাখুঁজিতে নিজের চোখে সে দেখে নিতে চায়, এবং অন্যদেরকেও যেন দেখাতে পারে, যে আমি নিছক এক অন্ধ ভবঘুরে।
পথে পথে ঘুরি, আর বোম ফাটালেও একটি অক্ষর বেরোবে না সভ্যতার হাল-হাকিকত নিয়ে।
এরই মঝে কিছু সময় হাতে পেয়ে লাগিয়েছি কিছু বৃক্ষচারা, গান গাইছি প্রেমের।
ভালবাসি, আহা বড়ো ভালবাসি।
এসেছে সেই সময়, যখন আর কথা নয়, কাজ।
এসেছে সময় প্রমাণ করার – ভালবাসি এই মাটি, দোয়েলের গান।
এমনই এক কাল, অস্ত্রের ঝনঝনা গিলে খায় বংশীধ্বনি, আর আমি আয়নার বুক থেকে ক্রমশ অপসৃয়মাণ
কেননা আমার পিছনে গজিয়ে উঠছে অপর আরেক বৃক্ষ।
ফিলিস্তিনের হে প্রেমময়ী
বালিকা হে,
আঁখি দুটি তোমার ফিলিস্তিনি
ফিলিস্তিনি তোমার নাম
আভরণ ও বেদনা তোমার ফিলিস্তিনি
ফিলিস্তিনি তোমার রুমাল, দু’খানি পা, অনুপম তনু,
তোমার শব্দ ও নীরবতা ফিলিস্তিনি
আর জন্ম ও মৃত্যুও বটে ফিলিস্তিনি
তুমিই কি সে জন?
তুমিই কি সে জন?
আমি দেখি কেবল এক নারী,
যে পায়নি কোন বিজ্ঞাপন,
কেউ একজন অনুসরণ করছে আমার পদচিহ্ন, আমি নিজেকে দেখি চিত্রে খচিত, বহুধাবিভক্ত, তাড়িয়ে ফিরি স্মৃতি থেকে স্বজ্ঞায়।
পেতলের তরণীতে, আমাকে অন্ধ করে দেয় পথ চেনার আলো,
এমনকি যখন আলোকিত হয় বৃক্ষচূড়াগুলো,
তাদের অন্ধকার হৃদয়, আর আমি বিলিয়মান সুগন্ধির মতোই অস্পৃশ্য,
এক ভবঘুরে দমকা হাওয়া, যাকে আর স্মরণে আনছে না কেউ।
তিনি এক মহান বাদশা,
তিনি এক মহান বাদশা বটে,
কাস্তের শব্দ যিনি গিলে গিলে খান, আর নিঃশব্দে বৃক্ষের শেকড়ে করাত চালান।
পতঙ্গপাল তো উপেক্ষা করে সেই রমণীকে, যে পুড়িয়ে ফেলে তার আপন ইতিহাস,
আর যখন সে নবরুপে জন্মায়
যে কেউ আলোময় করে তার অতীত, ভবিষ্যতকে রেখে দেয় বহ্নিশিখায়।
এমন এক অনল, যা জ্বালায় না তরণী, আর হৃদয়েও ফেলে না কোন দাগ!
তারা চায় আমি মরে যাই
তারা আমাকে মৃত দেখতেই ভালবাসে। বলে, সে তো আমাদেরই
বিশ বছর যাবৎ তাদের পায়ের আওয়াজ শুনছি রাত্রির দেয়ালে
কোন দুয়ার খোলে না তারা, তবু এখন তারা এখানেই, তিনজনকে দেখছি আমি
একজন কবি, একজন খুনী, আরেকজন বইপাঠক,
তোমরা কি মদ খাবে? আমি জানতে চাইলাম,
হ্যাঁ। তারা উত্তর দিল
জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে কখন হত্যা করবে বলে ভাবছ?
বিষয়টা স্বাভাবিক ভাবে নাও, তারা উত্তর দেয় পূনরায়।
তারপর গ্লাসগুলি সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে জনতার উদ্দেশে গান গাইতে লাগল।
আবার জানতে চাইলাম, আমার হত্যাপর্ব শুরু হবে কখন?
ইতোমধ্যেই তা সমাপ্ত হয়েছে, তুমি কেন আত্মার দিকে পাঠিয়েছ জুতাগুলি?
যেন তারা পৃথিবীময় চড়ে বেড়াতে পারে, আমি বললাম।
গভীর অন্ধকার পৃথিবীতে তো্মার কবিতা এত শুভ্র কেন?
আমি বলি, কারণ আমার হৃদয় পূর্ণ তিরিশটা সমুদ্রে,
ফরাসি মদ পছন্দ কর কেন? জানতে চায় তারা।
সুন্দরতম নারীকে ভালবাসা আমার কর্তব্য, আমি বললাম।
কিভাবে মরতে পছন্দ করো? তারা জিজ্ঞেস করল
নীল, গভীর নীলে, যেন নক্ষত্র ঢেলে দেয়া হচ্ছে কোন জানালা থেকে,
তো্মাদের কি আরও মদ লাগবে? জানতে চাইলাম
তারা বলল, আরও মদ দাও তবে!
আমি বললাম, আরও কিছু সময় দাও আমাকে, ধীরে ধীরে হত্যা করো,
যেন শেষতম কবিতাটি লিখে যেতে পারি হৃদয়ের বধূর কাছে!
তারা অট্ট্রহাসিতে ফেটে পড়ল, এবং কেড়ে নিল তার প্রতি নিবেদিত সকল শব্দমালা
ঢালুতে অশ্বের হ্রেষারব
ঢালুতে অশ্বের হ্রেষারব, উর্ধ্বে অথবা নিম্নে
একটি প্রতিকৃ্তি তৈরী করছি আমার রমণীটির জন্য
যেন আমি মরে গেলে ঝোলাতে পারে ঘরের দেয়ালে
সে বলল, ছবি ঝুলানো্র মত দেয়াল কি আছে কোথাও?
আমরা একটি বাড়ি নির্মাণ করে নেবো এর জন্য, আমি বললাম।
সে জানতে চায়, কোথায়?
আমি বলি, যে কোন বাড়িতে,
ঢালুতে অশ্বের হ্রেষারব, উর্ধ্বে অথবা নিম্নে।
সংসার পাতানোর জন্য তিরিশ বছর বয়সী কোন মহিলার প্রয়োজন আছে কি কোন মাতৃভূমির?
আমি কি পারবো পৌঁছাতে দুর্গম পাহাড়-চূড়ায়? ঢালু বড় মসৃণ, ধরে রাখে না।
মাঝপথে বিভক্ত হয়ে গেছে এই যাত্রা, শহীদেরা হত্যা করে একে অপরকে
প্রতিকৃ্তি তৈরী করছি আমার রমণীটির জন্য ,
যখন নতুন আরেকটি ঘোড়া ডেকে উঠবে তো্মার ভেতর,
তখন তাকে বেধে ফেলো।
ঢালুতে অশ্বের হ্রেষারব, উর্ধ্বে অথবা নিম্নে
অনুবাদকঃ
হুজাইফা মাহমুদ
কবি