মনঋত পাখির গান ও চতুর্ভুজের চতুর্থ কোণ | মাহমুদ মাসুদ

সাধারণত মানুষ সোজাভাবে ওঠে। আমি কোন কারণ ছাড়াই বাঁকাভাবে উঠি। আর প্রত্যেকবারই পা হড়কে পড়ে যাই। পড়ে যাওয়ার ভয়ে সেখানে খুব একটা যেতে চাই না। যেতে যে চাই না সেদিন সেটা ভুলে গিয়েছিলাম।


 

বিদ্যা নিকেতন চিনেন? গ্র্যান্ড রোডে। তার সামনে দেখবেন একটা মার্কেট আছে। রাস্তা থেকে চারটা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হয়। সাধারণত মানুষ সোজাভাবে ওঠে। আমি কোন কারণ ছাড়াই বাঁকাভাবে উঠি। আর প্রত্যেকবারই পা হড়কে পড়ে যাই। পড়ে যাওয়ার ভয়ে সেখানে খুব একটা যেতে চাই না। যেতে যে চাই না সেদিন সেটা ভুলে গিয়েছিলাম। তো শেষ সিঁড়িতে গিয়ে পা হড়কালো। গিয়ে পড়লাম তিন নম্বর পিলারের পাশে। কেমন একটা শব্দ শুনলাম। খুব অচেনারকম কণ্ঠে কে যেন বললো, “আহা! আহা!” না উঠেই সামনের দিকে তাকিয়ে দেখি একটা পেঁয়াজের বস্তার মধ্যে তিনটা নীলাভ ধূসর পাখি। চড়ুইয়ের চেয়ে বড়, আবার শালিকের চেয়ে ছোট। বস্তার মুখ মিষ্টির প্যাকেট বাঁধার দড়ি দিয়ে বাঁধা। পাশে এক বয়স্ক চাচা কিসের জানি একটা ডাল হাতে বসে। চাচার পরনে লুঙ্গি আর একটা হাফময়লা সাদা টিশার্ট। টিশার্টে লেখা পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন। তিনটা পাখিই আমার দিকে দুখী দুখী চোখে তাকিয়ে আছে। চাচা এগিয়ে এলো আমায় তুলতে। আমি অবশ্য তার আগেই উঠে পড়েছিলাম। চাচাকে জিজ্ঞেস করলাম,’এইগুলান কী পাখি?’ পাখিগুলোকে একটু উপরের দিকে তুলে বললেন, ‘হাইল্যা বাবাজী, রাম হাইল্যা।‘ আমি যেহেতু রাম হাইল্যা চিনি না তাই বেশি কিছু আর বললাম না। ‘লইবানি বাবাজী?’, চাচা জিজ্ঞেস করলো। আমি বললাম, ‘কত?’ ‘একদাম ছয়শ।‘ বললো চাচা। আমি আর কিছু বললাম না। আসলে আমার নেওয়ার কোন ইচ্ছাই ছিল না। এমনিই কোন পশু পাখি পোষা ভালো লাগে না। তার উপর যাচ্ছি গ্রামের বাড়ি। এই পেঁয়াজের বস্তায় থাকা রাম হাইল্যা নিয়ে বাসে ওঠার আইডিয়াটা খুব একটা সুবিধার মনে হলো না। চলে যাচ্ছিলাম। এসময় মনে হলো পাখিগুলো দুখী দুখী চোখে আমার চলে যাওয়া দেখছে। সিদ্ধান্ত নিলাম নিয়ে নেব। তারপর কোথাও গিয়ে ছেড়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু পকেটে আছে মাত্র তিনশ সাতান্ন টাকা। একটু দূরেই ব্যাংকের এটিএম বুথ। সেদিকে গেলাম। একাউন্টে টাকা আছে সাতাশ শ’ বার টাকা। এর মধ্যে ব্যাংকে এক হাজার টাকা মিনিমাম জমা ধরলে থাকে সতের শ’ বার। টাকা তুলবো কি তুলবো না ভাবতে ভাবতে এক হাজার টাকা তুললাম। টাকা তুলে মার্কেটের দিকে গেলাম। গিয়ে দেখি চাচাও নাই পাখিও নাই। এদিক ওদিক অনেক খুঁজলাম। কোথাও নেই। মনটা গেলো খারাপ হয়ে। এখন এই মন খারাপ নিয়ে আর বাড়ি যেতে ইচ্ছে করলো না। বাসায় চলে এলাম। প্রথমে চা খেলাম, তারপর সিগারেট। মুভি দেখতে বসলাম। মুভির নাম বার্ডম্যান। দেখতে দেখতে সেই তিনটা রাম হাইল্যার কথা মনে পড়লো। মন আরও খারাপ হলো। মুভি অর্ধেক দেখে বাদ দিলাম। ফেসবুক স্ক্রল করা শুরু করলাম। এক লোক সেকেন্ড হ্যান্ড সিলিন্ডারের গ্যাসের চুলা কিনতে চায় বলে ‘এনিথিং ইন টাউন’ গ্রুপে পোস্ট দিয়েছে। তখনই মাথায় বুদ্ধিটা এলো। একটা পোস্ট দিলাম গ্রুপে :

 


‘আজ সকালে এক চাচা বিদ্যা নিকেতনের সামনে তিনটা রাম হাইল্যা বিক্রি করছিল। পাখি তিনটা আমার প্রয়োজন। উপযুক্ত মূল্যে কিনে নেওয়া হবে।’

পরের দিন দুপুরের টাটকা রোদের মধ্যে শহরের একপাশে একটা চারতলা বাড়ির ছাদ পুড়ে যাচ্ছিলো। আর তার সাথে পুড়ে যাচ্ছিলাম আমি আর আমার হাতে থাকা খাঁচায় সেই তিনটা রাম হাইল্যা। পাখিগুলোকে খুঁজে পাওয়াটা অবিশ্বাস্য মনে হলেও পেয়ে গিয়েছিলাম। গ্রুপে পোস্ট দেওয়ার এক ঘণ্টা পরে চেক করে দেখি তিনটা লাইক আর একটা হা হা রিঅ্যাক্ট। হা হা রিঅ্যাক্টের কোনো কারণ খুঁজে পেলাম না। আরও কিছুক্ষণ পরে দেখি আরও একটা লাইক, একটা লাভ রিঅ্যাক্ট আর দুইটা কমেন্ট। প্রথম কমেন্টে লেখা, ‘রাম হাইল্যা কি জায়গামতো এনার্জি বাড়ায় নাকি ভাই? তাইলে আমিও নিতাম।‘ দ্বিতীয় কমেন্ট, ‘অনলি রিয়েল আইডি। ইমো কল ৩০০ টাকা।’ দুইটাতেই লাইক দিলাম। প্রথমটাতে লিখলাম, ‘জানি না ভাই।‘ পরেরটাতে কি লিখবো বুঝতে পারছিলাম না। ঘুমাতে যাওয়ার আগে আরেকবার চেক করলাম। কোন নতুন লাইক নাই। প্যারাডাইজ বার্ডস এন্ড পেটস কমেন্ট করেছে,’ইনবক্সে আসেন’। আমি মেসেজ দিলাম। জানা গেল এই পাখি তাদের কাছে আছে, চাইলে সকালে যেতে পারি। সকালে গিয়ে দেখি দোকানের মালিক রেগে-মেগে কাই হয়ে আছে। আমি গিয়ে বললাম যে গতরাতে মেসেজ দিয়েছিলাম। আমাকে দেখেই বললো, ‘কত বড় বাটপার বুড়া দেখছেন? এগুলান নাকি রাম হাইল্যা। রাম হাইল্যা তো শিখাইলে কথা কইতে পারে। পাঁচ শ’ টাকা দিয়া নিছি। এখন দেখি রাম হাইল্যা না।  আরে ভাই তিনটারই ঝুরানি ব্যারাম। আপনার যদি কোন দরকার লাগে নিয়া যান। খালি খাঁচার দাম দিলেই হইবো।’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘খাঁচার দাম কত?‘ বললো, ‘এক হাজার টাকা।‘ আমি বললাম যে পাখিগুলো সেই পেঁয়াজের বস্তায় করে দিতে। কিন্তু তার এক কথা পাখি নিতে হলে খাঁচা নিতে হবে। পরে সাত শ’ টাকা দিয়ে খাঁচা নিলাম আর পাখি পেলাম ফ্রি। বাসায় ফিরতে দুপুর হলো। তো আমরা ছাদের উপর রোদে পুড়ছিলাম। রোদ মাড়িয়ে আমি খাঁচার দরজা খুলে দিলাম। পাখিগুলো বের হয়ে ছাদের কার্ণিশে গিয়ে বসলো। আমি অপেক্ষা করে থাকলাম কখন উড়ে যাবে, কিন্তু উড়ে গেল না। হাত দিয়ে ঈশারা করে তাড়াতে চাইলাম। তাও গেল না।  হাতে একটা লাঠি নিলাম। এবার আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনটি পাখিই একসাথে মানুষের মতো করে গান গেয়ে উঠলো।  গানের সারমর্ম হলো, তাদের কপালে খালি দোষ আর দোষ। কোথায় যাবে তারা জানে না তাই এভাবে বসে আছে। তারা নিজেদের দেশে যেতে চায় , কিন্তু পারে না। গানের মাঝে আমাকে ধন্যবাদও জানায়।  আবার অনুরোধ করে আমি যেন তাদের দেশে ফিরতে সাহায্য করি। এই শুনে আমার হার্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হলো । অনেক রকম অনেক পাখিকে কথা বলতে দেখেছি কিন্তু  এমন করে সুরে সুরে গান গাইতে দেখিনি। তাও আবার আমার নিজের ভাষায়। মনে পড়লো ছোটবেলায় রূপকথায় এরকম কথা বলা পাখি পেয়েছিলাম। আবার মনে হলো এরকম কথা বলা পাখি তো আছেই। পাখির দোকানদারও বলেছিল যে রাম হাইল্যা শিখিয়ে দিলে কথা বলতে পারে। কিন্তু সে তো এও বলেছে যে এই পাখি রাম হাইল্যা না। এরই মধ্যে যেন আমার মন পড়ে ফেললো তারা। বললো যে তারা আসলেই রাম হাইল্যা না, তারা হলো মনঋত পাখি। ‘এ আবার কেমন পাখি?’, আমি মনে মনে বললাম।

 


তখন ডানের পাখিটা বলে উঠলো,’ মনই হলো পরম সত্যের আধার। মনে যা থাকে তাই সত্য আর মিথ্যারা থেকে মানুষের মাথায়। মিথ্যা তারা ছাড়িয়ে গিয়েছে তাই তারা মনঋত পাখি।’

 

আর বামের পাখিটা বলে, ‘মনঋত পাখিরা দেশে যেতে চায়। এখানে তাদের অনেক কষ্ট।’  মাঝখানেরটা বললো, ‘আমাদের যেতে হবে। এরকম কয়েক আকাশ পরে আমাদের দেশে সবাই অপেক্ষা করে আছে। আমরা এভাবে হারিয়ে যেতে চাই না।’ আমি কি বলবো বা কি করবো বুঝতে না পেরে বললাম, ‘তো যাও।’ পাখিরা কিছু বলে না। সূর্য তার জায়গা থেকে একটু পশ্চিমে সরে যায় । সূর্যের সরে যাওয়া দেখে পাখিরা আহত হয় আর বলে যে চাইলেই তারা যেতে পারে না। আবার বলে তাদের সময় ফুরিয়ে আসছে। আমি জিজ্ঞেস করি তারা কেন যেতে পারে না। বামের পাখিটা মাঝখানে যায় আর বলে যে এজন্য শুনতে হবে তাদের পাখিজীবনের আগের গল্প। আমি গল্প শুনতে বসে যাই।

৩.১

‘ইলেভেন’-এর শোরুমে কাজ করা নিয়ে সিলভীকে অনেক কথাই শুনতে হয়। এসব শুনে শুনেই সে কাজ করে যায়। তার আর কিছু করারও নেই। সেলসগার্লের চাকরি বলে প্রেমিক তাকে তিনবার ছেড়েছে। অবশ্য তিনবারই ফিরে এসেছে। এখন দিচ্ছে বিয়ের তাড়া। ওইদিকে মা, বাবা আর ছোট বোনকে দেখার কেউই নেই। অল্প যা বেতন পায় তা দিয়েই চলতে হয়। সে জানে বিয়ে করলে আর এই চাকরি করা যাবে না। তাই এই-সেই করে বিয়ের কথা এড়িয়ে যায়। প্রেমিক রাগ করে, গালি দেয় খানকি মাগি বলে, ফোনে ব্লক করে দেয়। কদিন পরে আবার ঠিক হয়ে যায়। সকালেই মেসেজ দিয়েছে। শুধু তিন শব্দের মেসেজ, ‘ইয়েস অর নো?’ সে কোন উত্তর দেয় না। শোরুমে আসতে তার অনেক কষ্ট করতে হয়। সরকার নামানোর আন্দোলন আর গদি ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টার মাঝে পড়ে তার মতো ক্ষুদ্র এক সেলসগার্লের প্রতিদিনই গাড়ি পেতে বেগ পেতে হয়। চতুর্দিকে যেভাবে জ্বালাও-পোড়াও তাতে ভয়ও হয়। এমনই আতংকের দিনগুলোতে তার প্রায়ই শো রুমে পৌঁছাতে দেরি হয়। সেদিনও দেরি হলো। এসে দেখে ম্যানেজার বদলি হয়েছে। এ খবরে সিলভীর খুব খারাপ লাগে। খুব ভালো মানুষ ম্যানেজার। সব নিজের হাতে শিখিয়েছে তাকে। সারাদিন মন খারাপ থাকে তার। শিফট শেষ হলে সে ম্যানেজারের সাথে দেখা করতে যায়। ম্যানেজার তাকে একটা খাম ধরিয়ে বলে, অভিনন্দন সিলভী। তোমাকে এই শোরুমের ম্যানেজার করা হয়েছে। সে কিছু ভেবে পায় না। কি বলবে বুঝতে পারে না। খুব খুশি মন নিয়ে বেরিয়ে আসে। আর কিছু টাকা বেশি আসবে, আর একটু ভালো থাকা যাবে। রাস্তায় নেমেই টাউন সার্ভিস পেয়ে যায়। সিটে বসে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখতে পায় প্রেমিকের ছাপ্পান্ন মিসড কল আর আটটা মেসেজ। মেসেজ আটটার সাতটাতেই অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ। কয়েকটাতে তার মা-বোনকে নিয়েও আজেবাজে কথা। মেসেজের রিপ্লাই অপশনে গিয়ে সে লিখে, ‘নো’।

৩.২

রফিকুলের মাথায় ছিল দুনিয়ার টেনশন। টেনশনের সাথে ঘামের একটা সম্পর্ক আছে। তার টাক মাথা থেকে ঘাম বের হয়ে ফোঁটা ফোঁটা হয়ে চোখ-মুখে ঢুকে যাচ্ছে। সে রাস্তার পাশ থেকে এক গ্লাস লেবুর রস কিনে খেলো। খুব একটা ভালো লাগলো না। সেদিন ছিল তার কিস্তি জমা দেওয়ার শেষ দিন। অথচ পকেটে ছিল সব মিলিয়ে  ঊনপঞ্চাশ টাকা। কিস্তিতে যে বাইকটা কিনেছিলো রাইড শেয়ার করবে বলে সেটা গতমাসে ছিনতাই হয়ে গিয়েছে। একটু বেশি টাকা পাবে বলে দূরের ভাড়া নিয়েছিলো। রাস্তার শুনসান জায়গায় যেতেই বাইক থামাতে বললো পেশাব করবে বলে। তারপর কোথা থেকে আরও কয়েকজন এসে তাকে মেরেধরে বাইকটা নিয়ে গেলো। সাথে নিলো মানিব্যাগ, মোবাইল আর পানির বোতল। বাসায় এখনও কাউকে কিছু বলা হয়নি। এমনিতেই বউ তার অল্প টাকার মধ্যে খুব কষ্টে সংসার চালায়। দুই ছেলের পড়াশোনা, সবার খাবার-দাবার, ডাক্তার ওষুধ কিভাবে ম্যানেজ হয় সে কিছুই জানে না। সে শুধু বউয়ের হাতে টাকা তুলে দেয়। এখন বউকে সে কোন চিন্তায় ফেলতে চায় না। এই এক মাসে সে বেশ কয়েকবার থানায় গিয়েছে। এএসআই, কনস্টেবল এদের খাইয়েছে, টাকাও দিয়েছে। প্রতিবারই আশ্বস্ত হয়ে এসেছে যে বাইক অবশ্যই পাওয়া যাবে। কার কার বাইক পাওয়া গিয়েছে সেটাও শুনে এসেছে। তার এক মামাতো ভাই আছে ডাক্তার। সে আজ কিছু টাকা দিবে বলেছে। তাই এসব হরতাল-অবরোধের মধ্যেও বের হয়েছে। অনেকক্ষণ ধরে হেঁটে সামনে টাউন সার্ভিস আসতে দেখে। বাসে উঠে জানালার পাশের একটা সিটে বসে। হালকা একটা বাতাস গায়ে এসে লাগতেই  ঘাম সব নেই হয়ে যায়।

৩.৩

কবির খানের মন মেজাজ বেশ ফুরফুরেই ছিল সেদিন। চাকরির শেষ দিন ছিল। যেটা সে আশা করেনি তাই হয়েছে। বড় বড় স্যারদের বিদায়ের দিন বড় করে প্রোগ্রাম হয়। খাওয়া দাওয়া হয়। বিভিন্ন দামী দামী উপহার দেওয়া হয়। পিয়ন হয়েও তার ক্ষেত্রে তা হয়েছে। বিয়াল্লিশ বছর পর সে অবসরে যাচ্ছে। মন খারাপ থাকলেও নিজের জন্য এত আয়োজন দেখে তার ভালো লাগছে। সবাই তাকে নিয়ে অনেক ভালো ভালো কথা বললো। সে কি বলবে ভেবে না পেয়ে শুধু দোয়া চেয়ে চলে আসলো। দুই হাত ভর্তি উপহার নিয়ে অফিস থেকে বের হলো। বড় স্যারের গাড়ি সামনে এসে থামলো। কাচ নামিয়ে স্যার বললো গাড়িতে উঠতে, সামনের মোড়ে নামিয়ে দেবে। কবির লজ্জিত হয়ে গাড়িতে উঠলো। মোড়ে নেমে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হলো। গত কয়েকমাস ধরে প্রতিদিনই এমন হয়। সরকার আর বিরোধী দলের কারণে রাস্তায় রাস্তায় গাড়িঘোড়া পোড়া হচ্ছে। তাই ভয়ে মানুষ গাড়ি নিয়েই বের হচ্ছে না। সরকার বলে বিরোধীদল জ্বালাও পোড়াও করছে, আবার বিরোধী দল বলছে সরকারই করছে এসব। যত জ্বালা হয়েছে তার মত মানুষদের যাদের প্রতিদিনই বের হতে হয়। সে প্রচণ্ড বিরক্ত হয়। এই এক ছোট্ট দেশের ক্ষমতা নিয়ে কি একটা কাড়াকাড়ি। এদের কাউকেই তার ভালো লাগে না। সে বিড়বিড় করে গালি দেয় একটা, ‘সুদ্দানির ফুয়ারা।‘ এত ব্যাগ-ট্যাগ নিয়ে এখন কি করবে ভেবে পায় না। এই সময় উল্টো দিক থেকে টাউন সার্ভিস আসে। দুইটা খালি সিট পেয়ে একটাতে বসে আরেকটাতে ব্যাগগুলো রাখে। স্যুটের কাপড়টা কোলের উপর রাখে। এটা তার বড় ছেলের জন্য। কয়দিন পরেই চাকরি-বাকরির ইন্টারভিউ দেবে। স্যুট পরা ছেলেকে চিন্তা করতেই তার ভালো লাগে।

৩.৪

ড্রাইভার হেলপার রিস্ক নিয়ে বের হলেও টাউন সার্ভিসে আজ যাত্রী কম। ভয় থাকলেও পেট তো আর ভয় মানে না। খেজুরের মোড় পার হতেই কোথা থেকে আগুনের দুইটা দলা এসে জানালা দিয়ে ঢুকলো। মুহূর্তেই আগুন কয়েকগুণ হয়ে পুরো বাস খেয়ে ফেলতে শুরু করলো। বাস থামিয়েই ড্রাইভার হেলপার নেমে গেল। যে যার মত করে নেমে যাচ্ছিলো। এই সময় কবির খানের মনে হলো স্যুটের কাপড়টা অন্তত নিতে হবে। স্যুটের কাপড় নিতে গিয়ে সিটের ফাঁকে তার পা আটকে গেলো। এই অবস্থায় সিলভী যায় তাকে টেনে বের করতে। রফিকুল বের হয়েই গিয়েছিলো। আবার উঠে পড়ে এই দুইজনকে বের করতে। এই তিনজন ছাড়া বাকি সবাই-ই নামতে পারে। এসময় কান ফাটানো শব্দে বাসের গ্যাস সিলন্ডার উড়ে যায়। এর কয়েক ঘণ্টা পরে যখন আগুন নিভে যায় মানুষজন যায় এই তিনজনের লাশ খুঁজতে। পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া তিনটা কঙ্কাল ছাড়া আর কিছুই পায় না।


এইসব ছাইকয়লা থেকে সবার আগোচরে তিনজনই পাখি হয়ে উড়ে যায় । উড়ে গিয়ে বসে শহরের সবচেয়ে বড় বটগাছের চূড়ায়। সেখান থেকে জেগে থাকা এই শহরকে তাদের কাছে কয়েক হাজার বছর ধরে মৃত মনে হয়।

‘আমরাই সেই তিনটা পাখি। আমাদের এখন মন ছাড়া আর কিছুই নেই। আগেই বলেছি মনে যা থাকে তাই ঋত। এজন্য আমাদের নাম মনঋত পাখি।’, বলে ডানপাশের পাখিটা। আর মাঝের পাখি বলে, ‘মনঋত পাখিদের আলাদা দেশ আছে । আমরা সেখানেই যাচ্ছিলাম। কিন্তু যেতে পারছি না। আমাদের যেতে দিচ্ছে না।’ এবার বলতে থাকে বামের পাখিটা, ‘ আমাদের ব্যাপারে কিছু একটা ভুল হয়েছে। আমাদের দেওয়ার কথা একটা ত্রিভুজ বাহন। কিন্তু দেওয়া হলো চতুর্ভুজ। চতুর্ভুজের তিন কোণে আমরা বসে ছিলাম। কিন্তু ওরা বলে চারটা কোণই পূর্ণ না হলে যাওয়া যাবে না।’ মাঝের পাখি আবার বলে,’আমরা ত্রিভুজের জন্য অনেক কাঁদলাম। কিন্তু কারো মন গলে না। আমাদের বলে চতুর্ভুজের চতুর্থ কোণ পূর্ণ করে নিতে। আমরা সামান্য মনঋত পাখি। আমরা কোণ কিভাবে পূর্ণ করবো?’ এবার তিনটাই একসাথে গান ধরে। গানের ভেতর বলে যে তাদের কপালের দোষ তাই তারা নিজেদের দেশে যেতে পারছে না। দেশে যেতে না পারলে এই দূষিত জগতে তারা থাকতে পারবে না। আজ সূর্যাস্ত পর্যন্তই তাদের সময়। সময় শেষ হলে তারা অদৃশ্য হয়ে বাতাসে মিশে যাবে। তারা আমাকে অনুরোধ করে আমি যেন তাদের সাহায্য করি কারণ তাদের হাতে আর সময় নেই। আমি জিজ্ঞেস করি যে আমি কিভাবে তাদের সাহায্য করতে পারি। এবার মাঝের পাখি বলে যে আমি যদি মরে যাই তাহলে চতুর্ভুজের চতুর্থ কোণ পূর্ণ হবে। তারপর আমরা সবাই মিলে তাদের দেশে চলে যেতে পারি। এটাও বলে যে, আমি মরে যাই এটা তারা চায় না। কিন্তু এই দূষিত জগতে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া তাদের কাছে ভালো মনে হয়। বলে যে, তাদের দেশে এত এত ঝামেলা নেই। সেখানে তারা মনের আনন্দে গান গেয়ে বেড়ায়। সবাই মিলে যাদুমাখা নদীতে গোসল করে, একসাথে তিনটা চাঁদের আলোর নিচে উড়ে বেড়ায়। সেই দেশে কোন সরকার বা বিরোধী দল নেই। যার কারণে কোনো আগুনও নেই। এসব কিছুতেই আমার মন গলে না। আমি তাদের দূর দূর করে তাড়িয়ে দিই। খুব করুণ আর হতাশ চোখে তারা আমার দিকে তাকায় তারপর উড়ে চলে যায়।

আমি নিচে যাই। চা-সিগারেট খাই। এই অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে তা বিশ্বাস হয় না ঠিক। চা-অলা মামাকে জিজ্ঞেস করি বাসে বোমা আর তিনজন মরে যাওয়ার কথা ঠিক কিনা। সে বলে যে ঠিক। সেও খুব দুঃখ করে আর কয়েকটা গালি দেয়। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি সূর্য পশ্চিমে হেলে তার তেজ ফুরিয়েছে প্রায়। পাখিগুলোর কথা মনে পড়ে আর খারাপ লাগতে থাকে। তাদের শেষ কথাগুলো মাথায় ঠোকর মারে। সত্যিই তো, এই দেশের চেয়ে মনঋত পাখির দেশ ঢের ভালো। ততক্ষণে আমার মন ছাড়া আর কিছুই আমার ভেতর নেই। মন চাইলো না সেই তিনটা পাখিকে অদৃশ্য হতে দিতে। একটা ব্লেড কিনে নিয়ে সোজা ছাদে উঠে যাই। কিন্তু ওদের টিকিটাও চোখে পড়ে না। বেশ কয়েকবার ডাকি। নাম ধরেও ডাকি। কোথাও কিছু দেখা যায় না। ওইদিকে সূর্য লাল হতে শুরু করেছে। কিছু বুঝতে না পেরে ইটের কণা দিয়ে ছাদের মেঝেতে বড় একটা চতুর্ভুজ আঁকি। তারপর একটা কোণকে চতুর্থ কোণ ভেবে নিয়ে তাতে বসে যাই। ব্লেড হাতে নিয়ে এ পৃথিবীর জন্য খারাপ লাগে। আবার পাখিদের জন্যও খারাপ লাগে। সূর্যটাকে দেখতে চেষ্টা করি। কিন্তু ছাদ হতে এখন আর সূর্য দেখা যাচ্ছে না।  সূর্য ডুবতে আর কতক্ষণ আছে কেউ যদি এসে একটু বলে দিতো!


মাহমুদ মাসুদ

জন্মস্থান চট্টগ্রাম হলেও বেড়ে উঠেছেন ফেনীতে। পড়াশোনা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে।
প্রকাশিত গল্পবই ‘দরিয়াভাল্লার মাঠে’

শেয়ার