বৃষ্টি কখনো আকাশ থেকে ঝরে পড়েনি | মোজাফ্ফর হোসেন

একবার আলু কাটতে গিয়ে আমার আঙুলটা বেশ খানিকটা কেটে গিয়েছিল। আঙুল কাটল আমার আর দেখি সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেল মেয়েটা।

 

অনেক তপ্ত দুপুর জোড়া দেওয়ার পর বৃষ্টিদের বাড়ি। পশ্চিমে আমাদের বাড়ি আর পুবে বৃষ্টিদের, মাঝখানে ফসলহীন খাঁ খাঁ মাঠের টনটনে সাঁকো। আমাদের বাঁধাধরা পিয়ন ছিল দগ্ধ পোড়া সূর্যটা। কোনো কোনো দিন খুব সকালে ঘুম ভেঙে গেলে দেখতাম, বৃষ্টিদের ভাঙাচোরা বাড়িটার ওপর অপেক্ষা করছে, বৃষ্টি তখনো হয়তো ঘুম থেকে উঠতে পারেনি। নিরুত্তাপ সূর্যের অমন নির্বিঘ্নে অপেক্ষা দেখতে ভালো লাগত। আমিও অপেক্ষা করতাম, আসছে বৃষ্টির বার্তা নিয়ে। কিন্তু আমাদের বাড়ি আসতে আসতে পৃথিবী পুড়িয়ে ছারখার করে দিত পিয়নটা। সঙ্গে বৃষ্টির চোখের ইশারায় বলে দেওয়া সব কথাও। আগুন পুড়িয়ে পথচলা ওর। যখন আমাদের বাড়ির ওপর এসে দাঁড়াত, বৃষ্টির কিছুই আর বলার থাকত না আমাকে। আমাদের পোড়া গোয়ালঘরের ওপরটাতে কিছুক্ষণ থেমে জিরিয়ে নিত, দেখত ওপাশ থেকে বৃষ্টি, আবার ফিরবে এই প্রতিশ্রুতি ছাড়া ওকে আর কিছুই দিতে পারেনি বিষণ্ন পরিশ্রান্ত সূর্যটা। আমি যা বলতাম বৃষ্টিকে বলার জন্য এক রাত ঘুমের পর ঠিকই ভুলে যেত। আমার কোনো কথা জানত না বৃষ্টি, বৃষ্টির কোনো কথা জানতাম না আমি। আমরা শুধু জানতাম, আমাদের একান্ত ব্যক্তিগত একটা পিয়ন আছে।

আমাদের বাড়ির পেছন দিকে অনেক দূরে বড়ো বাগানটার নিচে দিনের সমস্ত আলো ঝেটিয়ে নিয়ে সূর্যটা ঘুমতে গেলে, আমি শূন্য মাঠের দিকে মুখ করে বসে থাকতাম। অন্ধকারে বৃষ্টির মা আসত আমাদের বাড়িতে। গোলাঘরের আড়ালে বসে থাকত চুপচাপ। দাদি এক থালা ভাত দিলে খেত। কিছুটা খেয়ে কাপড় দিয়ে ঢেকে নিয়ে যেত বাড়িতে, বৃষ্টির জন্য। আমি কাছে গেলে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকাত, ভয়ে সরে দাঁড়াতাম। কিছু কিছু মানুষ থাকে রোগের মতো, কাছে যেতে হয় না, দাদি আমাকে রাতে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলতেন।

তাহলে যে এখানে আসে? তুমি খেতে দাও? আমার অনেক কিছু বুঝতে না পারা কৈশোরের প্রশ্ন দাদিকে।

রোগ যাতে ছড়িয়ে যেতে না পারে, সে জন্য দেখাশোনার দরকার হয়। দাদির এই কথা না বুঝতে পেরে আর প্রশ্ন করতাম না। মনে করতাম, কিছু কিছু প্রশ্ন করার জন্যও বয়স লাগে। পৃথিবীর সব আলো সবার জন্য না, পৃথিবীর সব অন্ধকারও সবার না। যেমন যে অন্ধকারে বাবা ঘর থেকে বের হয়ে পশ্চিম থেকে পুবের সাঁকো ধরে হাঁটা দিতেন, সেই সাঁকো যত মজবুতই হোক, আমার চলার জন্য না।

দাদি খাবার দিয়ে চলে গেলে আমি বৃষ্টির মার পেছনে, দূরে না কিন্তু আড়ালে গিয়ে দাঁড়াতাম। অন্ধকারে আমাদের দুজনের ছায়া কখনো কখনো নড়ে উঠত পরস্পরের দিকে।

বৃষ্টি কি আমার সমান? আমি জিজ্ঞাসা করি।

হুম। লম্বায় না হলেও বয়সে।

তাহলে স্কুলে যায় না কেন?

আমাদের মেয়েদের ওসব স্কুলে যেতে নেয়। বৃষ্টির মা বলে।

তার মানে বৃষ্টি পড়তে পারে না?

আমাদের রাতের স্কুল আছে লেখা শেখার জন্য। আমিও বৃষ্টির বয়সে সেখানে নামসই করতে শিখেছি। তোমার বাবা তখন সেই স্কুলে পড়াতে যেত।

বাবা, এখনো যায়? পড়াতে? আমার প্রশ্নের আর কোনো উত্তর আসে না। কিন্তু এরপর থেকে বাবাকে অন্ধকারে ওদিকে যেতে দেখলে আমার ভালো লাগতে শুরু করে। অন্যদের সঙ্গে বৃষ্টিকেও নিশ্চয় লিখতে-পড়তে শেখায়। একদিন বৃষ্টির মার হাতে একটা বই দিলাম, আমার প্রিয়, ঠাকুরমার ঝুলি। বৃষ্টি পড়লে অনেক মজা পাবে। যদি পড়তে না পারে, যেদিন যাব বৃষ্টিকে পড়িয়ে শোনাব। বৃষ্টির মা বইটি ধরে বসে থাকলে আমি বলি।

 


আমার মা ছিল না, শুনেছি জন্মের পরপরই হেঁচকি উঠে মারা গেছে। কবিরাজ অনেক চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারেনি। দাদি আমাকে মায়ের যত্নে বড়ো করে তুলেছে। রাতে অন্ধকারে বৃষ্টির মা আমাকে বুকের দুধ খাইয়ে রেখে গেছে।

 

না না, তুমি এসো না। কোনো দিন এসো না আমাদের পাড়ায়। অনেক লম্বা পথ, তোমার পা ব্যথা করবে। অনেক সাপ কীট সে পথে, তোমাকে কামড়ে দেবে। গাছে গাছে নিশি, তোমাকে তুলে নিয়ে যাবে।

আমি তো রাতে যাব না, দিনে যাব, সকাল সকাল যাব।

দিনে তো আমাদের পাড়াতে কেউ আসে না। দেখো না স্কুলটাও হয়েছে রাতের, নাইট স্কুল। এ পৃথিবীতে কিছু কিছু পাড়া পাড়া, কিছু কিছু বাড়ি, কিছু কিছু মানুষ রাতকে জ্বালিয়ে রাখতেই বেঁচে থাকে। ল্যাম্পটা কেমন সুন্দর জ্বলছে দেখছ না? বৃষ্টির মা দূরে রান্না ঘরে ল্যাম্পটা দেখিয়ে বলে।

হ্যাঁ, কেরোসিনে।

কেরোসিনে আগুন জ্বলে, আলো জ্বলে না। বড়ো হও বুঝতে পারবা। বৃষ্টির মা বলে।

আমার মা ছিল না, শুনেছি জন্মের পরপরই হেঁচকি উঠে মারা গেছে। কবিরাজ অনেক চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারেনি। দাদি আমাকে মায়ের যত্নে বড়ো করে তুলেছে। রাতে অন্ধকারে বৃষ্টির মা আমাকে বুকের দুধ খাইয়ে রেখে গেছে। আমি আর বৃষ্টি দুই বাড়িতে থেকে এক মায়ের দুধ খেয়ে বড়ো হয়েছি। কিন্তু কোনো দিন কেউ কাউকে দেখিনি। আমি বৃষ্টির গল্প শুনি। বৃষ্টিও হয়তো আমার গল্প শোনে। গল্পে গল্পে আমাদের সম্পর্ক বাঁধা পড়ে। ঘুড়ি ওড়াতে ওড়াতে যখন অনেক ওপরে উঠে যায়, যখন অনেক দূরে পুবের আকাশে দাপাদাপি শুরু করে। দূরে, আরও দূরের পথ এঁকে দিয়ে সুতো কেটে দিই। বৃষ্টির কাছে কোনো দিন কি পৌঁছাতে পারে এর কোনো একটা? বৃষ্টিদের আকাশে কখনো কোনো ঘড়ি ওড়ে কি না, জানি না। টাকা জমিয়ে স্কুলের সামনের দোকান থেকে একটা দূরবীক্ষণ যন্ত্র কিনেছিলাম, লুকিয়ে লুকিয়ে বৃষ্টিদের আকাশ দেখব বলে। সস্তা যন্ত্রে আরও ঘোলা হয়ে ওঠে সব।

বৃষ্টির কথা মনে করতে করতে স্কুলে যাই। স্কুল থেকে আসি। বই খুলে বৃষ্টির কথা ভাবি। একদিন আমাদের ঠিকই দেখা হবে। আরও যখন বড়ো হব, তখন বাবার মতো ওদের নাইট স্কুলে পড়াতে যাব। তখন বৃষ্টি হয়তো আর পড়তে আসবে না। তবু আমাদের দেখা হবে। কিংবা হঠাৎ কোনো দিন বৃষ্টি আসবে ওর মায়ের সঙ্গে। আমি ওর মার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে দেখব বৃষ্টি পাশে দাঁড়িয়ে। যদি তত দিনে সে ঠাকুরমার ঝুলি না পড়তে পারে, আমি তাকে সাত ভাই চম্পার গল্পটা শোনাব। বই থেকে পড়ে না, নিজের মতো করে। শোনাব বলে এতবার পড়েছি যে মুখস্থ হয়ে আছে।

বৃষ্টিকে আমার কথা বলেন না আপনি? বৃষ্টির মাকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম।

না বলে উপায় আছে! তোমার নতুন লাল সাইকেলটার কথা বলেছি।

কী বলল শুনে?

বলল, লাল না হয়ে নীল হলে ভালো হতো। নীল ওর প্রিয় রং তো!

লাল প্রিয় না কেন?

রক্তের রং তো। রক্ত দেখলে বৃষ্টি খুব ভয় পায়। একবার আলু কাটতে গিয়ে আমার আঙুলটা বেশ খানিকটা কেটে গিয়েছিল। আঙুল কাটল আমার আর দেখি সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেল মেয়েটা।

শুনে খুব হাসি পেল। কিন্তু এরপর থেকে সাইকেলটার দিকে তাকালেই মনটা খারাপ হয়ে যেত। আমিই পছন্দ করে নিয়েছিলাম। নীলও ছিল। কোনো একদিন স্যার পড়াতে পড়াতে বলেছিলেন বেদনার রং নীল হয়। লাল হলো সাহসের প্রতীক। বীরত্বেরও। তারপর থেকে লাল কিছু দেখলে খুব টানে। একদিন এই লাল সাইকেলই আমাকে বৃষ্টির কাছে পৌঁছে দেবে, এমনটা কত ভেবে চালাতে চালাতে পুবের মাঠ ধরে অনেক গভীরে চলে গেছি। রক্তের রংও লাল, এইটা সেদিন স্যার বলেনি কেন? একটা নীল রঙের ঘুড়ি এনে বৃষ্টির মার হাতে দিই। সঙ্গে কিছুটা সুতোও। নাটাইটা আমার নিজের বানানো। একদিন এক ভ্যাপসা গরমের দুপুরে বাড়ির থেকে একটু দূরে একটা বাবলাগাছে উঠে বসে আছি। বাবলাগাছের ঝিরিঝিরি পাতা কীভাবে যেন রোদের তাপটাকে ঠেকিয়ে দেয়। ‘আর্ট! ক্ষমতা দিয়ে কিছু হয় না।’ মাছরাঙার কথা বলতে গিয়ে একদিন ইংরেজির শিক্ষক বলেছিলেন। বাবলাগাছে বসে সেই কথাটা আবার মনে হলো। ভাবতে ভাবতে দেখি পুবের আকাশ থেকে একটা ঘুড়ি নেমে আসছে, নীলরঙা ঘুড়ি। আকাশের অনেক ওপর থেকে নামছে। শকুনের মতো অনেকটা জায়গাজুড়ে পাক খেয়ে খেয়ে। আমি অপেক্ষা করি। ঘুড়িটা সুতোহীন আমার মাথার ওপরে এসে একই জায়গায় পাক খেতে থাকে। দুপুর গড়িয়ে যায়, নিচে আর পড়ে না। গাছের নিচেই আমার লাল সাইকেলটা।

 


সূর্যটা তখনো ডুবে যায়নি। দিনের শেষ আলোটুকু জড়ো করে মুঠোই নিয়ে আড়াল হওয়ার পথে। মুঠো ফসকে কিছু আলো তখনো পাখিদের ঘরে ফেরার পথ দেখাচ্ছে। বাড়ি থেকে কিছু দূরে বিছালি পালার ওপর শুয়ে থেকে আলো ও অন্ধকারের শেষ মিলনটুকু আলাদা করার চেষ্টা করছি।

 

সেদিন ঘুড়িটা কেটে গেছে। বাতাস খুব বেশি না থাকলেও মাঝেমধ্যে ঘুড়ি কেটে যায়। সুতো ভালো হলেও কাটে। বৃষ্টিকে বলবেন মন খারাপ না করতে। বৃষ্টির মা আবার এলে আরেকটা নীল ঘুড়ি দিয়ে বললাম।

সেই ঘুড়ি তো ওড়ায়নি। বিছানায় মাথার কাছে রেখে দিয়েছে। বোলে বৃষ্টির মা আর নতুন ঘুড়িটা নিল না। বলল, বৃষ্টি বলেছে তুমি ওড়াও তাতেই হবে। সব ঘুড়ির উড়তে শেখার দরকার নেই।

এই কথা শোনার পর দেখলাম আমার চোখ ভিজে যাচ্ছে। আমার খুব ইচ্ছে করছে বৃষ্টির মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে। আমার যেসব ঘুড়ি কেটে গেছে, যাদের আমি নিজে সুতো কেটে যেতে দিয়েছি, সব কটির মায়ায় আমার খুব কান্না পাচ্ছে। কিন্তু কাঁদতে পারি না। জীবনের কত সুগভীর যন্ত্রণা প্রবঞ্চনা নিয়ে ঠায় শক্ত হয়ে বসে থাকা নারীটির পাশে এত সামান্য কারণে কাঁদলে যে জীবনকেই অপমান করা হয়, এই বোধটুকু কীভাবে যেন সেদিন তৈরি হয়ে যায়।

সূর্যটা তখনো ডুবে যায়নি। দিনের শেষ আলোটুকু জড়ো করে মুঠোই নিয়ে আড়াল হওয়ার পথে। মুঠো ফসকে কিছু আলো তখনো পাখিদের ঘরে ফেরার পথ দেখাচ্ছে। বাড়ি থেকে কিছু দূরে বিছালি পালার ওপর শুয়ে থেকে আলো ও অন্ধকারের শেষ মিলনটুকু আলাদা করার চেষ্টা করছি। এদিকটাতে মানুষের চলাচল কম। কাছের এক ডোবা থেকে কতগুলো হাঁস উঠে এসে পথ ভুল করে কি না জানি না, পায়ের নিচে এসে দাঁড়িয়েছে। হাঁসগুলোর পায়ে ফিতা বাঁধা, লাল ফিতা। মনে হলো কিছু দূরে ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে থেকে কেউ আমাদের দেখছে, আমাকে ও হাঁসগুলোকে। ছায়াটি দিঘির জলের মতো কাঁপে। দিনের সবটুকু আলো নিয়ে ডুব দিয়েছে সূর্য। অন্ধকার তখনো সবখানে সমানভাবে গলে যেতে পারেনি। আলো না থাকলেই যে অন্ধকার, এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। সেদিন বুঝলাম সেটা। অন্ধকারেরও নিজস্ব অস্তিত্ব আছে। এই কারণে এমন জায়গাও থাকতে পারে যেখানে আলো নেই, অন্ধকারও নেই। তেমনই একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে ছায়ার মতো কেউ একজন। একবার চোখ সরিয়ে নিচে হাঁসগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখি পায়ের লাল ফিতেগুলো বদলে দিয়েছে কেউ, নীল হয়ে গেছে সবগুলো। অন্ধকারে নীল রং কালো দেখানোর কথা। কিন্তু দিনের আলোর মতো নীল ফিতাগুলো টকটক করে ফুটছিল। বৃষ্টি কি জানে নীল রং বেদনার? স্কুলে না গেলে তো জানার কথা না। জানে না বলেই হয়তো নীল ওর এত প্রিয়! যে জানে না তার কাছে নীল কি কোনো বেদনা বয়ে আনতে পারে? পৃথিবীতে বেদনা বাড়ার কারণই হলো জানা। অল্প জানা মানুষের বেদনাও অল্প। কিন্তু মজার ব্যাপার, মানুষ সব সময় বেশি জানার পেছনে ছোটে। বেশি জানার জন্য স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত তৈরি করেছে, বেদনার প্রতি মানুষের এমনই অকৃত্রিম টান। বৃষ্টি এসব প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ পাবে না কোনো দিন। ওর বেদনাগুলো একটা জায়গায় ঘুরপাক খাবে। চারদিকে অন্ধকার নেমে আসলে বিছালির গাদাটা চাঁদের আলোয় চিকচিক করে। আমি অপেক্ষা করি। মনে হয় সত্যি সত্যি বৃষ্টি আসবে। আমরা একসঙ্গে বাড়ি ফিরব। কিন্তু আমাদের তো বাড়ি আলাদা। বাড়ি শুধু না, পাড়াও- এমনকি গ্রামও।
বাড়ি এসে দেখি আজ বৃষ্টির মা আসেনি। রোজ তো আর আসে না। দাদি আমাকে হেঁসেলে খেতে ডাকেন। যেদিন বৃষ্টির মা আসে না, সেদিন আমার মার কথা মনে পড়ে। বৃষ্টির মা আছে বলে হিংসা হয় তখন। আমার মা নেই কেন জানি, বৃষ্টির বাবা নেই কেন জানি না। জানি না বলে এ নিয়ে আমার মধ্যে কোনো বেদনা তৈরি হয় না। বৃষ্টির নিশ্চয় হয়, যেমন আমার হয় আমার মাকে নিয়ে। মার কথা ভাবতে ভাবতে মুখে খাবার তুলে নিতে ভুলে যাই। দাদি দেখেও কিছু বলে না। সংসারে এই মানুষটা সব ঘটনার সাক্ষী হয়ে পুরোনো গাছের মতো কীভাবে যেন নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকে। ঝড়ঝাপটা সব তার ওপর দিয়ে যায়।

 


বাবা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে একবার ওপরে তাকিয়েছিল। গাছের গোড়াটাতে প্রস্রাবও করল। মাত্র কয়েক হাত ওপরে আমি বসে, অথচ দেখতে পেল না।

 

দাদি, বাবা কি এখনো গুচ্ছগ্রামে যায়? খেতে খেতে জিজ্ঞাসা করি।

বাবার সবকিছু জানতে হয় না। দাদি অন্যমনস্ক হয়ে বলে।

আমিও বড়ো হলে বাবার মতো বৃষ্টিদের পাড়ার নাইট স্কুলে পড়াতে যাব। আমি আপনমনে বলি।

তোকে শহরে পাঠিয়ে দেব। অনেক দূর লেখাপড়া করবি। তারপর শহরে চাকরি করবি, সংসার করবি। এই পোড়া গাঁয়ে তোর পড়ে থাকার দরকার নেই। দাদি বলে উঠে যায়। তাহলে বৃষ্টির সঙ্গে আমার দেখা হবে না? দাদি শুনেও না শোনার ভান করে। সেদিন রাতে বৃষ্টির মা আসে। দাদি ডেকে নিয়ে চুলা ঘরের পেছনে বসায়। এদিক দিয়ে একটা গোখরা সাপ চলাচল করে। বৃষ্টির মা পা ঝুলিয়ে বসে থাকে। চুলাঘরের ভেতরে শুকনো খড়িগুলো গোছাতে গোছাতে দাদি বলে, বৃষ্টি এখন কেমন আছে?

রক্ত পড়া এখনো বন্ধ হয়নি। বাঁচাতে পারব তো? বলে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে বৃষ্টির মা।

পারবি। কাল কবিরাজ পাঠাব।

শহরে নিলে হতো না?

খবরদার, হাসপাতালে নিবি না। সেরে উঠুক ওকে আমি ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করব, গার্মেন্টসে কাজ করবে। দাদি শাসিয়ে দিয়ে বলে।

একটা তো থেকেও নেই। জোড়া ভেঙে তরতাজা ছেলেটাকে বিনিময় করে রাতের অন্ধকারে একটা মরা বাচ্চা উঠোনে কবর দিছি। কাঁদতে কাঁদতে বৃষ্টির মা বলে। দিলামই যখন, মেয়েটাকে দিলে আজ চোখের সামনে এই সব সহ্য করতে হতো না।

যার রক্ত তাকেই দিছস। মেয়ে দিয়ে তো বংশের প্রদীপ জ্বলে না। দাদি বলে। বেটা ছেলে, বেশি দিন ঠেকানো যাবে না। বৃষ্টিকে তার আগেই সরিয়ে দিতে হবে। না হলে আরও যা ঘটবে, মা হয়ে সহ্য করতে পারবি? দাদির এই কথা শুনে বৃষ্টির মা মুখের মধ্যে কাপড় গুঁজে দেয়। খুব কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। দাদি দেখলে বকাবকি করবে ভেবে সরে আসি। দুজনের এসব কথার অনেক কিছু বুঝতে পারি না। শুধু এটুকু বুঝি, বৃষ্টির হাত-পা বা শরীরের কোথাও কেটে গেছে। রক্ত ঝরছে। বৃষ্টি সুস্থ হলে ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হবে। বৃষ্টির সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না। আমাকেও ঢাকায় পড়তে পাঠাবে দাদি, যাতে বৃষ্টিদের নাইট স্কুলে আমি কখনো পড়াতে যেতে না পারি। বৃষ্টিও ঢাকায়, আমিও ঢাকায়। আমরা কেউ কাউকে কোনো দিন দেখিনি। আমরা দুজনে দুজনের সব গল্প জানি। আমাদের যদি হঠাৎ কখনো দেখা হয়ে যায় অচেনা শহরে চিনতে পারব পরস্পরকে? চেনা গল্প নিয়ে কি মানুষ চেনা যায়?

বৃষ্টির মা কখন গেছে টের পাইনি। বাড়ি থেকে বের হয়ে মাঠের মধ্যে একা দাঁড়িয়ে থাকা বাবলাগাছে উঠে বসে থাকি। গাছের নিচ দিয়ে বৃষ্টির মা আসা-যাওয়া করে। কদিন আগে বাবাকেও অন্ধকারে এ পথে যেতে দেখেছি। এই গাছটাতে উঠে বসে থাকলে আমাকে কেউ কেন জানি দেখতে পায় না। বাবা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে একবার ওপরে তাকিয়েছিল। গাছের গোড়াটাতে প্রস্রাবও করল। মাত্র কয়েক হাত ওপরে আমি বসে, অথচ দেখতে পেল না। আজও হয়তো বৃষ্টির মা আমাকে দেখতে পায়নি। দূরে বৃষ্টিদের বাড়ির ওপরের চাঁদটা নিশ্চল থেকে একটু একটু করে এগিয়ে আসছে আমাদের বাড়ির দিকে। যত এগিয়ে আসছে ততই লাল হয়ে উঠছে চাঁদের চারপাশে। চাঁদ কেন কখনো নীল হয় না? বিজ্ঞানের স্যারকে একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি হাসতে হাসতে বলেছিলেন, চাঁদের তো কোনো বেদনা নেই! চাঁদটা মাথার ওপরে এসে এবার নিচের দিকে নামতে থাকে। চারদিকে লাল রক্ত, কুসুমের মতো সোনালি অংশটা নীল হতে শুরু করে। আমি বাবলাগাছে বিছানার মতো উপুড় হয়ে শুয়ে বৃষ্টিকে দেখতে পাই। রক্তাক্ত বৃষ্টি। ফোঁটায় ফোঁটাই চাঁদটা গলে পড়তে শুরু করে সমস্ত মাঠজুড়ে, গ্রামজুড়ে, নদীজুড়ে। সেই বৃষ্টি পৃথিবীর কোনো কিছু ভেজাতে পারে না।


মোজাফফর হোসেন

কথাশিল্পী-প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক মোজাফ্ফর হোসেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে সাংবাদিকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। বর্তমানে বাংলা একাডেমির অনুবাদ উপবিভাগে কর্মরত। প্রধানত কথাসাহিত্যিক। দুই বাংলার অন্যতম পাঠকপ্রিয় ছোটগল্পকার। পাশাপাশি সাহিত্য সমালোচক ও অনুবাদক হিসেবেও তাঁর পরিচিতি আছে। ‘তিমিরযাত্রা’ উপন্যাসের জন্য কালি ও কলম সাহিত্য পুরস্কার, ‘পাঠে বিশ্লেষণে বিশ্বগল্প’ বইয়ের জন্য ব্রাক ব্যাংক সমকাল সাহিত্য পুরস্কার, ‘অতীত একটা ভিনদেশ’ গল্পগ্রন্থের জন্য তিনি এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ কথাসাহিত্য পুরস্কার এবং ‘স্বাধীন দেশের পরাধীন মানুষেরা’ গল্পগ্রন্থের জন্য আবুল হাসান সাহিত্য পুরস্কার, নো ওম্যান’স ল্যান্ড গল্পগ্রন্থের জন্য আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেছেন। এছাড়াও তিনি প্রতিভা প্রকাশ সাহিত্য পুরস্কার, অরণি সাহিত্য পুরস্কার ও বৈশাখি টেলিভিশন পুরস্কারে ভূষিত হন। মোজাফফরের গল্প ইংরেজি, হিন্দি, গুজরাটি, ইতালি, নেপালি ও স্প্যানিশ ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

শেয়ার