রবীন্দ্রনাথ কবিতা বইয়ে ছাপা হওয়ার পর এডিট করায় ঘোরবিরোধী ছিলেন। এর উল্টোটা দেখি জীবনানন্দের ক্ষেত্রে। বাতাসের বাইনোকুলার-এর প্রথম সংস্করণ বের হয় ২০১০ সালে। সাত বছর পর দ্বিতীয় সংস্করণে আমি কিছু পরিবর্তন ও পরিমার্জনের পাশাপাশি নতুন কবিতা সংযোজনের সুযোগ নিলাম। সেই সঙ্গে জেব্রাক্রসিং-এর কর্ণধার কবি দন্ত্যন ইসলামকে জিজ্ঞাসা: কেন তিনি এমন রদ্দি বই রিপ্রিন্ট করলেন?! তাতে অবশ্য পজ করা ‘বালিঘড়িকে কামার্ত করা’র সুযোগ হলো। অনেক ভেবে তুলে দিলাম তিন ফোটা ডট, অন্ত যতি। আগের কিছু বানান-ভুল শুধরে এই সংস্করণে আমি বিসর্গহীন দুখী। ‘প্রিয় শত্তুর তোমার জলসীমায় ডুবিয়ে দিলাম জাফরানের পলোয়ারি’—এখন খুঁটে নাও জলজ হাতি।
– মাজুল হাসান
উৎসর্গ কবিতা
সমুদ্র, নীলগাই, মুকুটরমণী দূরের কথা, একটা সাইকেল দেখলে
তব্দা মেরে যাই। মাথার ভেতর ক্রিং ক্রিং। তবু গোটা হরফে
প্যারাম্বুলেটর লিখতে পারলাম কৈ?
ভাস্কর বলেছিলেন, কথায় জাদু আছে, শব্দ থেকে
খুলে ফেলতে হয় অলংকার। অর্থাৎ ঘন নীল থেকে হালকা নীল
আকাশ থেকে ঊনআকাশ; সাইকেল থেকে ক্রিং ক্রিং
আমার সব শব্দের ভেতর একটা করে বিকল সাইকেল পড়ে থাকে
ঊনআকাশে ক্রিং ক্রিং, হালকা নীলে জেঁকে বসে অনন্ত শীতকাল
যদিও ওখানে শীতনিদ্রা বলে কোনো মহকুমার উপস্থিতি নেই
আমার নিভন্ত তারাগুলো টিকব তো ভাস্কর?
আবে রাখ
মিঠাই
ক্রেয়ন হারালে ডুকরে ওঠে পরী। পরীরা কাঁদে এবং সহবাসের প্রস্তাব দেয়
অথচ ডিগবাজির মতো ডালিমকুমারও কোথাও ফ্রিজ হয়ে আছে
আর তুমি ও তোমার নীলঘোড়া, শাদা তোয়ালে, পুঁইদানার রক্ত, সব
নিখোঁজ
তোমার ঘুম-নগরের দুয়ারে বসে আছে জলজ হাতি। পিঠে তার অগ্নিবলয়
মুণ্ডু ঘুরানো পাহারাদার, হাতে জীয়ন-চাবুক
চাবুকের চুমুতে ধসে-ধসে গেছে তোমার সবশেষ ছায়ার
পোশাক
শিমপাতার সবুজ হারিয়ে যাবার মতো এখন তুমি নেংটো
এখন তুমি হেমন্তের চে’ একা এবং তেঁতুলপাতার মতো গা-ছমছম
বাতাস
বুদ্ধমূর্তি ও করুণা দি‘র লাল–শাদা
কে আমাকে দিলো মাটির বুদ্ধমূর্তি?
জড়িয়ে ধরলো মাঝ রাস্তায়
দ্যাখো কেমন অর্ধেক সাপ আর অর্ধেক ব্যাটন-ধরা
সাপুড়ে হয়ে গেলাম
কে আমাকে দিলো খালি রাস্তার খাঁ-খাঁ যৌনবেদনা?
থেকে থেকে রাস্তা দাবড়াচ্ছে চাকা খুলে যাওয়া মাতাল ট্রাক
আকাশ থেকে ঝরে পড়ছে চিঠি ও অন্তর্বাস
মাথার ভেতর ডানা ঠুকছে খুনসুটি; টুনটুনি-টুনটুনি
টুনটুনির রক্ত চাই
আজ লালে শাদায় হেসে উঠছে করুণাদি’র বাড়ি
একলা দুপুর একলা যুবতিকে
কিশোরের হাতে ক্রিকেট ব্যাট আর পাঁচ ফুট উঁচু দেয়াল
দেয়ালের শরীরে এতো এতো পাতার শব্দ! তুমি আয়নায়
মুখ দেখতে ভুলে যাও
তখন মানিপ্লান্টের মতো পাঁচিল ডিঙিয়ে বল এসে যদি
ভেঙে দেয় জানালার কাচ, তুমি কিন্তু রাগ করো না
তোমার জানা উচিত, পৃথিবীর সব কাচের জন্ম এই জন্য যে
বেচারা ভ্যানঅলা না চাইলেও যেন চুপিসারে
রূপসী পেসেঞ্জারকে একঝলক দেখে নিতে পারে
তুমি চাইলে বুকে একটা মানকচুর পাতা টেনে নিতে পারো,
কিন্তু মাইন্ড করো না
জেনে রেখো, জ্যৈষ্ঠদুপুরে আঙুল ও মধ্যমা কেটে
যে কিশোর চলে যায়; মসৃণতা ছাড়া
গোলাপ বাগান থেকে সে আর কিছুই নেয় না
পারিবারিক অস্ত্রাগার
সহোদরার স্নানদৃশ্য দ্যাখে কিশোর। তৈরি করে গ্ল্যাডিওলাসের বাগান। সপ্তাকাশ থেকে খসে পড়ে ধূমকেতু। ঝাঁটা, বর্শা, শুকনো সেঞ্চুরি পাতার মর্মর শব্দের ধুমকেতু। তখন শহরের সবচেয়ে ভালো কালেকশনের নীলছবির স্টোরটিতেও ভয়ে, জীবনের প্রতি আঠালো মমতায় ফুল বেচতে লেগে যায় ভীতু দোকানদার। তারা ধামাচাপা দিতে চায়, মাকে চুমু খেতে দেখে মনে মনে বাবাকে খুন করার ইচ্ছে পোষণকারী ৮২ হাজার শিশুকে। সমস্ত শৈশবজুড়ে যারা কিনা খুঁজতে থাকে ৮২ লক্ষ জুতসই অস্ত্র। তাই ফিতাঅলা জুতো, নাইটক্যাপ আর স্ট্রবেরি রাবারের মতো ৮২ কোটি উপহার—শিশুকে যা-ই দেয়া হোক না কেন, তাদের মন ভরে না। কারণ, শিশুরা পিস্তল পছন্দ করে।
ফ্রেস্কোর যেহেতু হাত থাকে না
একটানা বেশি দিন ঝগড়া না হলে প্রেমিকেরা টেরাকোটার
ফ্রেস্কো হয়ে যায়
তখন প্রেমিকা, যে আশলে লীলাবালার ঘুম, সেও অঙ্ক
কষতে লেগে যায়
বলে, পিঠের দিকটায় চরকাঁটাটা একটু লাগিয়ে দাও তো
এমন সময় যদি ঝনঝন করে ওঠে ব্রিটিশ আমলের কাসার গ্লাস
তবু চুপ থাকাই শ্রেয়। কমলার ঘোরতর অফ-সিজনে
ফাজিল পড়শি এসে যদি হাসতে হাসতে মুখে পুরে দেয়
১ কোয়া টসটসে কমলা—তখন সৌজন্যের হাসি ছাড়া
পৃথিবীতে কোনো ঢাল থাকে না
তাই ইকারুশের মতো পতিত প্যারাট্রুপার ও প্রেমিক মাত্রই
অকারণে হাসেন
আর, তাদের ঘিরে হাসতে থাকে এক লক্ষ সুতাদাহি সাপ
বাতাসের বাইনোকুলার
রুদ্ধশ্বাস, অপেক্ষায় রাখো, আমাকে নাও
নাও, যাতে কাল ক্যামেরার সামনে মাথায় একটা হলুদ মুনিয়া নিয়ে
আমি স্বাভাবিক পোজ দিতে পারি। খবরদার, তোমরা কিন্তু
ভিড় করো না। ভিড়ে আমার কেবলি পেখম খসে-খসে যায়
আর ছোট্ট মুনিয়া যখন আরও ছোট্ট ঠোঁটে
চেরি-সন্ধ্যাসমেত আমাকে উড়িয়ে নেবে চেরাডাঙ্গীর পথ
তখন তোমরা সবাই নীলচোখের অধিকারী হবে
কিন্তু প্রয়োজনের সময় একটা বাইনোকুলারও তোমরা খুঁজে পাবে না