বাংলাদেশে সিনেমার গল্প কেন কমপ্লিকেটেড হয় না? এই প্রশ্ন মাথার ভেতর ঘুরতেছে। ঘুরতেছে সিনেমা যদি একটা শিল্প মাধ্যম হয় আর তাতে যদি জীবনেরই প্রকৃত রূপ না উঠে আসে তবে সেই শিল্প কতটুকু মানুষের কল্যাণে কাজে লাগে? সিনেমা আদৌ মানুষের কল্যাণে কাজে লাগে কি না এই প্রশ্নও আসে। তবে এই প্রশ্নের সাথে কখনোই ঐ প্রশ্নের জোড়া দেয়া উচিত হবে না, জীবনের জন্য শিল্প না শিল্পের জন্য শিল্প। এই তর্ক বহু পুরনো এবং সমাধান আপেক্ষিক। কিন্তু যেইসব প্রশ্নের সমাধান আপেক্ষিক না বলে মনে হয়, খুঁজি সেইসব প্রশ্নের উত্তর; মিলে না।
সিনেমার বিকাশের সাথে সাথে যেই বিষয়টার বিকাশ খুবই প্রাসঙ্গিকভাবে এগিয়েছে তা হইলো পুঁজি। পুঁজির ধর্মই হলো তার যা প্রয়োজন সেইটা সে নিজের মতো করে নিবে। সিনেমার সম্পূর্ণ শিল্প মাধ্যম তাই তুমুল বাণিজ্যিক মাধ্যমে রূপান্তরিত হইতে দেরি হয় নাই। বরং শিল্প মাধ্যমের চেয়ে বাণিজ্যিক মাধ্যম বেশিই শক্তিশালি। পুঁজির কাছে তাই বাঁধা পড়ে সম্পূর্ণ রঙিন স্বপ্ন ধূসর হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এইভাবে কতদিন? সিনেমাটাকে কেবল পুঁজির মুঠোবন্দি করে না রেখে বাইরে ছড়িয়ে দিলে যদি এর থেকে কিছুটা বাঁচা যায়। তাই সিনেমাকে পুঁজির কাছে বন্দী করার আগে, সিনেমার কাছেই আশ্রয় নিতে হবে। আর তার জন্য সিনেমাটা বানাইতে হবে। তবে সেই সিনেমাটা যেন ‘ড্রামাটিক’ বা নাটকের মতো না হয়ে সিনেমা হয়। খেয়াল রাখতে হবে এই বিষয়টা।
আমাদের দেশে সিনেমার স্বপ্ন দেখা তরুণের এখন অভাব নাই। একটা সময় ছিলো শাহবাগে তিনটা ঢিল দিলে চারজনের গায়ে লাগতো, আর তাদের চারজনই কবি। এখন এইটা ফিল্মম্যাকার হয়ে গেছে। ঐ সময়কার অবস্থা থেকে আমরা কবিতার চেহারার দিকে যদি তাকাই, তবে বলতে হয় ঐ সময়কার কবিদের কয়জনের কবিতা আমরা মনে রাখতে পারছি? বা এখনো সদর্পে লিখে যাচ্ছেন? যারা আছে, তাদের সংখ্যা খুবই কম। এই যে এখনকার এই ফিল্মম্যাকার প্রজন্ম (আমার বন্ধুরাই অধিকাংশ) ঐ নব্বই বা শূন্য দশকের কবিদের মতো লিটলম্যাগের পাতা ভরতে গিয়ে এখন টিভির বা তার থেকে একটু উন্নত বিজ্ঞাপনের ভিজুয়াল নির্মাণ করে। এইসব অনেকটা পত্রিকার সাহিত্যপাতা বা দৈনিক পত্রিকার ফিচার লেখার মতো। এইভাবে সিনেমাটা হয় না, বন্ধু। হবে না। সিনেমাটা আরও বড় বিষয়, আরও বড় স্বপ্নের, আরও দূরে তার গন্তব্য। তবে আশাহত হতে বলি না। প্রতুলের গানের মতো করে বললে বলতেই হয়,
আলু বেচো ছোলা বেচো,
বেচো বাকরখানী,
বেচো না বেচো না বন্ধু
তোমার চোখের মনি;
কলা বেচো, কয়লা বেচো,
বেচো মটর দানা,
বুকের জ্বালা বুকেই জ্বলুক
কান্না বেচো না
ঝিঙে বেচো পাঁচ সিকে তে
হাজার টাকায় সোনা
বন্ধু তোমার লালটুকটুকে
স্বপ্ন বেচো না
তাই বলি কি, স্বপ্নটা লাল টুকটুকে হওয়া চাই। চাই তাকে আগলে রাখার ক্ষমতাও। স্বপ্নকে আগলে রাখতে রাখতে সে আবার আপনার চেয়েও বেশী বড় বা বেশি বয়স্ক যেন না হয়ে যায় সেই দিকটাও খেয়াল রাখতে হবে। আল্টিমেটলি তারে স্বপ্নের মতো করেই বানাইতে হবে। সে হবে স্বপ্নের বাস্তব একটা আয়না। তাই বলি কি- বন্ধু, পুঁজি আর মরিচিকার পেছনে না ছুটে স্বপ্নের পিছনে ছুটে নিজের ছবিটা বানাও। বলো নিজের গল্পটাই। কারণ, একমাত্র স্বপ্নই তোমার গল্প বলার স্বাধীনতা দিবে। আর কেউ না। পৃথিবীর কোনও প্রযোজক তোমার গল্পের জন্য প্রযোজক হয় নাই। সে হইছে তার গল্পের জন্য, তার বাণিজ্যের জন্য। তাই তোমার গল্পটাই বলো না!
এখন, কেমন হবে তোমার গল্প? এই প্রশ্ন আমার ভাবার আগে আমি যা ভাবছি, তা হইলো আমার কি আদৌ কোনও গল্প আছে নাকি? সেই গল্পটা কিসের? জীবনের, রূপকথার, নাকি রোমাঞ্চের? এইসবের বাইরে আমার নিজের গল্প ছাড়াও আমাদের চারপাশের কত গল্প আছে। জীবনের চেয়েও রোমাঞ্চকর, রূপকথার চেয়েও উত্থান-পতনে ভরপুর, সিনেমার চিত্রনাট্যের চেয়েও বেশী বাস্তব। এইসব গল্প আমরা বলি না কেন? আমাদের সিনেমায় আমরা এইসব গল্প না বলতে বলতে আমাদের সিনেমার জীবনের বা সিনেমার গল্পের দর্শক দূরে চলে গেছে। এখন সেখানে কেবল পুজিঁর দর্শক ঢুকে গেছে। এই দর্শককে জীবনের, গল্পের, রোমাঞ্চের দর্শক বানানোর দায়িত্ব নিতে হবে। তবেই সিনেমাটা নিজের পায়ে দাঁড়াবে। প্রয়োজনে মানুষকে অভ্যস্থ করতে হবে ছোট ছোট জীবনের গল্প দেখাইয়া। একের পর এক, বারবার। তাই এতসব চিন্তা বাদ দিয়ে নিজের গল্পটাই বলতে হবে। প্রয়োজনে সবাই একসাথে… সবার গল্প, তবুও বলতে হবে নিজের ও চারপাশের গল্পটাই।
ইলিয়াস কমল
কবি, নির্মাতা