বই পরিচিতি : ঘুমন্ত মার্কারি ফুলে ।। রিভিউ: রুহুল মাহফুজ জয়

হাসান রোবায়েত। কবি। রোবায়েতের প্রথম কবিতার বই ঘুমন্ত মার্কারি ফুলে। বাংলা ভাষার তরুণ কবিদের কবিতা পড়েন, এমন পাঠকমাত্রই রোবায়েতের কবিতার সঙ্গে পরিচিত। এটা আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস। রোবায়েতের বই প্রকাশ হয়েছে ফেব্রুয়ারিতে। ক’টা মাস কেটে গেছে। অবশেষে গোপন মার্কারি ফুলে পড়া হলো। পড়া হলো মানে, সত্যিকার পড়াটা হলো। সময় নিয়ে, প্রতিটি কবিতার মর্মে ঢোকার চেষ্টা করা হলো। পাঠক হিসাবে রোবায়েতের কবিতা এবং ঘুমন্ত মার্কারি ফুলে নিয়ে আমার কিছু কথা বলার আছে।

গ্লেন ম্যাকগ্রা। দ্য পিজিওন। অস্ট্রেলিয়ার সর্বজয়ী ক্রিকেট দলের অন্যতম সদস্য। বলা যায়, বিশ্বজয়ী অজি দলটার অন্যতম প্রাণ ভোমরা। ভাবছেন, কবিতার বইয়ের আলোচনায় ম্যাকগ্রা কিভাবে এলো! এসে পড়লো তো! যারা ম্যাকগ্রার বোলিং দেখেছেন, একবার মনে করার চেষ্টা করুন, একই চ্যানেলে নিখুঁত লাইন-লেংথে ওভারের পর ওভার বল করে যাচ্ছেন একজন বোলার। ক্লান্তিহীন! রোবায়েতকে এ সময়ের বাংলা কবিতার গ্লেন ম্যাকগ্রা মনে হয় আমার। ক্লান্তিহীনভাবে রোবায়েত কবিতা লিখে যাচ্ছেন— নিজের নির্মিত ভাষা, পরিমিতিবোধ আর নিজস্ব বলার ভঙ্গিতে; অর্থাৎ নির্দিষ্ট চ্যানেলে। পাঠককে যদি ব্যাটসম্যান ধরি, আনাড়ি পাঠক রোবায়েতের কবিতাকে সহজে নিতে পারবেন না; যেমন বেশিরভাগ ব্যাটসম্যানই ম্যাকগ্রাকে ঠিকমতো খেলতে পারতেন না।  রোবায়েতের কবিতার এটা একটা ব্যাপার। শক্তিশালী পাঠক না হলে একই ধাঁচের, একই ভাষায় লেখা রোবায়েতের কবিতায় পরিপূর্ণ ডুব দেয়া কঠিন। যেরকম টপঅর্ডার ব্যাটসম্যানদের যন্ত্রের মতো ম্যাকগ্রার অফ করিডোরে টানা বল খেলা খুব কঠিন হতো। পিজিওন শচীন-লারা মানের ব্যাটসম্যানকেও একদম প্রথম বলেই ভড়কে দিতে পারতেন। ঘুমন্ত মার্কারি ফুলে বইয়ের প্রথম লাইনটিই পাঠককে ভড়কে দেবে। লাইনটি এরকম, “এতটা বৈমাত্রেয় কেন এই ভাষা!”

ম্যাকগ্রা তথাকথিত এক্সপ্রেস বোলার ছিলেন না। ধীরে ধীরে তার অলস সৌন্দর্যের বোলিং অ্যাকশন, নিখুঁত লাইন-লেংন্থ আর বাউন্স দিয়ে ব্যাটসম্যানকে আটকে রাখতেন। দর্শককেও। শুরুতে ম্যাকগ্রাকে কিছুটা বিরক্তিকর মনে হতো। কিন্তু ঠিকই মায়াজাল ছড়ানো শুরু করতেন ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে। রোবায়েতের কবিতাও সেরকম। একই চ্যানেলে বল করতে করতে খেলা প্রায় অসম্ভব ইয়র্কার ছুটে আসতো আর ব্যাটসম্যানের স্ট্যাম্প ছত্রখান করে দিতো। আবার কখনো কখনো স্লোয়ার বাউন্সারে ভড়কে যেতেন ব্যাটসম্যান। স্বাভাবিক পেসের বাউন্সার তো ছিলোই। রোবায়েতের কবিতাও সেরকমই। উদাহরণ দেই-

“একদিন, অশ্বেরা ঘরে ফিরে গেলে জ্বলে ওঠে তোমার পেতল
কোথাও কোন গল্পে হয়তো পেকে আছে
লুব্ধ দৃষ্টির প্রতিবেশী।
গমের জাহাজ এক ডুবে গেছে রেডিওর নবে।” (স্বাভাবিক চ্যানেল)

“কী অসংখ্য চোখ
উড়ছে
নামছে

এলিজির বাইরে আর বৃষ্টি হলো না কোথাও!” (ইয়র্কার)

শ্রীমন নামের ছোট্ট এই কবিতাটি এত তীব্রভাবে পাঠকের মন বরাবর আঘাত করতে সক্ষম যে, আমি ম্যাকগ্রার ইয়র্কারে মাইক আথারটনের স্ট্যাম্প ভেঙ্গে পড়ার শব্দ শুনতে পাই। আমার মনে হয়, এই বইয়ে আর কোন কবিতা না থাকলেও চলতো!

কয়েকটা স্লোয়ার বাউন্সার দেখানো যাক,

“বিমূর্তই ধর্ম যখন; জগতের সব জল ভিন্ন অধিকার।”

“আত্নার সমান বাঁকে শুয়ে আছে পথ— ”

“ঘুম—
কত দূর, হিব্রু ভাষার ছুরি।”

“দূরে, পাতা নড়ে হিংসার চেয়েও ধীরে—”

আর স্বাভাবিক পেইসে দুর্দান্ত এক বাউন্সার ঘুমন্ত মার্কারি ফুলের শেষ কবিতাটি— ঘূর্ণ্যমান দেরাজের গান। অক্ষরবৃত্তে লেখা দীর্ঘ এক কবিতা। যে কবিতার রেশ বইটা পড়ার পরও পাঠকের মনোজগতে থেকে যেতে বাধ্য-ম্যাকগ্রার ভয়ংকর বাউন্সার যেভাবে ব্যাটসম্যানকে আচ্ছন্ন করে রাখতো! আর ছন্দসমালোচকদের প্রতিও এ এক অনবদ্য বাউন্সার। রোবায়েত প্রমাণ করে দিয়েছেন, ছন্দেও নিজস্ব ভাষায় কবিতা লেখা যায়। আর পুরো বইয়ের ৩৭টি কবিতায় একইরকম ভাষার ধারাবাহিকতা হলো ম্যাকগ্রার এক নাগারে একই জায়গায় বল ফেলে যাওয়ার মতো ব্যাপার।

ডেনিস লিলির পাগলাটে ফাস্ট বোলিং, ওয়াসিম আকরামের বৈচিত্র, ওয়াকার ইউনিসের রিভার্স সুইং বা শোয়েব আক্তারের গতি ম্যাকগ্রার মধ্যে ছিলো না। আম পাবলিকের কাছে ওনাদের মতো জনপ্রিয়ও ছিলেন না ম্যাকগ্রা। তাতে কী আসে যায়! তিনি শুধু নিজের দর্শনে বিশ্বাস করে ক্লান্তিহীন বল করে গেছেন। ফলও তো পেয়েছেন। সর্বকালের সেরা বিশ্ব একাদশ গঠন করতে গেলে ম্যাকগ্রাকে কেউ বাদ দিতে পারেন না। টেস্ট-ওয়ানডে মিলিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পেসারদের মধ্যে তার উইকেটই সবচেয়ে বেশি। রোবায়েত যেভাবে নিজের কবিতা লিখে যাচ্ছেন, যেভাবে চর্চা করে চলেছেন, এই কবিকে অস্বীকার করবে এমন কেউ নেই। ঈর্ষা নিয়ে সমীহই শুধু করবেন সমালোচক-কবিদল। আর কবিতার পাঠক ঠিকই একটা বড় জায়গা রোবায়েতের কবিতার জন্য রাখবেন। রাখতে বাধ্য। ম্যাকগ্রারা নিজের যোগ্যতায় কিংবদন্তী হন। রোবায়েত, বাঙলা কবিতার ম্যাকগ্রা হয়ে হয়ে উঠুক। শুভ কামনা।

শেয়ার