প্রথাবিরোধী সংস্কৃতি | সাখাওয়াত টিপু

ব্যাঙ্কসির ‘ইঁদুর’ ও আমাদের ‘চিকা’

পশ্চিমা সমালোচক মার্টিন বুলের একটা বইয়ের নাম ‘দিস ইজ নট এ ফটো অপর্চুনিটি’। বাংলা বাক্যে অর্থ দাঁড়ায়— ‘ছবির জন্য উপযুক্ত সময় নয়’। বইটি দুনিয়া কাঁপানো গ্রাফিতি শিল্পী ব্যাঙ্কসিকে নিয়ে। প্রশ্ন হচ্ছে, ব্যাঙ্কসি কে? একজন রহস্যময় চিত্রশিল্পী তিনি। যিনি অজ্ঞাতসারে উন্মুক্ত দেয়ালকে ক্যানভাস বানিয়েছেন। তাঁর মুক্ত হাতের শিল্পকর্ম নব্বইয়ের দশকে ইংল্যান্ডের সমাজ ও সংস্কৃতির জগতকে নাড়িয়ে তুলেছিল। ব্যাঙ্কসির শিল্পকর্মের ঢেউ দুনিয়ায় অন্য শহরেও লাগে। অজানা এক শিল্পীর দেয়াল সর্বসাধারণের শিল্পের ধারণাকে নতুন প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছিল। তাঁর চিত্রকর্মের গুরুতর শব্দ ‘হোয়াট’। বাংলা মানে ‘কি’ কিংবা ‘কী’! বাংলা ‘কি’ কিংবা ‘কী’ শব্দের অনেক মানে খাড়ায়! মানে ‘কিছু না’ অথবা ‘আবার কিছুই’। একদিকে অস্তিত্ব আর অন্যদিকে যেন এক অস্তিত্বহীনতার অস্তিত্ব¡! কথাটার উত্তর— বলা বা না বলার ‘ইচ্ছার স্বাধীনতা’। কেমন?

‘স্বাধীন ইচ্ছা’ আর ‘ইচ্ছার স্বাধীনতা’ কথাটা এক নয়। দার্শনিক জ্যঁ পল সার্ত্র ‘বিং এন্ড নাথিংনেস’ বা ‘আকার আর নিরাকার’ বইয়ে নানা অর্থ, নানা পরিস্থিতি, নানা স্থানাবস্থার কথা বলেছেন। সার্ত্রের ‘স্বাধীন ইচ্ছা’ মাত্রই ‘কি বলবেন’, ‘কেন বলবেন’, ‘কিভাবে বললেন’, ‘কখন বলবেন’, ‘কোথায় বলবেন’, ‘কোন দায়ে বলবেন’ নাকি ‘অ-দায়ে বলবেন’ নানা ভাবের উপর ভর করে আছে! আমরা সার্ত্রের ভাবকে ঘুরিয়ে বললাম, ‘ইচ্ছার স্বাধীনতা’! অস্তিত্বের জগতে মানুষ ‘স্বাধীন ইচ্ছা’র দাস। সার্ত্রের মতে, ‘স্বাধীনতার প্রথম শর্ত— করা’। তাহলে ‘না করা’ কী করা নয়? কেননা স্বাধীনতা তার অধিকার দিয়ে ইচ্ছাকে অধীন করে নেয়। কিন্তু মানুষের ‘ইচ্ছার স্বাধীনতা’ অধীনতাকে ভাঙতে চায়। সেই ভাঙতে চাওয়াই ব্যাঙ্কসির শিল্পাদর্শ! ব্যাঙ্কসি সরাসরি সংঘাতে যান না। তিনি প্রশ্নের ভেতর দিয়ে সংশয় সৃষ্টি করেন। যা রাষ্ট্র, আইন কাঠামো আর প্রচলিত পরিস্থিতিকে জিজ্ঞাসার মুখে খাড়া করায়! কিন্তু মার্টিন বুলের গল্প অন্যখানে? গল্পটা বলেছেন ‘দ্য আর্ট অব দ্য র‌্যাট’ ওর্ফে ‘ইঁদুর নিয়ে শিল্প’ অধ্যায়ে। মার্টিন বলেছেন, ‘ব্যাঙ্কসির শিল্পে ইঁদুর দৃশ্য ২৪ রকমের।’ তিনি ইঁদুরের ২৪ রকমের ভঙ্গিটাই আমলে নিয়েছেন। মানে একেক দেয়ালচিত্রে ইঁদুর একেক ভঙ্গি নিয়ে গতিশীল! তিনি তার কার্যকারণ আমলে নেন নাই! ফলে মার্টিন বুলের দেখা সার্ত্রেরই দেখা বলা যায়! ব্যাঙ্কসির শিল্পে লোহার তালা দরজার সামনে ইঁদুর যেন অস্তিত্বহীন এক প্রাণী। তালা কাটার দাঁত নাই তার। ভঙ্গি বিদ্রুপাত্মক। এই অক্ষমতা এক ধরনের অস্তিত্বহীনতাই বটে! নব্বইয়ের দশকে এমন অস্তিত্বহীনতার দশায় পড়েছিলাম আমরা ক’য় বন্ধু। সেটা কেমন?

 

১৯৯২ কি ৯৩ সালের গল্প। চাটগাঁ শহর থেকে বেশ দূরে সীতাকুণ্ড শহরে চিকা [দেয়াল লিখন] মারতে যাই আমরা। স্থানীয় ছাত্রনেতারা আমার চিকাসঙ্গী। হবে ৬/৭ জন। কিন্তু লিখতে লিখতে কখন গভীর রাত হয়ে গেছে টের পাইনি। সুনসান গভীর রাত। নির্জন এলাকা। ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রাঙ্ক রোডের এক যাত্রী ছাউনির দেয়ালে লিখতেছি— ‘এসো ভাঙ্গনকে ভাঙ্গি, সৃষ্টিকে গড়ি, সুন্দরের কানে কানে বলি— এ দ্রোহ আমার’। এমন সময় খুব দ্রুতগামী একটি ভ্যান আমাদের অতিক্রম করে কিছুদূর চলে গেল। খানিক দুরে গিয়ে ব্রেক কষল ভ্যানটি। ভ্যানটি ফিরে এসে আমাদের পেছনে দাঁড়াল। তারপর মারমুখি ভঙ্গিতে একদল পুলিশ আমাদের ঘিরে ধরল।
ওয়াকিটকি হাতে এক পুলিশ অফিসার জিজ্ঞেস করলেন:

এত রাতে কী করেন?
আমি বললাম, চিকা মারি!

অন্য বন্ধুরা ঠাঁয় দাড়িয়ে! আমার হাতের কৌটায় কালো জিঙ্ক অক্সাইট। এক কন্সটেবল সঙ্গে সঙ্গে আমার হাতের রঙের কৌটা কেঁড়ে নিলেন। কৌটা নেড়েচেড়ে বললেন:
‘কোঁনাই ছার, ছিকা! ইঁয়ানে তো ছিকা দেইয়ের না! ছার, হেতেরা মিছা কতা কয়!’আমাদের একদিকে পুলিশি ভয়, আর অন্যদিকে ভদ্র পুলিশকর্মীর কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠলাম। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ কর্তাও হেসে উঠলেন। আমাদের যৌথ হাসিতে মারমুখি পরিস্থিতি স্বাভাবিক আর রসাত্মক হয়ে ওঠে। হাসি যেন এক নির্মল আনন্দ আর রসিকতায় পর্যবসিত হলো। হাসিটাই সেদিন আ

 

মাদের প্রতি পুলিশের সহানুভূতি এনে দিয়েছিল। আর ‘অনস্তিত্ব চিকা’ বা ‘ইঁদুরহীনতা’ অন্য অস্তিত্বকে জানান দিয়ে গেল। ঘটনাক্রমে পুলিশ কর্মকর্তা যা বোঝার তা বুঝে নিলেন। কর্মকর্তা পরে খানিক নৈতিক ও রাজনৈতিক জ্ঞান দিলেন। তারপর চলে গেলেন। আমরাও মনে মনে পুলিশকে ধন্যবাদ জানালাম। তাহলে কি জ্যঁ পল সার্ত্রের ভাষায় আমরা বলতে পারতাম— স্থান, কাল, পাত্র সাপেক্ষে ‘চিকা’ বা ‘ইঁদুর’

 নিরাকার জিনিস? নিরাকার ইঁদুরই তো এখানে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ভাষা। এই তো অনুপস্থিতির ভাষা! মানে যা নাই, তা চাওয়াই তো অধিকারের ভাষা! বলবার, করবার আর মুক্তির স্বাধীনতা। কে

 

ননা মুক্তি মানে ‘ইচ্ছার স্বাধীনতা’। আর ‘স্বাধীন ইচ্ছা’ তার বৈকুণ্ঠ মাত্র। ফলে আমাদের ‘চিকা’ আর ব্যাঙ্কসির ‘ইঁদুর’ দুই অস্তিত্বের সমার্থক হয়ে আছে। তা নয় তো কি?

 

 

আধুনিক জীবন নিরর্থক!

গ্রাফিতির ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, প্রাচীন রোমান, গ্রিক আর মিশরে তার বিকাশ। পাথর খোদাই এইসব শিল্পকর্ম গ্রাফিতিরূপে বিবেচিত হতো না। প্রথমত জ্ঞানগত ধারণা, দ্বিতীয়ত টেকনিকের কারণে। জ্ঞানগত ধারণায়, রোমান সভ্যতাই গ্রাফিতিকে শিল্প আকারে চিহ্নিত করেছে। ইতালিয়ান শব্দ গ্রাফিতি মানে রেখার পরিমিত শিল্প। প্রাচীন টেকনিক ছিল পাথর খোদাই। স্মৃতি আর ভাববস্তুর কল্পনাই তার সার। কিন্তু ইউরোপে শিল্প বিপ্লব আর রাষ্ট্রের খবরদারির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক স্লোগানের মধ্যে ইমেজ বা চিত্র সেঁটে দেয়ার সংস্কৃতির শুরু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর। গ্রাফিতির টেকনিকও বদলায়। ১৮ শ’ শতকে ম্যাক্স বিয়েরহেম আর আব্রে ভিনসেন্ট বিয়ার্দস্লি গ্রাফিতিকে ভিন্ন রূপে রূপান্তর করেন। ফিগার বা অবয়বকে ভেঙেচুড়ে কাঠামোগত বদল ঘটান। ক্যারিকেচার বা বিকৃতি ধরনের ফিগার বা অবয়ব বাস্তবতা নস্যাৎ করে। মানে এই বাস্তব আমার না। চিত্রকর্মের উপাদানে যোগ হয় ‘কয়লা’ আর ‘চক’। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, রাজনৈতিক আদর্শ আর সাংস্কৃতিক আকাঙ্ক্ষা একসূত্রে গেঁথে গেছে গ্রাফিতিতে। সামাজিক দিক থেকেও এক হয়ে গেছে। এই রূপান্তর ঘটে খোদ এশিয়ায়। ১৯২০ সালে চীন বিপ্লবের নায়ক মাও জে দঙের দল বিপ্লবী স্লোগান আর সম্পূরক চিত্র আঁকা শুরু করেন। ধারণা করা হয়, মাও জে দঙের হাতেই গ্রাফিতির বিস্তার ঘটে এশিয়ায়। মাওয়ের সেই বিপ্লবাকাঙ্ক্ষা একদিন চীন বিপ্লবে সূচিত হয়।
নানা সময়ে শিল্পের এই রূপান্তর গ্রাফিতিকে অন্য টেকনিকে নিয়ে আসে। আধুনিক এই রূপান্তরের কারণ— শিল্পের উপকরণ আর কৌশল। প্রথমত দেখা যাবে, আদি যুগ থেকে আধুনিক কাল নাগাদ গ্রাফিতির ক্যানভাসই খোলা দেয়াল। কিন্তু আধুনিক যুগে কয়লা আর চকের বদলে ব্যবহার হয় ‘কালার স্প্রে’ আর ‘পেনসিল’। কারণ একটা ফ্রেমের মধ্যেই দ্রুতই শিল্পকর্মটি সহজভাবে করা সম্ভব। অন্তত নিরাপত্তাজনিত ঝামেলা এড়ানোর জন্য এটা জনপ্রিয় উপাদান হয়ে ওঠে। আর তারপর বৈচিত্র রঙের বদলের সঙ্গে পশ্চিমা দুনিয়ায় এটা পপ আর্টের সঙ্গে মিশে গেছে। পপ আর্ট গ্রাফিতি নয়, কিন্তু কৃৎকৌশল গ্রাফিতি দিয়েই প্রভাবিত। আরেকটি কারণ খুব অল্প সময়েই এই শিল্পকর্ম নির্মাণ করা যায়। প্রশ্ন হচ্ছে, গ্রাফিতির রাজনৈতিক সংস্কৃতি কী?

ধারণা নয়, এটা সত্যি— ব্যাঙ্কসির শিল্পের প্রভাব আমাদের সমাজের উপর পড়েছে। খোদ রাজধানীর নানা মুক্ত দেয়ালে সেই গ্রাফিতির আদলে চিত্রকর্ম দেখা যায়। কে বা কারা এই গ্রাফিতি করেছেন সেটা রহস্যজনক। অজানা বলেই রহস্য থেকে গেল! কিন্তু ব্যাঙ্কসির ‘WHAT’ শব্দের আদলেই ‘HOBEKI’ শব্দ লেখা। লেখার ধরনে মিল থাকলেও ব্যাঙ্কসির সঙ্গে এটার রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ভিন্ন। কারণ ‘হোয়াট’ বা ‘কি’ আর ‘হবেকি’ অর্থগত সদর্থক নয়। ‘কি’ সাংস্কৃতিকভাবে ধনাত্মক ভাব ধারণ করলেও ‘হবেকি’ ঋণাত্মক ভাবই ধারণ করে আছে। ধনাত্মকভাবেই ‘কি’ সময়, স্থান, বস্তু সাপেক্ষে অর্থ নির্দিষ্টবাচক। আর ঋণাত্মক ‘হবেকি’ সময়, স্থান, বস্তু সাপেক্ষে সংশয়বাচক। ‘হবেকি’ অর্থগতভাবে অজানা এক শংকার কথা মনে করিয়ে দেয়। উপায়হীন সমাজ আর রাষ্ট্রের এক বিদ্রুপাত্মক পরিস্থিতি! সময় আর মানুষ অনেকটাই অকূল পাথারে ভাসার মতনই! ধনাত্মক কিংবা ঋণাত্মক যেভাবেই দেখা হোক না কেন— ব্যাঙ্কসির গ্রাফিতির প্রভাব এতে জায়মান। সেটা কেমন?

মার্টিন বুলের বইয়ের একটি অধ্যায়ের নাম ‘মর্ডান লাইফ ইজ রাবিশ’। যার বাংলায় করলে দাঁড়ায়, ‘আধুনিক জীবন নিরর্থক’। আধুনিক জীবন নিরর্থক বা সদর্থক কিনা সেটা তর্ক সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে ব্যাঙ্কসির এক গ্রাফিতিতে দেখা যায়— বিমূর্ত অবয়বের এক মানুষ স্ট্রলারে করে কিছু পণ্য নিয়ে যাচ্ছে। বিমূর্ত অবয়বের এবড়োথেবরো মানুষটি পণ্য হাতে সামনের দিকে এগুচ্ছে। আধুনিক সমাজ বা রাষ্ট্রব্যবস্থার দিক থেকে এটা ঠিকই আছে— পুঁজিবাদ মাত্রই পণ্য সংস্কৃতির যুগ। পুঁজিবাদ সবকিছুকেই বাজারে তোলে। পণ্য বানিয়ে বেচে দেয়। ব্যক্তিক মুনাফার বিকাশই তার লক্ষ। যার পেছনে আছে শোষণ। লক্ষ মানুষের মুক্তি নয়! মোদ্দা কথা— আধুনিক যুগে মানুষ পণ্য খায় আর পণ্য হাগে! ব্যক্তিকেন্দ্রিক মুনাফার বিকাশের যুগে অবক্ষয়ই যে মূখ্য এটাই প্রমাণ। মানে জনগণ মাত্রই ভোক্তা, মুনাফার অংশীদারিত্বে তাদের অধিকার নাই। ফলে অধিকার এখানে নতুন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

 

 

সময় এখন পক্ষে না!

‘পাগলামী করিসনে বন্ধু সুধাংশু

সময় যে পার হয়ে যাচ্ছে
এবার তোর পালাবার বেলা
জিদ করিসনে বন্ধু; এখনি তুই পালা
জানি তুই কি ভাবছিস বন্ধু সুধাংশু’

— শামসুর রাহমান

ধারণা করা হয়— কবি শামসুর রাহমানের কবিতা ‘পাগলামী করিসনে বন্ধু, সুধাংশু’ থেকে ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, সময় এখন পক্ষে না’ গ্রাফিতির স্লোগানের জন্ম। আবার এটাকে কেউ কেউ বলছেন ‘পলায়নবাদী সংস্কৃতি’। পালানোর দিক থেকে হয়তো পরিস্থিতি বাস্তব বাস্তব লাগে! কিন্তু কবিতা আর গ্রাফিতির স্লোগানে ফারাক বিশেষ্য আর বিশেষণে। ‘বন্ধু সুধাংশু’ নিছকই বিশেষ্য মাত্র। আর অর্থগত দিক থেকে ‘সুবোধ’ বিশেষ্য আর বিশেষণ দুই ধারণ করে আছে। মানে ‘সুবোধ’ নিছক ব্যক্তি নয়, ব্যক্তি অতিক্রান্ত ‘শুভবুদ্ধির ফলক’। ফলে কথাটা অনেকাংশে খাটে না। শামসুর রাহমানের বন্ধু সুধাংশু বাস্তব দশায় পর্যবসিত হয়ে পালানোতেই শেষ হয়! ‘হবেকি’ গ্রাফিতিতে পালানোতেই শেষ হয় না। চিত্রকর্মের সঙ্গে স্লোগানের সম্পর্ক নানা পরিস্থিতির বাস্তব দশা ভেতর দিয়ে সুবোধকে যেতে হয়। সেটা কেমন? ‘হবেকি’ গ্রাফিতির ক’খানি স্লোগান আমলে নেয়া যাক:


সুবোধ তুই পালিয়ে যা
সময় এখন পক্ষে না


সুবোধ তুই পালিয়ে যা
সময় এখন পক্ষে না
মানুষ ভালবাসতে ভুলে গেছে


সুবোধ তুই পালিয়ে যা
তোর ভাগ্যে কিছু নাই


সুবোধ তুই পালিয়ে যা
ভুলেও ফিরে আসিস না


সুবোধ এখন জেলে
পাপ বোধ নিশ্চিন্তে করছে বাস মানুষের হৃদয়ে


হবেকির অভিশাপ বলছে তোকে
সুবোধ তুই পালিয়ে যা
ভুলেও ফিরে আসিস না

স্লোগানগুলো আপাত নিয়তিবাদী মনে হতে পারে। কারণ ‘পালানো’, ‘পাপবোধ’, ‘ভাগ্য’ ভাবার্থের দিক থেকে নিয়তিবাদীই। দর্শনের জগতে নিয়তিবাদের কুঠুরি— সন্দেহ থেকে প্রশ্নের জন্ম দেয়া। প্রথমত সন্দেহ শুরু হয়— কেনো সুবোধ পালিয়ে যাবে? কি এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে সুবোধকে পালাতে হবে? কেন সময় সুবোধের পক্ষে নয়? স্লোগানেই তার উত্তর আছে— সময় এখন পক্ষে না। কারণ— মানুষ ভালবাসতে ভুলে গেছে! বস্তুত আধুনিক সমাজে ‘ভালবাসা ভুলে যাওয়া’টাই ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতা। এই বিচ্ছিন্নতা ভাঙতে গেলেই, যা হয়— সুবোধ এখন জেলে! মনে হতে পারে স্লোগানের কথামালায় খানিক চ্যূতি আছে। আর খানিক আছে বিচ্যূতি। মজার ব্যাপার হলো— বাঙ্কসির চিত্রকর্মে অবয়বের যেমন প্রভাব আছে, ঠিক তেমনি তার স্লোগানেরই ভাবগত প্রভাব আছে ‘হবেকি’ গ্রাফিতিতে! যেমন— ‘কিপ ইট’ — সোসাইটি’, ‘টেক দিজ— সোসাইটি’, ‘নো ফিউচার’ ইত্যাদি!

কিন্তু ‘হবেকি’র চিত্রের সঙ্গে স্লোগান মিলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে— বিমূর্ত এক অবয়বের ব্যক্তি খাঁচাবন্দী সূর্য নিয়ে পেছন দিকে পালাচ্ছে। এখানে ‘সুবোধ’ শব্দের রূপক ‘সূর্য’। মানে সুবোধ একা যায় না। সঙ্গে সূর্যের রূপটাও নিয়ে যায়। আলোটাই নিয়ে যায়। অন্ধকার ফেলে যায় কিংবা গ্রাস করে! তাহলে আলো কী মুক্তি? তবে সংশয়ের শুরু হয় এখানেই— ‘সুবোধ এখন জেলে’ স্লোগানে! কারণ শেষনাগাদ সুবোধ পালাতে পারেন নি! ‘হবেকি’ গ্রাফিতির এহেন চিত্রকলার ফর্মের ভেতর একজন লোক খাঁচাবন্দী। কয়েদির পোশাক পরা। এখানে একটা জিনিস স্পষ্ট— মানুষের পাপ বা অন্যায় থেকে জেলের জন্ম! কিন্তু কাউকে অন্যায়ভাবে জেলে ঢোকানোও অন্য এক পাপ। এই পাপের জনক রাষ্ট্র, নয় তো কি? কিন্তু গ্রাফিতির সৌন্দর্য অন্যখানে। অর্থহীন এক দেয়ালকে অর্থপূর্ণ করে তোলা। যা শিল্পভাষ্যের ভেতর দিয়ে রাজনৈতিক ভাষা সৃষ্টি করে।

 

ভাঙার রাজনীতি, কিন্তু কোথায়?

চিকা বা দেয়াল লিখনকে স্থির প্রচারপত্র হিসেবে ধরা হয়। কেননা মানুষ নড়বে, দেয়াল নড়বে না। ফলে গ্রাফিতি এমন রূপ স্থির! কিন্তু দেয়ালিকা বা চিকা কী শিল্প? কেউ কেউ বলবেন, না! কারণ হিসেবে দেখাচ্ছেন, গ্রাফিতির অর্থমূল্য নাই! কথাটায় ফাঁক আছে! আবার ফাঁকিও আছে। ফাঁকটা শ্রেণী বিভাজনে। আর ফাঁকিটা বাজার মূল্যে। শ্রেণী বিভাজন এই অর্থে— উচ্চকোটির শিল্প আর নিম্নতলার শিল্প। শিল্পের এই শ্রেণি-বিভাজন নতুন নয়। প্রশ্ন হলো— ভোক্তা আর বাজার মূল্যের নিক্তিতে শিল্পের এহেন শ্রেণি-বিভাজন এসেছে। কেননা ভোক্তার অর্থই তার রুচি নির্ধারণ করে দিয়েছে। পণ্য জগতের এটা প্রথাগত সংস্কৃতি। আর যেই শিল্প উচ্চকোটির জায়গা থেকে শ্রেণিচ্যুত হয়েছে, সেখানেই জনসাধারণ ‘নাই’ হয়ে গেছে। প্রশ্নটাই সেখানে। দেশে দেশে গ্রাফিতি আন্দোলন সেই দূরত্ব ঘুচিয়ে দিতে চেয়েছে। ফলে গ্রাফিতির আন্দোলন একসময় পণ্যের বিজ্ঞাপনে পর্যবসিত হয়েছে। কিন্তু বিষয় হচ্ছে— মানুষের রাজনৈতিক অধিকারের প্রশ্নে! সেটা কেমন?

ব্যাঙ্কসির গ্রাফিতির মানুষ সমাজবদ্ধ জীব— কথাটা হলফ করে বলা যায়। কিন্তু মানুষ শৃংখলাবদ্ধ জীব— একথা কী হলফ করে বলা যাবে? যুক্তির খাতিরে বলা সম্ভব— সমাজবদ্ধ বলে মানুষ শৃংখলাবদ্ধ। সমাজের কিছু শর্ত তাকে বদ্ধ রাখতে বাধ্য করে। মানে বাধ্য হয়ে মানুষকে সেই সেই শর্ত মানতে হয়। বলতে পারেন, শৃংখলাবদ্ধ না হলে মানুষ সমাজবদ্ধ জীব কথাটাই অমূলক। নিতান্তই সরল কথা বটে। শৃংখলাবদ্ধ হলে মানুষ সমাজবদ্ধ হবেই বা কেন? মূলত প্রকৃতিগত শর্ত তাকে সমাজবদ্ধ রেখেছে। কথাটা রাষ্ট্রীয় আইন-কাঠামোর বেলায় ঠিক আছে। তাতে কী মানুষের মুক্তি মিলবে? রাষ্ট্রের আইন-কাঠামোর যদি মানুষের অধিকার, স্বাধীনভাবে বাঁচবার, মানবিক মর্যাদা আর গণতান্ত্রিক সাম্য নিশ্চিত না করে সেখানে প্রশ্ন উঠবেই— মুক্তি কী? গ্রাফিতি আন্দোলনের প্রধান বিষয় রাষ্ট্র কিংবা সমাজের সংকট চিহ্নিত করা। প্রথাগত অচলায়তনকে ভাঙা। কিন্তু ভাঙবে কীভাবে? দর্শনের দিক থেকে বলা হয়— তুমি যদি আইন ভাঙতে পারো, তাহলে সমাজ রাষ্ট্রের যে কোন কিছুকেই বদলাতে পারো। আর গ্রাফিতি সবকিছু বদলাতে পারে আইন ভাঙার পর। উদাহরণ দিলে পরিষ্কার হবে— ব্রিটিশের আইন না ভাঙলে ভারত কখনো স্বাধীন হতো না। আর পকিস্তানি আইন না ভাঙলে আমরা ভাষার অধিকার পেতাম না। ফলে বলা যায়, গ্রাফিতিও খাঁচাবন্দী সূর্যকে মুক্ত করতে চায়। কিন্তু সেটা কতদূর?


তত্ত্বতালাশ:

  1. This is not a photo opportunity: The street art of Banksy, by Martin Bull, PM press, USA, 2015.
  2. Being and Nothingness, by Jean-Paul Sartre, translated by Hazel E. Barnes, Washington Square Press, 1984.

x

x

x

x

শেয়ার