নিজের কবিতা সম্পর্কে বলতে যাওয়া কমবেশি বিব্রতকর। বিশেষ করে যে লেখা প্রকাশিত হয়েছে তা নিয়ে কবি/লেখকের বলবার আর কি থাকে? ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, কবিতা বা সে যেকোন সাহিত্যকর্ম প্রকাশ্য হয়ে যাবার পর কবি/লেখক তার নিয়ন্ত্রন হারান। এ পর্যায়ে পাঠক তার নিয়ন্ত্রক> একান্ত ঈশ্বর। গ্রন্থ বেরিয়ে যাওয়ার পরে লেখক হিসেবে পাঠক থেকেই প্রত্যাশা করতে হয় তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। যেহেতু শর্ত মোতাবেক ‘শিরিষের ডালপালা’ ওয়েবম্যাগের ‘পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন’ বিভাগে কিছু লিখতেই হবে; তাই আমার সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘ভ্যান গঘের চশমা’ প্রসঙ্গ ধরে কিছু ব্যক্তিগত সাদামাটা যাপনের কথাই হোক।
‘ভ্যান গঘের চশমা’ প্রকাশ ধারাবাহিকতার দিক থেকে আমার অষ্টম কবিতাগ্রন্থ। এর পূর্বে ছোট-বড় মিলিয়ে ৭টি কবিতাগ্রন্থ বেরিয়ে গেছে। এবছর কলকাতা বইমেলায়ও বেরিয়েছে ‘হরপ্পা’ নামে একটি কবিতাগ্রন্থ।
রাজধানী থেকে ঢের দূর উত্তর জনপদের গ্রামীন এক রেলস্টেশন। সেখান থেকেও ১৫ কিলোমিটার দূরের একটি গ্রাম। ধানখেত আঞ্চলিক নদীনালা হাটবাজার আর পথের দু’পাশে কয়েকটি গ্রাম পেরিয়ে গিয়ে পৌঁছে যাওয়া যায় সোনাপাড়া। আমার ডেরায়। এখানে বসে লেখা ‘ভ্যান গঘের চশমা’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো। আমার প্রায় সমস্ত কবিতা সেখান বসেই লেখা। এখান থেকে পুলিশ স্টেশন সিভিল প্রশাসন এসবের দূরও ওই ১৫ কিলোমিটার। এই ১৫ কিলোমিটার যেন আমার কবিতার পথ। দুর্গম ও বিচ্ছিনতায় একটা বাইক একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম। সোনাপাড়ার চারপাশ, মাঠঘাট-মানুষ-প্রকৃতির দিকে যতবার দেখি; সবকিছুই কবিতা বলে মনে হয়। এখানে যেন সবকিছু কবিতা হয়েই আছে। কবি তার সংকলক মাত্র। ঋতু পরিবর্তন, মেঘ-বৃষ্টি-রোদ-বর্ষা এখানে এতো প্রকটভাবে তার অস্তিত্ব জানান দেয় ব্যক্তিসত্তা সেখানে চূর্ণ হতে বাধ্য। যখন শীতকাল এখানে হিম ঢেলে দেয় তখন কুয়াশার কুহক ডেকে নেয় দূর আলাস্কায়। পৃথিবীর উত্তরের চিরশীতাঞ্চল উত্তরমেরু আর এখানকার ভেদ রেখা মুছে যেতে থাকে। এতো প্রকট কবিতার আলো-বাতাসে কবির ঝুঁকিও থাকে তীব্র। যেমন- মৌমাছি সরাসরি একটি মধুভাণ্ড থেকে মধু সংগ্রহ করতে গেলে সেখানে মৌমাছির ডুবে মরারও ঝুঁকি অনেক। কবির ঝুঁকি যেখানে যতবেশি পাঠকের ত্রাতার ভূমিকা সেখানে ততটাই। পাঠক সহায় হোন।
ভ্যান গঘের চশমা পাণ্ডুলিপি থেকে কবিতা
কলোনির কেউ নই। হতে পারি এক ঝাপটা হাওয়া
ওপথে বেরিয়ে যেতে তোমাকে দেখেছি
হাওয়া থমকে গেলে কী ভ্যাপসা গরম; পরে বৃষ্টি নেমেছিল
বৃষ্টির দিনে সমস্ত পৃথিবী এক আমব্রেলা কলোনি
সবচেয়ে উজ্জ্বল ছাতাটি তোমার
জঙ্গলের পাশে বাড়ি। বাবা হারিয়ে গেছেন
ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে মায়ের মুখভারি সংসার
ড্রয়িং খাতায় পেন্সিলে ছবি আঁকে জঙ্গলের
এখনও স্কুলে না যাওয়া মেয়েটি
ইরেজার ঘষে ঘষে জঙ্গল ফিকে করে-
দেখে, সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরছেন বাবা
মাচা বেঁধে দিচ্ছি লাউগাছটির জন্যে
বউ পাশে দাঁড়িয়ে লাউগাছটির এলোচুলে খোঁপা করে দেয়
ছোট চারা গাছটিকে বউ খুব যত্ন করে যুবতী করেছে
বৌয়ের কথায় আমি ওর জন্য মাচা বেঁধে দিই
মাচা তো কেবল মাচা নয়, পালঙ্কও
এই পালঙ্কে যুবতী লাউগাছটির সঙ্গে বউ আমাকে ফুলশয্যা দেবে
সিলভিয়া প্লাথের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক এক ছাদের নিচে এলো
মাছ-আড়তের পাশে বাড়িভাড়া নিয়ে আছি
শস্তায় মাছ কিনি; সহজ আমিষ খাই
আশপাশে অনেক বরফকল। আমরা প্রস্তুত আছি
কখনও পচন এলে; শস্তা বরফ কিনে পচন ঠেকাব
দুপুরের বারান্দা হতে নেমে দেখি মেঘের ভেতর রেডিও স্টেশন; দুপুরটি গান হয়ে বাজে। পাড়ার গানের দলে গান হয়ে আমিও ছিলাম। ওরা গেছে বায়নার গান নিয়ে দূরের মেলায়
আমার কোথাও যাওয়া কেন যে হয় না !
অপেক্ষা দীঘিটির ঘাট হয়ে, কংক্রিট হয়ে পড়ে আছে
ঘাটে স্নানের পর রূপসী ফড়িং তার ডানা দুটো ফেলে গেছে, কুড়িয়ে নিয়ে আমি পকেটে রেখেছি
আমার ফড়িংজন্মে ডানা দুটো উড়বার কাজে লাগতে পারে
এক ফোঁটা ডেটল গন্ধে হাসপাতাল বাড়ি চলে আসে। বকের পাখায় উড়ে কাছে আসে এক ঝাঁক নার্স। তারপর আবিষ্কার করি, আমি শুয়ে আছি সাদা বিছানার সমুদ্র ঢেউয়ে। এবং ভাটির টানে ভেসে যাই; ফিরে আসি জোয়ারে তোমার
করিডোরে দীর্ঘ হেঁটে আসা বিড়ালটি; মনে হয় মৃত্যুদূত হবে! দেখি তাও তোমার উপস্থিতি টের পেয়ে পালিয়ে গিয়েছে
সমস্ত ছুটির দিন জিরাফের লম্বা গলা; ঘাস খেয়ে আসতে চায় স্যাভানার বনে। সে ক্ষেত্রে ভরসা চ্যানেল জিওগ্রাফি। স্কিন খুলে দেখি, হেলিকপ্টারে চড়ে আকাশের বাড়ি হতে একজন লাফ দেয় রোমাঞ্চ জাগাতে। আমার তাতেও কিছু রোমাঞ্চ হল
গভীর পর্যবেক্ষণে মনে হল; রিমোট বাটন টিপে পৃথিবী দেখা হস্তমৈথুন প্রায়
কাছের ধানখেত ছুটির দিনেও তুমি দূরের নেপচুন
অজস্র ঝরাপাতা! কোন কবি লেখার টেবিলে; লেখা না হওয়ায় পাতাগুলো ছুঁড়ে ফেলে গেছে। সমস্ত বছর ধরে কম বেশি পাতাগুলো ঝরে ফেলে গাছ
আমার উঠোন দেখে মনে হয় গাছদের রিসাইকেল বিন
অনেক ভাবনা, তার সামান্য লেখা আর সমস্ত লেখা থেকে দু’একটি তোলা থাকে টাইম লাইনে
ডেটল মেশানো হাওয়া; ক্ষতগুলো সেরে ওঠো। নিমডালে তেতুপাখি ডাক, গ্লাসে ভরে পান করি। দীগন্ত বিছানো এই ধানখেত, সোনাপাড়া গ্রাম তুমি সবুজ হাসপালাত
চিকিৎসা ও নার্সিং-এ সেরে তোল রুগ্ন কবিকে