পাঁচটি কবিতা | কুমার চক্রবর্তী


উজান


সংশয় আর বিশ্বাসভূমির মাঝ দিয়ে
একটি নদী বয়ে গেছে ঈশ্বরবেদনার দিকে—আদিগন্তহীন
সে নদীতে আমি একা নৌকা বাই, চলি
অনন্ত, উজানের দিকে:
একা, বৈঠাহীন


কবি


নামহীন কোনো কবি মরে গেলে
তার কবিতাগুলোর কী হয়?
কবিতাগুলো তখন
বই, খাতা আর পরম শূন্যতা থেকে উড়ে গিয়ে
জীবনপাতা হয়ে যায়, তাদের মৃত স্রষ্টাকে গান-স্যালুট জানায়
আর কোনো এক শীতের সায়ন্তনবেলায়
ওসে ভিজে ভারী হয়ে
তাঁর কবরের ওপর লুটিয়ে পড়ে যায়।


আমার জীবন


চাইনি হতে বাগানের ফুল,
চেয়েছি— আড়ালের সানুদেশে
ফুটে থাকতে,— একটি নিসর্গের ছলে, আপন খেলায়।
পথচারী হয়তো-বা নয়, হয়তো-বা কোনো অজানা পথিক
আসবে একদিন,
দেখবে আমায়, আপন আশ্চর্যবোধে— ফুটে আছে আনন্দলহরি
হারানোর বেদনায় কেঁপে ওঠে, আচ্ছন্ন শোভায়!
পর্যটক অবশেষে সুরভিতে ফিরে গিয়ে
চুম্বন করবে প্রেয়সীকে, অনন্ত-শুভেচ্ছায়—
সে-চুম্বনে আমি ফুটব প্রেমিকার ঠোঁটের মায়ায়!

আমার এ ফুলের জীবন—একান্ত আর অননুমেয়
আত্ম-আনন্দের দান, ফুটি চিরপাহাড়ের কোলে,
সময়ের আগেই ঝরে যাই আপন ছায়ায়, যেনবা
জীবন বোধে আত্মগত—স্পর্শ করে যায়,
দূরের আকাশ তাই আমার দিকেই চেয়ে থাকে—অনন্ত-ইশারায়।

আমি শুধু আপন খেয়ালে ফুটি, আর ঝরে যাই,
কোনো এক অজানার ছলে, কোনো মহাপ্রকৃতির ভুলের খেলায়!


সামুদ্রিক


তোমার চোখে এক চঞ্চল স্তব্ধতা
একটি নীল ছায়া নড়ে ওঠে, স্পর্শ করে অজানাকে।
ঝাউবনের দিকে হাওয়া আজ ফেলে রেখে গেছে ধ্বনির দুপুর
তারা ছুটে বেড়াচ্ছে—আর ভেঙে ফেলতে চাইছে ঋত বাসনাকুটির।
তোমার চোখের সমুদ্র বেয়ে চলে যায় এক বিষণ্ণ জাহাজ,
আকাশ ধরে রাখে তার ছবি, জীবনের শ্বাস।


আমি


আমি ঠিক আমি নই, অন্য কিছু
আমার ভিতরে কে যেন আছে যে নড়ে ওঠে, কাঁপায় আমাকে;
কে যেন আমাকে বলে, হে মর্ত্যমানব তুমি এই পৃথিবীর নও,
তুমি মহাজগতের, এসেছো আকাশের আশীর্বাদে এইদিকে
আর যাবেও চলে আকাশের ওইদিকে একদিন, বাতাসের পোশাক পরে।

আমার জীবনেও আছে শ্বাসাঘাত খেলা
পোলার নাইটে হঠাৎ জ্বলে ওঠা আলোয় আমি দেখি
পৃথিবীর হারিয়ে-যাওয়া পাখিগুলোকে,
আরও দেখি কিছু বিশ্বাসী বিড়াল, যারা একদিন ছপছপ করে
দুপুরে হেঁটে বেড়াত আমাদের বাগানবাড়ির পাতাছাওয়া জমিনে।
পৃথিবীর হারিয়ে যাওয়া সত্তাগুলো আমার ভিতরে ভর করে,
তারা বলে, তুমি তো বিশ্বাসী, অনুসরণ করো ঈশ্বরের গলিপথ,
আমি দোমনা হয়ে রই!
আমি আমি নই, আমার ভিতরে রয়েছে অন্য কেউ, অন্য কিছু:
কোনো জিন বা দিয়ামোন, বা এক ব্রহ্মদৈত্য, যে আমাকে নাড়ায়,
ফেলে রাখে ফেনোমেনোলজি অব স্পিরিটের অনিঃশ্বেষ খেলায়।
অপদেবতা স্তোত্র আওড়ায়,
বলে, তুমি তো অবিশ্বাসী, অস্তিত্বভাবনার অবকাশে
তুমি নিজেকে খোঁজ করো, আর তুলে নাও মহাকালের মুদ্রা,
ছিটিয়ে দাও তোমারই দেহের গহ্বরে।

আমি আসলে আমি নই, আমি আসলে অসংখ্য,
এক ইনফিনিট অ্যালগরিদম,
যা সরল হতে হতে কঠিন হয়ে যায়, আবার কঠিন হতে হতে
উন্মুক্ত করে জগতের মহাশূন্যতাকে
যাকে আমরা বলি প্রজ্ঞাপারমিতা:
শূন্যতা শূন্য নয়, অশূন্যও নয়,
তাহলো, অন্যকে নিয়ে পূর্ণ হওয়ার এক জীবন-জীবন খেলা।


কুমার চক্রবর্তী

কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক কুমার চক্রবর্তীর জন্ম ২ চৈত্র ১৩৭১ বঙ্গাব্দে, কুমিল্লায়। প্রধান পরিচয়ে কবি হলেও প্রবন্ধ ও মননশীল গদ্যে তিনি সিদ্ধহস্ত। বরং তাঁর গদ্যের শক্তি কবিপরিচয়কেও যেন ছাপিয়ে উঠতে চায়। কুমার চক্রবর্তীর কাব্যগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘লগপুস্তকের পাতা’, আয়না ও প্রতিবিম্ব’, সমুদ্র, বিষণ্ণতা ও অলীক বাতিঘর’, ‘পাখিদের নির্মিত সাঁকো’, ‘হারানো ফোনোগ্রাফের গান’, ‘তবে এসো, হে হাওয়া হে হর্ষনাদ’, এবং অবশ্যই কবিতাসংগ্রহ। প্রবন্ধ ও গদ্যগ্রন্থের মধ্যে বিশেষভাবে বলা যায় ‘আত্মধ্বনি’, ‘উৎসব: দেহ প্রেম কাম’, ‘পথিকমন’, ‘কবিতার অন্ধনন্দন’, ‘ঈশ্বর বিষয়ক বিপ্রতীপ চিন্তা’, ‘মাত্রামানব ও ইচ্ছামৃত্যুর কথকতা’ এবং ‘অস্তিত্ব ও আত্মহত্যা’র কথা। কুমার চক্রবর্তীর অনুবাদে প্রকাশিত হয়েছে ‘আমি শূন্য নই, আমি উন্মুক্ত: ট্রোমাস ট্রান্সট্রোমারের নির্বাচিত কবিতা’, ‘বৃক্ষের মতোই তুমি ফেলেছিলে নিশ্বাস: জর্জ সেফেরিসের কবিতা, সাক্ষাৎকার ও প্রবন্ধ’, এবং ‘বিশাল প্রশান্তি, প্রশ্ন আর উত্তরেরা: ইয়েহুদা আমিহাইয়ের নির্বাচিত কবিতা’।

শেয়ার