পাঁচটি কবিতা | কবির কল্লোল


চাবি


কোমরে চাবির তোড়া ঝুলছে। এদিক-ওদিক দুলছে

সম্রাটের মতো তুমি পায়চারি করছো
            এদিক
                    থেকে
                            ওদিক
হে কারারক্ষী, সূত্রমতে তুমিও একটা চাবি
ঝুলে আছো অন্য কারো কোমরে
            এদিক
                    থেকে
                            ওদিক
নিজেকে ঝুলতে দেখে কষ্ট পেও না।

তুমি যার কোমরে ঝুলে আছো তাকে, এবং
তার মতো অসংখ্য চাবিকে রিঙে ঝুলিয়ে
আঙুল ঘুরাচ্ছে যে বিচারক, আদতে সেও একটা চাবি।


ফুহ


শূন্যতা হেঁটে গেলো নদীতীর দিয়ে
আমি তারে দেখিলাম, ইয়ে মানে ইয়ে
দেখি নাই, মানে হলো—দেখার মতোই
হাঁসগুলো চ’লে গেলো, চই চই চই
ডাক ভেসে আসছিল গাছতলা থেকে
সেইদিকে তাকালাম, পদছাপ এঁকে
হাঁসগুলো চ’লে গেলো, ধানক্ষেত কাঁপে
এই সেই ধানক্ষেত—সখিনার বাপে
জ্বীনের রাজার সাথে লড়েছিল শুনি
লড়াই দেখেনি কেউ তবু তাকে গুনী
মান্যি করেছে সাত গেরামের লোক
পরাজিত জ্বীন ছিল চলার বাহক
চলতে চলতে হাঁস প্যাঁক প্যাঁক ডাকে
শূন্যতা নিরাবেগ হেঁটে যেতে থাকে
আমি তারে দেখিলাম, আল্লার কিরে—
যেতে যেতে বারবার চাইছিল ফিরে
হাঁসগুলো চ’লে গেলো, চই চই চই
ডাকছিল কার বউ? তাকালাম, কই?
কেউ নেই, পা’র তলা ভেজে পেচ্ছাপে
হাঁস চ’লে গেলো তবু ধানক্ষেত কাঁপে
একটা মানুষ নেই, নেই পশুপাখি
সুনশান নদীতীরে হঠাৎ জোনাকি!
ঘাড়ের পিছন থেকে যেন আচানক
সজোরে খামচি দিলো বাতাসের নখ
প’ড়ে যেতে গিয়ে শেষ যখন তাকাই
এ আমি কী দেখিলাম অমাবস্যায়!
বিশ্বাস করো আর নাই করো, শোনো
আসমানে থাকে যিনি নাই তার কোনো
শরীক, তাহার নামে নিলাম শপথ
যা দেখেছি তাই যদি ঘটে আলবত—
অনাগত শিশু আর অনূর্ধ্ব পাঁচ;
সাক্ষী হাঁসের পাল—সাক্ষী এই গাছ,
কী ক’রে যে মুখে আনি, কী যে ভয়ানক!
তেরো মাসে সওয়া যায় আড়াইশ শোক?
দেড় বাই দুই ফুট সফেদ রুমাল
পরিবারে মাথাপিছু তিন মণ চাল
হাঁস ছিল তেরোখানা, দুইটা মোরগ
মানুষের নয়, এ যে গেরামের রোগ
সাক্ষী হাঁসের পাল—সাক্ষী এই গাছ
নদীতীরে গিয়ে দেখো ভাসে মরা মাছ
পাকঘরে কেন লাগে প্রায়শই আগুন?
কলপাড়ে পা পিছলে ঝ’রে যায় ভ্রূণ
মানুষের নয়, এ যে গেরামের রোগ
তেরো মাসে সওয়া যায় আড়াইশ শোক?
আমি তারে দেখিলাম, হাজার শুকুর
পশ্চিমে মেঘ ছিল—অবিকল তুর
পাহাড়ের মতো, তার ডগায় ডগায়
শূন্যতা মিশে গেলো, কী যে চমকায়!
হাঁসগুলো চ’লে গেলো, একটা মানুষ
পেলাম না, আমি পড়ি দোয়া ইউনুস
প’ড়ে যেতে গিয়ে শেষ যখন তাকাই
এ আমি কী দেখিলাম অমাবস্যায়!
বালা মুসিবত সব ফসলে ছড়িয়ে
শূন্যতা হেঁটে গেলো নদীতীর দিয়ে।
তেরোখানা হাঁস আর তিন মণ চাল
জমা রেখে যেতে হবে সফেদ রুমাল
মনে করো আমি তোমাদের কাছে নূহ্
মাথাপিছু একগ্লাস পানি পড়া—ফুহ্


আবর্তন


সন্ধ্যা নামলে— সূর্যটাকে আমেরিকান ব’লে সন্দেহ করি

যখন ভোর ফোটে— সন্দেহ বাড়ে, সারারাত
সমগ্র পশ্চিম ঘুরে ঘুরে সে নিশ্চয় সঙ্গে এনেছে
                                 অতিবেগুনী উপনিবেশবাদ!

সন্ধ্যায়— আমাদের সংস্কৃতি নিয়ে চ’লে যায়
ভোরে— ওদের কালচার নিয়ে ফেরে যেন

যেন সূর্যটাও বিক্রি হয়ে গেল—এই দ্বন্দ্ব
মাথায় নিয়ে ঘুরি। তুমি প্রশ্ন করো—
                             ‘পূর্ণিমায় ছাদে আসো না কেন?’

– সূর্য আমেরিকায়। জ্যোৎস্নায় শেতাঙ্গ শেতাঙ্গ গন্ধ।


ঋতুর রচনাবলি ০৫


কলি তো কতিই পারি, কয়ে দিলি থাকপে তোর মুক,
পতিরাত্তি ক্যানো বাড়ে চৌকির পায়ার অসুক?
ওরে পাগলা, শীতি কাঁপে, এ্যাকন কি সে বয়েস আচে?
পইষ নেই, মাগ নেই, কিষকেরা ভোরবেলা চাষে
নিয়েরে পিচ্চুল থাকে রাস্তাঘাট, জমিনির আইল।
তালি কি কচ্চাও তুমি শুদু শীতি কাঁপচিলে কাইল?
খুব কিন্তুক পেকে যাচ্চিস, রস পড়ছে খাজুরির মতো
ঢেকেঢুকে না রাকলি পুকামাকড় মুক দ্যায় কতো,
ইডাই বয়েস বুজলি? তোগের তো আগুন লাগে না?
এ্যাতো যে বিচুলি পুড়াই তবু শালা জাড় তো ভাগে না।

ইরকম কতা হয়, নানাবিধ খুনসুড়ি চলে
দাদাতে নাতীতি আর শুকনো খড়েতে আগুন জ্বলে
কিন্তুক পোকিতো আগুন দেকতি কি পায় কোনো লোকে?
দেকেও দ্যাকে না য্যানো সদ্য কোনো বিধবার চোকে
বয়েস কাঁচাই কিন্তুক কোলে তার এ বাড়ির ছেলে
কুয়াশার ছদ্ম নিয়ে সুমাজ এ্যাক জাল ধরে মেলে
একুড়ে কইতর য্যানো, ঝিম মেরে বসে থাকে কুনাই
যতই পুড়ুক তবে সুনা কিন্তুক রয়ে যাবে সুনাই
ঢেঁকি পাড় দিতি দিতি শুরু হবে শীতকালের ভোর
জসিম ভাগায়ে নিয়ে চলে যাবে ফন্টুর বৌর

ত্যাওড়া পুড়ায়ে খাবে ছোট ছোট ছেলেপিলেগুলো
কুল খাবে পুয়াতিরা, ঘরে ঘরে রান্না হবে মুলো
পিটেমাটা গড়া হবে, নলেন গুড়ির সাতে মুড়ি
বউ দেকে দাদি কবে, এ্যা মা এ তো কালকের ছুড়ি
এ্যাক বাড়ি বিয়ে হলি পুরো পাড়া নেচে ওটে তালে
সকাল না হতি হতি সন্দি নামে, চিড়িকপাতালে
ছ্যামড়াগের মতো য্যানো শীতকেলে বেলার সুভাব
গমখেতে সাপে কেটে মরে যাবে ডবলু’র বাপ
মিলাদে খিচুড়ি হবে, রান্না করবে সুবাস বাউল
হাওয়ার ফুকোটি এসে শরীলি বসাবে ঠান্ডা হুল

লেপেও কুলোয় না তাই শোসশের তেল ডোলে গায়
এর ওর গার সাতে চিপকেচুপকে থাকা খুব চাই
মুক দিয়ে ধুমা আসে, দাঁতে দাঁত ঠনঠন করে
এইর‍্যাম শীতিও জ্বলে হেরিকেন কারু কারু ঘরে
হঠাত আদ্দেক রাতি টিউকলে চাপ দ্যায় কিডা?
মুরুব্বিরা বুজলিও পুলাপান বুঝবি না সিডা।
পুরোনো তালার ঘাটে আটকে গেলি জং ধরা চাবি
সারা পাড়া রটে যায়, মুচকি হেসে চোক টেপে ভাবী
শীতির এমন লীলা, গরম গরম খাতি সুক
কলি তো কওয়াই যায়, আরও কলি থাকপে না মুক।


জাল


মাকড়শার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে একটি টিকটিকি
টিকটিকিকে লক্ষ্য ক’রে নেমে আসছে একটি শকুন
শকুনের বুকে নিশানা পরীক্ষা করছে একজন ধনুর্বিদ
পিছনেই ঘাপটি মেরে ব’সে আছে রক্তখেকো চিতা
চিতাটির পা একজোড়া সাপের গর্তে, ফণা তুলেছে সাপ
একদল বেজি এগিয়ে আসছে সর্পফণা লক্ষ্য ক’রে
বেজিদল লক্ষ্য ক’রে নেমে আসছে একটি ঈগল
ধনুর্বিদ দ্বিধান্বিত, নিশানা সে ঘুরিয়েছে ঈগলের বুকে
পিছনেই ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়েছে আরেকজন মানুষ
মানুষের মাথায় নিশানা লাগিয়েছে আরেকজন মানুষ
তার পিঠ থেকে কয়েকটি মশাকে রক্ত চুষতে দেখে
মাকড়শাটি বুনে যাচ্ছে জাল। পেছনে টিকটিকি…


 কবির কল্লোল

জন্ম ১০ মার্চ ১৯৯০, শার্শা, যশোর। পড়াশোনা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (অর্থনীতি বিভাগ)
2k3lecorhyme@gmail.com

প্রকাশিত গ্রন্থ

কবিতা

আমিও ঈশ্বরের মতো একা (২০১৬)
সন্দেহ হবে না কেন (২০২২)
আয়নাটা বুড়ো হয়ে যাচ্ছে (২০২৩)

শেয়ার