আমি
ফুল হতে বাতাসে মিশে যাচ্ছে যে রেণু,
এ তার মতই- অলক্ষণীয়;
কিন্তু নয় গন্তব্যহীন,
নিদারুণ ধূ ধূ একাকীত্বই এর রহস্য;
‘নাই’ হওয়াটাই তার অবিনাশের পথ।
কে বলে, এর নামে বাজি ধরো না!
পরাগ রেনু, যে উড়ে যায়
দলছুট ঘোড়ার কেশরের বাতাসের টানে;
তার নামেই শুরু হোক যত বাজির দান!
ঝা ঝা রোদ্দুরে বিষণ্ণ বুলফাইট
ফুর্তিবাজ স্পেনীয় তরুণ
তুমি জানলে না কতটা বিষণ্ণ
দুপুরের এই ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুর।
ঝরনা তলায় যেখানে মারমা মেয়ে
ভরছে কলস
সেখানে পাহাড়ের সবুজ মায়ায়
পাখির গানের দিকে তাক করা
সিপাহীর নল;
হ্রদের নীল জলে বাঁকা হয়ে
ফুটে আছে যে রংধনু
তারও মালিকানায় রয়েছে বিরোধ।
বেপথু বাতাস শুধু ব্যারিকেড বোঝে না
আঁরাকের ঝোঁক ছাড়াই
নলের ফাঁক গলে উঁকি দেয়
তোমার জানালায়।
অভিমান নিও না যুবক
কানে কানে একবার
তোমাদের বুলফাইটের ষাঁড়টিকে
জিজ্ঞেস করে দেখো
অনর্থ বিরোধ বাধিয়ে
রাজারা কেমন আনন্দ পায়।
আমাদের হিয়ার ভেতর আমরা যখন গান হয়ে যাই
আমরা খরচ হয়ে যাচ্ছি রোজ;
হিসেবের খাতায় ভাংতি পয়সার মতন
সেই খরচ তুলতে ভুলে যাচ্ছেন গিন্নি মা।
জীবন-জীবন করে আমরা ছুটছি
আর জীবন আমাদের নাম ধরে
ডাকতে-ডাকতে ছুটছে আমাদেরই পিছু।
আমরা একটা সার্কেলে ঘুরছি
এই ঘূর্ণনে কোনো বিরতি-বিন্দু নেই;
দৌড়ের নিয়মে চলতে থাকলে এইখানে
কোনোদিন আমাদের হবে না দেখা।
তবে, কেউ-কেউ দেখা পেয়ে যায়;
তারা নিয়ম ভাঙে
তারা দৌড় থামিয়ে দেয়;
তাদের দেখে লুথা মনে হতে পারে
তাদের দেখে বোকা মনে হতে পারে
তাদের দেখে ঋষি মনে হতে পারে
তাদের দেখে মনে হতে পারে
ফুটো পকেট গলে পড়ে যাওয়া ভাংতি পয়সা;
কিন্তু তারা জীবনের দেখা পায়
চলতে-চলতে জীবন এসে একদিন
হুমড়ি খেয়ে পড়ে তাদের বুকের উপর
সেদিন তাদের দেখা হয়ে যায়;
দৌড় থেমে গেলে।
আমিও অপেক্ষায় আছি
একদিন আমাদের দেখা হয়ে যাবে;
জীবন মিলিয়ে দেবে
তোমাকে ও আমাকে ঠিক;
সেদিন ভাদ্র মাসের রোদ্দুরে
ভরদুপুরে ঘামতে-ঘামতে হাসতে-হাসতে
দূর গাঁয়ের মেঠো পথে আমরা
বাঁশঝাড়ের নিচে এসে জিরোব;
বাঁশপাতার শন শন শব্দে
আমার শরীরে জাগবে শিহরণ;
তাই দেখে তুমি বুজবে চোখ,
শুনবে শনশন শব্দের ভেতর
কেমন গান বয়ে যায়।
এমন দিন আমাদের সত্যিই আসবে;
এমন প্রেমের দিন না এলে
আমরা মরব না;
পৃথিবীতে কেউ মরে না
প্রেমের দিন না দেখে;
বাস্তবে না হোক,
অন্তত কল্পনায়
বেঢপ দেখতে
ভুঁড়িওয়ালা
কুৎসিত যুবকটির ঠোঁটেও
ভালোবেসে চুমু খায় এক পরী;
আর চিরজন্ম দুঃখে থাকা
ডানা খসে যাওয়া পরীটিও
কল্পনায় একদিন
ডানা খুঁজে পেয়ে দেয় উড়াল;
উড়াল রচিত না হলে
মৃত্যুর শর্ত হয় না পূরণ।
তাই, জেনে রেখো, প্রিয়
এই ঘূর্ণন চাকায় আমাদের দেখা হবেই;
সেই আশায় আমি দৌড় থামিয়ে
বসে আছি পথের ধারে;
তুমি এলে আমরা রোদের মধ্যে
ঘামতে-ঘামতে মেঠো পথে হাঁটব
আর শুনব বাঁশের পাতার সঙ্গে
পাতার স্পর্শে কেমন হচ্ছে সঙ্গীত;
শুনব, আমাদের হিয়ার ভেতর
আমরা কেমন গান হয়ে যাচ্ছি।
উত্তুঙ্গ-সুখ
যেভাবে বৃন্তে জাগে শিহরণ
সেভাবে নিয়েছো আমার দখল, প্রভু হে!
তুমি, দুপুরের সঘন রোদ,
এমন করে লেপ্টে আছ
ভবনের গায়ে, গাছের পাতায়
যেনো মধু কেউ
দিয়েছে মেখে পরম দরদ ভরে।
আহার শেষে তুষ্ট ধার্মিক
যেভাবে চেটে-চুষে খায়
আঙুল ও হাতের চেটো
সেভাবে তোমাকে দমে দমে নিই;
অঙ্গে অঙ্গে তোমাকে আমি মাখি
নিবিড় পুলকে জাগে হিয়া
চামড়া ও হাড়ের দেয়াল মুছে
তুমি-আমি যাই মিশে
ঘোর পুলকে জাগে প্রাণ,
জাগে আরো তৃষ্ণা গভীর।
এ জীবন পুলক-তৃষ্ণা এক, জেনেছি শেষে
প্রভু হে, দুপুরের মায়ারোদ,
তোমার নামে আজ লিখে রাখি
এ জনম উত্তুঙ্গ-সুখ।
পরমের সাথে কথোপকথন
—সাধু কে?
—যিনি জানেন, পৃথিবীতে পাপ-পূণ্য বলে কিছু নেই।
—শয়তান কে?
—যিনি জানেন, পৃথিবীতে পাপ-পূণ্য বলে কিছু নেই।
—সাধু ও শয়তানে তবে ফারাক কোথায়?!
—ফারাক কি হয় জানায়? না। তা নয়।
ফারাক রচিত হয় কর্ম-চিন্তায়
পাপ-পূণ্য নেই জেনেও যিনি ন্যায় মনে চলেন, তিনিই সাধু।
আর পাপ-পূণ্য নেই জেনে যিনি ক্রুর হেসে
ধুন্দুমার উড়িয়ে চলেন বিজয় কেতন তিনিই শয়তান।
আফরোজা সোমা
প্রকাশিত কবিতার বই ৫টি। সেগুলো হলো : অন্ধঘড়ি (২০১০), হারমোনিকা (২০১৪), ডাহুক (২০১৫), পরমের সাথে কথোপকথন (২০১৯), রোদে ঘোর লাগা একলা শালিক (২০২১)।
জেন্ডার ও মিডিয়া বিষয়ক প্রবন্ধগ্রন্থ ‘বেশ্যা ও বিদুষীর গল্প’ (২০২১)। প্রকাশিতব্য গণমাধ্যম বিষয়ক প্রবন্ধগ্রন্থ ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং ম্যাকলুহান: গণমাধ্যম, নয়ামাধ্যম ও সমাজ’।
তিনি পেশায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। অধ্যাপনায় আসার আগে সাংবাদিকতা করেছেন দেশি-বিদেশী গণমাধ্যমে।