দীর্ঘতম নিঃশ্বাসে বছরের দীর্ঘতম কবিতা
বরং তুমি হতে পারতে
পৃথিবীর একমাত্র কবিতার বই
যার কোথাও কোনো কপি নেই,
হারিয়ে গেছে মূল পাণ্ডুলিপি!
গুনে গুনে ১৯টা দেশ ঘুরে
খুঁজে পেতাম তোমাকে, আর
মুহূর্ত না ভেবেই, নিশ্চিত করতাম
একমাত্র মালিকানা নিজের।
তোমাকে রাখার উছিলায়
কেনা যেত নতুন বুকসেলফ
বাকিরা ফ্লোরে অযতনে,
তোমাকে ঈর্ষা করে মুখ বাঁকাতো- নতুন বলে!
দিনের প্রথমভাগ, চিয়াসিড ভেজানো লেবু পানি
চুমুক দিতে দিতে তোমাকে জড়াতাম বুকের মাঝে
আর কানের খুব কাছে,
সিমতিয়ের দু পের লাশেজ থেকে ওঠে এসে
মরিসন গুন গুন গাইতো-
“কাম অন বেবি, লাইট মাই ফায়ার!”
তখন মাত্রই দিনের শুরু
তবু, “ট্রাই টু সেট নাইট অন ফায়ার…”-এর ভাবনা
মস্তিষ্কে যেতেই বেড়ে যায় সেরোটোনিন!
ধুক ধুক ধুক ধুক- সশব্দে বেড়ে যায় হার্টবিট,
যেন প্রতিটা বিটের শব্দই
আলাদাভাবে গুনতে পারছি আমি!
যেহেতু জীবিকার তাগিদে যেতে হবে
মলম বেচা-কেনার সুদর্শন কপি লিখতে
তোমার মলাটে তাই ঠোঁট ছুঁয়ে
গুটি কয়েক তুলে রাখি অন্তরঙ্গ সেলফি!
যেন দিন কেটে যায়, দেখতে দেখতে তোমাকে- নিজস্বভাবে!
তোমাকে ছাড়া কাটাতে হবে দীর্ঘ নয় ঘণ্টা!
নাহ! হিসাবে আরেকটু বেশি!
যাতায়াতের সময়টুকু যুক্ত করলেই
সময়সীমা দাঁড়াবে দশ ঘণ্টার প্রায় কাছাকাছি!
এর মাঝে, মরি-বাঁচি
কিংবা যদি না ফেরা হয়
আবার এই ঘরে,
তোমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে
খোদাভীরু আমি পড়ি আয়াতুল কুরসি!
ফুঁ দিই কপাল-চোখ-মুখে, সবশেষে বুকে।
আর মনে মনে হাজারবার বলি-
তোমাকে যেন হারাই না আমি,
হারিয়েও ফেলি যদি নিজেকে!
ভীতু মন নিয়েই বেছে নিই পছন্দের শাড়ি আয়নায় দাঁড়িয়ে
চোখ দুটো কাজল-কালো বানাই আর বলি-
এম আই লুকিং সেক্সি, ইউর ম্যাজেস্টি?
বারান্দার ছোট্ট মোড়াটায়
বসে ছিলে তুমি আধখোলা হয়ে
হঠাৎ বাতাসে এলোমেলো সব
পাতাগুলো দ্রুত গতিতে উল্টে
কী যেন চাইলো জানাতে!
হয়তো তুমুল আলোড়নে ঝড় বইছে প্রতিটি পৃষ্ঠায়
হয়তো চাইছো তীব্র আলিঙ্গন পেছন থেকেই
নতুবা চাইছো বুকের ভাঁজে
আবারও কাটাতে কিছুটা সময়,
অথবা অনন্তকাল ধরে…
বুকের মাঝ বরাবরই চেয়েছো- অন্তিম ঠাঁই।
এসবই পৃথিবীর একমাত্র এগজিস্টিং কপির
কবিতার বই ঘিরে
কল্পনাগুলো নিজের মতো করে নিজস্ব সংসার গড়ে,
যেন তুমি কোনো পুরুষের চেয়ে কম কিছু নও!
যেন তোমার আছে প্রাণ,
আছে অনুভূতি, আছে প্রেম, অথবা যৌনাবেগ
আছে পুরুষের চেয়েও কোমল হৃদয়, ভালোবাসবার ক্ষমতাও!
যাওয়ার সময় হলেই, মলাটে চুমু খেয়ে
আবার তুলে রাখি তোমাকে বুকসেলফে।
এই খালি ফ্ল্যাটে, কোনো ঘরে বা বুকসেলফে
তালা না দিলেও চলে,
তবুও মনে হয়- কখন, কোথা থেকে কেউ
যদি এসে চুরি করে ফেলে আমার হৃদয়?
অনিচ্ছায় তবু অনিরাপদ বোধে,
কয়েক রকমের তালা দিই ঘরে ঘরে।
নিজেকে কি তুমি মনে করো বন্দী?
হয়তো! প্রতি মুহূর্ত, কাছাকাছি থাকতে মন চায় আমারও!
ইচ্ছে করে, তোমাকে বুকে জড়িয়েই ঘুরে বেড়াই সারা পৃথিবী!
কিন্তু আমার তো ওই একটাই- হারিয়ে ফেলার ভয়!
যদি আমার চেয়ে লিবারেল কেউ,
যদি আমার চেয়ে কম পজেসিভ,
যদি আমার চেয়েও শাড়িতে সুন্দরী-সেক্সি নারী
তোমাকে পেয়ে বা চেয়ে বসে?
যদি তুমিও যাও চলে- নতুন মালিকানার স্বাদ নিতে
অথবা, এমন বন্দীত্ব থেকে পেতে চিরমুক্তি?
তোমাকে হারানোর বেদনায়,
আমার পৃথিবী এক ধাক্কায় শূন্য হয়ে যাবে,
আর আমি- ফাঁকা ঘরের আনাচে-কানাচে
ঘুরে ঘুরে খুঁজবো তোমার স্মৃতি।
তারচেয়ে তুমি তালাবন্দীই থাকো-
আমার একান্ত ব্যক্তিগত ব্লুবার্ড,
আই’ম নট গোয়িং টু লেট এনিবডি সি ইউ!
যেন তোমাকে হারাতে না হয়,
প্রয়োজনে আমি হতে পারি হিটলার অথবা বেনিতো মুসোলিনি!
শুরু করতে পারি আরো একবার
পৃথিবী জুড়ে নাৎসিবাদ।
আজীবন কাছে রেখে দিতে তোমাকে
হতে পারবো দুনিয়ার সর্বোচ্চ নিকৃষ্ট স্বৈরাচার!
তোমার ভাগ অন্যকে দেওয়ার আগে
কার্বন মনোক্সাইড গ্যাসে
শেষ করে ফেলতে পারবো নিজেকে
তার আগে, তোমার শেষ চিহ্নটুকুও
পুড়িয়ে ছাই করা নিশ্চিত করবো!
সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়
প্রতিদিন এই একই সময়,
একই রুটিনেই বাড়ি ফিরি তাড়াহুড়ায়।
মেইন ডোরের লক খুলতে খুলতেই ডাকি-
বেবি, আই’ম হোম!
তুমি অপক্ষায় ক্লান্ত যুবকের মতো
কিছুটা যেন তাকাও উঁকি মেরে,
বাকিটা অভিমানে, ফিরে থাকো অন্যদিকে।
আমি ছুটে,
একে একে সব তালা খুলে দিতে থাকি
তুমি কি ছটফট করো, মুক্ত হবে বলে?
এমন ভাবনায়
অপরাধ বোধ কুরেকুরে খায়
আট কুঠুরি, নয় দরজার সবটুকুই প্রায়।
তালা খুলে,
বুকসেলফ থেকে বের করি আদরে-আদরে
বুকে জড়াই, চুমুতে চুমুতে কাটে অনেকটা সময়!
এভাবেই কিছুটা ভাঙে অভিমান,
কিছুটা রাগ ভাঙে আহ্লাদীপনায়।
রাত নয়টা বাজতেই
সাইকিয়াট্রিক ওষুধগুলো কাজ শুরু করে
সাইরেন বাজিয়ে জানায়- “আর পনের মিনিটের মধ্যেই ঘুমের সময়।”
আমি শুয়ে, শিথানের ডান পাশে
তোমাকে রাখি মনপাখি করে।
তারপর ধীরে, খুব ধীরে
তোমার সমস্ত পৃষ্ঠায়, আঙুল দিয়ে আঁকি-বুকি করে যাই
একবার সামনের মলাট খুলি, একবার খুলি পেছনের
বারবার, যত খুশি, এভাবেই উল্টে-পাল্টে
আর যতভাবে, মনে চায় যতক্ষণ সময়
তোমাকে নেড়ে-চেড়ে দেখি, দেখাই তোমাকেও মন ভরে
যা কিছু খুব প্রিয়, যা কিছু চিরকাঙ্ক্ষিত!
আবার মাঝরাতে,
প্যারিসে ফেরার পথে
মনের বাসনাকে তীব্র করে তুলতে
মরিসন কানে কানে বলে-
“লেট মি স্লিপ অল নাইট ইন ইউর সৌল কিচেন!”
তোমার মলাটে মাথা রেখে শুয়ে পড়ি
প্রশস্ত কোনো বুকের ছবি কল্পনা করে।
আর ভোররাতে,
ঘুম ভেঙে যায় ভয়ংকর দুঃস্বপ্নে!
তুমি ঘুমিয়ে আছো ক্লান্ত শরীর নিয়ে
আমি চুপচাপ,
তোমার ঘুমন্ত মুখ দেখি গভীর প্রেম আর মায়াভরে!
আবার ভয় জাগে!
দেয়ালগুলো চারপাশ থেকে যেন
পিষে ফেলতে চেপে আসছে কাছে!
আমি প্রাণপণে, তোমাকে জড়িয়ে ধরে ভাবি-
আমি মরে গেলেও
কেউ যেন পায় না খোঁজ তোমার।
কারো যেন প্রয়োজন না হয় তোমাকে, এই ইহকালে।
অথবা যদি পুনর্জন্ম থাকে, সেখানেও আমি ছাড়া
তোমার খোঁজ যেন না পায় কেউ আর!
প্রতি জন্মে, তোমার একটাই কপি থাকবে
আর হারিয়ে যাবে মূল পাণ্ডুলিপি,
শুধু আমার মালিকানার হয়ে
তুমি একলাই থাকবে- বারবার, প্রতি আর শত জন্মে।
আমি চাই না তোমার মানবজনম
মানুষকে এভাবে চাইতে গেলে
পুড়ে যায় মন, ব্যথা জাগে বারেবারে,
সমস্বরে ঝিঁঝিঁ পোকারা জানায়- অযোগ্যতা
অথবা হাজার সীমাবদ্ধতা
জানালার গ্রিলে ঝুলে স্লোগান তোলে-
“একই অনুভূতি, একই ভালোবাসা নিয়ে
মানুষ চিরকাল থাকে না মানুষের পাশে!
তারচেয়ে তুমি ভালোবাসো প্রাণহীন
একমালিকানার বই, পৃথিবীর কোথাও
যার আর কোনো কপি নেই।”
পৃথিবী আর মানুষ প্রেমহীন হোক,
অথবা পুড়ে যাক ঘৃণার হাবিয়ায়
তুমি বরং থেকে যাও আমার কাছে
পৃথিবীর একমাত্র কবিতার বইয়ের, একমাত্র কপি!
৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪
চন্দ্রিমা মডেল টাউন, ঢাকা।
হাশরের ময়দান
রোজ হাশরের দিনে
আমার পাপের হিসাব দিও
খোদার আসরে।
আমি বাধ্য পাখির মতো
সাক্ষ্য দেবো, পক্ষে তোমার
চোখের ভেতর ক্ষত।
আর বাদ বাকিটা যত
ক্ষয় করেছি শব্দ-গানে
থাকবে আহত।
আমি অল্পটুকু লোভী
কাছে ধরে রাখতে চেয়ে
হারিয়ে ফেলি সবই।
আমার বিরাট পাপী মন
বুকের কাছে কান পাতলে
তোমার নামই শোনে।
আমার দাগী অনুভূতি
সামনে কদম ফেলতে গেলে
তোমার ডাকে থামে।
আমার নিঃস্ব হওয়ার দিনে
মৃত্যু-সমান দূরে বসে
পড়েছি কালাম।
যদি ভুলেও ডাকো নাম
তোমার ডাকের প্রতিধ্বনি
আমার শরীর ঘিরে।
রোজ হাশরের দিনে
আমার সকল পাপের তুমি
হিসাব দিও গুনে।
কাঁপলে কাঁপুক,
খোদার আরশ তাতে
তোমার ছোঁয়ার ঋণে আমি
সাক্ষ্য দেবো সাথে!
১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪
চন্দ্রিমা মডেল টাউন, ঢাকা।
পিতা পরম তপস্যা
মৃত্যু প্রহর গুণছে…এক, দুই, তিন
হৃদয়ে রক্তক্ষরণ নিয়ে সারাদিন
নিঃশব্দেই দেখছি আতঙ্কিত চোখ
খোদার কাছে হাত পাতি- যন্ত্রণা কম হোক।
অকস্মাৎ পাল্টে যাচ্ছে পুরো পৃথিবী
কিছুই থাকে না, দেখো; থাকে না কেউ অবিনশ্বর
ধসে পড়ে প্রাণ,
তারই সাথে খোদার প্রতি আলতো অভিমান।
কিছুই থাকে না কেন?
ভালোবেসে যদি হবে হারাতেই
কেন তবে এ দেহে হৃদয় স্থাপিত হলো?
ভেঙে যাবে সবই, ভাঙতে হয় হারালে প্রিয়জন
আর যে জন হৃদয়ে জাগায়
ভালোবাসা প্রথম।
তারে হারালে হবে, এই বেঁচে থাকা পাহাড়সম ভারী
তবু কি বিদায় নেয় সকল দৃশ্যগুলি?
আব্বার বহু বছর পর ফিরে আসা
দিয়েছিল নতুন জন্ম।
এক জীবনে বহুবার মরে
বেঁচে উঠেছি তারই জন্য
এখন হন্য হয়ে খুঁজছি মির্যাকল কোনো।
যদি আজরাঈলকে এ যাত্রায়
খালি হাতে ফেরত পাঠানো যায়,
এমন মন্ত্র জানা আছে কারো?
আব্বা হাঁটছেন কুয়াশাঘেরা পথে
সমস্ত ব্যথা আর যন্ত্রণা উপেক্ষা করে
একটা একটা শেষ হচ্ছে সমস্ত অর্গান
আর এই প্রাণ, ডুকরে কেঁদে ওঠে অবসাদে, ভয়ে।
এ পৃথিবীতে কারো কারো অমর হওয়া প্রয়োজনীয়
নতুবা যদি চাইতে পারতাম, সম্রাট বাবরের মতো
নিজের জীবনের বিনিময়ে ভিক্ষা পুত্রের প্রাণ
পিতাও তো জানি পুত্রসম!
মরে অমর হওয়ার সাধ নেই কোনো
কিছু সময় তবু আব্বার আগেই চলে যাওয়া
মনে করি শ্রেয়।
বুকের ভেতর ছটফট করে ওঠে যে আহত পাখি
তার এই শোক কোথায় ধরে রাখি?
একবার! শুধু একবার যদি
খোদার আরশে পৌঁছে যেত বুকের এই বিলাপ
পরওয়ারদিগার কি বুঝতে পারতেন-
ভালোবাসা শূন্য হয়ে বেঁচে থাকা মৃত্যু-সমান?
আব্বা- আমার জীবনরেখা
মৃত্যুকে আরো একবার
উপেক্ষা করে বলো-
চল মা; আরেকটু বাঁচি, গেয়ে ওঠি একসাথে আনন্দগান।
মৃত্যু প্রহর গুণছে…
এক, দুই, তিন
আব্বা, তোমার কাছেই আমার
সমস্ত জীবনের ঋণ।
২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪
চন্দ্রিমা মডেল টাউন, ঢাকা
পানাহ্
বুকের ভেতর, থেকে থেকে
মৃত সব প্রিয়জন কড়া নেড়ে ওঠে
আর এই শেষরাতে, মস্তিষ্কে দীর্ঘতর হয় নানা সংলাপ
যা কিছু বাকি ছিল বেঁচে থাকতে;
অথবা যা বলার জন্য
খুব কম হয়ে যায়- একটা জীবন।
এ সকল সংলাপ চলাকালে
চোখের পলক পড়ে মুহূর্তে মুহূর্তে
এরই সাথে
পাল্টে যেতে থাকে দৃশ্যগুলোও
আর সমস্ত স্মৃতি, দিস্তার পর দিস্তা পৃষ্ঠায়
ভেসে ওঠে বুকের বাম পাশ ঘিরে।
ইচ্ছে করে, আরেকটু দেখি
ইচ্ছে করে, দীর্ঘতম হোক আজকের রাত
ইচ্ছে করে, পায়ের ভাঁজে মাথা রেখে
আলাপকে করে তুলি দীর্ঘতর।
তবু তীব্র অনিচ্ছাতেই,
দমন করতে হয় ইচ্ছেগুলো।
ছুঁতে গেলেই যদি হারিয়ে ফেলি?
অথবা ছোঁয়ার অপরাধে,
কখনোই যদি না আসে এই রাত আর?
তবে তো দেখা আর কথারা
হারিয়ে যাবে একেবারেই
এই ভয়ে, কিছুটা দূরে দূরে থাকি।
দূরত্বে বসেই ধীর স্বরে বলি-
তোমার এখন ঘুম হয়, আব্বা?
এমন প্রশ্ন শুনে মুচকি হাসেন তিনি,
সমস্ত চোখে-মুখে ঝরে পড়ে অদ্ভুত শান্তি।
মুখে তাকিয়েই বিড়বিড় করে কয়েকবার পড়ি-
সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত চব্বিশ
আর আমার সারা ঘরে
ছড়িয়ে পড়ে আলোর জ্যোতি।
খুব ধীরে আবার প্রশ্ন করি-
আব্বা, মেহদী হাসান ছাড়ি?
মুখে একই হাসি,
হাত দিয়ে ঘষছেন সাদা চুল আর দাড়ি।
ওস্তাদের সুরেলা কণ্ঠে বাজে-
“জিন্দেগি মে তো সাবহি পেয়্যার কিয়া কারতে হ্যাঁয়
ম্যাঁয় তো মারকে ভি মেরি জান তুঝে চাহুঙ্গা…”
আমার চোখ বেয়ে পড়ে নিঃশব্দ পানি।
চুপচাপ দুজনই গজল শুনি,
দূরের মসজিদ থেকে ভেসে আসে ভোরের আজানধ্বনি।
গান থেমে গিয়ে,
শুরু হয় পাখিদের কলকাকলি।
ভয় জাগে আবার!
নামাজে দাঁড়ালে, আব্বা ফাঁকি দিয়ে চলে যায় যদি?
আরেকটু বড় হাসিতে, চোখের ঈশারায়
আবার আসবেন বলে আশ্বস্ত করেন।
ওই হাসিই যেন আব্বার বিদায়,
পুরো ঘর তন্ন-তন্ন করে খুঁজেও দেখা পাইনি আর।
ধীরে ধীরে পা ফেলে
ঘরের সব দরজা-জানালা খুলি
বাইরে হু হু বাতাস;
ভোরের আলোর বুকে জ্বালাই একখানা আগরবাতি
আর জায়নামাজে হাত তুলে,
সুরা ইব্রাহিমের আয়াত একচল্লিশ থেকে পড়ি-
“রাব্বানাগ ফিরলি ওয়ালি ওয়ালিদাইয়া
ওয়ালিল মু’মিনিনা ইয়াওমা ইয়াক্কুমুল হিসাব…।”
জানি না, খোদার আরশে পৌঁছায় কি না
ব্যর্থ সন্তানের ডাক; এই ফজরওয়াক্তে তবু
সিজদায় মাথা ঠুঁকে আরজ করি-
খোদার শ্রেষ্ঠ পানাহ্-তে যেন আব্বার ঠাঁই মেলে।
৩ মার্চ, ২০২৪
চন্দ্রিমা মডেল টাউন, ঢাকা
নিঃসঙ্গতার হাজার বছর
ফিরে আর আসবো না বলে
বারবার চলে যেতে থাকি
তবু একবার পেছন ফিরলেই
ছিঁড়ে যায় বুক, কী যেন ডাকে।
না চেনার ভান করে, পাড়ি দেওয়া যায়
কতটাই পথ?
অতৃপ্ত বাসনার নোনাজলে
হৃদয় বৃক্ষের মতো থাকে না অনড়।
চলে গেলে শেষ হবে কি-
সন্দেহ আর অভিযোগের আলো-আঁধারি?
এই বিদায়ে মেঘ কাটবে কি
তোমার গগণজুড়ে?
চলো যাবো বলে ফের বাড়ালাম পা
তবু পথে পথে আটকে যাচ্ছি নিয়ে নিবিড় স্মৃতি
যেদিন রেখেছিলে, অথবা রাখতে চাওনি যেদিন
মাথার উপরে স্নেহভরা হাত
এ সকল দৃশ্যকল্প ভেসে এলেই
টলে ওঠে পা।
জানি, যেতে হবে
অন্তিম দৃশ্যের পৌঁছে গেছি, খুব কাছাকাছি
এখান থেকে যায় না ফেরা চাইলেই
মৃত্যুই যখন একমাত্র বিকল্প হয়ে ওঠে।
চিরকালের মায়ায়
ভালোবাসবার দিয়েছিলেন অসীম ক্ষমতা,
খোদার কাছে তাই শুকরিয়া জানাই বিদায়বেলা।
আর চলে যাওয়ার ঠিক আগে
জায়নামাজে ঝুঁকে পড়ি খোদারই কালাম-
রাখে যেন ভালো তাকে, বুকে বাজে যার নাম।
৭ মার্চ, ২০২৪
রিং রোড, মোহাম্মদপুর, ঢাকা
সিফাত বিনতে ওয়াহিদ
জন্ম ২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৮ ঢাকার মগবাজারে। শৈশব কেটেছে নানাবাড়ি মগবাজার এবং দাদাবাড়ি মিরপুরে। অদ্ভুত নিঃসঙ্গতা যাপনে কৈশোর পেরিয়েই কবিতার প্রতি প্রেম জন্মায় তার। কবিতা লেখায় বুঁদ হয়ে পড়েন কলেজ পেরোনোর পরই। ওরিয়ানা ফাল্লাচিতে মুগ্ধ সিফাত সাংবাদিকতাকে এক সময় পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন। একের পর এক খ্যাতিমান ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রশংসিতও হন। নির্মলেন্দু গুণ, হেলাল হাফিজ, ফরহাদ মজহারসহ অসংখ্য খ্যাতিমানদের সাক্ষাৎকার তিনি নিয়েছেন বিভিন্ন সময়৷ ফিকশন এবং ফিচার লেখাতেও রয়েছে তার সমান দক্ষতা। বর্তমানে কাজ করছেন সিনিয়র কনটেন্ট রাইটার হিসেবে। ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক করা সিফাতের এই পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে চারটি কাব্যগ্রন্থ- পুনর্জন্ম (২০১৬), ঘরের ভেতর ঘর নাই (২০১৮), নিঃসঙ্গতায় আরো কিছু দেখা হোক (২০১৯) এবং সকল পুণ্যের মাঝে আমি একটাই পাপ (২০২৪)। ২০০৮ সালে তিনি বাংলাদেশি ব্যান্ড রি-কলের জন্য লিখেছেন ‘প্রেম সমাচার’ নামের গানটি। পরবর্তীতে তরুণদের কাছে এ গান বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। এছাড়া তিনি সাব-কনসাশ এবং আধখানা চাঁদ ব্যান্ডের জন্যও গান লিখেছেন।