অগ্রন্থিত
ভাড়াটে
নতুন ভাড়াটে এল পাশের বাড়িতে
আসবাবের সাথে একটা বিষাদ উঠছে
হাঁড়িপাতিলের সাথে একটা কান্না
পালঙ্কের সাথে একটা দীর্ঘশ্বাস
ওয়ার্ডরোবের সাথে একটা অভিমান
পোশাকের সাথে একটা অপমানবোধ
এত সব জিনিস কি আঁটবে ওখানে
অলংকারশাস্ত্র
কোন ছন্দে প্রেম করো জানা হলো
মনে রেখো সে ভাষায় সংসার চলবে না
তোমাকে হতেই হবে বহুভাষাবিদ
তা দিয়ে হয়ত সামলানো যাবে কাম
কিন্তু মহাকাব্যে পয়ার লাগবে
সংসার ব্যাপারটা মহাকাব্যিক ধাঁচের
প্রেম প্রায়শই লিরিক কবিতা
মদ
মদের তরলে আমি তাদের ফ্লেভার খাই
খেয়ে খেয়ে না পাওয়ার গ্লানিকে খানিক
তুমি যদি আড্ডায় কখনো বসো মদের টেবিলে
ইনার মিনিং তুমি কিছুতে পাবে না
সে কারণে বিনাপ্রশ্নে আলগা করেছি আজ
আমি না বললে তোমরা জানবে কীভাবে হে
শরীরে বানানভুল
এত এত বানানভুল তোমার শরীরে যে চমকে যেতে হয়, হাজারটা মানুষের যেখানে চন্দ্রবিন্দু নেই তোমার সেখানে আছে, তোমার সব এ-কারেই মাত্রা এবং সব রেফ বে-জায়গায়
কাজল পরতে গিয়ে তুমি সহসাই খাদে পড়ে যাও, বাধা ডিঙোতে গিয়ে পড়ো অহেতুক লতাগুল্মে বাঁধা, ঝড়ে পড়ে পথেঘাটে ঝরাও বেদনারাশি
এসব মিলিয়ে যে বুনো সৌন্দর্য জন্ম হয়েছে তাতে যে কোনো পাখি এসে নির্ভয়ে তোমার শরীরে বাসা বাঁধতে চাইবে, তোমার পাহাড়ে চাইবে থেকে যেতে ঘর বেঁধে, সাগরে চাইবে জাহাজ ভাসাতে সব পর্যটকের পুত
তোমার সৌন্দর্য তোমার মধ্যেই থাকুক, কেননা ভুল বানানেই তোমাকে মানায়, শুধু এইটুকু সাবধান থেকো, হরেক রঙের কলম পকেটে নিয়ে ঘোরা লোকেদের আশেপাশে যেও না কখনো, বিশেষ করে লাল কলমওয়ালাদের
জঙ্গলের নিজস্ব শব্দাবলি (Own Words of Timberland), ২০১৪ থেকে
উচ্চাঙ্গ শিশির
ভিজে যাচ্ছি উচ্চাঙ্গ শিশিরে, সরোদে-সেতারে
স্নানাশায় ভেসে আসি সুরের খেয়ায় আজ শুদ্ধ সরোবরে, ছায়ানটে-ইমনকল্যাণে-পুরিয়ায়
পুরিয়ায় পঞ্চম লাগালে হয় পুরিয়াকল্যাণ, তাতে ভেসে সমস্বরে ঘুরে আসি সোহিনীতে, ছোটো খেয়ালের ছলে হংসধ্বনিতে
আজ দেখি নিজে আমি সুরভরা বাঁশি হয়ে গেছি এক গণ্ডুলা বাঁশের, পারো তো এবার তুমি আমাকে বাজাও এই প্রকাশ্য সভায়
খামারবাস
আমার কোনো শাখানদী নেই, বেতস ঝোপের পাশ দিয়ে ভেসে চলা সরীসৃপেরা আমায় এ সাক্ষ্য দিয়েছে
পার্শ্বআঙিনা থেকে পেঁপে, ডাটা, বেগুন ও ঢেঁড়স সংগ্রহরত ভদ্রমহিলার দিকে চেয়ে থাকি মুগ্ধ নয়নে, কেমন একটা মা মা গন্ধে ছেয়ে যায় প্রান্তর, আমার তাকে পেঁপে পাড়ায় সাহায্য করার ইচ্ছে জেগেছিল
যে পথে গেলে ভালোবাসা পাবার অঢেল সম্ভাবনা, সে পথ থেকে দূর দিয়ে হেঁটে প্রেমের আকালকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করার বাতিকটা আমাকে কী কী দিয়েছে তা সময় নিয়ে ভেবে দেখতে হবে, তবে বুকের ভেতরটা ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া নারকেল গাছটা কবে অল্প বাতাসেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে সে ভাবনা আমাকে কখনো ছাড়ে না, তবে কি আমি পিছিয়ে পড়েছি খাটাস ভাই
প্রান্তরের খোলা হাওয়ার স্মৃতি আমি প্রায় ভুলে যেতে বসেছিলাম, শীতল ভয়ের দিকে ঠেলে দিয়ে, হে হে, তুমি আমাকে নবজন্ম দিয়েছ মশাই
পাতার জীবনী
উদ্যানে শীতার্ত রোদে লেখা হচ্ছে পাতার জীবনী, নোটপ্যাডে আমি যার ভাষালিপিকার, মনোযোগে টুকে যাচ্ছি বাতাসের নির্দেশনাবলি
গত জনমের এক পাঠ ছিল ভুলে ভরা, খাগের কলমে লেখা পত্রালিআখ্যান নামে চালু ছিল মানুষের কামনা-বাসনা, বাতাস-শাসন মেনে পুড়ে ফেলা হচ্ছে ওই বানানো কাহিনি
বনের চোখের জলে কলম ডুবিয়ে আজ এই লেখা, বাতাসতাড়িত, শেষ হলে জারি হবে বনজুড়ে নতুন বিধান
পাহাড়ে মেঘলা ঋতু
নীল রং বেশি দিয়ে আকাশ বানিয়ে সাথে রেখেছি পাহাড়
গাছেরা যেহেতু আছে বিনা প্রশ্নে থেকে গেল পাখিরাও দলে
অল্পস্বল্প গোধূলি স্প্রে করে মাত্র বসেছি দু’জন
না-জানিয়ে অমনি অদূরে কিছু মেঘদল ঠেসে গেল
সে বলল, ছিপি খোলো, তীর ছুড়ে সেটেলার কালোমেঘ মারি
নো-ম্যান্স-ল্যান্ডে আশ্রিত জুমিয়ারা ভয়ে কাঁদতেও ভুলে গেছে
শূকরছানার ঘোঁত ঘোঁত আওয়াজ শোনা যায়
আগুন ওদের দেহ পোড়াতে পারে নি
তাইন্দঙের আকাশে ভাসে সর্বনাশা অগ্নিবর্ণ মেঘ
বাঁধ
হাসি শুনে তার চিনেছি আক্রোশ, ছায়ায় দাঁড়িয়ে আজ মনে হলো
ছোঁয়াচে হাসির তোড়ে দেখো আজ পাতারাও দোলাচ্ছে মাথা
থাকবে না এইসব পাতা, হাসিরাই ছিটিয়ে যাবে শুধু প্রলয়োচ্ছ্বাস
বাতাসের পরাক্রম মানি, সমীহ জিইয়ে রেখে হেঁটে হেঁটে এত দূর
উজান বাঁকের ঢালে, যেইখানে শনগাছ নিরিবিলি সমাজ গড়েছে
জোড়া খরগোশ নারায়ণ এ বেলায় এইখানে মোড়ল অতিথি
তুমি এইসব সমাজ মানো না তাই মাছেদের গাছেদের
পাখি আর প্রাণীদের কলরব মুছে দিতে উজানে দিয়েছ বাঁধ
দু’হাতে উড়াচ্ছ ছাই নদীদের চোখে-মুখে আদিম খেয়ালে
অণুভাষ
একটা রব্বানীগাছের ছায়া অদূর প্রান্তরে নিভে আর জ্বলে
পোড়া মবিলের গন্ধ মাখা একটা বুলডোজার অপলক চেয়ে থাকে
আপেলের ভেতরে একটা শুকিয়ে যাওয়া নদী আছে
বলুয়া সুন্দরী হলে কথা মোটে ফেলতে পারি না
উপকূল এক্সপ্রেস যখন ঢাকায় ঢুকে পড়ে
লাল কাঁকড়ার সাথে আসে কাচবালিরাও
বিদেশি ভাষায় রচিত দুর্বোধ্য গ্রন্থ তুমি
খুলে বসে থাকি পড়তে পারি না
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিছানায় গদ্যছন্দের কবিতা বেশি লিখিত হলে দু’জনেরই পদ্যছন্দের প্রতি আসক্তি বাড়ে
ঘরের ও বাইরের এই ছন্দভেদ যারা বুঝতে পারেন, তারা দুই ছন্দেই বেশ পারদর্শী হন
কেউ কেউ এর বাইরেও তৃতীয় কোনো ঠেকাছন্দ শিখে নেন, মারি ও মন্বন্তরে শব্দে শব্দে জোড়া লাগাতে যেটা বেশ কাজে লাগে
ছেলে বড়ো হলে বাপেদের স্পেস কমে যায় শ্বাস ফেলবার, মেয়ে বড়ো হলে মায়েদের
বাউণ্ডুলে বাপের তদ্রূপ ছেলেরা বিব্রত থাকে হরদম বাপেদের নিয়ে
বাপ ও ছেলের পেশা এক হলে, পেশার আড়াল সব ভেঙে পড়ে
ঘোড়াদের হাসিমুখ লাগামসাপেক্ষ, মাঢ়ীরঙা এই হাসি হেসে হেসে আমরা ছুটেছি সবে দূরের বন্দরে
ঘোড়াদের চলাফেরা কথা বলা ইশারাতাড়িত, আড়ালে লাগাম হাতে বসে থাকে মানবেশ্বর
জ্বলন্ত কয়লা হলো কবিতাকর্মীরা
ত্রিভুজাসম্ভাষ (Trinomial Expressions), ২০১৩ থেকে
হাইকুপ্রহর
বাইকু বর্ণমালা
বাইকুসহায়
আধপোড়া একটা পৃষ্ঠা উড়ে এসে পড়ে পথে
ওতে লেখা, ‘জ্ঞান কখনো পোড়ে না’
বাড়ির মালিক ও ভৃত্যের নাকে
সমভাবে গন্ধ পৌঁছে দিচ্ছে
জগতের সকলের জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ দিবস
সেনরুবিতান
চিরপুষ্প একাকী ফুটেছে (Solitary Bloom Perpetuates), ২০০৯ থেকে
পুরুষের ধর্ম
নারীমানুষের ধর্ম আছে, নারীশরীরের নেই
সম্প্রদায়নিরপেক্ষ খুব নারীর শরীর, জাতপাতহীন
জাতপাতে অন্ধ ধর্মঅলারাও ধর্ম খোঁজে না বিশেষ শরীরপূজায়
পুরুষের ধর্ম বড়ো বিচিত্র জিনিস
শর্মাবিষয়ক জটিলতা
কখনো চিকেন শর্মা খেতে খেতে তনুজা শর্মার কথা
কারো কোনো দায় নেই চিকেন বা তনুজার
সব দায় গিয়ে বর্তায় কুচিকুচি শর্মায়
প্রভাব শব্দটি ঘিরে যা কিছু অস্বস্তি আমার
শর্মার বরাতে দেখি কিছুটা কমেছে তাই
সাহসে দাঁড়াই এসে প্রকাশ্য রোদ্দুরে
চুল দেখলেই যারা মেয়ে ঠাওরায়
আর গোঁফ দেখলেই পুরুষ বেড়াল
মোটেই তাদের কথা হচ্ছে না এখানে
নিন্দুকের হাতে অস্ত্রের মজুত বাড়ানো
ছেঁড়া নদী কেননা কখনো সাগরে পৌঁছে না
থেমে থাকে কানাগলিতে এসে সকল যন্ত্রযান
বেড়াল থাকল বেড়ালের জায়গায়
চোরা উল্লিখনে ছেয়ে গেল কেবল
ঢেকে যাচ্ছে পশ্চিমে পশ্চিমে
আপন রূপের বিভা অপরতমস লেগে কালো
ভুবনবিদ্যার ঘাটে নিভে আসে সূর্য ক্রমে ক্রমে
লালনের সুর-তাল র্যাপ মিউজিক দিয়ে মোড়া
আমার এ পূর্ব তবে ঢেকে যাচ্ছে পশ্চিমে পশ্চিমে
ঠাকু’মার ঝুলি পেল আসরের এক কোণে ঠাঁই
বাংলা থিতিয়ে আসে বিভাষার সীমাহীন চাপে
রসনা কাতর ধ্বনি তুলে বটে বিদেশি বর্ণের
জমা অভিমানটুকু পুবালি বাতাস লেগে কাঁপে
ইড়া ও পিঙ্গলা জানে দেহের মহিমা কত খাটো
ভেতরে বাড়ছে দ্রুত লেলিহান ভোগের পিপাসা
মানুষ এগোল কত ভুলে থাকি তার ইতিহাস
যেন বহে পিতামহদেরই কালে কাবেরী-বিপাশা
পুবের মাটিতে মহা জেগে আছে শস্যসম্ভাবনা
মাথায় গোছানো তবু পরকীয় পশ্চিমা ভাবনা
একাগাছ
শালজঙ্গলের কোনো জেরক্স হয় না
পোড়োবাড়ির কোনো সারাই হয় না
আমাকে আধলে রেখে উড়ে গেলে তুমি
পোড়োবাড়ির ধারণা পড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে
বাতাসে বাতাসে ভাঙনের সুর বেজে ওঠে
মাঠের ভিতরে থাকা একাগাছ যত দেখি
শূন্যতার তত বেশি পড়ে যাই প্রেমে
গোড়ার জল কী দারুণ আগলে রাখে
ধুধুপথে হাঁটা দেব শূন্য অভিলাষে
মৃত্যু
জীবনের ভিতরে আজ মৃত্যুর লোমশ একটা হাত ঢুকে গেছে
আনাচে কানাচে তার জন্মেছে পাথরকুচি
ময়দানের হাওয়া (An Unfastened Air-Stream), ২০০৬ থেকে
নিসর্গ ব্যানার্জী
উলটোদিক থেকে নামতে গিয়ে অনিবার্য পতন ঠেকাতে পা ফেলানো শিখে গেছি আজ প্রাণান্ত কৌশলে, কেননা নামতে হবে, কোথাও উঠতে হলে পূর্বাবস্থান থেকে নামতে হয়, রংজেং-এর চূড়া থেকে বিরিশিরি ম্যালা পথ, দুর্গম ঢাল, হ্রদ এবং বুনো সন্ত্রাস, বৃক্ষবিরোধ পার হলে কিমিয়া সীমান্ত ফাঁড়ি, কাঁটাতার ও সোমেশ্বরীর অনন্ত বালি
শ্যাওলাবিব্রতিসহ সমস্ত ছাল-বাকল ছাড়িয়ে একটি নদীকে জাগাব, এহেন সিদ্ধান্তে দেখো পুনরুত্থানের মতো মাথা উঁচিয়েছি— দুই পা আমার দুই ভুল কুমিরের মুখে, সতত নিচের দিকে টান, হাতির শক্তিতে তবু দুমড়ে-মুচড়ে যাব, মাহুতের প্রেমে তুমি শুঁড় ধরো শুধু
যেতে যেতে বহুকাল গেছে, এ বেলায় জেনে নিই বাহারি সৌরভ, আনুপূর্ব ছুঁয়ে-ছেনে বুনোকুসুমের, দিনে দিনে না-হয় পরে তুরীয়ানন্দে যাওয়া যাবে
বেশি নয় একটিই দারুণ খায়েশ, কোনো এক আরণ্যসন্ধ্যায় ঠিকঠাক তোমাতে আরূঢ় হব, নিসর্গদি
বিড়ালটি
তোমরা চলে যাচ্ছ, ট্রাকে মালামাল উঠে গেছে সব, এক জীবনে মানুষের কতবার যে বাড়িবদল জরুরি হতে পারে মানুষও বুঝি তা জানে না
একদিন এভাবেই ট্রাকে মাল বোঝাই করে রেলিংঘেরা এই বাড়ির নিচতলায় তোমরা নোঙর ফেলেছিলে, অতিথি পাখি ও গৃহস্থ বিড়াল একদিন ভোরবেলা চার সদস্যের একটি নির্ঝঞ্ঝাট পরিবার দেখে আহ্লাদে উল্লাস করেছিল
তোমরা ত্যাগ করে যাচ্ছ একটি অভ্যস্ত পরিমণ্ডল, তার বিয়োগব্যথায় তুমি কাঁদলে, তোমার মা কাঁদল, ট্রাকের সিটে গিয়ে বসলে সবাই, তুমি, তোমার মা, ছোটো ভাই, কুমারী আত্মীয়া
বাবাকে তো আগেই রেখে এসেছ অনিবার্য মাটির বিছানে
গাড়ি স্টার্ট নিতেই তাড়াতাড়ি হাত নাড়লে তোমরা সবাই, শেষবার তাকালে, বাড়িওয়ালা অনুভূতিহীন, তখনি টাঙিয়ে দিচ্ছেন ভাড়াটে ধরার ‘টু লেট’ বাহানা, ঘরে জল ঢেলে ধুয়েমুছে দেয়া হচ্ছে তোমাদের সুদীর্ঘ ছোঁয়া
সব মায়া কাটিয়ে বাধ্য হয়ে তোমরা শহরান্তরে যাচ্ছ, পেছনে কাজলা বিড়ালটি দৌড়াচ্ছে… দৌড়াচ্ছে… দৌ…ড়া…চ্ছে
সেতু
একই ভেলায় চড়ে পাড়ান্তরে যাচ্ছি আমি আর ইরা, ইরাবতী— ওপারে মৃত্যুর তীর, এলিয়ে পড়া কেশের বহুলতা ঢেকে থাকা মরণসুষমা, তার মহিমাকে ছুঁতে যাবার সঘন আর্তি কণ্ঠে মেখে আমি বলি, পারাপারলঘু এই দিন ও রাত্রির চিত আনন্দ কল্লোলগুলো গায়ে মেখে যাব, তানপুরাটা আয়েশে ধরে রেখো তুমি ঈষৎ হেলিয়ে, নিহিত আঙুল এসে অদৃশ্যে বাজিয়ে যাবে আনন্দলহরি, অবশ্যএষণা
পোলকা ডটের মতো চোখ তুলে আকাশের দিকে, বলে ইরাবতী, জলের গল্প কেবল তখনই ভালো লাগে, শুষ্ক মৌসুমে, খেলানো উচ্ছ্বাসগুলো পলকে মিলিয়ে গেলে দূর সমুদ্রপাড়ায়, তবু, ফেনাময় ঢেউয়ের রেখা যদি মূর্ত হয়ে ওঠে কোনোখানে, ভেসে যেতে পারব না আমি ললিত প্যাশনে
একই ভেলায় চড়ে তুরীয়ানন্দের দিকে আমাদের যাত্রা শুরু অনিবার্য বিভূতি বোধনে
মমি উপত্যকা (The Valley of Mummy), ২০০১ থেকে
ছন্নছাড়া কবিতা
মাথার ভেতরে এক জ্বলজ্যান্ত মরুভূমি নিয়ে আমি আফ্রিকা থেকে ক্রমে এশিয়া
ইউরোপ হয়ে
নিত্য ফিরে আসতে লেগেছি নিজগৃহে, অধীর অশান্ত স্ত্রী আমাকে জানিয়েছে
এটা ভয়ানক
এতে নাকি বালির প্রভাঁজে শুয়ে ক্যাকটাস গিরগিটি ও বিষাক্ত সাপখোপ
সঙ্গী হতে পারে
গত বছর তো আমি বাঁ’হাতে ঝুলিয়ে খোদ বঙ্গোপসাগর পৌঁছে গিয়েছিলাম
ঠিক শ্বশুরবাড়ি
সেবার বন্যায় ভেসে গিয়েছিল সব্বাই শ্বশুর মহলের, এমনকি ও-বাড়ির
পোষা বিড়ালিও
ভাতের থালায় হাত দিয়ে টের পেয়েছিলাম যে কী ভীষণ জলোরাজ্যে আমি
সমর্পিত আজ
বিছানায় উঠে এসেছিল গর্জনশীল মোহনা, জাপটে ধরা বিষখালির পাক দেয়া
জলের বাহিনী
সাহারায় এবারের আমার যাওয়া প্রধানত শখবশে নয়, এক ভোরে জেগে দেখি
ধু-ধুতর সব
মাথা ও পকেটজুড়ে পাতা খাঁ-খাঁ শুষ্ক এক বালির বিছানা আর দু’পায়ে সতত-চলা
চাকা লেগে আছে
যতদিকে যত ছিল প্রেম-ট্রেম ছিঁড়েখুঁড়ে পকেটে গুটিয়ে নিয়ে মুখ ধুয়ে
শুরু হলো যাতায়াত
কেননা ভ্রমণে আমার দারুণ মনোটান ছিল, যুবক স্বভাবে ঘোর ছন্নছাড়াপনা
তদুপরি চাকা
সেই থেকে ঠিকানাবিহীন ঘুরে আমেরিকা শেষ হলে অতলান্ত পাড়ি দিয়ে
সহসাই বাড়ি ফিরে আসি
নিজ হাতে গোছাই বিছানা আর দুইজনে ক্লান্ত হয়ে সারারাত চিকচিক বালিময়
মুখ গুঁজে থাকি
স্ত্রী যদি জিজ্ঞাসে ফের, বলব যে : পৃথিবী ও সুখাসুখ গোলাকার, এই কথা
বারেবারে প্রমাণ দিতেছি
হয়ে ওঠা বিষয়ে একটি দার্শনিক অনুধ্যান
এক আশ্চর্য হাওয়ার রাতে চাঁদের গুহামুখ থেকে যেভাবে আঠালো বর্জ্যরাশি গড়িয়ে পড়তে লেগেছিল লবণজলের ’পর এবং যে গূঢ় গোপন রাসায়নিক ক্রিয়ায় সমুদ্রকে ঢেকে জন্ম নিয়েছিল শক্ত ও কঠিন ঘন আস্তরণ এবং যে নিয়মে সবুজ এসে গ্রাস করেছিল ক্রমে ঊষর প্রান্তর, আমি সে খায়েশে এক ফোঁটা বর্জ্য ঢেলে বলি, ফুটে ওঠো ক্লেদজ কুসুম, বলি জেগে ওঠো ফল ও বীজের সম্ভাবনা
প্রতিটা হয়ে ওঠাই পদার্থিক, চিৎকৃত মূর্ছনায় সব সৃষ্টিই মোচড় দিয়ে ওঠে জোরে, পৃথিবীর কান্নার শব্দ যেমন সমুদ্র শুনতে পেয়েছিল একদিন, আমি সব নড়চড় তেমনি টের পাই তোমার
হয়ে ওঠো, ঘন সরের মতো সাদা দুধের সংসারে ধীরে জমে ওঠো আধারের গায়, সব কোলাহল ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া আমি জেনে নেব কান পেতে সুরম্য ওলানে
কল্পকাম
কখনো পাব না ছুঁতে নীহারিকা এটা বুঝে গেছি, বুঝে গিয়ে কাগজে লিখেছি তার নাম, এরপর হাত দিয়ে মুখ দিয়ে নানাভাবে ছুঁয়ে গেছি তারে
যেমন খুশি তারে পেরেছি বাজাতে, সরোদে গিটারে বা বীণার ঝংকারে যখন যেভাবে চাই হাত দিয়ে সেইমতো সুর তুলি, সুরের পরশে মেতে দুধস্বাদ ঘোলেই মেটাই
নীহারিকা আয়ত্তে আজ গোটাটাই
তারে ছোটো করে বড়ো করে কনডেন্স ও এক্সপান্ডে যে কোনোরকমে লিখি, অঙ্গমাধুরি দেই ফ্যাটিয়ে-ফাঁপিয়ে, কখনো-বা লহমায় স্লিম করি, নীহারিকা এখন তো হাতের পুতুল
আমূল পাব না তাকে এটা বুঝে গেছি, বুঝে গিয়ে নামের দেহ থেকে বস্ত্র সরিয়ে আনি রতিভাব, নানারঙে প্রিন্ট নেই, প্রিন্ট নিয়ে প্রিয়টার ওপরে জোসে শুয়ে পড়ি
মনে ভাবি, এই তো পেয়েছি তারে, এইবার নীহারিকা কেবলই আমার
মুজিব মেহদী
জন্ম ৩ জানুয়ারি ১৯৬৯-এ ময়মনসিংহে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। স্ত্রী শামীম আফরীন ও পুত্র প্রত্নপ্রতিম মেহদীসহ বসবাস করেন ঢাকায়। একটি অধিকারভিত্তিক জাতীয় উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের তথ্যায়ন ও প্রকাশনা বিভাগে কর্মরত। লেখালেখি করেন লিটল ম্যাগাজিনে।
প্রকাশিত গ্রন্থ
কবিতা : মমি উপত্যকা (শ্রাবণ ২০০১), ময়দানের হাওয়া (পাঠসূত্র ২০০৭), চিরপুষ্প একাকী ফুটেছে (অ্যাডর্ন ২০০৯), ত্রিভুজাসম্ভাষ (হাইকু-বাইকু-সেনরু, শুদ্ধস্বর ২০১৩), জঙ্গলের নিজস্ব শব্দাবলি (ঐতিহ্য ২০১৪) এবং (প্রকাশিতব্য) বাইকুশতক (ছোট কবিতা ২০১৮) ও ধূলি ওড়ানোর ভঙ্গি (নির্বাচিত কবিতা, ঐতিহ্য ২০১৮)।
উভলিঙ্গ রচনা : শ্রেণিকরণ এমন এক সংকীর্ণতা যা সৃষ্টির মহিমাকে ম্লান করে দেয় (প্রতীতি ২০০৩), বৃষ্টিগাছের তলায় (বাংলাপ্রসার ২০০৬) ও খড়বিচালির দুর্গ (ঐতিহ্য ২০১১)।
অনুবাদ : সটোরি লাভের গল্প (জেনগল্পের বাংলা রূপান্তর, পাঠসূত্র ২০০৯)।
এছাড়াও, তাঁর চারটি অনুসন্ধানমূলক গ্রন্থ রয়েছে।
২০১১-এ পেয়েছেন লোক সাহিত্য পুরস্কার।
ভার্চুয়াল সংযোগ : m.mehdy@gmail.com