দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু — বহু সত্তার কবি | আন্দালীব

“I have so many different personalities in me & I still feel lonely” – Tory Amos

 

সৃজনীর কোন সুনির্দিষ্ট ফর্মুলা নেই। কারুবাসনাই চিরকাল মানুষের আত্ম-অনুসন্ধান ও সৃজনীর পথ দেখিয়ে এসেছে। এ কারণেই একজন কবি/লেখক ক্রমাগত নিজেকে ভাঙেন এবং নিজের লেখনীকে পাঠকের সামনে হাজির করেন বিভিন্নভাবে। এ’ক্ষেত্রে প্রত্যেকের নিজস্ব ধরণের পন্থা-প্রক্রিয়া থাকে। স্টিমুলাস হিসাবে নিজের মধ্যে ভিন্ন-ভিন্ন চরিত্র বা সত্তাকে আবিষ্কার করাও এই প্রক্রিয়ারই অংশ। বাংলা ভাষার কবি দেলোয়ার হোসেন মঞ্জুর ক্ষেত্রে এমনটা ঘটতে দেখা গেছে বহুবার। গেওর্গে আব্বাস, মঞ্জু মিস্ত্রাল, সখিনা আফ্রোদিতি, অভিজিৎ কুণ্ডু, রহিমা ট্রাকল কিংবা মেহেকা আন্দ্রিলা — এসবই এই কবির ভিন্ন-ভিন্ন সত্তার নাম। এই নামগুলোর আড়ালে তিনি যে’ভাবে সাহিত্যচর্চা করেছেন তাতে এ’গুলোকে তার ছদ্মনাম বলে ভুল করা ঠিক হবে না। এ’গুলো বরং কবি দেলোয়ার হোসেন মঞ্জুর ভেতরে বাস করা ভিন্ন-ভিন্ন চরিত্রের নাম, বা তার অল্টার ইগো — যখন যাকে যেমন প্রয়োজন, তাকে তিনি অবমুক্ত করেছেন স্বাধীনভাবে। নিজের ভেতরে শিল্পসৃষ্টির লেলিহ-বাসনাটিকে তিনি বাঁচিয়ে রেখেছেন এই সব ভিন্ন-ভিন্ন সত্তায় বিরাজ করার মধ্য দিয়ে। ফলে একজন জৈব-চরিত্র হিসেবে কবি দেলোয়ার হোসেন মঞ্জুর অন্তর্ধান ঘটলেও, দৈব-চরিত্র হিসেবে যেন তার অপরাপর সত্তাগুলো পাঠকের সামনে জ্বলজ্বলে ও অস্তিত্বমান। হাওয়ার শরীরে ক্ষত চিহ্নের মত দগদগ করছে এই পংক্তিগুলো —

হাত-পা, জিহবা কলিজাসহ

আমিই শূন্যতার মাথামুণ্ডু

আমি অভিজিৎ কুণ্ডু।

 

২)

ভাষা, লেখনী ও চিন্তার দিক থেকে সমসময়ের চেয়ে বহু  এগিয়ে ছিলেন কবি দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু। ফলে বাংলা সাহিত্য অঙ্গনের মানুষ তাকে আবিষ্কার করেছে খানিকটা বিলম্বেই। তাছাড়া, আড়ালে থাকবার প্রবণতা ও সুদীর্ঘ প্রবাসজীবন তাকে প্রয়োজনীয় সেই নির্জনতাটুকু দান করেছিল। প্রায় দেড়-দশক নিরবচ্ছিন্ন কাব্যচর্চার পর ২০০২ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ইস্পাতের গোলাপ’ প্রকাশিত হয়ে। ততদিনে তার সমসাময়িক কবিদের গোটাচারেক করে গ্রন্থ প্রকাশিত হয়ে গেছে এবং সকলেই প্রায় কবিখ্যাতি অর্জন ও ভোগ করছেন। এ’সব স্বত্তেও প্রকাশিত হওয়া বিষয়ে কখনোই কোন তাড়া ছিল না তার। এর বদলে দীর্ঘ সময় নিয়ে কবিতায় তিনি সৃজন করেছেন এক ভিন্নতর ভাষিক জগৎ, যা সম্ভবত তার সময়ের অন্য কোন কবিই তৈরি করতে সক্ষম হননি।

 

ফোকলোর, মুসলিম-হিন্দু মিথ, স্থানিকতা, ইতিহাসচেতনা, কিংবদন্তী — এইসব দেলোয়ার হোসেন মঞ্জুর হাতে ভিন্ন ব্যঞ্জনা পেয়েছিল। প্রাচ্য-প্রতীচ্য ভেঙেচুড়ে মিলেমিশে ধারণাহীন এক কাব্যজগৎ তিনি তৈরি করেছেন তার লেখায়। এক ভীষণ ও ভিন্ন ধরণের ‘ম্যাডনেস’ আমরা তার তার ভাষা ও বাক্যের প্রক্ষেপনে লক্ষ্য করি। দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু কী করে তৈরি করেছেন এই ‘ম্যাডনেস’? এমন আইডেন্টিক্যাল কাব্যভাষা? আমরা  আগেই জেনেছি, প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের আগে তার দেড়-দশকের প্রস্তুতির কথা। তার কবিতার ‘ম্যাডনেস’ ও স্বতন্ত্র কাব্যভাষা গড়ে ওঠার বিষয়টি এই দীর্ঘ প্রস্তুতির সাথে জড়িত বলে ধারণা করা যায়। ফলে একজন কবি হিসেবে তার গড়ে ওঠার প্রক্রিয়াটি অনেকটাই ধীর, শ্লথ এমনটা আমরা দেখতে পাই। কিন্তু কে না জানে মন্থর সেই কচ্ছপটির কথা, যে নিজেকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পেরেছিল। তবে সে’ কথা এখানে সুপ্রযুক্ত নাও হতে পারে। যেহেতু সাহিত্য আসলে চূড়ান্ত বিচারে প্রতিযোগিতামূলক কোন কর্মকাণ্ড বা ব্যাপার নয়। এরচে’ বরং ফিরে আসা যাক দেলোয়ার হোসেন মঞ্জুর কাব্যভাষা প্রসঙ্গে। দেখা যাক, কেমন ছিল তার শুরুর দিককার কবিতার ভাষা। পাঠক হিসেবে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থের ভাষা আমার কাছে খুব স্বতন্ত্র কিছু মনে হয়নি। তবে ভবিষ্যতের কাব্যভাষা নির্মাণের নানান ইঙ্গিত ছড়ানো-ছিটানো ছিল সেখানে। ‘ইস্পাতের গোলাপ’ গ্রন্থের সর্বশেষ শব্দটিতে দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু নিজেকে বলেছেন — ‘আমিশ্বর’। একজন নতুন কবির আত্মবিশ্বাস ও তার ভবিষ্যতের কাব্যভাষা গড়ে ওঠার বিবিধ ইশারা এই শব্দটির মধ্যে চাইলে খুঁজে নেয়া যেতে পারে। এরপর থেকে দ্রুতই গড়ে উঠতে থাকে তার কাব্যভাষা। যাকে আমরা ‘ইসাপাখি বেদনা ফোটে মরিয়মবনে’, ‘মৌলিক ময়ূর’ ও ‘নীলকাব্যের বয়াত’ গ্রন্থ সমূহে ধীরে-ধীরে দেহ নিতে দেখি। এগুলো যথাক্রমে তার দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ। তবে দেলোয়ার হোসেন মঞ্জুর নিজস্ব কাব্যভাষার এক অপূর্ব প্রয়োগ আমরা ঘটতে দেখি তার পরবর্তী গ্রন্থ ‘সাপ ও সূর্যমুখী’তে, যেটি ২০০৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। মূলত এরপর থেকে বাংলা কবিতার পাঠক কূল এই কবির ‘সিগনেচার’ কাব্যভাষার সাথে পরিচিত হতে থাকে। পাঠকীয় অবস্থান থেকে ‘সাপ ও সূর্যমুখী’কে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাব্যগ্রন্থ বললে অত্যুক্তি হবে না।

 

৩)

ইংরেজি Dream ও Trance শব্দ দু’টো ভাবগত দিক থেকে কাছাকাছি হলেও এর মধ্যে অর্থগত পার্থক্য রয়েছে। Dream শব্দটি তো সর্বজনবিদিত — এর মানে স্বপ্ন, যা মূলত আমাদের ঘুমের মধ্যে ঘটে। আর Trance ব্যাপারটা ঘটে থাকে এক ধরনের স্বাপ্নিক ও অর্ধচেতন অবস্থায়; যখন ব্যক্তি ওই অবস্থায় তার পরিপার্শ্বের প্রায় সকল ঘটমানতাই বুঝতে পারে, যদিও তার কোন মটর অ্যাকটিভিটি থাকে না ওই অবস্থায়। কিন্তু ড্রিমের চেয়ে ট্র‍্যান্স অবস্থায় ব্যক্তি চৈতন্যগত দিক থেকে অধিকতর সক্রিয় অবস্থায় থাকে। আমরা জেনেছি স্বপ্নে কবিতা পাওয়া সম্ভব। কোলরিজের ‘কুবলা খান’ কবিতাটি নাকি একটি ‘Opium influenced dream’ এর মাধ্যমেই পাওয়া বা লিখিত। তো ঠিক তেমনিভাবে Trance পরিস্থিতিতেও কবিতা নির্মিত হতে পারে। দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু বিরচিত ‘অভিজিৎ কুণ্ডুর লায়ন লিলিগুচ্ছ’ গ্রন্থের সত্তরেরও অধিক কবিতা নাকি এক রাতের মধ্যেই রচিত হয়েছিল বলে কবিসূত্রে জানতে পেরেছিলাম। কবিতাগুলো পাঠ করে দেখেছি, অত্যুজ্জ্বল সেই সব কবিতা! যার একটির বিভাকে ছাপিয়ে যেতে চাইছে যেন অন্যটি। কোন সে’ ‘স্টিমুলাস’, যার বলে এক রাতের মধ্যেই এমন সব চমৎকার কবিতা রচনা করতে পারলেন কবি দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু! এর উত্তর খুঁজতে গেলে দেখা যাবে, অভিজিৎ কুণ্ডুর অল্টার ইগোটিই যেন তার সেই সঞ্জীবনী সুধা। এ’থেকে আমরা ধারণা লাভ করতে পারি যে, নানবিধ শিল্প সৃষ্টির স্বার্থেই দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু অভিজিৎ কুণ্ডুসহ তার অপরাপর অল্টার ইগোসমূহে উপনীত হতেন। ধ্যানী ও অন্তর্মুখী স্বভাবের দেলোয়ার হোসেন মঞ্জুর বিপরীতে অভিজিৎ কুণ্ডুর অবতারটি বহির্মুখী ও মুখর; খানিকটা চটুলও বটে। একইভাবে গেওর্গে আব্বাস, সখিনা আফ্রোদিতি বা মেহেকা আন্দ্রিলা প্রমুখেরাও বাস করতো দে.হো.ম-এর করোটির গভীরেই। কিন্তু একজন সৃজনশীল ব্যক্তি হিসেবে একসাথে এতগুলো অল্টার ইগোকে কি করে মাথার ভেতরে ডুবিয়ে রাখা সম্ভব! দে.হো.ম এই প্রায়-অসম্ভব কাজটিই করেছেন অনায়াস দক্ষতায়। একই সময়ে এতগুলো সত্তায় কবিতাচর্চা করা এক দুঃসাধ্য কাজ বটে। তার মাথার মধ্যে জাহাজ ডুবে যাবার ঘটনাটি অভিজিৎ কুণ্ডুর একটি কবিতার মাধ্যমেই বরং জানা যাক —

“বেতারে শুনলাম — বাংলা কবিতার জাহাজ দুবলার চরে আটকা পড়েছে। অসহায় মাইকেল কালিদাস আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাহাজের ডেক হতে লাফিয়ে-লাফিয়ে আত্মহত্যা করছেন জীবনানন্দ আর সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। আমি কালাচানপুর হতে সোহরাবকে খবর দিয়েছি। কোথায় অনন্ত দশকের কবি? কোথায় উদ্ধারকারী জাহাজ বিবি মরিয়ম? 

আমরাও যাবো। আমাদের এলাচের বনে বহুদিন পর কুসুম ফুটেছে। কাপ্তাই বিদ্যুৎকেন্দ্রে বহে দক্ষিণা বাতাস। আজ নতুন করে আমরাও পাশা খেলবো। ধানমণ্ডিতে দাওয়াত খেতে যাবো। ওরা সবাই উদ্ধারে গেছে, যাক। মুনা, আমি কিন্তু সবগুলো জাহাজ মাথার ভিতরেই ডুবিয়ে দিয়েছি।”

(নমুনা — ৭৭, অভিজিৎ কুণ্ডুর লায়ন লিলিগুচ্ছ, সাল – ২০১১ খ্রিঃ)

 

৪)

১৭ নভেম্বর ২০১৮ খ্রীষ্টাব্দে কবি দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু দেহত্যাগ করেন, মাত্র ৪৮ বছর বয়সে। তিনি শুধু কবিতাই লিখেছেন, তা নয়, গদ্যও  লিখেছেন। আগ্রহী পাঠকরা জানেন, কবিতার মতই তার গদ্যও কতটা উৎকৃষ্ট ও কালোত্তীর্ণ। প্রচুর মুক্তগদ্যও লিখেছেন; তুলসিপত্র নামে একটি পাণ্ডুলিপি প্রকাশিত হয়েছিল তার নিজের সম্পাদিত ছোটকাগজ ‘ধীস্বর’-এ। পত্রিকাটি অনিয়মিতভাবে বিলেত থেকে এই প্রকাশিত হতো। তিনি ধীস্বর সম্পাদনা করতেন মঞ্জু মিস্ত্রাল নামের অন্তরালে থেকে। ধীস্বর এর প্রথম সংখ্যাটি সৌভাগ্যবশত আমার সংগ্রহে আছে। এর সম্পাদকীয় পাঠ করলে বিস্মিত হতে হয়। একজন সক্রিয় লেখকের রাজনৈতিক অবস্থান কেন জরুরী, দেহোম এর নিজস্ব রাষ্ট্রচিন্তা, সাহিত্যের সাথে সে’সবের সম্পর্ক কতটা ও কিভাবে — তার নির্মেদ ও চমৎকার বিশ্লেষণ রয়েছে সেখানে। লিখেছেন উপন্যাস, ‘অনবদ্য ইতর’ নামে তার উপন্যাসটি তার জীবদ্দশায় প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। সেটি ২০১৯ সালের বইমেলায় প্রকাশিত হবে বলে জেনেছি। মৃত্যুর পর আরও দুটো কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হবে তার। একটি ‘বিষুববৃক্ষ ও শাদামাছি’ ও অপরটি ‘পাপ ও পল্লীবিদ্যুতের চর্বি’। 

 

আগেই উল্লেখ করেছি, দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু তার সময়ের কবিদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম পঠিত হয়েছেন। তার মৃত্যুর পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সূত্রে আমরা দেখতে পেয়েছি — এখনকার অনেক সক্রিয় কবিই তার সাহিত্যের সাথে পরিচিত নন। বিষয়টি একইসাথে বেদনা উদ্রেককারী ও দুশ্চিন্তার। তবে এ’কথাও সত্যি, যে এই ক্ষুদ্র মরজীবনে সকল কবির কবিতা পাঠ করা সম্ভব নয়; এবং আসলে তার প্রয়োজনও নেই। কবি দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু বাংলা সাহিত্যের সেই উজ্জ্বলতম কবি, যাকে বাংলা কবিতার বর্তমান ও ভবিষ্যতের সচেতন পাঠককে পাঠের তালিকায় রাখতে হবে। আকাশের দিকে তাকালে কারও-কারও কাছে তাকে লুব্ধক বলেও ভ্রম হবে।

 

(ডিসেম্বর ৩১, ২০১৮ খ্রিস্টাব্দ)

 

শেয়ার