দশকপূর্তি সংখ্যা : ভাষানন্দিনী পর্ব | সম্পাদকীয় ও সূচি

তিহাস বলে পৃথিবীর প্রথম কবির নাম এনহেদুয়ান্না, যিনি একজন নারী, যাঁর আবির্ভাব হয়েছিলো আজ থেকে ৪ হাজার ২৮১ বছর আগে। তিনি প্রার্থনাসঙ্গীত ও স্তবগান লিখতেন। রাজ্যের লোকেরা তাঁকে এই লেখালেখির গুণের কারণে দেবীর সম্মান দিয়েছিলো। তিনি রাজ্যের পুরোহিত হিসাবেও নিয়োগ পেয়েছিলেন, যেটি ছিলো সবচেয়ে সম্মানীয় পদ। তিনি ৪২টি স্তবগান রচনা করেন, ৩৭টি প্রস্তরখণ্ড থেকে যা উদ্ধার করা হয়। গ্রিকরা যাকে বলে আফ্রোদিতি, আর রোমানরা ভিনাস/ভেনাস— সেই দেবী ইনানা বা ইস্তারের স্তুতি করেও কবিতা লিখেছিলেন তিনি। এনহেদুয়ান্নার উত্তরসুরী আমরা সকলে, কেবল নারীরাই নয়— এ সত্য মেনে নিতে আজও কত দ্বিধা! হাজার বছর ধরে পৃথিবীর সাহিত্যে নারী কবি-লেখকদের জয়-জয়কার, সেসব সাহিত্য পড়তে গিয়ে কেউ ‘লিঙ্গ’ বিচার করে না। কী লেখা ছাপা হয়েছে, সেই ব্যাপারটিই আলোচনা হয়, এবং সেটা হওয়াই স্বাভাবিক। যদি গত দশ বছরে সাহিত্যে নোবেলজয়ীদের তালিকা খেয়াল করা যায়, দেখবো এই পুরস্কার পেয়েছেন পাঁচজন নারী। এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি’র নাম রুপি কৌর, সারা দুনিয়ায় যার লেখা বই মিলিয়ন মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়। ‘ইন্সটা পোয়েট্রি’ নামে কবিতার একটা নতুন ধারা তৈরি হয়েছে রুপি’র হাত ধরে। জনপ্রিয়তা সাহিত্যের মাপকাঠি নয় এবং ইন্সটা পোয়েট্রি নিয়ে সিরিয়াস কবি-সাহিত্যিক ও পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক সমালোচনা আছে, কিন্তু এর সাম্প্রতিক প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না। সাহিত্যে কোনো নতুন ধারা প্রতিষ্ঠা করা খুব ছোটো ব্যাপার নয়।

এবার আসি বাংলাদেশ ভূখণ্ডে— ষোড়শ শতকে ময়মনসিংহের গ্রামে একজন কবিকন্যা ‘চন্দ্রাবতী’ নিজের লেখার গুণে কবি-পরিচিতি পেয়েছিলেন। আজও চন্দ্রাবতীকে নিয়ে চর্চা হয়। যে বার্বি সিনেমা নির্মাণ করে গ্রেটা গারউইগ/গারবিগ ২০২৩ সালে দুনিয়ায় ঝড় তুলেছেন, প্রায় একই রকম বিষয়কে উপজীব্য করে এক শ বছর আগে ‘সুলতানার স্বপ্ন’ নামে উপন্যাস রচনা ক’রে গেছেন বেগম রোকেয়া। সুলতানা’স ড্রিম নামে ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে সেই উপন্যাস আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য হলো এইতো সেদিন। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্যে যাঁরা অবদান রাখছেন, তাঁদের মধ্যে বিরাট একটা অংশ নারী এবং টেক্সটের বিবেচনাতে তাঁরা অত্যাধুনিক ও বহুমাত্রিক; অনুসরণীয়ও বটে। আমরা কতটুকু খবর রাখি? অনেকের লেখা ভৌগোলিক সীমানা অতিক্রম করে সমাদৃত; এই ছড়িয়ে যাওয়া নিশ্চয়ই তাঁদের টেক্সটের গুণে— তাঁরা নারী না পুরুষ— সেই বিবেচনায় নয়। কারো কারো আখ্যানবিশ্ব মাল্টি-ডাইমেনশনাল এবং সমকালীন অনেকের চেয়ে এগিয়ে। অনেকের গদ্যের যে প্রবাহ, যে ভাষা, যে বিষয়াবলি আর বহুমাত্রিক চরিত্রদের তারা যেভাবে সৃষ্টি করেন, তা বিরল। এই মুহূর্তে বাংলা ভাষার তরুণতম কবিদের মধ্যে লিঙ্গ পরিচয়ে ‘নারী’- এমন কবিরা ব্যাপক উজ্জ্বল। তাদের দেখার চোখ, জগতকে আবিষ্কারের বোধ বিস্ময়কর। ভাষা, প্রকরণ, সিনট্যাক্স ভেঙে দিয়ে কবিতার নতুন যে জগৎ তারা অনেকে তৈরি করছেন, তা ইতোমধ্যে ধ্যানী পাঠকের কাছে বিস্তৃত হচ্ছে। একজন কবি বা লেখকের পরিচয় কেবল ‘কবি’ বা ‘লেখক’। পুরুষ কবি-লেখকের বেলায় আমরা এই শব্দগুলি ব্যবহার করি। নারীদের ক্ষেত্রে এখনও কেউ কেউ ‘মহিলা-কবি’, ‘মহিলা-লেখক’ বা ‘লেখিকা’ শব্দগুলি লিখেন ও উচ্চারণ করেন— এখন, এই একবিংশ শতাব্দীতেও, এভাবে উচ্চারণ করা মূলত পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা থেকেই। যদিও কোনো মানুষের জেন্ডার আইডেন্টিটি তার ব্যক্তিগত এবং সেই পরিচয় অবশ্যই গর্বের! কিন্তু একজন কবি বা লেখকের পরিচয় তাঁর লেখা বা টেক্সট। আর কিচ্ছু না। টেক্সটের কোনো লিঙ্গান্তর হয় না, হতে পারে না।

তারপরেও কেন নারী কবি-লেখকদের নিয়ে এই আলাদা আয়োজন! বিস্ময়ের সঙ্গে এমন প্রশ্নের উদ্রেক হবেই। নারীদের পুরুষ থেকে আলাদা করার  সাহিত্যরাজনীতি মাথায় রেখে আমরা এই আয়োজন করছি না। শিরিষের ডালপালার দশকপূর্তি বিশেষ সংখ্যা কয়েকটি পর্বে ভাগ ক’রে প্রকাশিত হচ্ছে; দ্বিতীয় পর্বটিতে থাকছে ৩৩ জন কবির ১৬৫টি কবিতা, ১৮ জন কথাসাহিত্যিকের ১৮টি গল্প, একজন করে কবি ও কথাসাহিত্যিকের সাক্ষাৎকার— হ্যাঁ, এই কবি-লেখকদের প্রত্যেকেই লিঙ্গ বিবেচনায় নারী। আমাদের নারী কবি-সাহিত্যিকদের টেক্সট যে অনেকখানি এগিয়ে, তারই প্রমাণ বা চিহ্ন হিসাবে এত জনের লেখা একসঙ্গে রাখা একটা উদ্দেশ্য (আমরা আরও অনেকের কাছেই পৌঁছাতে পারিনি, সেটা আমাদের ব্যর্থতা); আরেকটা কারণ শিরিষের দশকপূর্তির উৎসবকে পূর্ণতা দিতে সাহিত্যে নারীর অবদানকে শ্রদ্ধা জানানো। যদিও কেউ কেউ এমন সমালোচনা করছেন এবং করবেন, যখন নারীদের লেখা সকল জায়গায় সমানতালে প্রকাশ হয়, তখন এরকম আয়োজন প্রাসঙ্গিক কিনা। তাদের উদ্দেশে বলি, ক্ষমতাচক্রের কিছু জায়গায় নারী দেখতে পাওয়া আসলে অন্ধের হাতি দেখার মতো কেবল বিশেষ কোনো অঙ্গকেই দেখা। সমাজের সর্বত্র তলিয়ে দেখার চোখ থাকলে ‘নারী’ যে আজ অবধি পুরুষালি সমাজের চাপে কোনঠাসা তা স্পষ্টতই দেখা যায়। আর সৃজনশীল লেখাজোখার জগতে ‘নারী’- ‘পুরুষ’ লেখকদের চোখে আড়ালে-আবডালে টিকা ও টিপ্পনীর বিষয়, তা তো ঢাকার সাহিত্য-আড্ডায় কান পাতলেই শোনা যায়। ফলে একটা সময়ের এতো বিপুল সংখ্যক নারীকে একটা প্ল্যাটফর্মে আনা দরকারি বলেই আমরা মনে করেছি। সেদিক বিবেচনায় এটা একটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত; এবং অবশ্যই নারীর আগমনীকে জোরেশোরে জানান দেওয়ার প্রচেষ্টা। এই সংখ্যা কেবল শত পুরুষ লেখকের মাঝে দুই-চারজন নারী লেখকের আলঙ্কারিক উপস্থিতি নয়, বরং সাহিত্যের গতি-প্রকৃতিকে বিপুল উপস্থিতিতে নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়ার এক যুগসন্ধির মুহূর্তকে বর্তমান ও ভবিষ্যতের পাঠকের সামনে উন্মোচন করা।

এই পর্বের শিরোনাম ‘ভাষানন্দিনী’ নিয়েও কারো কারো সমালোচনা আছে। নন্দিনীর বেশ কিছু সমার্থক শব্দ আছে, এর মধ্যে থেকে আমরা ‘কন্যা’ বা ‘জায়া’কে গ্রহণ করেছি। কবি-লেখকেরা ভাষা নিয়ে কাজ করেন, তারা যেমন ভাষার জনক-জননী, ভাষাকে নানান রূপে হাজির করেন, তেমনি তাঁরা ভাষার সন্তানও। ভাষা ও সাহিত্যিক একে-অপরের পরিপূরক। এ নিয়ে কারো সন্দেহ থাকা উচিত নয়। ভাষানন্দিনী বলতে আমরা ভাষার জায়া বা কন্যা-ই বুঝিয়েছি, অন্য কিছু নয়।  আর কর্মের স্বীকৃতি ও সম্মান দেওয়ার কোনো স্থান-কালের সীমানা নাই। এখনও যেমন আলাদা করে সম্মান দেওয়া যায়, এক শ- পাঁচ শ বছর পরেও নিশ্চয়ই দেওয়া যাবে। সম্মান দিলে বা নিলে কেউ ছোটো হয় না বলেই বিশ্বাস করি। সাহিত্যে কেবল টেক্সটের জয় হোক। চিয়ার্স!


সম্পাদনাঃ রুহুল মাহফুজ জয় ও রনক জামান

অলঙ্করণ ও শিল্প-সম্পাদনাঃ রাজীব দত্ত


দশকপূর্তি বিশেষ সংখ্যা : ভাষানন্দিনী পর্ব

 


গল্প


অদিতি ফাল্গুনীআনোয়ারা সৈয়দ হকআফসানা বেগমউম্মে ফারহানাউম্মে রায়হানাকিযী তাহ্‌নিনগাজী তানজিয়াপাপড়ি রহমানপূরবী বসুবর্ণালী সাহাবদরুন নাহারনাহার মনিকারওনক মিরাশদাররাশিদা সুলতানারিফাত আনজুম পিয়ালুনা রুশদীশাহীন আখতারসানিয়া রুশদী


সাক্ষাৎকার


রিমঝিম আহমেদের সাক্ষাৎকার | আলাপকারীঃ রনক জামান

বর্ণালী সাহার সাক্ষাৎকার | আলাপকারীঃ রুহুল মাহফুজ জয়


কবিতা


আফরোজা সোমাআসমা অধরাওয়াসিফা জাফর অদ্রিজুয়েইরিযাহ মউতানজিনা নূর-ই সিদ্দিকীতাসনুভা অরিনতাহিতি ফারজানাতৌফিকা নাসরিনদৃষ্টি দিজানাদিয়া জান্নাতনুসরাত নুসিনপাপিয়া জেরীনফাতেমা মুন্নীফারজিনা মালেক স্নিগ্ধাফারাহ্ সাঈদফেরদৌস আরা রুমীমন্দিরা এষমাসিয়াত জাহিনরওশন আরা মুক্তারহিমা আফরোজ মুন্নীরাঈসা সিদ্দিকারাবিয়া সাহিন ফুল্লরারুম্মানা জান্নাতলুবনা চর্যাশতাব্দীকা ঊর্মিশান্তা এফ আরাশাফিনূর শাফিনশ্বেতা শতাব্দী এষসানজিদা আমীর ইনিসীসিফাত বিনতে ওয়াহিদসুপ্তা সাবিত্রী সৈয়দা নীলিমা দোলাহাসিন এহ্সাস লগ্ন



দশকপূর্তি বিশেষ সংখ্যা : প্রথম পর্ব | সম্পাদকীয় ও সূচি

শেয়ার